বিতর্কিত ইবাদাত শবে বরাত
লিখেছেন: ' atiqr88' @ শনিবার, জুন ১৪, ২০১৪ (৬:১৮ পূর্বাহ্ণ)
বিতর্কিত ইবাদাত শবে বরাত
শবে বরাত বা লায়লাতুল বরাত সত্যি একটি বিতর্কিত ইবাদাতের রাত। এই রাত ইবাদাতের কোন রাত কিনা তা নিয়ে বিস্তর মতপার্থক্য রয়েছে। কুরআনে এই রাত সম্পর্কে কোন কথাই নেই। অনেকে সুরা আদদুখানের নিম্নোক্ত আয়াতটিকে লায়লাতুল বারাত সম্পর্কিত বলে দাবি করেন “হা মিম” স্পষ্ট কিতাবের শপথ, নিশ্চয় আমি তা বরকতময় রাতে নাযিল করেছি। নিশ্চয় আমি মানুষদের সতর্ককারী। ঐ রাতে প্রতিটি হেকমত পূর্ন বিষয় আমার তরফ থেকে জারী করা হয়।
যদি উল্লিখিত আয়াতের “লায়লাতুল মুবারাকাহ” শব্দ দুটিকে বরাতের রাত ধরা হয় তবে আয়াতের অর্থ দাঁড়ায় এই যে আল্লাহ তায়ালা কুরান শরিফে শাবান মাসের ১৫ তারিখে নাযিল করেছেন, অথচ কোরানে স্পষ্ট বলা আছে, ১) আমি কোরানকে কদরের রাতে নাযিল করেছি।(সুরা কদর) ২) রমজান মাসে কোরান নাযিল হয়েছে। (সুরা বাকারা)। অতএব উপরোক্ত ধারনা একেবারেই ভুল।
এবার হাদীস দিয়ে একটু যাচাই করে দেখা দরকার এই রাতের ইবাদাতের জরুরত কতখানি?
১) “হযরত আয়েশা রা থেকে বর্নিত,তিনি বলেন, এক রাতে আমি নবী করীম (সা) কে বিছানায় পেলাম না,তাই আমি তার তালাশে বের হলাম, অতপর আমি বাকী নামক কবরস্থানে তাকে আকাশের দিকে মাথা উঠানো অবস্থায় দেখতে পেলাম,তিনি বললেন, হে আয়েশা! তুমি কি এ ধারণা করছ যে ,আল্লাহ ও তার রাসুল তোমার উপর ওপর যুলুম করছেন? আয়েশা রা বলেন, আমি তদ্রুপ ধারনা করেনি। তবে আমি ভেবেছিলাম আপনি আপনার কোন স্ত্রীর কাছে গেছেন তখন নবী সা বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাতে প্রথম আকাশে অবতীর্ন হন। অতপর তিনি কালব গোত্রের বকরীগুলোর পশমসমুহের চেয়েও বেশী লোকের পাপ ক্ষমা করেন। (ইবনে মাজাহ,তিরমিযি,মেশকাত)
২) হযরত আয়েশা রা বলেন নবী করিম সা বাকী নামক কবরস্থানে সিজদারত ছিলেন এবং দীর্ঘক্ষন সিজদায় কাটান।আমি ধারণা করলাম, হয়ত তার জীবন চলে গেছে। এরপর তিনি সালাম ফিরিয়ে আমার দিকে দষ্টিপাত করলেন। (মিশকাত)
৩) হযরত আয়েশা রা থেকে বর্নিত, তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সা আমার কাছে এসে তার গায়ের কাপড় খুলে ফেললেন। এরপর তিনি না ঘুমিয়ে দন্ডায়মান রইলেন, অতপর কাপড় আবার পরিধান করলেন আমি ধারণা করলাম যে, তিনি আমার কোন সতীনের কাছে যাবেন। এতে আমার খুব হিংসা হলো, তাই আমি তাকে অনুসরন করলাম, অতপর আমি তাকে বাকিওল গারকাদ নামক কবরস্থানে পেলাম। তিনি মুমিন নারী পুরুষ অ শহীদদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। (মাছাবাতা বিসুন্নাহ)
৪) হযরত আলী রা থেকে বর্নিত তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সা এরশাদ করেছেন যখন শাবান মাসের মধ্যবর্তী ১৫ তারিখের রাত উপস্থিত হয় তখন তোমরা সে রাতে ইবাদাতে দন্ডায়মান হ্ও এবং দিনে রোজা রাখ। কারন সে রাতে আল্লাহ তায়ালা সুর্যাস্তের সাথে সাথে প্রথম আকাশে অবতরন করেন, অতপর বলতে থাকেন কে আছ ক্ষ্মা প্রার্থী আমি তাকে ক্ষমা করব। কে আছ রিযিক প্রার্থী আমি তাকে রিযিক দেব, কে আছ বিপথগ্রস্থ আমি তাকে বিপদমুক্ত করবো।প্রভাত হও্যা পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা এরুপ বলতে থাকেন। (ইবনে মাযাহ,পষ্ঠা ৯৯,মিশকাত)
হযরত আয়েশা রা এর প্রথম তিনটি হাদীস একই বছরের বর্নণা হতে পারে, আবার ভিন্ন ভিন্ন বছরের ঘটনাও হতে পারে। সে যাই হোক, উপরোক্ত হাদীস তিনটি পড়ে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে,এই রাতের ফযীলত সম্পর্কে হযরত আয়েশারা কিছুই জানতেন না। এই রাতটি যদি ইবাদাতের জন্য কোন বিশেষ গুরুত্বপূর্ন রাতই হতো তাহলে হযরত আয়েশা রা এর তা অজানা থাকবে কেন? তিনি খুজে খুজে রাসুল সা কে গোরস্থানে আবিস্কার করলেন, তিনটি হাদীস থেকেই জানা যায় রাসুল সা সে রাতে কবরস্থানে ছিলেন, নিশ্চয় কবরস্থান কোন ইবাদাতের জায়গা নয়। অতএব তিনি কবরস্থানে গিয়েছিলেন কবর জিয়ারাত এবং মত ব্যাক্তিদের জন্য দোয়া করতে।
৪ ও ৫ নং হাদীস অনুযায়ী প্রমানিত হচ্ছে যে, এটি একটি নফল ইবাদাতের রাত যদিও হাদীস দুটি সহিহ নয় মুরসাল। হতে পারে উপরোক্ত হাদীস দুটিতে প্রমানিত হয় যে, রাতটি নফল ইবাদাতের রাত। দোয়া কবুলের রাত। এ রাত সম্পর্কে ও এ মাস সম্পর্কে আরো কয়েকটি হাদীস আছে। যেমন –
ক) রজব মাস শুরু হলে রাসুল সা এই দোয়া টি পড়তেন “হে আল্লাহ আমাদের জন্য রজব ও সাবান মাসে বরকত দান করুন এবং আমাদের রমজান মাস পর্যন্ত পৌছে দিন।
খ) রাসুল সা কে শাবান মাস ছাড়া বেশি রোজা অন্য কোন মাসে রাখতে দেখিনি। (বোখারী)
উল্লেখ্য আছে, সর্বপ্রথম ভারতের বিহার অঞ্চলে এই ১৫ই শাবান রাতকে শবে বরাত নামকরণ করে খুব জাঁকজমকের সাথে হিন্দুদের দেয়ালী পুজার অনুকরণে এই রাতটি উদযাপন করে। সে দেশে এই নতুন প্রথাটি খুব খ্যাতি লাভ করে। তখন আনাড়ি লোকেরা তা পুথি পুস্তুকে লিপিবদ্ধ করে এর প্রশংসায় আজগুবী ফজীলত ও কিচ্ছা কাহিনি দ্বারা ভরপূর করে দেয়। ভারতের অন্য এলাকায়ও এই প্রথাটি দ্রূত ছড়িয়ে পড়ে। এরেপর ‘মকসুদূল মুমেনীন’ নামক বাংলা কিতাবটি পূর্ব রঙের উপর আরো রঙ ছড়িয়ে অতিরঞ্জিত ব্যাখ্যা ও কিচ্ছা কাহিনিতে পূর্ন করে। তারপর বাংলাদেশের ঘরে ঘরে তা পৌছে দেয়।
এই কাজের সবচেয়ে বড় পষ্ঠপোষক যে ইবলিশ তাতে কোন প্রকার সন্দেহ নাই,কারন ইবলিশ জানে শরিয়তের মধ্যে ইবাদাতের মধ্যে ন্তুন কিছু সংযোজন করার নামই বিদায়াত,। আর বিদআতকারীর পরিনাম জাহান্নাম। প্রচলিত শবে বরাতে করনীয় প্রতিটি কাজই বিদআত ও শিরকে পূর্ন যেমন-
ক) ইবাদাতের অংশ হিসেবে হালুয়া রুটি তৈরী করা। কোন কোন এলকায় রোজা রাখা হ্য,তারা এও রোজার নাম দিয়েছে রুটির রোজা, রমজান মাসের রোজা আল্লাহর রোজা। আর এই শাবান মাসের রোজার নাম রুটির রোজা,কারো কারো মতে হালুয়া রুটি না হলে শবে বরাতই হয় ন, তারা খুব জোর দিয়ে বলেন, এই তারিখে রাসুল সা এর দান্দান মোবারক শহীদ হয়েছিল আর ফাতেমা রা তখন পিতাআর জন্য নরম রুটি ও হালুয়া বানিয়ে নিয়ে এসেছিলেন, অতএব এই দিনে হালুয়া রুটি বানানো ও খাও্যা সুন্নাত। তামাশা আড় কাকে বলে? রাসুল শা এর দাঁত শহিদ হয়েছিল ওহুদের যুদ্ধে যা সংঘটিত হয়েছিল শাওয়াল মাসে। তারপর যদি ধরেও নেয়া হয় যে, এই মাসেই তার দাঁত শহীদ হয়েছিল আর তিনি হাল্যা রুটি খেয়েছিলেন। দাঁত ভেঙ্গে অসুস্থ হয়ে তিনি নরম হালুয়া রুটি খেলেন। এই হালুয়া রুটি খাওয়া হলো সুন্নত আর ইসলামকে বিজয়ী করার জন্য দাঁত ভাঙলেন ,রক্ত ঝরালেন তা সুন্নাত হলো না?
খ) অনেক এলাকায় হিন্দুদের দেওয়ালি পুজার ন্যায় আলোকসজ্জা করা হয়। কল্পনা করা যায় কত বড় মুর্খতা।
এ রাতের ইবাদাতের মধ্যে ঢুকে গেছে পরিপূর্নভাবে আরো অনেক বিদআত। আমি নমুনা স্বরূপ কয়েকটি উদাহারন পেশ করছি । এটি হাদীস হিসেবে ‘বার চাদের ফজিলত এবং মুকসদুল মোমিন’ বইয়ে উল্ল্যেখ করা হয়েছে ’১৫ ই শাবান সন্ধ্যার পর গোসল করা উচিত। হযরত রাসুল সা ব্লেছেন, যে ব্যাক্তি ১৫ই শাবাণ রাত্রিতে ইবাদাতের নিয়তে গোসল করে তার জন্য প্রতিটি ফোটা পানিতে সাত’শ রাকাত নফল নামাজের সওয়াব লেখা হবে। গোসলের পর দু রাকাত ‘তাহিয়াতুল অযু’ নামাযের প্রতি রাকাতে সুরা ফাতিহার পর একবার আয়াতুল কুরছি ও সুরা ইখলাছ তিন বার পড়তে হব। তাহিয়্যাতুল অজু শেষ করে আট রাকাত নফল নামাজ পড়তে হবে। প্রতি রাকাতে সুরা ফাতিহার পর সুরা কদর একবার সুরা ইখলাছ ২৫ বার পড়তে হবে।রাসুল শা বলেছেন যে ব্যাক্তি এ ভাবে এই নামায আদায় করবে তার সকল গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। সে সদ্যপ্রসূত শিশুর নযায় নিষ্পাপ হবে। এটি ‘বার চাদের ফজিলত এবং মুকসদুল মোমিন’ উল্লেখ আছে।
এরকম আরো ভিত্তিহিন মনগড়া হাদীস এই শবে বরাত কে উদ্দেশ্য করে তৈরী করা হয়েছে। আসলে এগুলো একটাও হাদীস নয়, অথচ রাসুল শা ব্লেছেন আমি যা বলিনি তা যদি কেও আমার নামে প্রচার করে তাহলে সে যেন জাহান্নামে তার ঘড় তৈরি করে নিল। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
যারা শবে বরাত ঊপলক্ষে ঊপরোক্ত নামাজ পরে তারা সম্পুর্ন্রুপে বিদআতকারী। আর যারা বই কিতাব ও ওয়াজ নসিহতের মাধ্যমে ঐ সব জাল হাদীস প্রচার করে তারা তাদের জন্য জাহান্নামে ঘর তৈরী করে নিচ্ছে।
শবে বরাত ঊপলক্ষে বিশেষ নিয়মের কোন নফল নামাযের কথা সহীহ হাদীসে অথবা ফিকহের কিতাবেও উল্লেখ নেই।
শাবান মাস যে বরকতের মাস, এ মাসে রাসুল সা বেশি করে সিয়াম পালন করতেন, এতে তো কোন সন্দেহ নাই। আমরাও আ মাসে বেশী করে নফল সিয়াম পালন করতে পারি। এই বছরের জন্য এই মাসের ১৫ তারিখে শেষ নফল সিয়াম। কারন রাসূল সা বলেছেন, তোমরা শাবানের ১৫ তারিখের পরে আর নফল সিয়াম করোনা’ এই রাতে নফল সালাত আদায়ও নিঃসন্দেহে সওয়াবের কাজ। আর নফল সালাত তো প্রতি রাতের জন্যই সওয়াবের আমল। কিন্তু তাই বলে মনগড়া নিয়ম পদ্ধতিতে পড়ার নাম সওয়াব নয়,ফরজের চেয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়ে পড়ার নাম সওয়াব নয়।
সকল মুসলিম উম্মাহর প্রতি আহ্বান করছি। আসুন আমরা কোরান ও সুন্নাহ অধ্যায়ন করি তাহলে ইবাদাত ও বিদাতের পার্থক্য বুঝতে পারবো। নিজেকে সত্যিকার অর্থে মুমিনরুপে গড়ে তুলতে হলে, সর্বপ্রকার বিদআতি ফাসেকি থেকে রক্ষা পেতে হলে, ইবলিশের ধোঁকা থেকে বাঁচতে হলে পড়ার কোন বিকল্প নেই। তাই আসুন আমরা বুঝে, উপলব্ধি করে কুরআন পড়ি, হাদীস পড়ি এবং স্মাজের প্রত্যেক মুসলিমের কাছে পৌছে দেই এই দাওয়াত।
আমাদের সমাজটা সত্যি সর্বপ্রকার গুনাহ ও কুসংস্কারে জর্জরিত হয়ে আছে। সমাজের শেরক, বিদআত, ফাসেকি থেকে উদ্ধার করার চেষ্টা করা আমাদের ইমানি দায়িত্ব।
মহান আল্লাহ যেন আমাদের ইবাদাত ও বিদআত বোঝার তৌফিক দাণ করেন আমিন।