কোরআন ও বিজ্ঞানঃ প্রসঙ্গ ‘ছায়া’
লিখেছেন: ' আমিরুল ইসলাম' @ মঙ্গলবার, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১০ (২:১১ অপরাহ্ণ)
[এটি পিস-ইন-ইসলামে আমার প্রথম পোষ্ট, লেখাটি somewhereinblog.net এ পূর্বে প্রকাশিত হয়েছে]
খ্রীষ্টীয় ধর্মবাদের মূলে প্রোথিত জিওসেন্ট্রিক থিওরি এবং কোপার্নিকাসের প্রবর্তিত যুগান্তকারী তত্ত্ব যা বিজ্ঞানকে জিয়োসেন্ট্রিক থিওরির গ্রহণী অন্ধকার হতে মুক্তিদান করেছিল, সেই হেলিওসেন্ট্রিক থিওরি- এই দুই এর কোনটাই যেখানে পরিপূর্ণভাবে সত্য ছিল না, সেখানে ঐ জিয়োসেন্ট্রিক তত্ত্বের যুগে বসে কোরআন আজকের উৎকর্ষময় বিজ্ঞানের সত্য ও সঠিক জ্ঞানকে অতি সহজ ভাষায় প্রকাশ করে রেখেছিল। কোরআনের প্রস্তাবিত সহজ ও বোধগম্য সত্যটি কেবল উপেক্ষা করে যাবার কারনেই মুসলমানরা কোপার্নিকাসের চাইতেও অধিকতর বাস্তব একটি তত্ত্ব দানের সুযোগ গ্রহন করেনি। সুধী পাঠক, আপনার বিষ্ময়কে তাক লাগিয়ে পবিত্র কোরআন উভয় তত্ত্বের বিরোধের অতি সুন্দর মীমাংসা করে রেখেছে। এই সত্যটি আমাদের এই অধ্যায়ে প্রত্যাক্ষ করার সুযোগ পাবেন। একই সাথে দেখতে পাবেন, সামান্য ছায়া যার প্রস্তাবটি অতি সহজ ও সাধারণ- সেই ছায়া বিষয়ক প্রস্তাবের ভিতর সৃষ্টির কত বড় নিগুঢ় রহস্যের ইঙ্গিত রয়েছে। অনুভব করবেন, কোরআন কেবল স্পর্শ দিয়ে গেছে আর এই স্পর্শ জ্ঞানের এক মহা-বিস্তার দিগন্তের উন্মোচন ঘটিয়েছে।
আমরা সকলেই জানি যে গণিতবিদ পিথাগোরাস পৃথিবী-কেন্দ্রীক বিশ্ব-ব্যবস্থার জন্ম দিয়ে যান। এই বিশ্বাসে মনে করা হতো যে সূর্য, চন্দ্র, জানা পাঁচটি গ্রহ- এরা সকলেই পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। দার্শনিক এরিষ্টটল এসে এই পাল্লাটি আরো ভারী করলেন। মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু হলো এই পৃথিবী- আর তা হলো স্থির এবং দৃশ্যমান আকাশ হলো একটি নিখুঁত ও অনড় গম্বুজ সদৃশ পূর্ণাঙ্গ ও অপরিবর্তনশীল (perfect) সৃষ্টি, তারারা হলো ঐ গম্বুজে এঁটে থাকা বাতি- এই সব শ্রুতিমধুর চিন্তা-ভাবনা দিয়েই মানব জাতির মহাবিশ্ব সংক্রান্ত জ্ঞানের যাত্রা শুরু হয়। আর এই তত্ত্বকে বিশেষভাবে পছন্দ করলেন খ্রীষ্টান ধর্মযাজকগণ, যাদের একটা বিশেষ অংশ আজো জিয়োসেন্ট্রিক মতবাদের দোসর হয়ে বেঁচে আছেন। আমরা আজ জেনেছি- এটা শুধু একটি ভুল মতবাদই ছিল না, এটি গ্রহণযোগ্যতার যে কোন পরিমাপের কাছে বর্জনীয়।
গ্রীক জ্যোতির্বিদ্যার সর্বশেষ ল্যান্ডমার্ক টলেমি (১০০-১৭৮ এডি) তার এলেমজেষ্ট (Alemgest) পুস্তকে জিয়োসেন্ট্রিক তত্ত্বের ভিত আরো মজবুত করে দেন। টলেমি শিখিয়ে যান, আকাশ তার গম্বুজের বক্রতলে সূর্য-তারাদের নিয়ে প্রত্যেক রাতে একবার প্রদক্ষিন করে যায়। এ বিশ্বাসটি প্রচলিত ছিল টলেমি-যুগ হতে আরো ১৫০০ বছর পর্যন্ত। ইতিহাস এই সময়কে জ্যোতির্বিদ্যার গ্রহণকাল অর্থাৎ অন্ধকার সময় হিসাবে চিহ্নিত করেছে। “For nearly 1500 years after Ptolemy, astronomy in Europe entered a period of total eclipse” -The Dark Age. সূধী পাঠক, এই তথ্যটিকে বিশেষভাবে মনে রাখবেন। বিশেষ করে মনে রাখতে হবে এ জন্য যে, এই গ্রহণকালের মধ্যেই অবতীর্ণ হয়েছিল পবিত্র কোরআন। খ্রীষ্টীয় সাত শতকে জিয়োসেন্ট্রিক তত্ত্বের দ্বারা বেষ্টিত দুনিয়ায় বসে পবিত্র কোরআন হেলিওসেন্ট্রিক তত্ত্বের চাইতেও অধিতর সাফল্যজনক এবং চূড়ান্ত তত্ত্ব দান করে যায়। এমনি একটি বিষ্ময়কর সত্য আমাদের সামনে অতি অনাদরে অবহেলায় উপেক্ষিত হয়। অথচ সম্পূর্ণ নির্ভুল নয় সেই হেলিওসেন্ট্রিক থিওরিকে বিজ্ঞানের অঙ্গনে রেনেসাঁ এনেছিল বলে ইতিহাসে সম্মান দেয়া হয়েছে।
১৫৪৩ সালে মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে প্রকাশিত পুস্তক On the Revolution of the celestial Spheres এর উদ্ধৃতি কোপার্নিকাসের হেলিওসেন্ট্রিক তত্ত্বের সারবস্তু তুলে ধরে – “As if seated upon the royal throne, the sun rules the family of the planets as they circle round” – রাজকীয় সিংহাসনে বসে সূর্য তার সৌর-পরিবারের সদস্য গ্রহদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে – এটাই বক্তব্য। উল্লেখ্য যে কোপার্নিকাস একটি স্থির সূর্যের কল্পনা করেছিলেন। জিয়োসেন্ট্রিক তত্ত্বে পৃথিবী স্থির এবং হেলিওসেন্ট্রিক তত্ত্বে সূর্য স্থির- এই মিলটি ছাড়া এই দুই তত্ত্বে যে বৈপরীত্যটি ছিল তা হলো, পৃথিবী কেন্দ্রিক বিশ্ব-ব্যবস্থা হতে বেরিয়ে এসে সূর্য কেন্দ্রিক বিশ্ব-ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখা। এতে কৃতিত্বটি ছিল এইটুকু যে, প্রথমটিতে একটি গ্রহ অন্যান্য গ্রহদের কেন্দ্রবিন্দু, এই মতবাদ হতে দ্বিতীয়টিতে একটি নক্ষত্র গ্রহগুলির কেন্দ্রবিন্দু, এবং পৃথিবীও এই নক্ষত্র-ব্যবস্থায় নক্ষত্রকেন্দ্রিক ঘূর্ণনে নিরত রয়েছে, পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্রস্থল নয়- এই বাস্তবতাটিতে পৌছা। শুধুমাত্র এইটুকু বৈপরীত্যের অবস্থানে পৌঁছুতে বিজ্ঞানকে দেড় হাজার বৎসর অপেক্ষা করে থাকতে হয়। অথচ খ্রীষ্টীয় সাত শতকে কোরআন একটি সুন্দর তত্ত্ব দিয়েছিল যা উভয় তত্ত্বের চাইতে গ্রহণযোগ্যতর এবং আজকের বিজ্ঞানের জ্ঞানে পরিপূর্ণ বিশুদ্ধতায় নির্বাচিত। প্রিয় পাঠক- আমরা এই পাঠে উভয় তত্ত্বের বিরোধ মীমাংসার বাস্তবতাটি প্রত্যক্ষ করব। আমরা উপলব্ধি করতে বাধিত হব যে দৃশ্যতঃ সামান্য একটি তথ্য যাকে আমরা এত যুগ অবহেলা করে এসেছি, আপাতদৃশ্যে যা কোনো জ্ঞানপূর্ণ প্রতিবেদন বলেই মনে হয় না- তেমনি কোনো প্রস্তাব কত পরিপূর্ণভাবে এই দুই মহাতত্ত্বের বিরোধের নিস্পত্তি করেছে।
দৃশ্যতঃ জ্ঞানপূর্ণ নয়, অতি সাধারণ ও জ্ঞানউদ্দীপক মনে হয় না এমনিভাবে কোরআনে প্রস্তাবিত হয়েছে একটি প্রসঙ্গ- তা হলো ছায়া। অথচ এর মাঝে একটি ইতিহাস লেখা হয়ে আছে। ছায়া সম্পর্কে কোরাআনে যে কয়েকটি আয়াত এসেছে আপাতদৃশ্যে সেগুলি অতিশয় সাদামাটা। এই সাদামাটা আয়াতগুলি মোটেই কিন্তু ততটা সাদামাটা নয়। এদের মাঝে যে তথ্য রয়েছে তা জ্ঞানী ও সূক্ষ্মদ্রষ্টাকে ইঙ্গিত করে যায় এক গভীর অনুভূতির জগতের দিকে। আপনার অনুভবকে অসার করে দিয়ে কোরআন এইসব সাদাসিধে আয়াতে সুগভীর তত্ত্ব পেশ করে গেছে যার সাথে রয়েছে আপনার, আমার অস্তিত্ত্বের সম্পর্ক। চলুন, আমরা আয়াতসমূহের প্রস্তাবগুলি পর্যবেক্ষন করি – “তাহারা (অবিশ্বাসকারীরা) কি লক্ষ্য করে না যে, আল্লহ যাহা সৃষ্টি করিয়াছেন, তাহাদের ছায়ারা কিভাবে ডাইনে এবং বায়ে স্থান পরিবর্তন করে? সেজদা করে তাহারা আল্লহকে যখন তাহারা নত হয়” (১৬:৪৮)। কিংবা ” তুমি কি লক্ষ্য কর না কিভাবে তোমার প্রতিপালক ছায়াকে সম্প্রসারিত করেন; তিনি ইচ্ছা করিলে উহাকে স্থির রাখিতে পারিতেন। অনন্তর আমরা সূর্যকে করিয়াছি ইহার নির্দেশক (২৫:৪৫)। অতঃপর আমরা ইহাকে আমাদের দিকে ধীরে ধীরে উঠাইয়া আনি” (২৫:৪৬)।
ডানে বা বায়ে ছায়াদের স্থান পরিবর্তনের মধ্যে লক্ষ্য করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কি তথ্য থাকতে পারে? তাছাড়া আল্লহপাকের প্রতি ছায়াদের সেজদাবনত হবার মধ্যে কোন বিশেষত্ব লুকিয়ে আছে- তা সঙ্গত কারনেই প্রশ্ন হয়ে আসে। তিনি ছায়াকে নিশ্চল রাখতে পারতেন- এই তথ্যই-বা মানুষের জেনে লাভ কি? অন্যদিকে ছায়ার দিশারী তো সূর্যই- তা কোরআন দাবী করুক কিংবা না করুক, এটি একটি সহজ সত্য বৈ কিছুই নয়। এতদসত্ত্বেও কোরাআনের পাতায় কোনরূপ বিশেষত্ব ছাড়াই কি এই প্রস্তাবগুলি মুদ্রিত হয়েছে?
ছায়াদের গতি-চরিত্র নিয়ে কোরআন বিশ্লেষকগণ যেসব তথ্য দিয়েছেন তা সবই আমাদের জানা। ড. মরিস বুকাইলি ছায়ার বিষয়ে আলোচনা করেছেন তার বিখ্যাত “বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান” পুস্তকে। তার আলোচনার সারাংশে ঐশী মহাবিজ্ঞানের কোনো ইঙ্গিত নেই*। তেমনি আল্লামা Yusuf Ali তার বিখ্যাত The Holy Quran-এ এই আয়াতসমূহের ব্যাখ্যা দিতে কোরআনের অনুভূতি হতে অনেক দূরে রয়েছেন। তাদের এই দূরত্বের অবস্থানের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় যে কোরআনের মূল্যবান প্রস্তাবকে আমরা হৃদয়ঙ্গম করতে ব্যর্থ হয়েছি। মূলতঃ আমাদের ব্যর্থতার জন্য আমরাই কেবল লজ্জিত হবার শর্ত সৃষ্টি করি- কোরআনকে না বোঝার ব্যর্থতা আমাদের। প্রকৃতপক্ষে আল্লহপাক যথার্থই বলেছেন যে – “এই কিতাবে কোনো কিছুর বর্ণনাই বাদ দেওয়া হয় নাই” (৬:৩৮)। ছায়ার প্রসঙ্গটিও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যদিও আমরা তার প্রস্তাব ও অনুভূতিকে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি।
আসুন আমরা ছায়া বিষয়ক নিস্পত্তির আগে দেখি বিজ্ঞান যে সময়কে জ্যোতির্বিদ্যার গ্রহণকাল বলে চিহ্নিত করেছে, সেই সময়ের মধ্যে অবতীর্ণ কোরআন পৃথিবী ও সূর্যের সম্পর্কে আমাদেরকে কি তথ্য দেয়।
মনে করুন আমরা কেউই পৃথিবী কিংবা সূর্যের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সচেতন নই এমন অজ্ঞ মানুষ, যাদের বসবাস খ্রীষ্টীয় সাত শতকের কোন সময়ে যখন কোরআন অবতীর্ণ হয়ছে। আমরা দেখছি সকালে ও সন্ধ্যায় ছায়া প্রলম্বিত হয় এবং এই দুয়ের মধ্যবর্তী সময়ে ছায়ারা সংকুচিত হয়ে বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করে। এমতাবস্থায় কোরআন ছায়া সম্পর্কে পূর্বোল্লিখিত আয়াতগুলি পেশ করেছে। ছায়াদের ডানে ও বামে স্থান পরিবর্তন করার বিষয়ে আমরা যেন দৃষ্টি নিক্ষেপ করি আমরা এই কোরআনিক নির্দেশও পেয়েছি। আসুন দেখি এমনি পরস্থিতিতে কোরআন থেকে আমরা কি তথ্য পাই।
স্বাভাবিক কারনেই আমাদের মনে প্রশ্ন উদিত হবে- ছায়াদের কেন সকাল সন্ধ্যায় আকৃতির হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে? আমরা দৃশ্যতঃ যা বুঝতে পারি, তা হলো যে সূর্য পুর্ব হতে পশ্চিমে স্থান পরিবর্তন করে, তাই তার অবস্থানের পরিবর্তনের জন্য ছায়ারা পশ্চিমে ও পূর্বে দিক পরিবর্তন করে। এখানে আমরা প্রকৃতিতে যা দেখি, সে অনুসারে পৃথিবী স্থির, সূর্যই ঘোরে। আমরা জিওসেন্ট্রিক তত্ত্বের অভিমত মেনে নিতে পারি যে পৃথিবী অনড় ও সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। এখন আমরা কোরআনের আয়াতের পর্যালোচনা করব – “সূর্য ও চন্দ্র আবর্তন করে সুনির্ধারিত কক্ষপথে (৫৫:৫)। সূর্যের সাধ্য নাই চন্দ্রকে নাগালে পায়, রাত্রির সাধ্য নাই দিবসকে অতিক্রম করে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ কক্ষে পরিভ্রাম্যমান (৩৬:৪০)। সূর্য তাহার গন্তব্যের (যেখানে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে) উদ্দেশ্যে ভ্রমণে নিরত। ইহা মহাপরাক্রমশালী মহাজ্ঞানীর সুনির্ধারিত ব্যবস্থা (৩৬:৩৮)। তিনি চন্দ্র ও সূর্যকে করিয়াছেন নিয়মাধীন। প্রত্যেকেই পরিভ্রমণ করে একটি নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত (৩১:২৯)”।
৩৬:৪০ আয়াতের রেশ টেনে এ পরিস্থিতিতে আমরা বলতে পারি যে সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী ইত্যাদি সকলেই নিজ নিজ কক্ষপথে পরিভ্রমনশীল। পৃথিবী নিজ কক্ষপথে চলনে নিরত। প্রতিদিন সূর্য আমাদের পৃথিবীর পূর্ব হতে উদয় হয়ে পশ্চিমে অস্ত যাচ্ছে, ব্যতিক্রম হচ্ছে না। সূর্য হারিয়ে যাচ্ছে না। তার অর্থ হলো পৃথিবী তার চলার পথে অবশ্যই সূর্যকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এমনভাবে, স্টিমারের সাথে বাঁধা বোট বা ডিঙ্গিকে যেভাবে মূলযানটি টেনে নিয়ে যায়। আমরা যেহেতু কোরআন হতে প্রত্যেক বস্তুর সঞ্চালনের তথ্য সম্পর্কে অবগত রয়েছি এবং সূর্যকে পৃথিবীর চারদিকে প্রদক্ষিন করতে দেখতে পাই, সেহেতু আশা করতে পারি যে – পৃথিবী যদি অদৌ কোন কক্ষপথে সঞ্চালনশীল হয়, তবে অবশ্যই সূর্যকে ডিঙ্গিনৌকার মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছে এবং সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে, ফলতঃ প্রতিদিন সূর্য-পৃথিবীর অপরিবর্তনশীল সম্পর্ক বজায় থাকছে। সিদ্ধান্তটি অবশ্যই আমাদেরকে পরিতৃপ্ত করবে- কারণ প্রকৃতিতে যা ঘটছে তার অবলোকনের সঙ্গে এই সিদ্ধান্তের কোনো বিরোধ নেই।
এখন আমরা কোরাআনের ৩৬:৩৮ আয়াতের দিকে তাকালে একটু ভিন্নতর প্রস্তাব প্রত্যক্ষ করি- “সূর্য তাহার গন্তব্যের উদ্দেশ্য ভ্রমণে নিরত। ইহা মহাপরাক্রমশালী মহাজ্ঞানীর সুনির্ধারিত ব্যবস্থা”। এই আয়াত আমাদের পূর্ব সিদ্ধান্তকে (পৃথিবী কেন্দ্রিক ধারণাকে) সম্পূর্ণরূপে বাতিল করে দেয়। সূর্য তার নিজ কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে থাকে এ তথ্য আমরা আয়াত ৩৬:৪০ হতে পেয়ে থাকি এবং আয়াত ৩৬:৩৮-এ সূর্যের আরো একটি বাড়তি গতির তথ্য সম্পর্ক জানতে পাই- সেটি হল তার গন্তব্য বা مُسْتَقَرٍّ (মুছতাকার) এর উদ্দেশ্যে ভ্রমণের তথ্য। তাহলে আমরা দেখছি যে পূর্বের ধারণা, অর্থাৎ পৃথিবী সূর্যকে টেনে নিয়ে যাবার তথ্যটি ভুল। এখানে আমরা সিদ্ধান্ত পাই যে, সূর্যই একটি গন্তব্যের পানে ছুটে চলছে, আর এই ছুটে চলার সময় সে পৃথিবীকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে পূর্বের কথিত ডিঙ্গি নৌকার মতো। সূর্য পৃথিবীকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এই তথ্যটি আমরা প্রাকৃতিক ভাবেই পেয়ে থাকি, কারণ প্রতিদিন একটি অনুপাতে আমরা পৃথিবী, সূর্য ও অন্যান্য গ্রহদের অভিন্ন সম্পর্ককে বিদ্যমান থাকতে দেখি। উপরের বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে আমরা আর জিয়োসেন্ট্রিক তত্ত্বের কথা অনুমোদন করতে পারি না। এ পর্যন্ত এসে আমরা কোরআন হতে যে সকল তথ্য পেয়েছি, তা নিম্নরূপঃ
ক) পৃথিবী ও সূর্য উভয়েরই নিজস্ব কক্ষপথ আছে।
খ) প্রত্যেকেই নিজ নিজ কক্ষপথে সদা চলমান।
গ) সূর্যের জন্য একটা গন্তব্যস্থল রয়েছে, সূর্য সে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে সব সময় ছুটে চলছে।
এই তথ্যসমূহকে সম্ভাব্যতার ছকে সাজালে আমরা সহজেই পেয়ে যাই যে- যেহেতু পৃথিবী ও সূর্যের সম্পর্ক একটি অপরিবর্তিত অনুপাতে বিদ্যমান, সেহেতু উভয়ই নিজ নিজ কক্ষে সন্তরণরত এবং যেহেতু সূর্য একটি গন্তব্যের দিকে ছুটে চলছে, সেহেতু পৃথিবীর কক্ষ অবশ্যই সূর্য কেন্দ্রিক, সূর্য পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে না– আর এই শর্তটি পূরণ না হলে লক্ষ্যের উদ্দেশ্যে চলমান সূর্য পৃথিবী হতে হারিয়ে যেত। এখানে এসে সূর্য কাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে সে প্রশ্নটিও উত্থাপিত হয়। সূর্য নিজ কক্ষে কোনো অজানাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে এবং গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ভ্রমনে নিরত রয়েছে- এই তথ্যগুলি কোপার্নিকাসের সূর্য ব্যবস্থার Royal throne বা রাজকীয় সিংহাসনের উচ্ছেদ ঘটায়। এই আয়াত সমূহ জিয়োসেন্ট্রিক ব্যবস্থাকে যেমন নাকচ করে দেয়, তেমনি মহাবিশ্ব হেলিওসেন্ট্রিক নয় সে ধারণার জন্ম দিয়া যায়, যা রেনেসাঁ সৃষ্টিকারী হেলিওসেন্ট্রিক তত্ত্বের অনেক অনেক অগ্রে অবস্থান নেয়। খ্রীষ্টীয় সাত শতকে কোনো কোরআন গবেষক যদি মাত্র দু’তিনটি আয়াতকে সত্যতায় বিশ্লেষণ করতেন, দেখতে পেতেন পবিত্র কোরআন প্রচলিত জ্ঞানের কত সম্মুখে অবস্থান নেয়। “তাহারা কি সতর্কতার সঙ্গে কোরআনকে অনুধাবন করে না? আর যদি উহা আল্লহ ছাড়া অন্য কাহারো নিকট হইতে আসিত, তবে অবশ্যই তাহারা উহাতে বহু অসামঞ্জস্য ও অসঙ্গতি প্রত্যক্ষ করিত (৪:৮২)। ইহা তো মানুষের জন্য এক বার্তা, যাহা দ্বারা উহারা সতর্ক হয় এবং জানিতে পারে যে, তিনিই একমাত্র উপাস্য, যাহাতে বোধশক্তিসম্পন্নরা উপদেশ গ্রহণ করে (১৪:৫২)”।
আমাদের আলোচনা সুস্পষ্টত তুলে ধরে যে- আল কোরাআন যে ব্যবস্থার অনুমোদন দিয়েছে তা জিয়ো এবং হেলিওসেন্ট্রিক তত্ত্বের বাইরে একটি পৃথক তত্ত্ব, যার মধ্যে বিবেচনা হলো যে পৃথিবী বা সূর্য কেহই স্থির নয়, সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ঘুরছে এবং সূর্য বা পৃথিবী কেহই মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয়। সূর্য চলমান তার নিজস্ব কক্ষপথে এবং একই সাথে সে একটি গন্তব্যের দিকে অগ্রসারমান (সূর্যের কক্ষপথ ও তার গন্তব্য বা সোলার এপেক্স অভিমুখী যাত্রা নিয়ে সুযোগ পেলে পরবর্তী কোনো অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করব)। বিষ্ময়করভাবে আমরা এখানে প্রত্যক্ষ করি যে, আজকের বিজ্ঞান যোগ্যতায় অর্জিত জ্ঞানের সাথে কোরাআনের কোন বিরোধ নেই। যেখানে টলেমির পরবর্তী ১৫০০ বছরকে জ্যোতির্বিদ্যার অন্ধকার যুগ বলা হয়, এমন একটি সময়েই উম্মি নবীর উপর অবতীর্ণ কোরআন এক চরম সত্যকে ধারন করে আছে, যা বিজ্ঞানের দুই তত্ত্বকে নাকচ করে দেয় এবং সঠিক তথ্যটি আমাদের জানিয়ে যায়, যখন বিজ্ঞান ছিল একটি শিশু- এই তথ্যটি আমাদের সুচিন্তার দাবি রাখে না কি? কোরআনের আয়াতের বিস্ময়কর মহিমাময় প্রকাশ কেবল কোরআনের আয়াতকেই ডেকে আনে – “যদি তোমরা সন্দিহান হও আমার বান্দার উপর অবতীর্ণ বাণী সমূহের সম্বন্ধে তবে ইহার অনুরুপ একটি আয়াত তৈরী করো যদি সত্যবাদী হও (২:২৩)। যদি না সক্ষম হও এবং কখনোই তাতে সক্ষম হইবে না- তবে ভয় করো সেই অগ্নিকে যাহার ইন্ধন হইবে মানুষ এবং প্রস্তর পিন্ড (২:২৪)”।
খ্রীষ্টীয় সাত শতকের অজ্ঞানতার অন্ধকারে বসেও পূর্বেকার আলোচনায় আমরা পৃথিবীর একটি কক্ষপথ সম্পর্কে অবহিত হয়েছি। আমরা জেনেছি কোরআন যে তথ্য দেয়, তা হল সূর্য নয়- পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে পরিভ্রমণ করে, এবং সূর্য স্থির নয়। এখন আমরা আলোচনাকে ছায়া বিষয়ক প্রশ্নের নিস্পত্তির দিকে নিয়ে যাব।
(চলমান…)
* ড. মরিস বুকাইলি কর্তৃক ছায়া সম্পর্কে প্রদত্ত ব্যাখ্যা নিম্নরূপঃ
“আল্লহর সৃষ্ট প্রতিটি জিনিসই তাদের ছায়াসহ তাঁর নিকটে বিনীত হয়ে রয়েছে- এই আয়াতে সেকথা বলার সাথে সাথে এও বলা হয়েছে যে, আল্লহ ইচ্ছা করলে তাঁর ক্ষমতার এই প্রকাশকে ফিরিয়ে নিতে পারেন। তদুপরি এই আয়াতে সূর্যের সাথে ছায়ার সম্পর্কও তুলে ধরা হয়েছে। এই পর্যায়ে একটা কথা অবশ্যই মনে রাখা দরকার। আর তা হলো, মোহাম্মদ (সঃ) এর আমলে বিশ্বাস করা হত যে, সূর্যের পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলাচলের দ্বারাই ছায়ার নড়াচড়া নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। সেই নীতির নিমিত্তেই সেকালে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময় গণনার জন্য ‘সান-ডায়াল’ (সূর্যঘড়ি) চালু হয়েছিল। এখানে দেখা যাচ্ছে, কোরআন ছায়ার নড়াচড়ার কথা বলছে ঠিকই; কিন্তু অবতীর্ণ হওয়ার কালে এ সম্পর্কে সাধারণ্যে যে ধারণা প্রচলিত সে কম্পর্কে কিছুই বলছে না। এক্ষেত্রে কোরআনে যদি প্রচলিত সেই ধারণাকে তুলে ধরা হতো, তাহলে মোহাম্মদ (সঃ) পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত সে ধারণাকে মানুষ সহজেই বিশ্বাসযোগ্য বলে মেনে নিতে পারত। কিন্তু পরিশেষে তা ভুল বলেও পরিগণিত হতো এবং সে ভুল চিহ্নিত করতেও মানুষ দেরি করত না। কিন্তু কোরআন সূর্যের উদয়-অস্ত সংক্রান্ত সে যুগের সেই প্রচলিত ধারণা সম্পর্কে কিছুই বলেনি। বরং ছায়ার প্রশ্নে সূর্যের ভূমিকা সম্পর্কে শুধু এইটুকু বলেছে যে, সূর্য হচ্ছে ছায়ার ইন্ডিকেটর বা নির্দেশক মাত্র। সুতরাং এটা খুবই স্পষ্ট যে, আধুনিককালে ছায়ার গতি সম্পর্কে আমরা যা জানতে পারছি, আর কোরআনে ছায়া সম্পর্কে যে বর্ণনা রয়েছে- এই দুইয়ের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই।”
=====================================================================================
>> আমার লেখাতে “আল্লাহ” এর পরিবর্তে “আল্লহ” লেখা হয়েছে। কারন মূল আরবি এর উচ্চারনে “লাম” কে মোটা করে উচ্চারন করতে হয়, আরবিতে “যবর” বা বাংলায় “আ-কার” উচ্চারন হয় না। “আল্লাহ” এর পরিবর্তে “আল্লহ” লিখলে সঠিক উচ্চারন সহজ হয়।
>> এটি কোরআনকে বিজ্ঞান দ্বারা বা বিজ্ঞানকে কোরআন দ্বারা প্রমাণ করার কোন চেষ্টা নয় বরং বিজ্ঞানের কল্যানে এখন পর্যন্ত অর্জিত জ্ঞান দ্বারা পবিত্র কোরআনের কিছু আয়াতকে বুঝবার চেষ্টা মাত্র।
>> এই সিরিজ লেখাটি মেজর কাজী জাহান মিয়া রচিত “আল-কোরআন দ্যা চ্যালেঞ্জঃ মহাকাশ পর্ব ১ ও ২” হতে সংগ্রহ করা হয়েছে। লেখাটি উক্ত বই থেকে প্রায় হুবহু তুলে দিয়েছি। পোষ্টের কলেবর সংক্ষিপ্ত রাখার উদ্দেশ্যে কিছু স্থানে সংক্ষেপ করা হয়েছে এবং মাঝে মাঝ আমি দু-একটা লাইন জুড়ে দিয়েছি, তবে আমার জুড়ে দেওয়া লাইনগুলো চিহ্নত করা হয়নি (আগামী পর্বগুলোতেও একই পদ্ধতি অনুসরন করা হবে)। আর এই সবই করা হয়েছে লেখকের অনুমতিক্রমে।
———————————————————————————————————————————————————