আমি তোমাদের মাঝে দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি……পর্ব – ২
লিখেছেন: ' ABU TASNEEM' @ বুধবার, মার্চ ১৪, ২০১২ (৬:০৮ পূর্বাহ্ণ)
পাঠকবৃন্দ ! বাস্তবতা এই যে , মুসলিম সমাজ আজ দলে দলে বিভক্ত আর মনে হয় সব দলই নিজেদেরকে সঠিকের উপরে রয়েছে বলে দাবী করে থাকে । কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বিভক্ত মুসলিম মিল্লাতে সব দলই কি বাস্তবে সঠিক পথের উপর রয়েছে ? আমরা সালাতের প্রত্যেক রাকা’আতে সূরা ফাতিহার মধ্যে সিরাতুল মুস্তাকীম (সোজা সরল পথ) চেয়ে থাকি । কিন্তু সব দলই কি সিরাতুল মুস্তাকীমের উপর প্রতিষ্ঠিত ? না , এরুপ হওয়ার কথা নয় । কারণ , সিরাতুল মুস্তাকীমের ব্যাখ্যায় হাদীসের ভাষায় তা জানুন :
“আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেন : রাসূল (সাঃ) একটি দীর্ঘ দাগ কেটে বললেন : এটি হচ্ছে আল্লাহর পথ । অতঃপর তিনি তার ডানে এবং বামে অনেকগুলো দাগ কেটে বললেন : এগুলো বহুপথ এগুলোর প্রতিটিতে শয়তান রয়েছে , সে সেদিকে আহ্বান করছে । অতঃপর পাঠ করলেন :
এটাই আমার সরল সঠিক পথ , কাজেই তোমরা তার অনুসরণ কর , আর নানান পথের অনুসরণ করো না , করলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে । এভাবে তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যাতে তোমরা তাঁকে ভয় করে যাবতীয় পাপ থেকে বেঁচে চলতে পার ।” সূরা আনআমঃ ১৫৩ ।
অন্যভাবে আমরা যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখব , একই বিষয়ের ক্ষেত্রে একজন বলছেন হালাল আবার অন্যজন বলছেন হারাম , একজন বলছেন গুনাহের কাজ অন্যজন বলছেন নেকীর কাজ । ইসলামী শরী’আতের মধ্যে এত বৈপরীত্য থাকতে পারে না । অতএব দুটি সিদ্ধান্তের যে কোন একটি ভুল হিসাবে গন্য হবেই ।
আর যদি সব দলগুলোই সঠিক পথের উপর থাকত তাহলে রসূল (সাঃ) হাদীসের মধ্যে বলতেন না যে ,
“………… আর আমার উম্মাত তেহাত্তর দলে বিভক্ত হবে । যাদের একটি মাত্র দল বাদে বাকী সব দলগুলোই জাহান্নামে যাবে ।” (সহীহ তিরমিযী : ২৬৪১ ) । অন্য এক হাদীসে বাহাত্তর দলের কথা বলা হয়েছে যেগুলোর একটি বাদে বাকী সবগুলোই জাহান্নামে যাবে । (সহীহ ইবনু মাজাহ:৩৯৯৩) ।
আবার তিনি বলতেন না যে , কিয়ামত দিবস পর্যন্ত একটি দল হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে ।
সাওবান (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেন : রসূল (সাঃ) বলেছেন : আমার উম্মাতের জন্য আমি পথভ্রষ্ট ইমামদেরকে ( আলেমদেরকে ) ভয় করছি । রসূল (সাঃ) আরো বলেন : আমার উম্মাতের একটি দল হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে । কোন ব্যক্তি কতৃক তাদেরকে অপমানিত করার প্রচেষ্টা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না …….. মুসলিম , সহীহ তিরমিযী : ২২২৯ ।” ইমাম তিরমিযী উল্লেখ করেছেন যে , আলী ইবনুল মাদীনী বলেন : সে দলটি হচ্ছে হাদীসের (সহীহ হাদীসের) অনুসরণকারীগণ । এরুপ হাদীস আবু দাউদও বর্ণনা করেছেন , দেখুন সহীহ আবু দাউদ : ৪২৫২ ।
অতএব রসূল (সাঃ) এর বাণী থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় সহীহ সুন্নাহ থেকে বিমুখ করার ক্ষেত্রে এক শ্রেনীর ইমামরা (আলেমরা) সচেষ্ট থাকবে এবং তারা সচেষ্ট আছেও বটে ।
এখানে ইমাম হতে বর্ণিত একটি উক্তি উল্লেখ না করলেই নয় , তিনি বলেন :
নবী (সাঃ) এর পরে এমন একজন ব্যক্তিও নেই যার কথা গ্রহণীয় আবার বর্জনীয় নয় । একমাত্র নবী (সাঃ) এর কোন কথা (সুন্নাত) বর্জনীয় নয় । অর্থাৎ নবী (সাঃ) এর সুন্নাত ব্যতীত অন্য যে কোন ব্যক্তির কথা বা মত গ্রহণ করার পরেও বর্জনীয় যদি তা সহীহ সুন্নাতের সাথে না মিলে ।
তিনি আরো বলেন : সুন্নাত হচ্ছে নূহ (আঃ) এর কিস্তি যে ব্যক্তি তাতে আরোহণ করবে সে রেহাই পাবে , আর যে তার থেকে পশ্চাতে থাকবে (পিছপা হবে) সে ডুবে যাবে ।
অতএব যে কেউ কোন মত প্রকাশ করুন না কেন এবং তার এ মতের অনুসারীর সংখ্যা যত বেশীই হোক না কেন এবং যে কোন স্থানেই এ মতের উপর আমল করা হোক না কেন তা বিবেচ্য হতে পারে না । বরং বিবেচ্য বিষয় হতে হবে কার পক্ষে সহীহ এবং সঠিক দলীল প্রমাণ রয়েছে তা অনুসন্ধান করা । মুসলিম সমাজ দলীল প্রমাণ অনুসন্ধান করা থেকে দূরে সরে গিয়ে অনেকের অন্ধ অনুসরণের কারণেই আজ শত দলে বিভক্ত । আর এ বিভক্তি থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে অন্ধ অনুসরণকে ত্যাগ করে দলীলের অনুসরণ করা । অতএব আমাদেরকে খুঁজতে হবে সহীহ দলীল , চাইতে হবে সহীহ দলীল , আর ধাবিত হতে হবে সহীহ দলীল ভিত্তিক আমলের দিকে । তাহলেই আমরা নবী (সাঃ) এর সহীহ তরীকাহ এবং তাঁর সাহাবীগণের পথের উপর নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব এবং সরাসরি যে দল জান্নাতে যাবে সে দলের অন্তর্ভুক্ত হতে পারব এবং মুসলিম সমাজে পরস্পরের মাঝের দূরত্বও কমে আসবে ইনশা-আল্লাহ ।
সবার বুঝা উচিত ছিল যে , শুধু ভালোই নয় বরং বাহ্যিকভাবে উত্তম নিয়্যাতে সর্বোত্তম কর্ম করা হলেও তা করে নবী (সাঃ) এর তরীক্বা থেকে বের হয়ে যেতে হবে যদি চমৎকার নিয়্যাতে করা সর্বোত্তম আমলের সমর্থনে কুরআন এবং সহীহ হাদীস থেকে দলীল না মিলে ।
কারণ বুখারী এবং মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদীসের মধ্যে সেই তিন ব্যক্তির (যারা ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিমগণের অন্তর্ভুক্ত এবং যাদের প্রতি আল্লাহ রব্বুল আলামীনও সন্তুষ্ট ছিলেন । তারা হচ্ছেন নবী (সাঃ) এর সাথী-সাহাবী) ঘটনা যাদের একজন সারা রাত না ঘুমিয়ে বাকী জীবন শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদাতে সালাত আদায় করে কাটিয়ে দেয়ার সংকল্প করেছিলেন , আরেকজন বাকী জীবনের প্রতিদিনই সওম পালন করবেন মর্মে সংকল্প করেছিলেন আর তৃতীয়জন শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করার লক্ষ্যে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন । কিন্তু এতো চমৎকার নিয়্যাত এবং ভালো ভালো আমল করার দৃঢ় সংকল্পগুলো রসূল (সাঃ) শুনার পর কি বলেছিলেন মর্মে বর্ণিত হাদীসটি সম্পূর্ণ উল্লেখ করা হলো :
আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেন : কতিপয় ব্যক্তি নবী (সাঃ) এর স্ত্রীগণের গৃহের নিকট এসে নবী (সাঃ) এর ইবাদাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল । তাদেরকে যখন তার ইবাদাত সম্পর্কে সংবাদ দেয়া হল তখন তারা যেন নবী (সাঃ) এর ইবাদাত কে (তাদের জন্য) সামান্য মনে করল । তারা বলল : নবী (সাঃ) এর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী যাবতীয় গুণাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে (তার পরেও যখন তিনি এত বেশী ইবাদাত করতেন) তখন তার তুলনায় আমরা কোথায় ? তাই তাদের একজন বলল : আমি এখন থেকে সর্বদায় সারা রাত ধরে সালাত আদায় করব । আরেকজন বলল : আমি সারা বছরব্যাপী সাওম পালন করব কখনও সাওম ভঙ্গ করব না । আরেকজন বলল : আমি স্ত্রীদের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকব কখনও বিয়ে করব না । অতঃপর রসূল (সাঃ) তাদের নিকটে এসে বললেন : তোমরাই কি এরুপ এরুপ কথা বলছিলে ? আর আমি ! আল্লাহর কসম অবশ্যই তোমাদের চেয়ে আল্লাহকে বেশী ভয় করি এবং তোমাদের চেয়ে আমি বেশী পরহেযগার । তা সত্ত্বেও আমি সাওম রাখি , ভঙ্গ করি , রাতে সালাত আদায় করি , আবার নিদ্রাও যাই এবং আমি মহিলাদেরকে বিয়েও করেছি । এটিই হচ্ছে আমার সুন্নাত – তরীক্বা । অতএব যে আমার এ সুন্নাত থেকে বিমুখ হবে সে আমার অন্তর্ভুক্ত নয় ।” – বুখারী , মুসলিম ।
অতএব আমল বাহ্যিকভাবে ভালো হলেই চলবে না । বরং আপনার দৃষ্টিতে এ ভালো আমলটিকে রাসূল (সাঃ) ভালো হিসাবে জানতেন কি জানতেন না – এ তথ্যটিও জানতে হবে । আপনি যদি বলেন যে এটি ভালো তাহলে আপনার প্রতি প্রশ্ন আসবে আপনার এ ভালো কর্মটি রসূল (সাঃ) কি জানতেন ? যদি বলেন , জানতেন । তাহলে আপনাকে – তিনি যে জানতেন তার প্রমাণ দিতে হবে ? ঐ প্রমাণটি সঠিক হলে সেটিই তো দলীল । আর যদি বলেন : তিনি জানতেন না ( জানবেন কিভাবে তাঁর যুগেতো ছিলই না) – তাহলে বলতে হবে যে , ভালো কর্ম নির্ধারণে আপনি রসূল (সাঃ) এর চেয়েও বেশী জ্ঞানী (নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক) । কারণ তিনি আল্লাহর নবী ও রসূল (সাঃ) হয়েও তা ভালো মনে করে বলে গেলেন না অথচ আপনি কর্মটিকে ভালো বিদ’আত বলে দিব্বি করে এবং বলে যাচ্ছেন অথবা চালু আছে আর আপনিও তার অনুসরণ করছেন ।
এ শেষোক্ত হাদীসটি প্রমাণ করছে যে , ভাল মনে করে কোন ইবাদাত করলেও সে ইবাদাত গ্রহণযোগ্য হবে না যে পর্যন্ত সে ইবাদাতের সমর্থনে সহীহ হাদীস দ্বারা দলীল বা প্রমাণ না মিলবে । কারণ সাওম ও সালাত শুধু ভাল ইবাদাতই নয় বরং সর্বোত্তম ইবাদাতের অন্তর্ভুক্ত , আর যে ব্যক্তি বিয়েকে ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন তিনিও আল্লাহর ইবাদাত করার উদ্দেশ্যেই বিয়েকে ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন । অতএব নিয়্যত ভালই ছিল । এতো চমৎকার নিয়্যত থাকা সত্বেও রসূল (সাঃ) তাদের এ মহৎ উদ্দেশ্য গুলোকে প্রত্যাখ্যান করলেন । কারণ , তারা রসূল (সাঃ) এর সুন্নাত – তরীক্বা বিরোধী (সুন্নাতে নেই এরুপ) সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন ।
এ হাদীস থেকে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট হচ্ছে যে , ভাল কর্ম হলেও তার সমর্থনে শার’ঈ দলীল না মিললে তা ভাল নয় বরং তা মন্দ কর্ম হিসেবেই গণ্য হবে । যাকে ইসলামী শরী’আতের ভাষায় বিদ’আত বলা হয় , সে বিদ’আতের সাথে জড়িত হলে পরিণতিটা অত্যন্ত ভয়াবহ । আগামী কোন এক পোস্ট এ বিষয়ে করব ইনশা-আল্লাহ । আর এসব ভয়াবহ কুপরিণতি থেকে রক্ষার লক্ষ্যেই মুসলিম সমাজকে বিদ’আতের ব্যাপারে সতর্ক করার চেষ্টা করছি । আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন – যেন আমি আমার কাজ ঠিক ভাবে করতে পারি ।