হাদিস শিক্ষা – ৪ ।
লিখেছেন: ' দেশী৪৩২' @ বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২২, ২০১০ (৩:৪৮ পূর্বাহ্ণ)
১।শান্ত ও ধীরস্থিরভাবে সালাতের জন্য আসা
.আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন: “যখন সালাত আরম্ভ হয়ে যায়, তখন দৌড়ে গিয়ে তাতে শামিল হয়ো না। বরং ধীরস্থিরভাবে হেঁটে এসে তাতে শামিল হও। যতটুকু পাও আদায় করে নাও এবং যতটুকু ছুটে যায় পরে পূরণ করে নাও।” [বুখারী: ৯০৮, মুসলিম: ১৩৫৯]
২।ওহীর পর বাহ্যিক কর্মকাণ্ডেই ব্যক্তির মান নির্ণিত হবে
.আব্দুল্লাহ্ বিন উতবা বিন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,আমি উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বলতে শুনেছি: রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে মানুষকে ওহীর মাধ্যমে যাচাই করা হত। আর এখন তো ওহী বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং আমরা এখন থেকে তোমাদের যাচাই করবো তোমাদের বাহ্যিক কাজ-কর্মের ভিত্তিতে। যে ব্যক্তি আমাদের সামনে ভাল কাজের প্রকাশ ঘটাবে,আমরা তাতে বিশ্বাস করবো এবং তাকে নিকটবর্তী বলে গ্রহণ করে নেবো,আর তার আভ্যন্তরীণ ব্যাপার আমাদের দেখার দরকার নেই। আর যে ব্যক্তি মন্দ কাজের প্রকাশ ঘটাবে অর্থাৎ বাহ্যত মন্দ কাজ করবে,তবে সে যদিও বলে যে,তার আভ্যন্তরীণ অবস্থা খুবই ভাল, তবুও আমরা তার কথা মানবো না এবং তার কথা বিশ্বাসও করবো না। (ইমাম বুখারী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।)
৩।ইসলাম অন্যের অধিকার সংরক্ষণ করতে শেখায়
.সাহল বিন সা’দ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট একটি পাত্র আনা হলো, তিনি তা থেকে পান করলেন। তাঁর ডান পার্শ্বে উপস্থিত লোকদের মধ্যে একজন অল্পবয়সী বালক ছিল। আর বয়স্ক লোকেরা ছিল তাঁর বাম দিকে। তখন তিনি বললেন: “হে বালক! তুমি কি আমাকে অনুমতি দিবে যে, অবশিষ্টটুকু বয়স্ক লোকদেরকে দেয়ার জন্য?” সে বলল: হে আল্লাহর রাসূল! আপনার মুখ লাগানো পানীয় পান করার ব্যাপারে আমি নিজের চেয়ে অন্যকে অগ্রাধিকার দেব না। তখন তিনি বালকটিকে সে পানীয় দিলেন। [বুখারী: ২৩৫১]
৪।সৎকর্ম অসৎকর্মকে মিটিয়ে দেয়
.ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি একজন অপরিচিত মহিলাকে চুম্বন করার পর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে তা জানালে মহান আল্লাহ্ আয়াত অবতীর্ণ করলেন: ((দিনের দুই প্রান্তে অর্থাৎ, সকালে ও সন্ধ্যায় মাগরিব এবং রাতের কিছু অংশ অতিক্রম হলে এশার সালাত কায়েম কর। নেক ও সৎ কাজসমূহ অবশ্যই অসৎ কাজ সমূহকে সরিয়ে দেয়।)) এরপর লোকটি বলল: হে আল্লাহর রাসূল! এ নির্দেশ কি শুধু আমার জন্য? তিনি বলইসলামের পাঁচটি ভিত্তি
.ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “ইসলাম পাঁচটি ভিত্তির উপর স্থাপিত। (১) এ সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ্ ব্যতীত আর কোন সত্য মা’বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। (২) সালাত প্রতিষ্ঠা করা। (৩) যাকাত দেয়া। (৪) হজ্জ করা। (৫) রমাদানে সওম সাধনা করা। [বুখারী: ৮]
লেন: “আমার সমস্ত উম্মাতের জন্য”। [বুখারী: ৫২৬]
৫।কেয়ামতে যার হিসাব নেয়া হবে তাকে শাস্তি দেয়া হবে
.আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নিশ্চয়ই নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “(কেয়ামতের দিন) যার হিসাব নেয়া হবে তাকে শাস্তি দেয়া হবে।” আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন, আমি প্রশ্ন করলাম: আল্লাহ্ তা’আলা কি এরশাদ করেননি? ((অতিসত্ত্বর তার হিসাব নেয়া হবে সহজ-সরলভাবে)) তখন তিনি উত্তর দিলেন: “তা কেবল মাত্র পেশ করা হবে; কিন্তু যে হিসাবের সম্মুখীন হবে, সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে!” [বুখারী: ১০৩
৬।নিয়তের উপরই কর্মফল নির্ভর করে
.উমার বিন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন: “সব কাজই নিয়তের উপর নির্ভর করে। আর প্রত্যেক ব্যক্তি যা নিয়ত করে সে তাই পায়। অতএব, যার হিজরত দুনিয়া লাভের আশায় বা কোন মেয়েকে বিয়ে করার নিয়তে হয়েছে, তার হিজরত উক্ত উদ্দেশ্যেই হয়েছে।” [বুখারী: ১, মুসলিম: ১৯০৭]
৭।লজ্জা কল্যাণ ও মঙ্গল বয়ে আনে
.ইমরান বিন হুসাইন রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “লজ্জা কল্যাণই নিয়ে আসে।” [বুখারী: ৬১১৭, মুসলিম: ৩৭] মুসলিমের অপর বর্ণনায় আছে: “লজ্জার সম্পূর্ণটুকু মঙ্গলই মঙ্গল,” অথবা বলেছেন: “সম্পূর্ণ লজ্জাই মঙ্গলজনক।”
৮।যি কিরের ফযীলত
.আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “এমন দু’টি বাক্য আছে যা উচ্চারণ করতে খুবই সহজ, ওজন-দণ্ডের পরিমাপে খুবই ভারী, দয়াময় আল্লাহর নিকট খুবই প্রিয়। (বাক্য দু’টি হলো-) ‘সুবহানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল ‘আযীম’। (অর্থ: মহা পবিত্র আল্লাহ্, তাঁর জন্য সমস্ত প্রশংসা। মহা পবিত্র আল্লাহ্, তিনি মহামহিম।)” [মুত্তাফাকুন 'আলাইহি, বুখারী: ৬৪০৬, মুসলিম: ২৬৯৪]
9.বিশ্বাসঘাতক আল্লাহর প্রতিপক্ষ
.আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আল্লাহ্ বলেন: কেয়ামতের দিন আমি তিন ব্যক্তির প্রতিপক্ষ হব। যে ব্যক্তি আমার নামে ওয়াদা ও চুক্তি করে তা ভঙ্গ করেছে, যে ব্যক্তি মুক্ত-স্বাধীন মানুষ বিক্রি করে তার মূল্য ভক্ষণ করেছে এবং যে ব্যক্তি কাউকে মজুর নিয়োগ করে পুরোপুরি কাজ আদায় করে নিয়েছে কিন্তু তাকে মজুরী প্রদান করেনি।” [বুখারী: ২২২৭]
১০।চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না
.হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।” [মুত্তাফাকুন 'আলাইহি, বুখারী: ৬০৫৬, মুসলিম: ১০৫] নোট- গোলযোগ সৃষ্টি বা মানুষের মধ্যের পারস্পরিক কলহ-দ্বন্ধ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে একের কথা অন্যকে বলা বা লাগানি-ভাঙ্গানী করাকে চোগলী বলা হয় আর যে ব্যক্তি এমন নিকৃষ্ট কাজ করে থাকে তাকে চোগলখোর বলা হয়।
11.কাঠিন্যতা নয়; সহজতার জন্যই প্রেরিত
.আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “এক বেদুঈন মসজিদে প্রশ্রাব করে দিলে লোকেরা তাকে মারার জন্য উঠে দাঁড়ালো। তখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তাকে ছেড়ে দাও এবং তার পেশাবের উপর এক বালতি পানি বইয়ে দাও। কেননা, তোমরা সহজতা অবলম্বী হিসেবে প্রেরিত হয়েছ, কাঠিন্যতা অবলম্বী হিসেবে প্রেরিত হওনি।” [বুখারী: ২২০]
12.
দাজ্জালের সাথে মুমিনের ঘটনা
.আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “দাজ্জাল আত্মপ্রকাশ করলে মুমিনদের একজন তার নিকট যাবে। পথে তার সাথে দাজ্জালের পাহারাদারদের দেখা হলে, তারা তাকে জিজ্ঞেস করবে: কোথাকার ইচ্ছায় বেরিয়েছ? সে বলবে: আমি এই আত্মপ্রকাশকারী ব্যক্তির কাছে যেতে চাই। তারা বলবে: আমাদের প্রভুর প্রতি কি তুমি ঈমান রাখ না? সে বলবে: আমাদের প্রভুর ব্যাপারে তো অপ্রকাশ্য কিছু নেই। তারা বলবে: একে হত্যা কর। অতঃপর তাদের কিছু লোক অন্য কিছু লোককে বলবে: তোমাদের প্রভু কি তোমাদেরকে তার অনুমতি ব্যতীত কাউকে হত্যা করতে নিষেধ করেনি? ফলে তারা তাকে দাজ্জালের কাছে নিয়ে যাবে। যখন মুমিন লোকটি দাজ্জালকে প্রত্যক্ষ করবে তখন বলবে: হে লোকসকল! এ সেই দাজ্জাল যার আলোচনা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেছেন। অতঃপর দাজ্জালের আদেশে তাকে উপুড় করে শোয়ানো হবে। দাজ্জাল বলবে: ওকে ধরে তার পিঠ ও মাথায় প্রহার কর। তাকে প্রহার করার কারণে তার পেট ও পিঠ চওড়া হয়ে যাবে। সে বলবে: তুমি কি আমাকে বিশ্বাস কর না? সে বলবে: তুমি তো মিথ্যাবাদী মাসীহ দাজ্জাল। অতঃপর তার হুকুমে মুমিন ব্যক্তির মাথার সিঁথি থেকে দু’পায়ের মধ্য পর্যন্ত করাত দিয়ে চিরে দু’টুকরো করে দেয়া হবে। অতঃপর দাজ্জাল দুই টুকরার মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাবে এবং লাশকে সম্বোধন করে বলবে: উঠ। তখন সে পূর্ণরূপে (জীবিত হয়ে) উঠে দাঁড়াবে। অতঃপর (দাজ্জাল) তাকে জিজ্ঞেস করবে: তুমি কি আমার প্রতি ঈমান এনেছ? সে বলবে: তোমার সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পেল। তারপর বলবে: হে লোকেরা! এ দাজ্জাল আমার পরে মানুষের মধ্য হতে আর কারো কোন কিছু করতে পারবে না। অতঃপর দাজ্জাল তাকে যবেহ্ করার জন্য ধরবে। তখন আল্লাহ্ তা’আলা তার গর্দান থেকে গলার নিচের হাড়ের মধ্যমাংশকে পিতলে পরিণত করবেন। ফলে সে তাকে হত্যা করতে সক্ষম হবে না। শেষে সে তার দু’হাত ও দু’পা ধরে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। এ দেখে লোকেরা ধারণা করবে যে, তাকে আগুনে নিক্ষেপ করল। বাস্তবে তাকে জান্নাতে ফেলা হলো। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: নিখিল বিশ্বের প্রতিপালকের নিকট এই ব্যক্তিই সবচেয়ে বড় শহীদ।” [বুখারী: ৭১৩২, মুসলিম: ২৯৩৮]
13.কেয়ামতে সাত ধরনের ব্যক্তি আল্লাহর ছায়ায় আশ্রয় পাবে
.আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ্ তাঁর ছায়াতলে আশ্রয় দেবেন, যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়াই অবশিষ্ট থাকবে না। (তারা হলো: ১) ন্যায়পরায়ন শাসক, (২) যে যুবক আল্লাহর ইবাদাতের মধ্যে বড় হয়েছে, (৩) যে ব্যক্তি মসজিদ থেকে বেরিয়ে গেলেও তার অন্তর এর সাথে সম্পৃক্ত থাকে, (৪) এমন দু’জন লোক যারা আল্লাহর জন্য পরস্পর ভালবাসা স্থাপন করেছে; এই সম্পর্কেই একত্র থাকে এবং বিচ্ছিন্ন হয়, (৫) এমন ব্যক্তি যাকে কোন অভিজাত পরিবারের সুন্দরী রূপসী নারী (খারাপ কাজে) আহ্বান করেছে কিন্তু সে তাকে এই বলে প্রত্যাখ্যান করেছে; আমি আল্লাহকে ভয় করি, (৬) এমন ব্যক্তি যে এত গোপনের দান-সদকা করেছে যে, তার ডান হাত যা দান করেছে তার বাম হাতও তা জানতে পারেনি যে, ডান হাত কি দান করেছে, (৭) যে ব্যক্তি নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করেছে এবং তার দু’চোখ বয়ে পানি পড়েছে।” [বুখারী: ৬৬০, মুসলিম: ১০৩১]