শিরকমুক্ত তাওহীদ
লিখেছেন: ' স্বতন্ত্র' @ মঙ্গলবার, মে ১৩, ২০১৪ (১০:৩৮ অপরাহ্ণ)
তাওহীদ শব্দের অর্থ কোন কিছুকে এক করা বা একএীকরণ।
ইসলামের পরিভাষায় তাওহীদের অর্থ আল্লাহ তায়ালাকে তার বিশেষত্বের ক্ষেত্রে এক বলে জানা ও বিশ্বাস করা এবং ইবাদতের ক্ষেত্রে তাকে এককভাবে বাছাই করা। অর্থাৎ তাওহীদকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে কিছু বিষয়কে বিশ্বাস করতে হয় এবং কিছু বিষয় পালন করতে হয়। এদিক থেকে তাওহীদ দুই প্রকার:-
ক. জানা ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তাওহীদ
খ. মানা অর্থাৎ র্কম ও ইবাদতের ক্ষেত্রে তাওহীদ।
সাধারন ভাবে তাওহীদকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়:
১. তাওহীদুর রুবুবীয়াহ:
অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালাকে তার সকল র্কমের ক্ষেত্রে এক বলে জানা ও বিশ্বাস করা। যেমন: তিনি একাই এই বিশ্বজগতের রব, সৃষ্টির্কতা, পালনর্কতা ইত্যাদি।
২. তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাত:
অর্থাৎ আল্লাহ পাকের নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে তিনি এক ও একক এবং তার অনুরূপ কিছুই নেই।
৩. তাওহীদুল ইবাদা বা উলুহীইয়া:
অর্থাৎ সকল ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালাকে এককভাবে বাছাই করা এবং শুধুমাত্র তারই নিকট সকল প্রকার দৈহিক, মৌখিক ও আন্তরিক ইবাদত নিবেদন করা এবং অন্য সকল ইবাদতকে অস্বীকার করা। ইবাদতের ক্ষেত্রে তাওহীদই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, কারণ- অধিকাংশ মুশরিকও আল্লাহপাককে রব হিসেবে স্বীকার করে। কিন্তু ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহর পাশাপাশি অন্য সত্ত্বাকে বাছাই করার কারণেই তারা মুশরিক। আবার কালেমা তাইয়্যেবা বা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু অর্থ: আল্লাহ ছাড়া ইবাদতের যোগ্য কোন ইলাহা নেই। যার সাক্ষ্য দেয়ার মাধ্যমে ব্যক্তি ইসলামে প্রবেশ করে। এখানেও মূলত তাওহিদুল ইবাদার সাক্ষ্য দেয়া হয় ।
শিরক :
আল্লাহ পাকের বিশেষত্বেও ক্ষেত্রে অন্যকোন সত্তাকে তার সমান বা অংশীদার করাই শিরক। তাওহীদের প্রতিটি ভাগেই শিরক সংঘটিত হতে পারে। তাই তাওহিদের মতো শিরককেও বিভিন্নভাগে ভাগ করা যায় । আবার বিধানের দিক দিয়ে শিরক দুই প্রকার:
১. বড় শিরক : এ ধরনের শিরকের কারণে ব্যাক্তি অমুসলিম হয়ে যায় ।
২. ছোট শিরক : এ ধরনের শিরকের কারণে ব্যাক্তি অমুসলিম হয়ে যায় না। তবে এটি কবিরা গুনাহের চেয়ে ভয়াবহ ।
তাওহীদবিরোধি বিষয়সমূহ
তাবিজ-কবচ, ঝাড়ফুক ও কাবাররুকের ক্ষেত্রে পথভ্রষ্টতা :
অনেকেই ব্যাপকভাবে তাবিজ-কবজ যেমন: পাথর, আংটি, সূরার নকশা (সর্ম্পূন ভিত্তিহীন) দ্বারা তৈরি তাবিজ কল্যাণে আশায় বা অকল্যাণ থেকে বাচাঁর জন্য ব্যবহার করে। এটি কখনো বড় শিরক কখনো ছোট শিরক হতে পারে ।
ক. যদি কেউ মনে করে তাবিজ আল্লাহ পাকের নিয়ন্ত্রন ছাড়াই সতন্ত্রভাবে কল্যাণ-অকল্যাণ ঘটাতে পারে, তবে তা বড় শিরক।
খ. কেঊ যদি মনে করে কল্যাণ-অকল্যাণ আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। কিন্তু তাবিজ কল্যাণ আনা বা অকল্যাণ দূর করার উপকরণ, তবে তা ছোট শিরক।
গ. কুরআন লেখা তাবিজের বৈধতার ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও এটি নিষিদ্ধ হওয়ার মতটিই সঠিক। কারণ :
১. তাবিজ নিষিদ্ধকারী হাদীসগুলো সাধারণভাবে সব তাবিজকেই অর্ন্তভুক্ত করে।
২. নবী (সা:) কুরআনকে তাবিজ হিসেবে ব্যবহার করেননি এবং অন্যদের করতেও বলেননি।
৩. কুরআন তাবিজ হিসেবে ব্যবহারের মাধ্যমে অন্য তাবিজ ও শিরকের পথ উন্মুক্ত হয়।
৪. এতে কুরআনের অবমাননা হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
ঝাড়ফুক (রুকাইয়া):
অর্থাৎ অসুস্থ, জাদুগ্রস্থ বা আক্রান্ত ব্যক্তির উপর কোন কিছু পরে ফু দেয়া। ঝাড়ফুকের একটি দিক আছে শরীয়তসম্মত কিন্তু এর দ্বারাও শিরক সংঘটিত হতে পারে। নবী (সা:) বলেছেন, তোমাদের ঝাড়ফুকগুলো আমার কাছে প্রকাশ করো, ঝাড়ফুকে সমস্যা নাই যদি না তাতে শিরক থাকে।
অর্থাৎ কুরআন বা শরীয়ত সম্মত দুআর মাধ্যমে ঝাড়ফুক করা বৈধ। এছাড়া অন্যান্য শিরকের অর্ন্তগত। এ ব্যাপারে নবী (সা.) বলেছেন, “ঝাড়ফুক, তাবিজ এবং তিওয়ারা (এক প্রকার জাদু) শিরক”।[আহমদ, আবু-দাউদ]
তাবারুক বা বরকত তালাশের ক্ষেত্রে পথভ্রষ্টতা:
মানুষ, গাছ, পাথর, মাজারের দেয়াল, হজ্জেও সময় মক্কা মদিনার বিভিন্ন স্থান, কোন বিশেষ পোষাক বা ব্যাক্তির সাথে হাত মেলানো, মাজার বা মিলাদের সিন্নি খাওয়ার মাধ্যমে বরকত তালাস করে।
কুরআন সুন্নতের দলীল ছাড়া অন্য কিছু থেকে বরকত তালাশ করা শিরক। এটি ছোট শিরক বা বড় শিরক হতে পারে।
শরীয়তসম্মত বিষয়সমূহ:
আল্লাহপাক কিছু বিষয়ের মধ্যে বরকত বেখেছেন বা কুরআন সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। যেমন:
১. বস্ত: শারীরিক সুস্থতার আশায় যমযমের পানি পান করা।
২. ব্যক্তি: নবী-রাসূল বা আলেমদের শিক্ষার মাঝে, নবী (সা:) এর জীবনদশায় তার দেহ লোম, ঘাম, চুল, পোশাক থেকে বরকত হাসিল করা।
৩. স্থান: মসজিদুল হারাম, মসজিদ নববী ও মসজিদ আল আকসায় বরকত ইবাদতের সোয়াব বৃদ্ধি।
৪. রামাদান, লাইলাতুল কদর, জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশদিন জুমআ, প্রতিরাতের শেষ তৃতীয়াংশে বরকত আছে ক্ষমা র্অজন, সোয়াব বৃদ্ধি, দোয়া কবুল, আল্লাহর নৈকট্য লাভে।
২. জাদুটোনা, জ্যোতিষশাস্ত্র ও ভাগ্যগণনা
বর্তমানে বিভিন্নপ্রকার জাদুটোনা প্রচলিত আছে যেমন: বাণমারা, বাটিচালান, জাদুকর র্কতৃক সংঘটিত অলৌলিক ঘটনা।
জাদুটোনা শেখা ও র্চচা করা কুফর যা ব্যাক্তিকে মুশরিকে পরিণত করে। অধিকাংশ আলেমের মতে জাদুর্চচাকারীদের শাস্তি মৃত্যুদন্ড। কারণ, এসব কাজের মাধ্যমে জিনদের ইবাদত করা হয় ফলে শয়তান জিন সন্তুষ্ট হয়ে এই নিষিদ্ধ র্চচায় সাহায্য করে।
যদিও মানুষের উপর জাদুর প্রভাব আছে, তবে তা আল্লাহ পাকের ইচ্ছাধীন। কেউ জাদু দ্বারা আক্রান্ত হলে র্ধৈয ও তাওয়াক্কুল সহকারে শরীয়তসম্মত চিকিৎসা (কুরআনের আয়াত, হাদীসে বর্ণিত দুআ পাঠ) গ্রহণ করা উচিত। এজন্য তাবিজ-কবচ পীর ফকির বা জাদুর্চচাকারীর সাহায্য নেওয়া তাওহীদ পরিপন্থী।
হাত সাফাই বা ভেলকীবাজি জাদু কুফর থেকে মুক্ত এবং শুধুমাএ কৌশলের মধ্যমে করা হয়। এটিও শরীয়তে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ কারণ এগুলো মানুষের ঈমান-আকিদ্বার জন্য ঝুকিপূর্ণ।
জ্যোতিষশাস্ত্র ও ভাগ্যগণনা:
অর্থাৎ নক্ষএের অবস্থান থেকে ভাগ্য বা ভবিষ্যত নির্নয় রাশিচক্র এবং ভাগ্যগণনার অন্যান্য সকল পদ্ধতিই শিরক। এক্ষেত্রে-
কেউ যদি মনে করে নক্ষত্র স্বাধীন সংঘটক বা স্রষ্টা, তবে তা বড় শিরক। এবং কেউ যদি এ উপায়ে গায়েব জানার দাবি করে তবে সে অমুসলিম হয়ে যাবে।
যদি কেউ মনে করে, আল্লাহ পাকই ঘটান, তবে তিনি নক্ষত্রের সাথে এসব ঘটনাকে সংশ্লিষ্ট করেছেন। তবে তা ছোট শিরক।
আবার ভাগ্যগণনার জন্য কোন ব্যক্তি যদি গণকের কাছে যায় এবং কিছু জানতে চায়, তবে হাদীস অনুযায়ী তার চল্লিশ দিনের ইবাদত কবুল হবে না, যদিও সালাত আদায় করা তার জন্য বাধ্যতামূলক থাকবে। আর যদি ব্যক্তি গণকের কথা বিশ্বাস করে বা তাকে গায়েবের জ্ঞানের অধিকারী মনে করে তবে সে অমুসলিম হয়ে যাবে।
কিছুক্ষেত্রে গণকের ভবিষ্যতবানী সত্য হয়। এ ব্যাপারে হাদীস থেকে জানা যায়, শয়তান আড়ি পেতে ভবিষ্যত সর্স্পকে আকাশের সীমানায় ফেরেশতাদের মাঝে যে কথা হয় তা শুনে গণকের কাছে পৌছে দেয়। তারপর গণক এর সাথে একশটি মিথ্যা মিশ্রিত করে।
শুভ বা অশুভ লক্ষণ
অনেকেই কোন ব্যক্তিবা ঘটনাকে শুভ বা অশুভ লক্ষণ মনে করে। যেমন: কোন বিশেষ কলম বা পোষাক, সংখ্যা সাত, দুই শালিক এগুলোকে শুভ মনে করা। আবার, বাইরে যাওয়ার সময় ঝাড়– দেখা, কালো বিড়াল, সংখ্যা তের, এক শালিক, হাত থেকে চিরনী পড়া, আয়না ভাড়া এগুলোকে অশুভ মনে করা বা কিছুকে কুফা মনে করা।
—এগুলো শিরক।
যদি কেউ মনে করে কোন বস্তু আল্লাহ থেকে স্বাধীন ও কল্যাণ বা অকল্যনের সংঘটক বা কল্যাণ-অকল্যাণ সৃষ্টি করে, তবে তা বড় শিরক।
কেউ যদি মনে করে ভালমন্দের স্রষ্টা আল্লাহপাকই, তবে তিনি এই বস্তুকে শুভ বা অশুভ লক্ষণ হিসেবে নির্ধারণ করেছেন, তবে তা ছোট শিরক।
যেহেতু কল্যাণ-অকল্যাণ আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে তাই জাগতিক কোন বস্তুকে লক্ষণ মনে না করে, প্রত্যেকের উচিত আল্লাহর উপরই ভরসা করা।
৪.দুআর ক্ষেত্রে শিরক
অনেক মুসলমান বিপদে পড়লে আল্লাহর বদলে পীড়, ওলী, মুহাম্মদ (সা.)-কে ডাকে এবং তাদের নিকট দুয়া করে। যেমন: মাজার বা পীরের নিকট সন্তান চেয়ে বা রোগমুক্তির জন্য করা।
দুআ একটি গুরত্বপূর্ণ ইবাদত। দুআ একমাত্র আল্লাহর হতে হবে। এর কোন অংশ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও উদ্দেশে করা তা হবে বড় শিরক। আল্লাহপাক বলেছেন, “আর আল্লাহছাড়া কোন কিছুকে ডাকবেন না [হে নবী] যদি আপনি তা করেন নিশ্চয় আপনি যালিমদের অর্ন্তভুক্ত হবেন।”
ওসীলা বা মাধ্যম:
কোন ব্যাক্তির (নবী বা পীরের) ওসীলা দিয়েও আল্লাহপাকের নিকট দুআ করা যাবে না ।
এটি বিদাত। এ ব্যাপারে কুরআনে এসেছে , “….তারা যাদের ডাকে তারাও নিশ্চয়ই তো তাদের রবের কাছে নৈকটের ওসীলা তালাশ করে…”(সূরা আল ইসরা,১৭:৫৬-৫৭)
যদি নবী (সা.) বা জ্ঞানীরা ওসীলা হতেন, তবে তারা অন্যকোন ওসীলা তালাস করতেন না। বরং তারাও আল্লাহর নৈকট্যেও জন্য যে ওসীলা তালাস করে তা হলো সৎর্কম। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজেদের সৎর্কমের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা।
এছাড়া নিস্মোক্ত ওসীলা অবলম্বন করা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত-
১. ঈমান ও সৎর্কম
২. আল্লাহপাকের সুন্দও নামসমূহ ডেকে র্প্রাথনা করা।
৩. ঈমান সৎর্কমের ওসীলায় আল্লাহর নিকট চাওয়া।
৪. নবী (সা.) জীবনদ্দশায় বা কোন জীবিত মুমিনের নিকট দুআ চাওয়া। যেমন: আপনি আমার জন্য আল্লাহর নিকট দুয়া করুন।
সাহায্য চাওয়া:
মৃত, দূরবতী কিংবা অক্ষম ব্যাক্তির নিকট সাহায্য চাওয়া নিষিদ্ধ ও শিরক। যেমন:
কবরবাসী এমনকি নবী (সা.) এর নিকট বা মাজারে চাওয়া।
ঘরে বসে দূরর্বতী পীরের কাছে চাওয়া।
রিজক বা কল্যাণের জন্য পীরের কাছে চাওয়া।
—-এগুলো বড় শিরক।
তবে জীবিত, উপস্থিত এবং সক্ষম ব্যাক্তির কাছে সাহায্যে চাওয়া বৈধ, যদি কাজটি বৈধ হয় তবে নিষিদ্ধ কাজে নয়।
শাফায়াত বা ওসীলা:
দুনিয়ার জীবনে আল্লাহ ও বান্দার মাঝে মধ্যস্থতাকারী ওসীলা বা শাফায়াতকারী (যেমন: কবরবাসী, পীর, ওলী) অবলম্বন করা এবং এদের ইবাদত করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা বড় শিরক।
আল্লাহপাক বান্দার অবস্থা সর্ম্পকে সম্মক অবগত। যাবতীয় ইবাদত, র্প্রাথনা সরাসরি আল্লাহর নিকট নিবেদন করা হবে, কোন মধ্যস্থতাকারী প্রয়োজন নেই। আল্লাহপাক বলেছেন, “…নিশ্চয় তিনি তার বান্দাদের ব্যাপারে পূর্ণ অবগত, পূর্ণ দ্রষ্টা”(সূরা আল ইসরা, ১৭ঃ৯৬)
এমনকি আখিরাতেও আল্লাহর নিকট শাফায়াত সুপারিশ করা তার র্কতৃত্বের অংশ। তার অনুমতি ব্যাতিত আগ বেড়ে শাফায়াত করার অধিকার কারও নেই।
শাফায়াতের ক্ষেত্রে দুটি র্শত আছে:
শাফায়াত কারীর ব্যাপারে আল্লাহর অনুমতি।
যার জন্য শাফায়াত করা হবে তার ব্যাপারে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং অমুসলিমদের জন্য কোন শাফায়াত হবে না।
যবেহ বা মানতের ক্ষেত্রে পথভ্রস্টতা:
যবেহ করা এক প্রকার ইবাদত। তাই আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও জন্য (যেমন: ওলী, পীর, মাজারে বা দুষ্টজিনকে সন্তুষ্ট করার জন্য) যবেহ করা বড় শিরক। হাদীসে আছে, “যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করে তাকে আল্লাহপাক লানত করেছেন…”
*অতিথি আপ্যায়নের জন্য যবেহ করা আতিথেয়তা এবং বৈধ।
মানত একপ্রকার ইবাদত। যার উদ্দেশ্য মানত করা হয় তাকে মাবুদ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। তাই আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও উদ্দেশ্যে মানত করা শিরক। শরীয়তে আল্লাহপাকের জন্য মানত করাও অপছন্দনীয়। কারণ:
মানত তাকদীরের বিপরীতে কোন কাজে আসে না।
এর মাধ্যমে ব্যক্তি এমনকিছুকে বাধ্যতামূলক করে নেয় যা র্পূবে বাধ্যতামূলক ছিল না।
মানতকারী ব্যাক্তি এমন ইঙ্গিত দেয় যে, মানত ছাড়া আল্লাহপাক অনুগ্রহ করেন না।
তবে, যদি কেউ মানত করেই ফেলে তবে তা পূরণ করা তার উপর বাধ্যতামূলক হয়ে যায়।
অনেকেই সৎর্কমশীলদের [নবী(সা.), পীর] প্রশংসার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করে, তার প্রতি আল্লাহর গুণাবলী আরোপ করে। যেমন:
১. নবী (সা.) নূরের তৈরী, তাকে সৃষ্টি না করা হলে কিছুই সৃষ্টি হতো না।
প্রকৃতপক্ষে, সৎর্কমশীলদের প্রশংসার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করা নিষিদ্ধ।
নবী (সা.) বলেছেন, “তোমরা আমার প্রশংসার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করো না যেমনিভাবে খ্রিস্টানরা মরিয়ামের পুত্রের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছে। কেননা নিশ্চয়ই আমি কেবলই বান্দা। সুতরাং বল, আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।”(বুখারী, ৩৪৪৫)
অথচ খ্রিস্টানরা যেমন ঈসা (আ.) কে আল্লাহর পুএ বলে আমরাও নবী (সা.) কে আল্লাহর নূরের তৈরী বলে দাবী করি। তারা ঈসা (আ.)এর জন্মদিনকে ধর্মীয় উৎসব বানিয়েছে আমরাও ঈদে মিলাদুন্নবী এবং জন্মদিন বা মিলাদকে ধর্মীয় উৎসব বানিয়েছে— এগুলো সম্পূর্ণ তাওহীদবিরোধী।
২.নবী-রাসূল, আউলিয়ারা গায়েব জানেন।
গায়েবের জ্ঞান শুধুমাত্র আল্লাহর অন্যকেউ গায়েব জানে বলে বিশ্বাস করা বড় শিরক।
৩.সৎর্কমশীলরা মৃত্যুও পরও জীবিত, শুনতে পান এবং সাহায্য করতে সক্ষম।
এ ধরনের বিশ্বাস ও এ ধরনের মাজারে সাহায্য চাওয়া বড় শিরক।
প্রকৃতপক্ষে, প্রক্যেকেই মরণশীল এবং মৃত্যুর পর কেউ ডাক শুনতে বা সাহায্য করতে সক্ষম নন, এমনকি নবী (সা.)-ও নন। তবে, ফেরেশতারা উম্মতের পক্ষ থেকে শুধুমাত্র সালাম নবী (সা.)-এর কাছে পৌছে দেন এবং আল্লাহপাক তার রুহ দেহে ফিরিয়ে দেন ফলে তিনি উত্তর দেন। আর অন্যদের ক্ষেত্রে এই বিশেষত্বও দেয়া হয়নি।
কবর পাকা করা, মাজার বানানো, সেখানে সাহায্য চাওয়া ও এটিকে ইবাদতের স্থান বানানো।
এগুলো নিষিদ্ধ। এমনকি কবরস্থানে তিলওয়াত, কবরের দিকে মুখ করে নামাজ পড়া, মসজিদের ভিতর কবর বা কবরস্থানের উপর মসজিদ র্নিমানও নিষিদ্ধ। যদিও নবী (সা.) এর কবর মসজিদের ভিতর কিন্তু র্পূবে এটি মসজিদের ভিতর ছিল না। পরবর্তীকালে মসজিদ সম্প্রসারণের সময় কবরটি মসজিদের অর্ন্তভুক্ত হয়। কাজটি অনুচিত ছিল এবং এতে অনেক আলেম বাধা দিয়েছিলেন।
কেরামতে আওলিয়া:
আউলিয়া হওয়ার র্শত ঈমান ও তাকওয়া। এর জন্য কোন কেরামতির দরকার নেই। তবে কোন সৎর্কমশীল দ্বারা আল্লাহর ইচ্ছায় কেরামত বা অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হলে সেটি তার জন্য ভাল লক্ষণ, সুসংবাদ এবং সম্মান।
অনেকসময় জাদুটোনা বা শয়তানী র্কমকান্ড দ্বারা অনুরূপ ঘটনা ঘটানো সম্ভব। তাই এ ব্যাপারে সর্তক হওয়া উচিত। কোন ব্যক্তি দ্বারা অলৌকিক কিছু কেরামত হতে পারে যদি–
ব্যাক্তি ঈমানদার ও সৎর্কমশীল হয়।
মানুষের দৃষ্টি আর্কষণ বা প্রসংশা কুরানোর চেষ্টা না করে।
শরীয়তবিরোধী কিছুর প্রতি আহ্বান না করে।
অপরদিকে ব্যাক্তি যদি অসচ্চরিত্রের হয়, মানুষের প্রশংসা কুড়ানোর চেষ্টা করে এবং শরীয়তবিরোধী কিছুর প্রতি আহবান করতে চায় তবে অবশ্যই তা শয়তানী র্কমকান্ড।
স্বপ্ন দ্বারা পথভ্রস্টতা
ধর্মের নামে প্রচলিত অনেক বিষয়ের ক্ষেত্রে বলা হয় যে, অমুক ওলী স্বপ্নে পেয়েছেন। কেউ বলতে পারে নবী (সা.) স্বপ্নে এসে বলেছেন-মিলাদ কর, অমুক পীরের মুরিদ হও। আবার কেউ স্বপ্নে আল্লাহকে দেখার দাবী করে। এসব স্বপ্ন তাওহীদের ক্ষেত্রে পখভ্রস্টতার আরেকটি কারণ।
প্রকৃতপক্ষে, ১. স্বপ্ন শরীয়তের বিধানের কোন উৎস নয়।
—দ্বীন ইসলাম পরিপূর্ণ এবং এর উৎস কুরআন সুন্নাহ। তাই স্বপ্নে পাওয়া নতুন কিছুর উপর আমল করা যাবে না।
২.সব স্বপ্নই সত্যি নয়। নবী (সা.) বলেছেন, “স্বপ্ন তিন প্রকার। সত্য স্বপ্ন আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে সুসংবাদ, এমন স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ থেকে, এমন স্বপ্ন যা চিন্তাভাবনার প্রতিফলন।
তাই স্বপ্ন যাচাই করতে হবে,
ক. স্বপ্নদ্রস্টার অবস্থা: মুমিন বা মুত্তাকি কিনা।
খ. স্বপ্নের বিষয়বস্তু: শরীয়তের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা।
৩. এমনকি কেউ যদি নবী (সা.)-কে স্বপ্নে দেখে, যাচাই করতে হবে যে, তার চেহারা হাদীসের বর্ণনার এবং বিষয়বস্তু শরীয়তের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা। অন্যথায় তা শয়তানের কারসাজি কারণ শয়তান নবী (সা.)-এর স্বরূপ ধারণ করতে পারে না। পারলেও অন্যকোন রূপে এসে মিথ্যাদাবী করতে পারে যে, সে মুহাম্মদ (সা.)।
৪. দুনিয়াতে আল্লাহপাককে বাস্তবে বা স্বপ্নে কোনভাবেই দেখা সম্ভব নয়। তাই এ জাতীয় স্বপ্ন আপাত দৃষ্টিতে সুন্দর মনে হলেও তা শয়তানের কারসাজী।
ইলহাম:
অর্থাৎ উপলব্ধির মাধ্যমে দিকর্নিদেশনা লাভ। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে হতে পারে। তবে, এক্ষেত্রেও ব্যাক্তিকে সৎর্কমশীল ও দিকনির্দেশনাটি শরীয়তের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। অপরদিকে মাজার দর্শন বা পীরের মুরিদ হওয়া এধরনের শরীয়ত বিরোধী ইলহাম হওয়া প্রকৃতপক্ষে শয়তানী ইলহাম।
বাতেনী (গোপন জ্ঞান) এর দাবী করা:
নবী (সা.) কাউকে [আলী (রা.)] গোপনে কিছু শিখিয়েছেন এবং তা বংশ পরম্পরায় হস্তান্তরিত হয়েছে, ফলে পীর ছাড়া এই জ্ঞান লাভ করা যায় না-এটি অন্যতম পথভ্রস্টতা। যারা এ ধরনের দাবী করে তারা মূলত আল্লাহপাক ও রাসূলকে মিথ্যাবাদী বলতে চায়। কারণ, আল্লাহপাক বলেছেন, “…আমি তোমার কাছে সবকিছু ব্যাখ্যা করে একখানি কিতাব নাযিল করেছি…।”
এবং রাসূল (সা.) এর কাজ স্পষ্ট করা, গোপন করা নয়। আর হেদায়াত যদি নবী (সা.) নির্দিস্ট ব্যাক্তির মাঝে গোপন রাখেন তবে বাকি সাহাবীরা কি হিদায়াত বঞ্চিত হয়ে জাহান্নামে গেছে। অথচ সাহাবীরা আল্লাহপাকের নিকট অধিক র্মযাদাশীল।
১০. ভালবাসা, ভয় ও আনুগত্যেও ক্ষেত্রে পথভ্রস্টতা:
১. ভালবাসা, ভয় ও আনুগত্যের ক্ষেত্রে চূড়ান্তরুপ যার কারণে বান্দা মাবুদের ইবাদত করে, তা আল্লাহ ছাড়া অন্যকোন সত্ত্বাকে দেয়া বড় শিরক।
২. এগুলোর স্বাভাবিক রূপ যদি খারাপ কাজে উদ্ভূদ্য করে বা ওয়াজিব কাজ থেকে বিরত রাখে, তবে তা নিন্দনীয়।
সাধারন ভালবাসার একটি অংশ যা আল্লাহপাকের ভালবাসা থেকে উদ্ভূদ এর দাবী মুমিনদের প্রতি ভালবাসা এবং কাফিরদের প্রতি ঘৃণা পোষণ। তাই ভালবাসার আতিশায্যে কাফির নায়ক-নায়িকাকে অনুকরণ নিন্দনীয়।
আবার যার ক্ষমতা আল্লাহ ছারা অন্য কারও নেই এমন বিষয়ে কোন সৃষ্টিকে ভয় করা বড় শিরক।
আনুগত্যের ক্ষেত্রে:
শরীয়তসম্মত বিষয়ে র্কতৃত্বের অধিকারী বা শাষকদের আনুগত্য করা বাধ্যতামূলক তবে শরীয়ত বিরোধী র্নিদেশের ক্ষেত্রে নয়। স্পষ্ট কুফর দেখতে না পাওয়া পর্যন্ত তাদের বিরোধীতা করা যাবে না। আর স্পষ্ট কুফর দেথলেও জনসাধারন তাদেরকে কাফের ঘোষণা দেবে না বরং এ দায়িত্ব আলেমদের। এক্ষেত্রেও বিরোধীতা করতে গিয়ে বিদ্রহ, ফাসাদ, গনহত্যার আশংকা থাকলে তাদেরকে নসিহত ও তাদের জন্য দুআ করতে হবে।
আইন প্রনয়ন ও আনুগত্য:
১। শরীয়তকে উপেক্ষা করে স্বতন্ত্র আইন প্রণয়ন করা ।
২। আল্লাহপাক ও রাসূলের বিধান দেয়ার অধিকারকে অস্বীকার করা ।
৩। অন্য বিধানকে অধিক উত্তম, সমকক্ষ, বৈধ বা ঐচ্ছিক মনে করা।
৪। উদ্ধত্য বা অবজ্ঞার কারণে শরীয়তকে অমান্য করা—–এগুলো বড় শিরক।
শরীয়তকে শিরোধার্য জেনেও যদি জাগতিক স্বার্থে অন্য বিধানকে অবলম্বন করে, তবে তা ছোট শিরক।
শরীয়তের বিধান চালু না থাকলে মানব রচিত ব্যবস্থাকে ঘৃণা করে শুধুমাএ হকটুকু আদায়ের জন্য এর শরণাপন্ন হওয়া বৈধ।
যেমন: গণতন্ত্র মানবরচিত তাই এটি কুফর কিন্তু অবস্থাভেদে এটি বড় শিরক, ছোট শিরক বা বৈধ হতে পারে।
হালাল-হারাম বিধান:
আল্লাহ ছাড়া অন্যকেউ হালাল-হারাম বিধান দেয়ার যোগ্য মনে করা ও এর আনুগত্যকে বৈধ মনে করা বড় শিরক।
নিষিদ্ধ জেনেও যদি জাগতিক র্স্বাথে এর আনুগত্য করা ছোট শিরক।
তাওয়াক্কুল:
ভরসা একমাত্র আল্লাহর উপরই করতে হবে তবে জাগতিক উপকরণকে অস্বীকার করা যাবে না। কারণ তা হবে র্মূখতা ও আল্লাহর হেকমতকে অস্বীকার করা। যেমন: রিযিকের জন্য তাওয়াক্কুলের পাশাপাশি জাগতিক চেষ্টাও করতে হবে।
যদি আল্লাহকে ছেড়ে এমন কোন সত্ত্বার উপর তাওয়াক্কুল করা যা সংঘটনের ক্ষমতা তার নেই তা বড় শিরক। আল্লাহর কথা ভুলে গিয়ে জাগতিক উপকরণের সাথে নিজের অন্ত-রকে যুক্ত করাও বড় শিরক। কিন্তু আল্লাহর স্মরণ থাকা সত্ত্বেও জাগতিক উপকরণের সাথে নিজের অন্তর যুক্ত করা ছোট শিরক।
উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে শিরক:
লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ইবাদত করা বা একে সৌর্ন্দযমন্ডিত করাকে রিয়া বলে। সাধারণত এটি ছোট শিরক। তবে মুনাফিক যার সকল ইবাদতই লোক দেখানোর জন্য তার ক্ষেত্রে এটি বড় শিরক। শুধু জাগতিক স্বার্থে কোন ইবাদত (কুরআন শেখানো, বদলি হজ্জ) করা –ছোট শিরক।
প্রবৃত্তির অনুসরণ:
প্রবৃত্তির অনুসরণে ব্যাক্তি যে কাজে লিপ্ত হয় তার ধরন অনুযায়ী এটি বড় শিরক, ছোট শিরক, কবিরা গুনাহ, নিফাক হতে পারে। যেমন: নাস্তিকতাকে পছন্দ করা বড় শিরক, কিন্তু হারাম জেনেও মদপান করা শিরক নয়, এটা মহাপাপ।