শবে বরাত সম্পর্কে আমাদের সালাফী ভাইরা যা জানেন না অথবা গোপন করেন – শবে বরাত এর ব্যাপারে কিছু সহীহ হাদিস আছে
লিখেছেন: ' abdullah al Mamun' @ বৃহস্পতিবার, জুলাই ৫, ২০১২ (৫:২৬ অপরাহ্ণ)
শবে বরাতকে বা লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বানকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণীর মানুষ বিদয়াতে লিপ্ত। আবার অনেকে শায়েখ বিন বাজের একটি ফতোয়ার উপর ভিত্তি করে শবে বরাতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা শুরু করেছেন। তাদের দাবী হল ইসলামে শবে বরাতের কোন ধারণা নেই। এ ব্যাপারে যত হাদিস আছে সব মওযু অথবা যয়ীফ। শবে বরাতকে বিশেষ কোন ফযীলতপূর্ণ রাত মনে করা শরীয়তের দৃষ্টিতে জায়েয নয়। এটাও আরেকটা ভুল অবস্থান।
শবে বরাতের ব্যপারে সঠিক ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান হল, এ রাতের ফযীলত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। সম্মিলিত কোন রূপ না দিয়ে এবং এই রাত উদযাপনের বিশেষ কোন পন্থা উদ্ভাবন না করে বেশি ইবাদত করাও নির্ভরযোগ্য রেওয়াত দ্বারা প্রমাণিত। এই রাতকে অন্য সব সাধারণ রাতের মতো মনে করা এবং এই রাতের ফযীলতের ব্যাপারে যত হাদীস এসেছে, তার সবগুলোকে মওযু বা যয়ীফ মনে করা ভুল যেমন অনুরূপ এ রাতকে শবে কদরের মত বা তার চেয়েও বেশি ফযীলতপূর্ণ মনে করাও ভিত্তিহীন ধারণা।
এখানে শবে বরাতের (পনের শাবানের রাত) ফযীলত বিষয়ক কিছু হাদীস যথাযথ উদ্ধৃতি ও সনদের নির্ভরযোগ্যতার বিবরণ সহ উল্লেখ করা হল।
১ম হাদীসঃ
عن مالك من يخامر , عن معاذ بن جبل, عن النبى (, قال : يطلع الله الى خلقه فى ليلة النصف من شعبان, فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مشاحن [رواه ابن حبان وغيره, ورجاله ثقات, وإسناده متصل غلى مذهب مسلم الذى هو مذهب الحمهورفى المعنعن, ولم يحزم الذهبى بأن مكحولالم يلق مالك بن يخامر كما زعم, وإنما قاله على سبيل الحسان, راجع ,سبر أعلام النبلاء
মুআয ইবনে জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম স. বলেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন।
সনদ বিষয়ক আলোচনাঃ
ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে হিব্বান তার কিতাবুস সহীহ এ (যা সহীহ ইবনে হিব্বান নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ, ১৩/৪৮১ এ) এই হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। এটি এই কিতাবের ৫৬৬৫ নং হাদীস। এ ছাড়া ইমাম বাইহাকী (রহঃ) শুআবুল ঈমান এ (৩/৩৮২, হাদীস ৩৮৩৩); ইমাম তাবরানী আল-মুজামুল কাবীর (২০/১০৮-১০৯) ও আল-মুজামুল আওসাত এ বর্ণনা করেছেন, আবুল হাসান আল কাজয়নি বর্ণনা করেছেন আল আমালী (৪/২), ইবনে আসাকির আত্* তারিখ (১৫/৩০২), ইবনে আবি আসিম আস সুন্নাহ (১/২২৪) তে এই হাদিস বর্ণনা করেছেন।
ইমাম ইবনে হিব্বান একে সহীহ বলেছেন। (দেখুনঃ ইবনে রজব রচিত লাতায়েফুল মাআরিফ, ১/২২৪)
ইমাম ইবনে হাজার হাইসামী (রঃ) বলেছেনঃ হাদিসটিকে ইমাম তাবরানী মুজাম আল কাবির এবং আল আওসাত এ বর্ণনা করেছেন এবং উভয় হাদিসের রাবীগণ সিকাহ (বিশ্বস্থ)। (দেখুনঃ মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৮/৬৫)
ইমাম মুনযিরী, ইবনে রজব, কাস্*তাল্লানী, যুরকানী এবং অন্যান্য হাদীস বিশারদ এই হাদীসটিকে আমলযোগ্য বলেছেন। (দেখুনঃ আততারগীব ওয়াততারহীব ২/১৮৮; ৩/৪৫৯; শারহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়্যা ১০/৫৬১)
শাইখ শুয়াইব আল আরনাউত (রঃ) হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন। (দেখুনঃ আল ইহসান ফি তারিক সাহিহ ইবনে হিব্বান, ১২/৪৮১, হাদিস নম্বরঃ ৫৬৬৫)
শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী (রহঃ) সিলসিলাতুল আহাদসিস্* সাহীহা ৩/১৩৫-১৩৯ এ এই হাদীসের সমর্থনে আরো আটটি হাদীস উল্লেখ করার পর লিখেছেনঃ
وجملة القول أن الحديث بمجموع هذه الطرق صحيح بلاريب.
এ সব রেওয়াতের মাধ্যমে সমষ্টিগত ভাবে এই হাদীসটি নিঃসন্দেহে সহীহ প্রমাণিত হয়।
তারপর আলবানী (রহঃ) ওই সব লোকের বক্তব্য খন্ডন করেন যারা কোন ধরণের খোঁজখবর ছাড়াই বলে দেন যে, শবে বরাতের ব্যাপারে কোন সহীহ হাদীস নেই।
২য় হাদিসঃ
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসুল (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং বিদ্বেষ পোষণকারী ও হত্যাকারী ব্যতীত আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন।
সনদ বিষয়ক আলোচনাঃ
হাদিসটি ইমাম আহমেদ (রঃ) উল্লেখ করেছেন। (মুসনাদে আহমাদ ২/১৭৬, হাদিস নম্বরঃ ৬৬৪২)
এছাড়াও হাদিসটি ইমাম বাজ্জার বর্ণনা করেছেন ও ‘হাসান’ বলে সাব্যস্থ করেছেন।
শাইখ আহমেদ শাকির তার মুসনাদে আহমেদের তাহকীকে হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন।
শাইখ আলবানী হাদিসটিকে ‘হাসান’ সাব্যস্থ করেছেন। (দেখুনঃ সিলসিলা আহাদিস আস সাহীহা ৩/১৩৬)
৩য় হাদিসঃ
একই রকম হাদিস বর্ণিত হয়েছে হজরত আবু বকর (রাঃ) থেকে যেখানে তিনি বলেছেনঃ রাসুল (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং বিদ্বেষ পোষণকারী ও হত্যাকারী ব্যতীত আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন।
সনদ বিষয়ক আলোচনাঃ
হাদিসটি ইমাম বাজ্জার তার মুসনাদে বর্ণনা করেছেন।
ইমাম মুনজিরি হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন। (দেখুনঃ আত তারগীব ৩/৪৫৯)
ইমাম ইবনে হাজার (রঃ) হাদিসটির একটি সনদকে হাসান বলেছেন। (দেখুনঃ আল আমালিল মুতলাকা ১১৯-১২০)
৪র্থ হাদিসঃ
একই রকম হাদিস বর্ণিত হয়েছে আবু মুসা আশয়ারী (রাঃ) থেকে যেখানে তিনি বলেছেনঃ রাসুল (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন।
সনদ বিষয়ক আলোচনাঃ
হাদিসটি ইমাম ইবনে মাজাহ তার সুনানে বর্ণনা করেছেন। (হাদিস নম্বরঃ ১৩৯০)
শাইখ নাসির উদ্দিন আলবানী হাদিসটিকে হাসান বলেছেন।
শবে বরাতের ব্যাপারে সকল হাদিস উল্লেখ করে শাইখ আলবানী মন্তব্য করেছেনঃ
وتكلم الشيخ محمد ناصر الدين الألباني في صحيحه 3/135 139 عن هذه الأحاديث كلاماً مستفيضاً، يشد بعضها بعضاً”
এই (শবে বরাতের ফজীলাতের ব্যপারে) কথাটি মুস্তাফিজ (সুরক্ষিত)। এ ব্যাপারে এক হাদিস অপরটিকে শক্তিশালী করেছে।
শবে বরাতের ব্যাপারে সলফে সালেহীনদের মতামতঃ
সলফে সালেহীনদের মধ্যে অনেকে এই রাতের বিশেষত্ব বর্ণনা করেছেন। যেমনঃ উমার বিন আব্দুল আজিজ (রঃ), ইমাম শাফেয়ী (রঃ), ইমাম আওযায়ী (রঃ), আত্তা ইবনে ইয়াসীর (রঃ), ইবনে তাইমিয়া (রঃ), ইবনে রজব আল হাম্বলী (রঃ), হাফিজ জয়নুদ্দিন আল ইরাকী (রঃ)। (দেখুনঃ হাফিজ ইবনে রজব রচিত লাতায়েফুল মায়ারিফ ২৬৩-২৬৪ পৃষ্টা ও ফায়জুল ক্বাদীর ২/৩১৭)
ক) ইমাম শাফেয়ী (রঃ) বলেছেনঃ
(قال الشافعي) وبلغنا أنه كان يقال: إن الدعاء يستجاب في خمس ليال في ليلة الجمعة وليلة الاضحى وليلة الفطر وأول ليلة من رجب وليلة النصف من شعبان {الأم – الامام -ج 1 الصفحات: 264}
আমাদের কাছে যেসব কথা পৌঁছেছে, (তার মধ্যে এটাও আছে যে) নিশ্চয়ই দুয়া ৫ টি রাতে কবুল হয়। জুমুয়ার রাত, ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর এর রাত, রজবের ১ম রাতে ও শাবান মাসের ১৫ তারিখ রাতে। (দেখুনঃ আল উম্ম ১/২৩১)
খ) ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রঃ) বলেছেনঃ
لكن الذي عليه كثير من أهل العلم، أو أكثرهم، من أصحابنا وغيرهم -على تفضيلها، وعليه يدلنص أحمد، لتعدد الأحاديث الواردة فيها، وما يصدق ذلك من الآثار السلفية، وقدروي بعض فضائلها في المسانيد والسنن . وإن كان قد وضع فيها أشياء أخر.فأما صوم يوم النصف مفردًا فلا أصل له، بل إفراده مكروه
(কেউ কেউ বলেছেন, এই রাতের সাথে বছরের অন্যান্য রাতের কোন পার্থক্য নেই) কিন্তু অনেক আলিম ও আমাদের মাজহাবের (হাম্বালী মাজহাবের) আলিমগণ এবং আরো অনেকের এই রাতের মর্যাদার ব্যাপারে একমত। এ ব্যাপারে অনেক হাদিস উপস্থিত থাকায় ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বালের মতও এটাই। সলফে সালেহীনদের কথা থেকেও যা প্রমাণিত হয়েছে। এই রাতের বিশেষত্ব কিছু কিছু সুনান ও মুসনাদ হাদিস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। এই (রাতের মর্যাদার) ব্যাপারটি সত্য যদিও এ ব্যাপারে অন্যান্য যা বর্ণিত হয়েছে সেগুলি মিথ্যা। আর শুধু ১৫ তারিখ দিনে আলাদা রোযা রাখা এ ব্যাপারে কোন দলীল নেই, বরং এই দিনকে রোযার জন্য আলাদা করা মাকরুহ। (দেখুনঃ ইক্*তিযাউস সিরাতিল মুস্তাকিম ২/৬৩১-৬৪১)
গ) ইমাম সুয়ুতী (রঃ) বলেছেনঃ শাবান মাসের ১৫ তারিখ রাতের ব্যাপারে কথা হলো এর অনেক ফজীলাত রয়েছে, এবং এই রাতের কিছু অংশ নফল ইবাদাতে কাটানো উত্তম। … যদি এই ইবাদাত অবশ্যই একাকী করতে হবে, জামায়াতে করা যাবে না। (দেখুনঃ হাকীকাতুস সুন্নাহ ওয়াল বিদয়াহ, ৫৮ পৃষ্টা)
ঘ) ইমাম আলাউদ্দিন আল সাকাফী (রঃ) বলেনঃ নফল নামাজ পড়া যায় … দুই ঈদের রাতে, শাবান মাসের ১৫ তারিখ রাতে, রমজান মাসের শেষ ১০ রাতে ও জিলহজ্জ্ব মাসের প্রথম ১০ রাতে। (দেখুনঃ দুররুল মুহতার ফি শারহ তানভীন আল আবছার, উল্লেখ্য এই কিতাবের বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ ইবনে আবেদীন (রঃ) রচিত রাদ্দাল মুহতার যা শরহে ইবনে আবেদীন / ফতোয়ায়ে শামী নামেও পরিচিত হানাফী মাজহাবের প্রসিদ্ধ ফিকহ গ্রন্থ)
ঙ) ইমাম নববী (রঃ) তার ফতোয়ার কিতাব আল-মাজমুতেও ইমাম শাফেয়ী (রঃ) উক্তি উলেখ করেছেন।
উল্লেখ্য কোনভাবেই উপরুক্ত হাদিস কিংবা ইমামদের বক্তব্য আমাদের সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন বিদয়াত যেমনঃ নতুন আবিস্কৃত নামাজ-দুয়া, সম্মিলিত ইবাদাত, সারারাত ওয়াজ, বিভিন্ন মেলা, হালুয়া-রুটি, মসজিদে ও কবরে লাইটিং, মিলাদ ইত্যাদিকে প্রমাণ করে না।
বরং সলফে সালেহীনরা এই রাতে ব্যক্তিগতভাবে কিছু ইবাদাত-বন্দেগী করতেন। আল্লাহর রহমত কামনা করতেন।
আল্লাহ আমাদেরকে সঠিকভাবে আমল করার তৌফিক দান করুন।
নিফসে মিন সাবানের বিষয়ে বর্ণিত যে হাদীসগুলো এখানে উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে এই রাতকে কেন্দ্র করে বা নির্দিষ্ট করে কোন আলাদা ইবাদত, যিকর, বিশেষ খুৎবা, বিশেষ নফল সালাত কিংবা বিশেষ নফল রোজার কথাও বর্ণিত হয়নি। এই রাত্রের মর্যাদা থাকলে হাদীস অনুযায়ী মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকল মুসলিমই আল্লাহ তা’আলার রহমতের দৃষ্টির অন্তর্ভূক্ত! ধন্যবাদ।