আলেমগণের মধ্যে মতভেদের কারণ -৩
লিখেছেন: ' ABU TASNEEM' @ শুক্রবার, এপ্রিল ৬, ২০১২ (৭:২০ পূর্বাহ্ণ)
কারণ ৭ : যঈফ হাদীছ দ্বারা আলেমের দলীল পেশ অথবা দুর্বলভাবে দলীল উপস্থাপন :
আর এমন ঘটনা অনেক। যঈফ হাদীছ দ্বারা দলীল পেশের অন্যতম একটি উদাহরণ হচ্ছে, কোন কোন আলেম ‘ছালাতুত তাসবীহ’-কে মুস্তাহাব বলেন। ‘ছালাতুত তাসবীহ’ হচ্ছে, দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করা, যাতে দন্ডায়মান অবস্থায় সূরা ফাতিহা এবং ১৫ বার তাসবীহ পাঠ করা হয়। অনুরূপভাবে রুকূ ও সিজদা সহ ছালাতের শেষ পর্যন্ত সব জায়গায় তাসবীহ পাঠ করা হয়। আসলে ঐ ছালাতের নিয়ম-কানূন আমি ভালভাবে রপ্ত করিনি। কারণ শারঈ দৃষ্টিকোণ থেকে আমি সেটিকে ঠিক মনে করি না। আবার কেউ কেউ মনে করেন, ‘ছালাতুত তাসবীহ’ জঘন্য বিদ‘আত এবং এ মর্মের হাদীছ ছহীহ নয়। ইমাম আহমাদ (রহঃ) এ মতের পক্ষে। তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) থেকে উহা সাব্যস্ত নয়। শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, ‘ছালাতুত তাসবীহ’ সংক্রান্ত হাদীছ হ’ল রাসূল (ছাঃ)-এর উপর মিথ্যা রটনা। আর বাস্তবেই যিনি এ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করবেন, তিনি দেখবেন যে, শরী‘আতের দৃষ্টিকোণ থেকেও ইহা অস্বাভাবিক ও ব্যতিক্রম একটি বিধান। কেননা ইবাদত অন্তরের জন্য উপকারী হবে। আর অন্তরের পরিশুদ্ধির জন্য সব সময় এবং সব জায়গায় তা শরী‘আত সম্মত হবে। পক্ষান্তরে উপকারী না হ’লে শরী‘আত সম্মত হবে না। আর যে হাদীছে এই ছালাত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে, মানুষ প্রত্যেক দিন অথবা প্রত্যেক সপ্তাহে একদিন অথবা মাসে একদিন কিংবা জীবনে অন্ততঃ একদিন আদায় করবে। ইসলামী শরী‘আতে এর কোন নযীর নেই। সেজন্য এ সংক্রান্ত হাদীছ সনদ এবং মতন উভয় দিক থেকেই শায বা বিরল এবং শায়খুল ইসলামের মত যিনি সেগুলিকে মিথ্যা বলেছেন, তাঁর বক্তব্যই সঠিক। আর সেকারণেই শায়খুল ইসলাম বলেন, কোন আলেমই এই ছালাতকে উত্তম বলেননি।
নারী-পুরুষ কর্তৃক ব্যাপকভাবে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় বলে আমি এই উদাহরণটি পেশ করেছি। এই বিদ‘আতী আমল শরী‘আত সম্মত গণ্য করা হবে মর্মে আমি ভয় করছি। কোন কোন মানুষের কাছে এমন বক্তব্য ভারী মনে হ’তে পারে ভেবেও আমি একে বিদ‘আতই বলছি। কেননা আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, কুরআন ও হাদীছে নেই এমন যা কিছু আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য করা হয়, তা-ই বিদ‘আত।
অনুরূপভাবে কেউ দলীল প্রদানের ক্ষেত্রে দুর্বল প্রমাণও গ্রহণ করে। দলীল শক্তিশালী, কিন্তু তার দ্বারা দলীল সাব্যস্ত করা দুর্বল। কোন কোন আলেম এ হাদীছ গ্রহণ করেছেন। যেমন, ذَكَاةُ الْجَنِيْنِ ذَكَاةُ أُمِّهِ ‘গর্ভস্থ বাচ্চার মাকে যবেহ করাই হ’ল গর্ভস্থ বাচ্চাকে যবেহ করা’।[1] আলেম সমাজের নিকট এই হাদীছের প্রসিদ্ধ অর্থ হল, ‘যদি গর্ভস্থ বাচ্চার মাকে যবেহ করা হয়, তাহলে সেই যবেহ গর্ভস্থ বাচ্চার জন্যও যবেহ হিসাবে গণ্য হবে’। অর্থাৎ মাকে যবেহ করার পর যখন বাচ্চাকে পেট থেকে বের করা হবে, তখন তাকে আর যবেহ করার প্রয়োজন পড়বে না। কেননা বাচ্চা ইতিমধ্যে মারা গেছে। আর মারা যাওয়ার পর যবেহ করায় কোন লাভ নেই।
আবার কেউ কেউ হাদীছটির অর্থ বুঝেছেন এরূপ, ‘গর্ভস্থ বাচ্চাকে তার মায়ের মত করেই যবেহ করতে হবে। ঘাড়ের দুই রগ কেটে দিতে হবে এবং রক্ত প্রবাহিত করতে হবে’। কিন্তু এটি অবাস্তব। কারণ মৃত্যুর পর রক্ত প্রবাহিত করা সম্ভব নয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَا أَنْهَرَ الدَّمَ وَذُكِرَ اسْمُ اللهِ عَلَيْهِ فَكُلْ ‘যার রক্ত প্রবাহিত করা হয় এবং আল্লাহ্র নামে যবেহ করা হয়, তা খাও’।[2] আর একথা স্পষ্ট যে, মৃত্যুর পরে রক্ত প্রবাহিত করা সম্ভব নয়।
কিনারাবিহীন সাগরের মত অসংখ্য কারণের মধ্যে উক্ত কারণগুলির কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া আমি ভাল মনে করেছি। কিন্তু এক্ষণে এ সম্পর্কে আমাদের অবস্থান কি হবে?
আমি আগেই বলেছি, শ্রবণযোগ্য, পঠনযোগ্য, দর্শনযোগ্য ইত্যাকার নানা প্রচার মাধ্যমে আলেম ও বক্তাগণের বিপরীতমুখী বক্তব্যের কারণে সাধারণ মানুষ আজ গোলক-ধাঁধায় পড়ছে আর বলছে, আমরা কার কথা মানব? [কবি বলেন,]
تَكَاثَرَتِ الظِّبَاءُ عَلَى خِرَاشٍ * فَمَا يَدْرِيْ خِرَاشٌ مَا يَصِيْدُ
‘শিকারী কুকুরের নিকট হরিণ এতই বেশী হয়ে গেছে যে, সে কোনটি ছেড়ে কোনটি শিকার করবে তা বুঝতেই পারছে না’।
এক্ষণে এসব মতানৈক্যের ব্যাপারে আমরা আমাদের অবস্থানের কথা আলোচনা করব। এখানে আমরা আলেমগণের মতানৈক্য বলতে ঐসকল আলেমকে বুঝিয়েছি, যাঁরা ইলম ও দ্বীনদারিতায় নির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বস্ত। নামকাওয়াস্তে আলেমের মতানৈক্য আমাদের উদ্দেশ্য নয়। কেননা তাদেরকে আমরা আলেমই গণ্য করি না। প্রকৃত আলেমগণের উক্তি ও মতামত যেমন সংরক্ষণ করা হয়, আমরা তাদের মতামত সেই পর্যায়ের মনে করি না। সেজন্য যেসব আলেম মুসলিম উম্মাহ, ইসলাম ও ইলম বিষয়ে মানুষকে হিতোপদেশ দিয়ে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছেন, আমরা আলেম বলতে তাদেরকেই বুঝি। ঐসব আলেমের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান দু’ভাবে হ’তে পারে-
১. ঐ সকল আলেম আল্লাহ্র কিতাব ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত মোতাবেক কোন বিষয় হওয়া সত্ত্বেও কেন সে বিষয়ে মতানৈক্য করেছেন? মতানৈক্যের যেসব কারণ আমরা উল্লেখ করেছি এবং যেগুলি উল্লেখ করিনি, সেগুলির মাধ্যমে এর জবাব জানা যেতে পারে। সেগুলি অনেক। জ্ঞান অন্বেষণকারীর জন্য তা সুস্পষ্ট হবে যদিও সে ইলমে সুপন্ডিত নয়।
২. তাঁদের অনুসরণের ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কি? এ সকল আলেমের মধ্যে আমরা কার অনুসরণ করব? মানুষ কি কোন নির্দিষ্ট ইমামের এমন অনুসরণ করবে যে, তাঁর কথার বাইরে যাবে না, যদিও হক্ব অন্যের সাথে থাকে। যেমনটি মাযহাব সমূহের অন্ধ ভক্তদের স্বভাব। নাকি তার কাছে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত দলীলের অনুসরণ করবে, যদিও তা তার অনুসারী ইমামের বিরোধী হয়?
দ্বিতীয়টিই সঠিক জবাব। সেজন্য যিনি দলীল জানতে পারবেন, তার উপর সেই দলীলের অনুসরণ করা আবশ্যক, যদিও কোন ইমাম তার বিরোধী হন। তবে তা যেন উম্মতের ইজমার বিরোধী না হয়ে যায়। আর যে ব্যক্তি বিশ্বাস করবে যে, রাসূল (ছাঃ) ব্যতীত অন্য কারো কথা সর্বাবস্থায় এবং সর্বদা অবশ্য পালনীয় বা বর্জনীয়, সে অন্য কারো জন্য রিসালাতের বৈশিষ্ট্য প্রমাণ করল। কেননা রাসূল (ছাঃ) ব্যতীত অন্য কারো কথার বিধান এমনটি হ’তে পারে না এবং অন্য কারো কথা সর্বদা শিরোধার্য হ’তে পারে না।
তবে এ বিষয়ে আরো একটু চিন্তা-ভাবনার দিক রয়েছে। কেননা কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দলীল থেকে কে হুকুম-আহকাম বের করবেন তদ্বিষয়ে আমরা এখনও গোলক-ধাঁধায় পড়ে আছি? এটি মুশকিলও বটে। কেননা প্রত্যেকেই বলা শুরু করেছেন, আমিই এই যোগ্যতা ও ক্ষমতার অধিকারী। প্রত্যেকের এমন দাবী যুক্তিসঙ্গত নয়। যদিও কুরআন ও সুন্নাহ একজন মানুষের দলীল হবে, এদিক বিবেচনায় সেটি ভাল। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, অর্থ ও মর্ম জানুক বা না জানুক কোন রকম দলীল উচ্চারণ করতে পারে এমন প্রত্যেকের জন্য আমরা দরজা খুলে দেব আর বলব, তুমি মুজতাহিদ বা শরী‘আত গবেষক, যা ইচ্ছা তুমি তাই বলতে পার। এমনটি হ’লে ইসলামী শরী‘আত, মানব ও মানব সমাজে বিশৃঙখলা সৃষ্টি হবে। এক্ষেত্রে মানুষকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়- ১. প্রকৃত আলেম, যাঁকে আল্লাহ গভীর ইলম ও বুঝশক্তি দু’টিই দান করেছেন। ২. দ্বীনের সাধারণ জ্ঞানপিপাসু, যার ইলম রয়েছে; কিন্তু প্রথম শ্রেণীর গভীর জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তির পর্যায়ে তিনি পৌঁছতে পারেননি। ৩. সাধারণ মানুষ, যারা তেমন কিছুই জানে না।
প্রথম প্রকার ব্যক্তি : তার অধিকার আছে শারঈ বিষয় নিয়ে গবেষণা করার এবং এ কথা বলার; বরং তাঁর জন্য একথা বলা ওয়াজিব যে, বিরোধী হ’লেও মানুষকে দলীলভিত্তিক সঠিক বক্তব্যই পেশ করতে হবে। কেননা তিনি আল্লাহ কর্তৃক তদ্বিষয়ে আদিষ্ট। মহান আল্লাহ বলেন,لَعَلِمَهُ الَّذِينَ يَسْتَنْبِطُوْنَهُ مِنْهُمْ ‘তবে তাদের মধ্যে তত্ত্বানুসন্ধিৎসুগণ তা উপলব্ধি করত’ (নিসা ৮৩)। এই শ্রেণীর আলেমগণই কুরআন এবং ছহীহ সুন্নাহ থেকে হুকুম-আহকাম উদ্ঘাটনের যোগ্য।
দ্বিতীয় শ্রেণীর ব্যক্তি : আল্লাহ যাকে জ্ঞান দান করেছেন। কিন্তু তিনি প্রথম স্তরে পৌঁছতে পারেননি। যদি শরী‘আতের সাধারণ বিষয়গুলি এবং তাঁর কাছে যে জ্ঞানটুকু পৌঁছেছে তার অনুসরণ করেন, তাহ’লে তাতে কোন দোষ নেই। তবে তাঁকে সে বিষয়ে খুব সতর্ক থাকতে হবে এবং তাঁর চেয়ে বড় আলেমকে জিজ্ঞেস করার ক্ষেত্রে সে মোটেও শিথিলতা প্রদর্শন করবে না। কেননা তার ভুল হওয়ার সম্ভাবনা তুলনামূলক বেশী। তাছাড়া তার জ্ঞান ‘আম-খাছ’, ‘মুত্বলাক্ব-মুক্বাইয়াদ’ ইত্যাদি সূক্ষ্ম বিষয় পর্যন্ত নাও পৌঁছতে পারে। কিংবা ‘মানসূখ’ হওয়া কোন বিষয়কে সে না জেনে ‘মুহকাম’ মনে করতে পারে।
তৃতীয় শ্রেণীর ব্যক্তি : যার ইলম নেই তার জন্য আলেমগণকে জিজ্ঞেস করা আবশ্যক। আল্লাহ বলেন, فَاسْأَلُواْ أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لاَ تَعْلَمُوْنَ ‘অতএব জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর, যদি তোমাদের জানা না থাকে’ (আম্বিয়া ৭; নাহল ৪৩)। অন্য আয়াতে এসেছে, بِالْبَيِّنَاتِ وَالزُّبُرِ ‘স্পষ্ট দলীল-প্রমাণসহ (জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর)’ (নাহল ৪৪)। সুতরাং এই শ্রেণীর ব্যক্তির দায়িত্ব ও কর্তব্য হ’ল, জিজ্ঞেস করা। কিন্তু সে কাকে জিজ্ঞেস করবে? দেশে অনেক আলেম আছেন এবং সবাই বলছেন যে, তিনি আলেম অথবা সবার সম্পর্কে বলা হচ্ছে যে, তিনি আলেম! তাহ’লে সে কাকে জিজ্ঞেস করবে? আমরা কি তাকে বলব যে, যিনি সঠিকতার অধিকতর কাছাকাছি, তুমি তাঁকে খুঁজে বের করবে এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করে তাঁর কথা মেনে চলবে? কিংবা বলব, আলেমগণের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তুমি জিজ্ঞেস করতে পার? কেননা নির্দিষ্ট কোন মাসআলায় কোন কোন সময় জ্ঞানে তুলনামূলক নিম্ন স্তরের আলেম সঠিক ফৎওয়া দিতে পারেন। যা উত্তম ও শীর্ষ পর্যায়ের আলেমও পারেন না।
আলেম সমাজ এ বিষয়ে বিভিন্ন মত দিয়েছেন :
কারো মতে, সাধারণ ব্যক্তির উপর তার এলাকার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আলেমকে জিজ্ঞেস করা আবশ্যক। কেননা মানুষের শারীরিক অসুস্থতার কারণে যেমন সে সবচেয়ে অভিজ্ঞ ডাক্তার খোঁজে, তেমনি এ ক্ষেত্রেও সবচেয়ে ভাল আলেম খুঁজে বের করবে। কারণ জ্ঞান হ’ল আত্মার ওষুধ। আপনি আপনার শারীরিক অসুস্থতার জন্য যেমন বিজ্ঞ ডাক্তার নির্ণয় করেন, এক্ষেত্রেও আপনাকে সুবিজ্ঞ আলেম নির্ণয় করতে হবে। দু’টির মধ্যে কোনই পার্থক্য নেই।
আবার কেউ কেউ বলেন, তার জন্য এমনটি আবশ্যক নয়। কেননা ভাল আলেম নির্দিষ্টভাবে প্রত্যেকটি মাসআলায় তুলনামূলক নীচের স্তরের আলেমের চেয়ে জ্ঞানী নাও হ’তে পারেন। সেজন্য দেখা যায়, ছাহাবীগণ (রাঃ)-এর যুগে মানুষ বেশী জ্ঞানী ছাহাবী থাকা সত্ত্বেও তুলনামূলক কম জ্ঞানী ছাহাবীকে অনেক সময় জিজ্ঞেস করতেন।
এ বিষয়ে আমার অভিমত হ’ল, সে দ্বীনদারিতায় ও জ্ঞানে তুলনামূলক উত্তম ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করবে। তবে এটা তার জন্য ওয়াজিব নয়। কেননা তুলনামূলক বেশী জ্ঞানী ব্যক্তি নির্দিষ্ট ঐ মাসআলায় ভুলও করতে পারেন এবং তুলনামূলক কম জ্ঞানী ব্যক্তি সঠিক ফৎওয়া দিতে পারেন। সুতরাং অগ্রগণ্যতা ও প্রাধান্যের দিক থেকে সে জ্ঞান, আল্লাহভীতি ও দ্বীনদারিতায় অধিকতর বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করবে।
পরিশেষে প্রথমত আমি নিজেকে এবং আমার সমস্ত মুসলিম ভাইকে, বিশেষ করে ছাত্রদেরকে নছীহত করব, যখন কারো কাছে কোন মাসআলা আসবে, তখন সে যেন ভালভাবে না জেনে তড়িঘড়ি করে ফৎওয়া না দেয়। ফলে অজ্ঞতাবশত সে যেন আল্লাহ্র উপর মিথ্যারোপ না করে বসে। কারণ একজন মুফতী মানুষ এবং আল্লাহ্র মধ্যে মাধ্যম হিসাবে আল্লাহ্র শরী‘আত প্রচার করে থাকেন। হাদীছে এসেছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন, اَلْعُلَمَاءُ وَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءِ ‘আলেমগণ নবীগণের উত্তরাধিকারী’।[3] রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন, اَلْقُضَاةُ ثَلاَثَةٌ : وَاحِدٍ فِي الْجَنَّةِ رَجُلٌ عَلِمَ الْحَقَّ فَقَضَى بِهِ فَهُوَ فِي الْجَنَّةِ.ِ ‘বিচারক তিন শ্রেণীর। এদের এক শ্রেণীর বিচারক কেবল জান্নাতে যাবেন। আর তিনি হচ্ছেন, এমন বিচারক যিনি হক্ব জেনেছেন এবং তদ্নুযায়ী রায় দিয়েছেন’।[4]
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হ’ল, যখন আপনার কাছে কোন মাসআলা আসবে, তখন আপনি নিজেকে আল্লাহ্র দিকে সোপর্দ করবেন এবং তাঁর মুখাপেক্ষী হবেন, তাহ’লে তিনি আপনাকে বুঝার এবং জানার শক্তি দান করবেন। বিশেষ করে বেশীর ভাগ মানুষের কাছে গুপ্ত থাকে এমন সব গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন বিষয়ে।
আমার কতিপয় উস্তাদ আমাকে বলেছেন, কেউ কোন মাসআলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হ’লে তার বেশী বেশী ইস্তেগফার পাঠ করা উচিৎ। মহান আল্লাহ বলেন,
إِنَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللهُ وَلاَ تَكُنْ لِّلْخَآئِنِيْنَ خَصِيْماً، وَاسْتَغْفِرِ اللهَ إِنَّ اللهَ كَانَ غَفُوْراً رَّحِيْماً-
‘নিশ্চয়ই আমি আপনার প্রতি সত্য কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি মানুষের মধ্যে ফায়ছালা করেন, যা আল্লাহ আপনাকে হৃদয়ঙ্গম করান। আপনি বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষ থেকে বিতর্ককারী হবেন না এবং আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহা ক্ষমাশীল, অতিশয় দয়ালু’ (নিসা ১০৫-১০৬)। কেননা বেশী বেশী ইস্তেগফার পাপের কুপ্রভাব দূর করার বিষয়টি নিশ্চিত করে। আর পাপ ইলম বিস্মৃত হওয়ার এবং মূর্খতার অন্যতম কারণ। মহান আল্লাহ বলেন,
فَبِمَا نَقْضِهِم مِّيثَاقَهُمْ لَعَنَّاهُمْ وَجَعَلْنَا قُلُوْبَهُمْ قَاسِيَةً يُحَرِّفُوْنَ الْكَلِمَ عَنْ مَّوَاضِعِهِ وَنَسُوْا حَظًّاً مِّمَّا ذُكِّرُوْا بِهِ
‘অতএব তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের দরুন আমি তাদের উপর অভিসম্পাত করেছি এবং তাদের অন্তরকে কঠোর করে দিয়েছি। তারা কালামকে তার স্থান থেকে বিচ্যুত করে দেয় এবং তাদেরকে যে উপদেশ দেয়া হয়েছিল, তারা তা থেকে উপকার লাভ করার বিষয়টি বিস্মৃত হয়েছে’ (মায়েদা ১৩)।
ইমাম শাফেঈ (রহঃ) থেকে বর্ণনা করা হয়, তিনি বলেন ,
شَكَوْتُ إِلَى وَكِيْعٍ سُوْءَ حِفْظِيْ * فَأَرْشَدَنِيْ إَلَى تَرْكِ الْمَعَاصِيْ
وَقَالَ إعْلَمْ بِأَنَّ الْعِلْمَ نُوْرٌ * وَنُوْرُ اللهِ لاَ يُؤْتَاهُ عَاصِيْ
‘আমি আমার দুর্বল স্মৃতিশক্তির কথা ওয়াকী (রহঃ)-কে বললে তিনি আমাকে পাপ কাজ ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশনা দেন এবং বলেন, জেনে রেখো! ইলম হচ্ছে আল্লাহ্র নূর। আর আল্লাহ্র নূর কোন পাপীকে দেওয়া হয় না’। অতএব ইস্তেগফার নিঃসন্দেহে আল্লাহ কর্তৃক মানুষকে জ্ঞান দানের অন্যতম কারণ।
আল্লাহ্র কাছে আমার নিজের জন্য এবং আপনাদের জন্য তাওফীক্ব ও সঠিকতা প্রার্থনা করছি। তিনি আমাদেরকে ইহকাল ও পরকালে কালেমায়ে ত্বাইয়্যেবাহ-এর উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন। হেদায়াত দানের পর তিনি যেন আমাদের অন্তঃকরণকে বক্র না করেন এবং আমাদেরকে তিনি যেন তাঁর পক্ষ থেকে রহমত দান করেন। নিশ্চয়ই তিনি মহান দাতা।
শুরুতে ও শেষে সবসময় মহান রাববুল আলামীনের প্রশংসা করছি। আল্লাহ আমাদের নবী মুহাম্মাদের উপর এবং তাঁর পরিবার-পরিজনের উপর এবং সকল ছাহাবীর উপর দরূদ ও সালাম বর্ষণ করুন- আমীন!!
[1]. আবূদাউদ হা/২৮২৮ ‘কুরবানী’ অধ্যায়; তিরমিযী হা/১৪৭৬ ‘শিকার’ অধ্যায়; ইবনু মাজাহ হা/৩১৯৯ ‘যবেহ’ অধ্যায়।
[2]. বুখারী হা/৫৪৯৮ ‘যবেহ’ অধ্যায়; মুসলিম হা/১৯৬৮ ‘কুরবানী’ অধ্যায়; আবূদাউদ হা/২৮২৭ ‘কুরবানী’ অধ্যায়; নাসাঈ হা/৪৪০৩, ৪৪০৪ ‘কুরবানী’ অধ্যায়; ইবনু মাজাহ হা/৩১৭৮ ‘যবেহ’ অধ্যায়।
[3]. বুখারী হা/১০ ‘ইলম’ অধ্যায়; আবু দাউদ হা/৩৬৪১ ‘ইলম’ অধ্যায়; ইবনু মাজাহ হা/২২৩ ‘মুকাদ্দামা’।
[4]. আবু দাউদ হা/৩৫৭৩ ‘বিচার-ফায়ছালা’ অধ্যায়; ইবনু মাজাহ হা/২৩১৫ ‘বিধি-বিধান’ অধ্যায়।
ভাই আসসালাম, আপনার সব লেখার পাশে জেই কিতাব গুলোর ছবি আছে, তাকি ঢাকাতে পাওয়া জাবে? for example – the books of Sheikh Faizi and so on?
@Fiqriyatu Fiddin, ভাই উত্তর দিতে দেরী হওয়ার জন্য দুঃখিত । আমি অনেক দিন নেটে বসতে পারিনি । আমার পোস্টে দেয়া যে বইয়ের ছবি গুলো , সেগুলি ঢাকায় পাওয়া যাবে । প্রকাশক তাওহীদ পাবলিকেশন্স , ৯০, হাজী আব্দুল্লাহ সরকার লেন, বংশাল, ঢাকা-১০০০। ফোন: ৭১১২৭৬২, ০১১৯০৩৬৮২৭২, ০১৭১১৬৪৬৩৯৬, ০১৯১৯৬৪৬৩৯৬, ০১৭৫১৭০৪৮৪৮।