ফরয-ওয়াজিব পালনকারী ব্যাক্তি (সালাত আদায়কারী, হজ্ব পালনকারী) কি কাফির হতে পারে ?
লিখেছেন: ' abdullah al Mamun' @ বুধবার, অক্টোবর ১৯, ২০১১ (১০:৫৮ পূর্বাহ্ণ)
(বিষয়টি বুঝার সুবিধার জন্য একসাথে পুরো পোস্ট দেয়া হয়েছে – একটু লম্বা হলেও কস্ট করে পড়লে ইনশা আল্লাহ উপকৃত হবেন)
[যে ব্যক্তি দীন এর কতিপয় ফরয ওয়াজেব অর্থাৎ অবশ্যকরণীয় কর্তব্য পালন করে, সে তাওহীদ বিরোধী কোন কাজ করে ফেললেও কাফের হয়ে যায় না - যারা এই ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করেন, তাদের ভ্রান্তির নিরসন এবং তার বিস্তারিত দলীল-প্রমাণ]
অনেক পীর-মাজার পূজারী বলে থাকে: যাদের প্রতি আল-ক্বুরআন নাযিল হয়েছিল (অর্থাৎ মক্কার কাফির-মুশরিক্গণ) তারা আল্লাহ ছাড়া কোনই মা’বুদ নেই একথার সাক্ষ্য প্রদান করে নাই, তার রসূল (সাঃ)-কে মিথ্যা বলেছিল, তারা পুনরুত্থানকে অস্বীকার করেছিল, তারা ক্বুরআন কে মিথ্যা বলেছিল এবং বলেছিল এটাও একটি জাদু মন্ত্র। কিন্তু আমরা তো সাক্ষ্য দিয়ে থাকি যে, আল্লাহ ছাড়া নেই কোন মাবুদ এবং (এ সাক্ষ্যও দেই যে,) নিশ্চয় মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর রসূল, আমরা ক্বুরআনকে সত্য বলে জানি ও মানি আর পুনরুত্থান এর বিশ্বাস রাখি, আমরা সালাত পড়ি এবং সিয়াম পালন করি, তবু আমাদেরকে এদের (উক্ত বিষয়ে অবিশ্বাসী কাফেরদের) মত মনে করেন কেন?
(১) এর জওয়াব হচ্ছে এই যে, এ বিষয়ে সমগ্র আলেম সমাজ একমত যে, একজন লোক যদি কোন কোন ব্যাপারে রসূলুলস্নাহ (সাঃ)-কে সত্য বলে মানে আর কোন কোন বিষয়ে তাকে মিথ্যা বলে ভাবে, তবে সে নির্ঘাত কাফের, সে ইসলামে প্রবিষ্টই হতে পারে না।
(২) এই একই কথা প্রযোজ্য হবে তার উপরেও যে ব্যক্তি ক্বুরআন এর কিছু অংশ বিশ্বাস করল, আর কতক অংশকে অস্বীকার করল, তাওহীদ কে স্বীকার করল কিন্তু সালাত যে ফরয তা মেনে নিল না। অথবা তাওহীদও স্বীকার করল, সালাত্ব পড়ল কিন্তু যাকাত যে ফরয তা মানল না; অথবা এগুলো সবই স্বীকার করল কিন্তু রোযাকে অস্বীকার করে বসল কিংবা ঐ গুলো সবই স্বীকার করল কিন্তু একমাত্র হাজ্জকে অস্বীকার করল, এরা সবাই হবে কাফের।
রসূলুলস্নাহ (সাঃ)-এর জমানায় কিছু লোক হজ্জকে অস্বীকার করেছিল, তাদেরকে লক্ষ্য করেই আল্লাহ আয়াত নাযিল করলেন:
وَلِلّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلاً وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ الله غَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ ( آل عمران : 97)
“(পথের কষ্ট সহ্য করতে এবং) রাহা খরচ বহনে সক্ষম যে ব্যক্তি (সেই শ্রেণির) সমস্ত মানুষের জন্য আল্লাহর উদ্দেশ্যে এই গৃহের (কা’বাতুল্লাহর) হাজ্জ করা অবশ্য কর্তব্য, আল্লাহ হচ্ছেন সমুদয় সৃষ্টি জগৎ হতে বেনেয়ায।” (আল ইমরানঃ ৯৭)
(৩) কোন ব্যক্তি যদি এগুলো সমস্তই (অর্থাৎ তাওহীদ, সলাহ্, ঝাকাত, সিয়াম, হাজ্জ) মেনে নেয় কিন্তু পুনরুত্থানের কথা অস্বীকার করে সে সর্ব সম্মতিক্রমে কাফের হয়ে যাবে। তার রক্ত এবং তার ধন-দৌলত সব হালাল হবে (অর্থাৎ তাকে হত্যা করা এবং তার ধন-মাল লুট করা সিদ্ধ হবে) যেমন আল্লাহ বলেছেন:
إِنَّ الَّذِينَ يَكْفُرُونَ بِاللّهِ وَرُسُلِهِ وَيُرِيدُونَ أَن يُفَرِّقُواْ بَيْنَ اللّهِ وَرُسُلِهِ وَيقُولُونَ نُؤْمِنُ بِبَعْضٍ وَنَكْفُرُ بِبَعْضٍ وَيُرِيدُونَ أَن يَتَّخِذُواْ بَيْنَ ذَلِكَ سَبِيلاً – ُوْلَـئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ حَقًّا وَأَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِينَ عَذَابًا مُّهِينًا (النساء : 150-151)
“নিশ্চয় যারা অমান্য করে আল্লাহকে তাঁর রসূলদেরকে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলগণের (আনুগত্যের) মধ্যে প্রভেদ করতে চায় আর বলে কতককে আমরা বিশ্বাস করি আর কতককে অমান্য করি এবং তারা ঈমানের ও কুফরের মাঝামাঝি একটা পথ আবিষ্কার করে নিতে চায়-এই যে লোক সমাজ সত্যই তারা হচ্ছে কাফের, বস্তুত: কাফিরদিগের জন্য আমরা প্রস্তুত করে রেখেছি এক লাঞ্ছনা দায়ক শাস্তি।” (আন নিসাঃ ১৫০)
আল্লাহ তা’আলা যখন তাঁর কালাম পাকে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে, যে ব্যক্তি দীন এর কিছু অংশকে মানবে আর কিছু অংশকে অস্বীকার করবে, সে সত্যিকারের কাফের এবং তার প্রাপ্য হবে জাহান্নাম।
(৪) আর এই একথাও তাকে বলা যাবে: তুমি যখন স্বীকার করছ যে, যে ব্যক্তি সমস্ত ব্যাপারে আল্লাহর রসূলকে সত্য জানবে আর কেবল সলাহ ফরয হওয়াকে অস্বীকার করবে সে সর্ব সম্মতিক্রমে কাফের হবে, আর তার জান-মাল হালাল হবে, ঐ রূপ সব বিষয় মেনে নিয়ে যদি পরকালকে অস্বীকার করে তবুও কাফের হয়ে যাবে। ঐ রূপই সে কাফের হয়ে যাবে যদি ঐ সমস্ত বস্তুর উপর ঈমান আনে আর কেবল মাত্র রামাযানের রোযাকে ইনকার করে। এতে কোন মাজহাবেরই দ্বিমত নেই। আর ক্বুরআনও এ কথাই বলেছে, যেমন আমরা ইতিপূর্বে বলেছি।
এটাও আমরা জানি যে, নাবী (সাঃ) যে সব ফরয কাজ নিয়ে এসেছিলেন তার মধ্যে তাওহীদ হচ্ছে সর্বাপেক্ষা বড় এবং তা সলাহ্, রোযা ও হাজ্জ হতেও শ্রেষ্ঠতর। যখন মানুষ নাবী (সাঃ) কর্তৃক আনীত ফরয, ওয়াজেব সমূহের সবগুলোকে মেনে নিয়ে ঐগুলোর একটি মাত্র অস্বীকার করে কাফের হয়ে যায় তখন কি করে সে কাফের না হয়ে পারে যদি রসূল, সমস্ত দীন এর মূল বস্তু তাওহীদকেই সে অস্বীকার করে বসে?
সুবহানাল্লাহ! কি বিস্ময়কর এই মূর্খতা!
(৫) তাকে এ কথাও বলা যায় যে, মহানাবী (সাঃ)-এর সাহাবাগণ বানুহানীফার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, অথচ তারা রসূলুলস্নাহ (সাঃ)-এর নিকট ইসলাম গ্রহণ করেছিল। তারা সাক্ষ্য প্রদান করেছিল যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ (উপাস্য) নেই আর মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহর রসূল। এ ছাড়া তারা আযানও দিত এবং সলাহ্ও পড়ত।
সে যদি তাদের এই কথা পেশ করে যে, তারা তো মুসায়লামা (কায্যাব)-কে একজন নাবী বলে মেনেছিল।
তবে তার উত্তরে বলা হবে: ঐটিই তো আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। কেননা যদি কেহ কোন ব্যক্তিকে নাবীর মর্যাদায় উন্নীত করে তবে সে কাফের হয়ে যায় এবং তার জান মাল হালাল হয়ে যায়, এই অবস্থায় তার দুটি সাক্ষ্য (প্রথম সাক্ষ্য: আল্লাহ ছাড়া নেই অপর কোন ইলাহ, দ্বিতীয় সাক্ষ্য: মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহর বান্দা এবং রসূল) তার কোনই উপকার সাধন করবে না। সলাহ্ও তার কোন কোন উপকার করতে সক্ষম হবে না। অবস্থা যখন এই, তখন সেই ব্যক্তির পরিমাণ কি হবে যে, শিমসান, ইউসুফ (অতীতে নাজদে এদের উদ্দেশ্যে পূজা করা হত) বা কোন সাহাবা বা নাবীকে মহা পরা- ক্রমশালী আল্লাহর সুউচ্চ মর্যাদায় সমাসীন করে? পাক পবিত্র তিনি, তাঁর শান-শাওকাত কত উচ্চ।
كَذَلِكَ يَطْبَعُ اللَّهُ عَلَى قُلُوبِ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ (روم : 59)
“আল্লাহ এই ভাবেই যাদের জ্ঞান নেই তাদের হৃদয়ে মোহর মেরে দেন।” (সুরা রূমঃ ৫৯)
(৬) তাদেরকে এটাও বলা যাবে: হযরত আলী (রাঃ) যাদেরকে আগুনে জ্বালিয়ে মেরেছিলেন তারা সকলেই ইসলামের দাবিদার ছিল এবং হযরত আলীর অনুগামী ছিল, অধিকন্তু তারা সাহাবাগণের নিকটে শিক্ষা লাভ করেছিল। কিন্তু তারা হযরত আলীর প্রতি ঐ রূপ বিশ্বাস রাখত যেমন খাজা বাবা, আজমীর বাবা এবং তাদের মত আরও অনেকের ব্যাপারে বিশ্বাস পোষণ করা হয়। (প্রশ্ন হচ্ছে) তাহলে কি করে সাহাবাগণ তাদেরকে (ঐ ভাবে) হত্যা বরার ব্যাপারে এবং তাদের কুফরির উপর একমত হলেন? তাহলে তোমরা কি ধারণা করে নিচ্ছ যে, সাহাবাগণ মুসলমানকে কাফেরের রূপে আখ্যায়িত করেছেন? নাকি তোমরা ধারণা করছ যে, খাজা বাবা, আজমীর বাবা এবং অনুরূপ ভাবেই অন্যান্যের উপর বিশ্বাস রাখা ক্ষতিকর নয়, কেবল হযরত আলীর প্রতি ভ্রান্ত বিশ্বাস রাখাই কুফরি?
(৭) আর এ কথাও বলা যেতে পারে যে, যে বানু ওবায়দ আল কান্দাহ বানু আব্বাসের শাসন কালে মরক্কো প্রভৃতি দেশে ও মিসরে রাজত্ব করেছিল, তারা সকলেই “ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রসূলুলস্নাহ” কালিমার সাক্ষ্য দিত-ইসলামকেই তাদের ধর্ম বলে দাবি করত। জুমা ও জামাআতে সলাহ্ও আদায় করত। কিন্তু যখন তারা কোন কোন বিষয়ে শরী’আতের বিধি ব্যবস্থার বিরুদ্ধাচরণের কথা প্রকাশ করল, তখন তাদেরকে কাফের আখ্যায়িত এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উপর আলেম সমাজ একমত হলেন। আর তাদের দেশকে দুরুল হরব বা যুদ্ধের দেশ বলে ঘোষণা করে তাদের বিরুদ্ধে মুসলমানগণ যুদ্ধ করলেন। আর মুসলমানদের শহরগুলোর মধ্যে যেগুলো তাদের হস্তগত হয়েছিল তা পুনরুদ্ধার করে নিলেন।
(৮) তাকে আরও বলা যেতে পারে যে, পূর্ব যুগের লোকদের মধ্যে যাদের কাফের বলা হত তাদের এজন্যই তা বলা হত যে, তারা আল্লাহর সঙ্গে শিরক্ ছাড়াও রসূল (সাঃ) ও ক্বুরআনকে মিথ্যা জানতো এবং পুনরুত্থান প্রভৃতিকে অস্বীকার করত। কিন্তু এটাই যদি প্রকৃত এবং একমাত্র কারণ হয় তাহলে “বাবু হুকমিল মুরতাদ” – “মুরতাদের হুকুম” নামীয় অধ্যায় কি অর্থ বহন করবে? যা সব মাজহাবের আলেমগণ বর্ণনা করেছেন? “মুরতাদ হচ্ছে সেই মুসলিম, যে ইসলাম গ্রহণের পর কুফরিতে ফিরে যায়।”
তারপর তারা মুরতাদের বিভিন্ন প্রকরণের উল্লেখ করেছেন আর প্রত্যেক প্রকারের মুরতাদকে কাফের বলে নির্দেশিত করে তাদের জান এবং মাল হালাল বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। এমন কি তারা কতিপয় লঘু অপরাধ যেমন অন্তর হতে নয়, মুখ দিয়ে একটা অবাঞ্ছিত কথা বলে ফেলল অথবা ঠাট্টা মশকরার ছলে বা খেল-তামাশায় কোন অবাঞ্ছিত কথা উচ্চারণ করে ফেলল। এমন অপরাধীদেরও মুরতাদ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাদের এ কথাও বলা যেতে পারে: যে তাদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন:
يَحْلِفُونَ بِاللّهِ مَا قَالُواْ وَلَقَدْ قَالُواْ كَلِمَةَ الْكُفْرِ وَكَفَرُواْ بَعْدَ إِسْلاَمِهِمْ (التوبة:74)
অর্থাৎ “তারা আল্লাহর নামে হলফ করে বলছে: কিছুই তো আমরা বলিনি” অথচ কুফরি কথাই তারা নিশ্চয় বলছে, ফলে ইসলামকে স্বীকার করার পর তারা কাফের হয়ে গিয়েছে।” (সুরা তওবাঃ ৭৪)
(৯) আপনি কি শোনেননি মাত্র একটি কথার জন্য আল্লাহ এক দল লোককে কাফের বলছেন, অথচ তারা ছিল রসূলুলস্নাহ (সাঃ)-এর সমসাময়িক কালের লোক এবং তারা তাঁর সঙ্গে জিহাদ করেছে, সালাত পড়েছে যাকাত দিয়েছে, হজব্রত পালন করেছে এবং তাওহীদের উপর বিশ্বাস রেখেছে?
আর ওইসব লোক যাদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন:
قُلْ أَبِاللّهِ وَآيَاتِهِ وَرَسُولِهِ كُنتُمْ تَسْتَهْزِؤُونَ – لاَ تَعْتَذِرُواْ قَدْ كَفَرْتُم بَعْدَ إِيمَانِكُمْ (التوبة : 65-66)
“তুমি বল: তোমরা কি ঠাট্টা তামাশা করছিলে আল্লাহ ও তাঁর আয়াতগুলোর এবং তাঁর রসূল এর সাথে? এখন আর কৈফিয়ত পেশ করো না। তোমরা নিজেদের ঈমান প্রকাশ করার পরও তো কুফরি কাজে লিপ্ত ছিলে।” (তওবা ৬৫-৬৬)
এই লোকদের ব্যাপারে আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলেছেন: তারা ঈমান আনার পর কাফের হয়েছে। অথচ তারা রসূলুলস্নাহ (সাঃ) এর সঙ্গে তাবুকের যুদ্ধে যোগদান করেছিল। তারা তো মাত্র একটি কথাই বলেছিল এবং সেটা হাসি ও ঠাট্টার ছলে।
অতএব, আপনি তাদের এই সংশয় ও ধোঁকাগুলোর ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা করে দেখুন। সেটা হল: তারা বলে, তোমরা মুসলমানদের মধ্যে এমন লোককে কাফের বলছ যারা আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষ্য দিচ্ছে, তারা সালাত পড়ছে, রোযা রাখছে। তারপর তাদের এ সংশয়ের জওয়াবও গভীরভাবে চিন্তা করে দেখুন। তখন সহজেই সত্য বুঝতে পারবেন।
“আমাদের জন্যও একটা উপাস্য মূর্তি বানিয়ে দাও যেমন তাদের জন্য রয়েছে বহু উপাস্য-মূর্তি।” (সুরা আ’রাফঃ ১৩৮
মুসলিমদের অবস্থা কি এখন তাই নয়?