জাপানে ইসলামের বিস্তার
লিখেছেন: ' বেদুইন' @ শুক্রবার, মার্চ ১৯, ২০১০ (১২:৫১ অপরাহ্ণ)
প্রবীর বিকাশ সরকার জাপান হচ্ছে অপূর্ব এক ধর্মীয় বৈচিত্র্যের দেশ, সেই বৈচিত্র্যের মধ্যে ইসলাম ধর্মও কম উজ্জ্বল নয়। জাপানের মতো ধর্মীয় সহাবস্থান ও শান্তি আর কোনো দেশে কি পরিলক্ষিত হয়? আজকের দিনে অধিকাংশ মুসলিম দেশেই শান্তি নেই নানা কারণে। বর্তমানে ৬ লাখ জাপানি মুসলমান আছেন সরকারি হিসাব অনুযায়ী। অন্যান্য ধর্মাবলম্বী জাপানিদের মতো জাপানি মুসলমানরাও শান্তিপ্রিয়। তাদের নিজেদের মধ্যে যেমন কোনো ভেদাভেদ নেই, তেমনি অন্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গেও নেই।
বৌদ্ধধর্ম, খ্রিস্টান ধর্ম, ইহুদি ধর্মের পর জাপানে ইসলাম ধর্ম আসে সবশেষে মেইজি যুগে (১৮৬৮-১৯১২), যখন মহাসংস্কার বা মহাজাগরণের মধ্য দিয়ে মধ্যযুগীয় দেশ জাপান সবদিক দিয়ে আধুনিক হতে শুরু করে। তখন মুসলিম উসমানীয় সাম্রাজ্য ছিল দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ-মধ্যপ্রাচ্য- পশ্চিম এশিয়া-গ্রিস- উত্তর আফ্রিকাজুড়ে একটি সুবিশাল স্বাধীন রাষ্ট্র; কিন্তু বরাবরই শ্বেতাঙ্গ রুশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে ছিল দ্বন্দ্ব-যুদ্ধ। শ্বেতাঙ্গ শক্তিকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের দিকে নৌপ্রধান ওসমান পাশার নেতৃত্বে ৬শ’ সেনার একটি দলকে জাপান শুভেচ্ছা-সফরে পাঠান। তারা সম্রাট মেইজি, রাজকীয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং ফ্রান্সের নেতৃত্বে রাজকীয় সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করেন। কিন্তু ফেরার পথে ১৬ সেপ্টেম্বর ওয়াকায়ামা প্রিফেকচারের (জেলা) ওশিমা দ্বীপের কাছে সামুদ্রিক ঝড়ে রণতরী ডুবে গেলে পরে সুলতানের এক ভাইসহ পাঁচ শতাধিক সেনা মৃত্যুবরণ করেন। তাদের রক্ষাকল্পে জাপানি নৌবাহিনী আপ্রাণ চেষ্টা করে মাত্র ৬৯ জনকে বাঁচাতে সক্ষম হয়। মৃতদের জাপানে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে সমাধিস্থ এবং জীবিতদের সম্রাটের নির্দেশে জাপানি রণতরী দিয়ে স্বদেশ পর্যন্ত পেঁৗছে দেওয়া হয়। এ ঘটনার মধ্য দিয়েই প্রথম কোনো মুসলিম রাষ্ট্রের সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় বলে কথিত আছে। ১৯০০ সালের দিকে একজন খ্রিস্টান জাপানি ব্যবসায়ী মি. আরিগা ভারতের বোম্বে (মুম্বাই) গিয়ে ইসলামী স্থাপত্যকলার প্রেমে পড়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে আহমদ আরিগা নাম নিয়ে স্বদেশে ফিরে আসেন।
রুশ-জাপান যুদ্ধের (১৯০৪-০৫) পর জাপান আগ্রহ প্রকাশ করে মুসলিম বিশ্বের প্রতি। মিসর থেকে কিছু সেনা কর্মকর্তা জাপানে এসে রাজকীয় সেনাবাহিনীতে স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করেন এবং তাদের কেউ কেউ জাপানি নারীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনেও আবদ্ধ হন। যুদ্ধের পরপর বন্দি রাশিয়ান মুসলিম সেনাদের দ্বারা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় নগর ওসাকায় প্রথম মসজিদ নির্মিত হয় বলে জানা যায়। ১৯০৯ সালে ভারতীয় মুসলিম পণ্ডিত এবং তুখোড় বিপ্লবী মোহাম্মদ বরকতউলল্গাহ্ টোকিও ইম্পেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ে উর্দু ভাষার অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি জাপান ও এশিয়ার মধ্যে প্যান-ইসলামিক আন্দোলন সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখার জন্য আজও স্মরণীয়। বরকতউল্লাহ্ ১৯২৭ সালে আমেরিকায় মৃত্যুবরণ করেন। এরপর ওই শূন্যপদে স্থলাভিষিক্ত হন ভারত থেকে আমন্ত্রিত নূর আল-হাসান পার্লাস নামে একজন উর্দুভাষী পণ্ডিত, তিনি এদেশে ১৯৩২-৪৯ সাল পর্যন্ত ওই পদে ছিলেন। এ বছরের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, আবদুর রশিদ ইব্রাহিমের সঙ্গে জাপানি মুসলিম ওমর ইয়ামাওকা মুসলিম তীর্থস্থান এবং ইস্তাম্বুল ভ্রমণ করেন। সম্ভবত তিনিই প্রথম জাপানি নাগরিক, যিনি মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে ইসলামের পবিত্র তীর্থস্থান পরিদর্শনে যান।
১৯২০-৩০ সালের মধ্যে জাপান মুসলিম চিন্তা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি প্রভৃতির প্রতি আরও দৃষ্টি সম্প্রসারণ করে। পবিত্র কোরআনের ব্যাখ্যা জাপানি অনুবাদসহ বিভিন্ন ইসলামী গ্রন্থ প্রকাশিত হতে থাকে। কমিউনিস্ট রাশিয়া থেকে তাতার মুসলিমরা জাপানে আশ্রয় গ্রহণ করে কোবে, নাগোয়া, টোকিও প্রভৃতি জায়গায় স্থায়ী হন। তাদের নেতা আবদুল হাই কুরবান আলীর প্রচেষ্টায় টোকিওতে প্রথম মসজিদ নির্মিত হয় ১৯৩৮ সালে। তাদের দেখাদেখি ভারতীয় মুসলমানরাও ১৯৩৫ সালে কোবে শহরে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। কুরবান আলী ছিলেন অত্যন্ত কর্মঠ এবং জাপানপ্রিয় ব্যক্তি, যিনি জাপানে আরবি ভাষার মুদ্রণযন্ত্র পর্যন্ত স্থাপন করেছিলেন। সেখান থেকে ওই ভাষায় পবিত্র কোরআনসহ বিভিন্ন ইসলাম ধর্মীয় গ্রন্থ ও সাময়িকী প্রকাশিত হয়েছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর উসমানীয় সাম্রাজ্য যখন ক্রমাগত বিদেশি আক্রমণ, শ্বেতাঙ্গ শক্তির চাপ, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বযুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক এবং পরবর্তীকালে তরুণ তুর্কি তথা ইয়াং টার্ক রেভল্যুশনারিদের উত্থানে রাজনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত, তখন সূচনা হয় তুর্কি জাতীয় আন্দোলনের_ মোস্তফা কামাল পাশা তথা কামাল আতার্তুকের নেতৃত্বে। এ সময় কিছু তুর্কি নেতা জাপানে আসেন সহযোগিতা লাভের জন্য। তাদের আশ্রয় এবং সহযোগিতা দেন তৎকালীন প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, আধ্যাত্মিক চিন্তাবিদ এবং গুপ্ত রাজনৈতিক সংস্থা ‘গেনয়োশা’, ‘কোকুরিইকাই’র প্রধান পরিচালক গুরু তোয়ামা মিৎসুরু এবং তার প্যান-এশিয়ানিস্ট সহযোগীরা।
এই প্যান-এশিয়ানিস্টদের মধ্যে অন্যতম প্রভাবশালী জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী, ভারতীয় বেদ, দর্শন ও ইসলাম ধর্মে সুপণ্ডিত ওকাওয়া শুমেই (১৮৮৬-১৯৫৭) বার্ধক্যে এসে একটি অসামান্য কাজ করেছেন। তিনি মূল আরবি ভাষা থেকে জাপানি ভাষায় পবিত্র আল-কোরআন অনুবাদ করেন হাসপাতালে অসুস্থ অবস্থায় ১৯৫০ সালে। এটা ছিল তার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন এবং এটাই জাপানি ভাষায় প্রথম অনুবাদ।
১৯৩৬ সালের দিকে আরেকজন ভারতীয় মুসলিম পণ্ডিত ও ধর্মপ্রচারক আলীমুল্লাহ্ সিদ্দিকী জাপানে আসেন এবং একাধিক বক্তৃতা দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান যখন এশিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্র দখল করে নেয়, সেসব দেশে অনেক জাপানি নাগরিক বিভিন্ন কর্মোপলক্ষে গমন এবং মুসলিম সংস্কৃতির প্রভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে বিখ্যাত জাপানি ব্যক্তিরাও ছিলেন। যুদ্ধের পর জাপানের সঙ্গে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হতে থাকে। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে পাকিস্তান থেকে একাধিক তবলিগ দল ও দলনেতা জাপানে আসেন। আধ্যাত্মিক চিন্তা সঞ্চারকারী এই আন্দোলনে বহু জাপানি ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হন মূলত শান্তির লক্ষ্যে।
সত্তর দশকের দিকে জাপানের দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণে সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি তেল উৎপাদনকারী মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং আজও তা কার্যকর। এশিয়ার দুটি মুসলিম রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার প্রভূত উন্নতির পেছনে জাপানের অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৭০ সালে সৌদি বাদশাহ ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ জাপান সফর করেন। এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।
আশি-নব্বই দশকে জাপানের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এশিয়া, আফ্রিকার প্রচুর মুসলিম ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক ও গবেষক উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আসতে থাকেন। অনুরূপ পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া থেকে অসংখ্য শ্রমিক এসে এদেশের কলকারখানা ও সার্ভিস ক্ষেত্রে কাজ করছেন, গড়ে তুলছেন মসজিদ, ছড়িয়ে দিচ্ছেন মুসলিম সংস্কৃতি, রেখে চলেছেন জাপানিদের সঙ্গে মৈত্রীবন্ধনে জোরালো ভূমিকা।
——লেখাটি জাপান প্রবাসীদের পড়ার জন্য দৈনিক সমকাল এর সৌজন্যে পুন: মুদ্রণ করা হয়েছে। লেখার সাথে ছবি ওসকা মসজিদে সম্পাদকের নেয়া।
Bibekbarta.com