লগইন রেজিস্ট্রেশন

-আব্দুস শহীদ নাসিম এর লেখা- মানুষের চিরশত্রু শয়তান।

লিখেছেন: ' দেশী৪৩২' @ বুধবার, জুন ৩০, ২০১০ (৪:০৫ পূর্বাহ্ণ)

মানুষের চিরশত্রু শয়তান

اَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ

১.শয়তান সম্পর্কে মানুষকে আল্লাহর সতর্কবাণী

মহান আল্লাহ মানুষকে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে অতি উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন, সম্মানিত করেছেন তাকে অনেক গুণ বৈশিষ্ট্য দিয়ে। তিনি বলেছেন :

وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْنَاهُم مِّنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَىٰ كَثِيرٍ مِّمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلًا

অর্থ : আর আদম সন্তানদের আমি দান করেছি সম্মান ও মর্যাদার আসন। তাদের পরিবহনের ব্যবস্থা করে দিয়েছি স্থলভাগ এবং জলভাগে। তাদের জীবন যাপনের উপকরণ হিসেবে সরবরাহ করেছি যাবতীয় উত্তম সামগ্রী। আর আমার অনেক সৃষ্টির উপরই তাদের প্রদান করেছি শ্রেষ্ঠত্ব। (সূরা ১৭ ইসরা : আয়াত ৭০)

মানুষ আল্লাহর ইবাদত ও খিলাফতের তথা তাঁর দাসত্ব ও প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে অধিষ্ঠিত থাকতে পারে এই মর্যাদার আসনে। মানুষের এই মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের মূল কারণ আল্লাহর দাসত্ব ও প্রতিনিধিত্ব। এই দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যেই তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু, সে যদি এই দায়িত্ব পালন থেকে বিচ্যুত হয়, কিংবা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন না করে, তখন সে অনিবার্যভাবে বিচ্যুত হয়ে পড়ে তার সেই মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের আসন থেকে :

ثُمَّ رَدَدْنَاهُ أَسْفَلَ سَافِلِينَ

‘তারপর আমি তাকে নামিয়ে দিই নিচুদের চাইতেও নিচে।’ (সূরা আত তীন : ৫)

মানুষের পেছনে লেগে এ দায়িত্বই পালন করে শয়তান। মানুষকে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের সহজ-সরল-সঠিক পথ থেকে বিভ্রান্ত ও বিচ্যুত করে তার প্রকৃত মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের আসন থেকে তাকে নিচে নামিয়ে দেয়াই শয়তানের প্রানান্তকর প্রচেষ্টা। এরি জন্যে সে মরিয়া হয়ে কাজ করে। এটাই তার জীবনের একমাত্র প্রতিজ্ঞা, একমাত্র অংগিকার।

কিন্তু মানুষ তার এই স্বঘোষিত সুস্পষ্ট শত্রুর বিষয়ে অচেতন, অসতর্ক ও গাফিল। যুগে যুগে আল্লাহ তায়ালা নবী রসূলগণের মাধ্যমে মানুষকে শয়তান সম্পর্কে সতর্ক করে আসছেন। শয়তানের ধোকা, প্রতারণা ও বিভ্রান্তি থেকে বাঁচার উপায় তাকে বলে দিয়েছেন।

আখেরি নবী মুহাম্মদ সা.-এর মাধ্যমে তিনি গোটা বিশ্ববাসীকে শয়তান সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন। তাঁর প্রতি তিনি বিশ্ববাসীর জন্যে নাযিল করেছেন আল কুরআন। চিরস্থায়ীভাবে হিফাযত করেছেন এ কিতাবকে। এই মহাগ্রন্থ আল কুরআনে তিনি কিয়ামত পর্যন্তকার মানবজাতিকে শয়তানের চরম শত্র“তা সম্পর্কে বারবার সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। আহবান জানিয়েছেন শয়তানের প্রতারণা থেকে আত্মরক্ষা করতে, শয়তানের পদাংক অনুসরণ না করতে, তার আনুগত্য ও দাসত্ব না করতে :

يَا بَنِي آدَمَ لاَ يَفْتِنَنَّكُمُ الشَّيْطَانُ كَمَا أَخْرَجَ أَبَوَيْكُم مِّنَ الْجَنَّةِ يَنزِعُ عَنْهُمَا لِبَاسَهُمَا لِيُرِيَهُمَا سَوْآتِهِمَا ۗ إِنَّهُ يَرَاكُمْ هُوَ وَقَبِيلُهُ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ ۗ إِنَّا جَعَلْنَا الشَّيَاطِينَ أَوْلِيَاءَ لِلَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ

অর্থ : হে আদম সন্তানেরা (সতর্ক হও)! শয়তান যেনো ধোকা প্রতারণার (ফবপবরাব) মাধ্যমে তোমাদের দায়িত্ব কর্তব্য পালন থেকে বিচ্যুত করে) ভুল পথে পরিচালিত করতে না পারে, যেভাবে সে (ধোকা প্রতারণার মাধ্যমে) তোমাদের (আদি) পিতা-মাতাকে জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছিল। তাদের পরস্পরকে তাদের গোপন অংগ দেখানোর জন্যে সে তাদের বিবস্ত্র করে দিয়েছিল। সে এবং তার দলবল এমনভাবে (বা এমন স্থান থেকে) তোমাদের দেখতে পায় যেখান থেকে তোমরা তাদের দেখতে পাওনা। আমি শয়তানগুলোকে সেই সব লোকদের অলি (অভিভাবক) বানিয়ে দিয়েছি, যারা ঈমান আনেনা, ঈমানের পথে চলেনা। (সূরা ৭ আল আ’রাফ : আয়াত ২৭)

وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ ۚ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ

অর্থ : তোমরা শয়তানের পদাংক অনুসরণ করোনা, নিশ্চয়ই সে তোমাদের ডাহা দুশমন। (সূরা ২ আল বাকারা : আয়াত ১৬৮)

وَلَا يَصُدَّنَّكُمُ الشَّيْطَانُ ۖ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ

অর্থ : (হে মানুষ!) শয়তান যেনো (সত্য-সঠিক-সরল পথে চলতে) তোমাদের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে না পারে। জেনে রাখো, সে তোমাদের সুস্পষ্ট শত্রু। (সূরা ৪৩ যুখরুফ : আয়াত ৬২)

يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ ۖ فَلَا تَغُرَّنَّكُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا ۖ وَلَا يَغُرَّنَّكُم بِاللَّهِ الْغَرُورُ إِنَّ الشَّيْطَانَ لَكُمْ

عَدُوٌّ فَاتَّخِذُوهُ عَدُوًّا ۚ إِنَّمَا يَدْعُو حِزْبَهُ لِيَكُونُوا مِنْ أَصْحَابِ السَّعِيرِ

অর্থ : হে মানুষ! নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াদা হক (সত্য); সুতরাং এই পৃথিবীর জীবন যেনো কিছুতেই তোমাদের প্রলুব্ধ ও প্রতারিত না করে এবং সেই মহা প্রতারক (শয়তান)ও যেনো আল্লাহ সম্পর্কে তোমাদের ধোকায় না ফেলে। শয়তান তো তোমাদের ডাহা শত্রু। সুতরাং তাকে শত্রু হিসেবে গ্রহণ করো। সে তো তার অনুসারীদের (এমন সব কাজের) আহবান জানায়, যাতে তারা জাহান্নামের জ্বলন্ত আগুনের অধিবাসী হয়ে যায়। (সূরা ৩৫ ফাতির : আয়াত ৫-৬)

মহান আল্লাহ এসব অকাট্য ও বিবেক জাগ্রতকারী সতর্কবাণী দ্বারা কি মানুষ শয়তানের ধোকা, প্রতারণা ও ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সতর্ক হবেনা?

২.শয়তান আল্লাহর অবাধ্য, মানুষের চরম দুশমন এবং মহাপ্রতারক

শয়তান সম্পর্কে মানুষের সুস্পষ্ট ধারণা থাকা জরুরি। কারণ যে ব্যক্তি শত্রুর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখেনা, সে সহজেই শত্রুর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়। দেখুন শয়তান সম্পর্কে মহান আল্লাহ কী বলেন :

১. শয়তান আল্লাহর চরম অবাধ্য : إِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلرَّحْمَـٰنِ عَصِيًّا ‘শয়তান দয়াময় রহমানের চরম অবাধ্য-নাফরমান।’ (সূরা মরিয়ম : আ. ৪৪)

২.শয়তান আল্লাহর প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ : وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُورًا ‘শয়তান তার প্রভুর প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।’ (সূরা ১৭ ইসরা : আয়াত ২৭)

৩.শয়তান মানুষের স্বঘোষিত সুস্পষ্ট দুশমন : ِاِنَّ الشَّيْطَانَ لِلْإِنسَانِ عَدُوٌّ مُّبِينٌ ‘নিশ্চয়ই শয়তান মানুষের সুস্পষ্ট শত্রু।’ (সূরা ১২ ইউসুফ : আয়াত ৫)

৪.শয়তান মানুষের জন্যে মহাপ্রবঞ্চক : وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِلْإِنسَانِ خَذُولًا ‘অবশ্যি শয়তান মানুষের জন্যে মহাপ্রবঞ্চক, মহা ধোকাবাজ।’ (সূরা ২৫: ২৯)

৫.শয়তান মুমিনদেরকে তার বন্ধুদের ভয় দেখায় : إِنَّمَا ذَ‌ٰلِكُمُ الشَّيْطَانُ يُخَوِّفُ أَوْلِيَاءَهُ
‘এ হলো শয়তান। সে তোমাদেরকে তার বন্ধুদের ভয় দেখায়।’ (সূরা ৩ : ১৭৫)

৬.শয়তানের সংকল্প মানুষকে চরম বিপথগামী করা : وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَن يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا : ‘শয়তান তাদেরকে সঠিক পথ থেকে বিভ্রান্ত করে বহুদূর নিয়ে যেতে চায়।’ (সূরা ৪ আন নিসা : আয়াত ৬০)

৭.মানুষের সামনে শয়তানের সব প্রতিশ্রুতিই প্রতারণা : وَمَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطَانُ إِلَّا غُرُورًا : ‘শয়তানের সমস্ত ওয়াদাই প্রতারণা আর ধোকাবাজি।’ (সূরা ১৭ ইসরা : আয়াত ৬৪)

৮.শয়তান মহাপ্রতারক : وَلاَ يَغُرَّنَّكُمْ بِاللهِ الْغُرُوْرَ ‘মহাপ্রতারক যেনো আল্লাহর ব্যাপারে তোমাদেরকে ধোকায় না ফেলে। (সূরা লোকমান : ৩৩ ; সূরা ফাতির : ৫)

৩. শয়তানের পরিচয়

আরবি ভাষায় শয়তান (شَيْطَانٌ) মানে- সীমালংঘনকারী, দাম্ভিক, স্বৈরাচারি।১ এই বৈশিষ্ট্যের জিন এবং মানুষ উভয়ের জন্যেই শয়তান পরিভাষা ব্যবহার করা হয়। কুরআন মজিদে উভয়ের জন্যে শয়তান পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, সূরা আল বাকারার ১৪ নম্বর আয়াতে ইসলামের বিরুদ্ধাচারী নেতাদের শয়তান বলা হয়েছে। شَيْطَانٌ-এর বহুবচন شَيَاطِيْنٌ। শয়তান শব্দটি একটি পরিভাষা হিসেবে প্রাচীন কাল থেকেই সকল ধর্মের লোকদের কাছে একটি সুপরিচিত শব্দ। এ শয়তান জিনদের অন্তরভুক্ত২। শয়তান কথাটি সর্বপ্রথম সেই জিনটির জন্যে ব্যবহার করা হয়েছে, যে আল্লাহ্র নির্দেশ অমান্য করে প্রথম মানুষ আদম আলাইহিস্ সালামকে সাজদা করতে অস্বীকৃতি জানায়। কুরআন মজিদে শয়তান শব্দটি একবচন ও বহুবচনে ৮৮ বার ব্যবহৃত হয়েছে।
শয়তানকে কুরআন মজিদে ইবলিসও বলা হয়েছে।৩ بَلَسٌ ও اِبْلاَسٌ শব্দমূল থেকে اِبْلِيْسٌ শব্দটি এসেছে। এর অর্থ হলো, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাওয়া, ভয়ে ও আতংকে নিথর হয়ে যাওয়া, দু:খে ও শোকে মনমরা হয়ে যাওয়া, সবদিক থেকে নিরাশ হয়ে সাহস হারিয়ে ফেলা এবং হতাশা ও ব্যর্থতার ফলে মরিয়া (desperate) হয়ে উঠা।

শয়তানকে ইবলিস বলার কারণ হলো, হতাশা ও নিরাশার ফলে তার আহত অহমিকা প্রবল উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং সে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে মরণ খেলায় নেমে সব ধরণের অপরাধ সংঘটনে উদ্যত হয়।৪ কুরআন মজিদে ইবলিস শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ১১ বার।
শয়তানকে কুরআন মজিদে খান্নাসও বলা হয়েছে।৫ خَنَّاسٌ শব্দটি خُنُوْسٌ শব্দমূল থেকে নির্গত হয়েছে। এর অর্থ- সামনে এসে আবার পিছিয়ে যাওয়া, প্রকাশ হয়ে আবার গোপন হয়ে যাওয়া। খান্নাস আধিক্যবোধক শব্দ। সুতরাং এর অর্থ বারবার সামনে আসা এবং পিছিয়ে যাওয়া, বারবার প্রকাশ হওয়া এবং গোপন হয়ে যাওয়া।

শয়তানকে খান্নাস বলা হয়েছে এ কারণে যে, সে বারবার এসে প্ররোচনা দেয় এবং বারবার পিছিয়ে এবং লুকিয়ে যায়। এভাবে সে প্ররোচনা দিতেই থাকে। ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন : মানুষ যখন গাফিল ও অসতর্ক-অসচেতন হয়, তখনই শয়তান এসে তাকে প্ররোচনা ও ধোকা দেয়; কিন্তু যখনই সে সতর্ক হয় এবং আল্লাহকে স্মরণ করে, তখন শয়তান পিছিয়ে যায়, লুকিয়ে যায়। এ কারণেই শয়তানকে খান্নাস বলা হয়েছে।৬ কুরআন মজিদে খান্নাস শব্দ ব্যবহার হয়েছে ১ বার।

কুরআন মজিদে শয়তানকে আল গারুর (اَلْغَرُوْرٌ)ও বলা হয়েছে। এর শব্দমূল হলো গরর (غَرَرٌ)। গরর মানে- ধোকা-প্রতারণা। আল গারূর মানে- মহা ধোকাবাজ, মহাপ্রতারক। কুরআন মজিদে ৩ স্থানে শয়তানকে আল গারূর বলা হয়েছে।

৪.শয়তানের পূর্ব ইতিহাস

কুরআন মজিদের সূরা কাহাফের ৫০ (পঞ্চাশ) নম্বর আয়াতে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে, ইবলিস শয়তান জিন গোত্রীয়। আর জিনদের সৃষ্টি করা হয়েছে আগুন থেকে। সুতরাং শয়তান আগুনের তৈরি জিন জাতির অন্তর্ভুক্ত।
মুফাস্সির এবং ঐতিহাসিক ইবনে জারির তাবারি এবং ইবনে কাছির তাঁদের তফসির এবং ইতিহাস গ্রন্থাবলীতে সাহাবী ইবনে আব্বাস রা. , ইবনে মাসউদ রা. এবং তাবেয়ী হাসান বসরি, তাউস, সায়ীদ ইবনে মুসাইয়্যেব, সা’দ ইবনে মাসউদ, শহর ইবনে হোশেব, কাতাদা প্রমুখ থেকে শয়তান ইবলিসের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। তাঁদের বর্ণনার সংক্ষিপ্ত সার হলো :
মানুষের পূর্বে আল্লাহর পক্ষ থেকে পৃথিবীর প্রতিনিধিত্বের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলো জিন জাতি। তারা ছিলো আগুনের তৈরি এবং দীর্ঘজীবী। একসময় এসে তারা পারস্পারিক বিবাদ বিসম্বাদে পৃথিবীকে চরম বিপর্যস্ত করে তোলে। তাদের দুষ্কর্মে ও ফিতনা ফাসাদে ভরে যায় পৃথিবী। তখন মহান আল্লাহ তাদেরকে পৃথিবীর কর্তৃত্ব থেকে অপসারণ করার সিদ্ধান্ত নেন। ফেরেশতাদের পাঠান তাদের কর্তৃত্ব ধ্বংস করতে এবং তাদের বিতাড়িত করতে। ফেরেশতারা এসে জিনদের একদলকে ধ্বংস করে দেন, কিছু জিনকে সমুদ্রের দিকে তাড়িয়ে দেন আর কিছু জিনকে তাড়িয়ে দেন পাহাড় পর্বতের দিকে। এভাবে মহান আল্লাহ পৃথিবী পরিচালনার কর্তৃত্ব থেকে জিনদের উচ্ছেদ করেন এবং তাদের কর্তৃত্বের ক্ষমতা বিনাশ করে দেন।

এই ফেরেশতাদল পৃথিবী থেকে ফিরে যাবার সময় আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে একটি জিন শিশুকে সাথে করে নিয়ে যায়। তার নাম ছিলো আযাযিল। সে ফেরেশতাদের সাথে বসবাস করতে থাকে এবং আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদত বন্দেগির ক্ষেত্রে ফেরেশতাদের গুণ বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। এভাবে সে ফেরেশতাদের সাথে মিশে যায়। পরবর্তীকালে এই আযাযিলই শয়তান এবং ইবলিস হিসেবে পরিচিত হয়।৭

৫.ইবলিস আল্লাহর হুকুম সত্ত্বেও আদমকে সাজদা করেনি

পৃথিবী থেকে জিনদের কর্তৃত্ব বিলুপ্ত করার পর মহান আল্লাহ ঘোষণা করলেন :

إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً

অর্থ : আমি পৃথিবীতে (নতুন করে) প্রতিনিধি/আরেকটি প্রজন্ম সৃষ্টি করতে যাচ্ছি। (সূরা ২ আল বাকারা : আয়াত ৩০)

অর্থাৎ পৃথিবীর ব্যবস্থাপনা পরিচালনার জন্যে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্যে আল্লাহ একটি নতুন প্রজাতি সৃষ্টি করার মনস্থ করলেন। এ প্রজাতির নাম দিলেন তিনি ‘মানুষ’। সৃষ্টি করলেন তিনি এ প্রজাতির প্রথম মানুষ আদমকে। পৃথিবীর প্রতিনিধিত্ব করার সব জ্ঞান দান করলেন তিনি আদমকে। পৃথিবীর প্রতিনিধিত্বের কর্তৃত্ব পরিচালনার জন্যে প্রয়োজন ফেরেশতাদের সহযোগিতা। তাই মহান আল্লাহ ফেরেশতাদের হুকুম করলেন আদমকে সাজদা করতে। অর্থাৎ আদম ও তার সন্তানদের আনুগত্য করার প্রতীকি প্রমাণ পেশ করতে। ফেরেশতারা সবাই আদমকে সাজদা করে। কিন্তু সাজদা করতে অস্বীকৃতি জানায় ইবলিস :

ثُمَّ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ لَمْ يَكُنْ مِنَ السَّاجِدِيْن

অর্থ : অতপর আমরা ফেরেশতাদের বললাম : ‘আদমের উদ্দেশ্যে সাজদা করো।’ তখন সবাই সাজদা করলো ইবলিস ছাড়া। সে সাজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হলোনা। (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ১১)

وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ

অর্থ : আমরা যখন ফেরেশতাদের আদেশ করলাম : ‘তোমরা সাজদা করো আদমকে।’ তখন সাজদা করলো সবাই; ইবলিস্ ছাড়া। (সূরা ০২ আল বাকরা : আয়াত ৩৪; সূরা ১৭ ইসরা : আয়াত ৬১; সূরা ১৮ আল কাহাফ : আয়াত ৫০)

فَسَجَدَ الْمَلَائِكَةُ كُلُّهُمْ أَجْمَعُونَ إِلَّا إِبْلِيسَ

অর্থ : তখন সাজদা করলো ফেরেশতারা সকলেই ইবলিস্ ছাড়া। (সূরা ১৫ আল হিজর : আয়াত ৩০-৩১; সূরা ৩৮ সোয়াদ : আয়াত ৭৩-৭৪)

আল্লাহ ইবলিসকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার নির্দেশ সত্ত্বেও কোন্ জিনিস তোমাকে সাজদা থেকে বিরত রেখেছে?

قَالَ أَنَا خَيْرٌ مِّنْهُ خَلَقْتَنِي مِن نَّارٍ وَخَلَقْتَهُ مِن طِينٍ

অর্থ : সে বললো : আমি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছো আগুন থেকে আর ওকে সৃষ্টি করেছো মাটি থেকে। (সূরা ৭ আল আ’রাফ : আয়াত ১২)

৬.সাজদা করার হুকুম কি শয়তানের উপর বর্তায়?

প্রশ্ন করা যেতে পারে, আল্লাহ তায়ালা সাজদা করার আদেশ তো করেছেন ফেরেশতাদের। শয়তান তো ফেরেশতা ছিলোনা, ছিলো জিন, তাহলে সাজদা করার হুকুম তার উপর বর্তায় কী করে? সে সাজদা না করায় তার কী অপরাধ হলো?

এটি কোনো জটিল প্রশ্ন নয় এবং অবোধগম্য বিষয়ও নয়। মানব জীবনে প্রচলিত ও সংঘটিত বিষয়গুলোই যদি আমরা দেখি, তবে দেখতে পাই একটি বিষয়ের একটি বাহ্যিক অর্থ থাকে, আবার একটি সংশ্লিষ্ট এবং বিবেচ্য অর্থও থাকে। যেমন, বাবুল পিস্তল দিয়ে গুলি করে যায়েদকে হত্যা করলো। তার এই হত্যা কান্ডের বিষয়টি সাক্ষ্য প্রমাণ এবং তার আত্মস্বীকৃতির মাধ্যমে প্রমাণিত হওয়ায় সে খুনি সাব্যস্ত হলো।

কিন্তু এখানে কিছু সংশ্লিষ্ট ও বিবেচ্য বিষয় থেকে যায়। তাহলো, খুন কি সে স্বপ্রণোদিত হয়ে করেছে? নাকি কারো নির্দেশে করেছে? সাক্ষ্য প্রমাণ এবং স্বীকৃতির মাধ্যমে প্রমাণিত হলো, ফজল শেখের নির্দেশে সে যায়েদকে হত্যা করেছে। ফজল শেখই তাকে পিস্তল সরবরাহ করেছে। তাই ফজল শেখ গুলি না করেও যায়েদের হত্যাকান্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং সেও একজন খুনি।

ঠিক ভালো কাজের ব্যাপারেও এই উদাহরণ প্রযোজ্য। যেমন আবু বকর চাঁদপুরের শাহাপুরে একটি মসজিদ নির্মাণ করলেন। তাই তিনি এ মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু মসজিদটি নির্মাণের অর্থ সরবরাহ করেছেন ঢাকার হাজী মুহাম্মদ মাহবুব। সুতরাং এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে হাজী মাহবুবও বিবেচ্য।

যেমন, আহমদ জন্মগতভাবে একজন বাংলাদেশী। ঢাকায় তার জন্ম, এখানেই পড়ালেখা করেছেন। পরে আমেরিকা গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি চাকরি লাভ করেন। একদিন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্দেশ ঘোষণা করলেন : হে আমেরিকানরা আগামিকাল থেকে আপনারা সকল ১০টার পরিবর্তে সকাল ৯টায় অফিসে আসবেন। এই নির্দেশটি আমেরিকানদের মতো বাংলাদেশী আহমদ-এর উপরও বর্তাবে। কারণ, তিনি আমেরিকানদের নিয়মকানুন রীতিনীতি অনুসরণ করে আমেরিকায় চাকুরি করেন।

আদমকে সাজদা করার যে নির্দেশ আল্লাহ পাক ফেরেশতাদের দিয়েছিলেন, সে নির্দেশ ফেরেশতাদের মতোই আযাযিল শয়তানের উপরও বর্তিয়েছিল। কারণ :

১.সে ফেরেশতাদের দলভুক্তির মর্যাদা লাভ করেছিল।
২.সে ফেরেশতাদের আইন কানুন ও নিয়মরীতিই মেনে চলছিল।
৩.সে ফেরেশতাদের মতোই আল্লাহর ইবাদত বন্দেগি ও হুকুম আহকাম পালন করছিল।
৪.সে ফেরেশতা চরিত্র অর্জন করেছিল।
৫.নির্দেশদানের মুহূর্তে সে ফেরেশতাদের মজলিসেই উপস্থিত ছিলো।

সুতরাং আযাযিলও যে এই নিদের্শের আওতাভুক্ত ছিলো তাতে আর কোনো প্রকার সন্দেহ নেই। এ ক্ষেত্রে দুইটি অকাট্য দলিল সকল সংশয়ীর সংশয় নিরসনের জন্যে যথেষ্ট। সেগুলো হলো :

১.মহান আল্লাহ ইবলিসকে বাদ দিয়ে নয়, তাকে সহই ফেরেশতাদের সাজদা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাইতো সাজদা না করার কারণে তিনি ইবলিসকে প্রশ্ন করলেন :

قَالَ مَا مَنَعَكَ أَلَّا تَسْجُدَ إِذْ أَمَرْتُكَ

অর্থ : আল্লাহ বললেন : (হে ইবলিস) আমি নির্দেশ দেয়া সত্তেও কোন্ জিনিস তোমাকে সাজদা করা থেকে বিরত রেখেছে? (সূরা ৭ আল আরাফ : আয়াত ১২)

قَالَ يَا إِبْلِيسُ مَا لَكَ أَلَّا تَكُونَ مَعَ السَّاجِدِينَ

অর্থ আল্লাহ বললেন : হে ইবলিস ! তোমার কী হলো যে, তুমি সাজদা কারীদের অন্তর্ভুক্ত হলেনা? (সূরা ১৫ আল হিজর : আয়াত ৩২)

قَالَ يَا إِبْلِيسُ مَا مَنَعَكَ أَن تَسْجُدَ لِمَا خَلَقْتُ بِيَدَيَّ ۖ أَسْتَكْبَرْتَ أَمْ كُنتَ مِنَ الْعَالِينَ

অর্থ : আল্লাহ বললেন : হে ইবলিস! আমি যাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছি , তাকে সাজদা করতে কিসে তোমাকে বাধা দিলো? তুমি কি ঔদ্ধত্য দেখালে, নাকি তুমি উচু মর্যাদার কেউ? (সূরা ৩৮ সোয়াদ : আয়াত ৭৫)

এখন একথা পরিষ্কার হয়ে গেলো, মহান আল্লাহ ইবলিসকে সহই ফেরেশতাদেরকে সাজদা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তা না হলে ইবলিসের কাছে সাজদা না করার কৈফিয়ত তলব করার কোনো কারণ ছিলনা।

২.দ্বিতীয় যে বিষয়টি ইবলিসকে সাজদা করার নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত প্রমাণ করে, সেটা হলো স্বয়ং ইবলিসের স্বীকৃতি এবং অস্বীকৃতি।

অর্থাৎ এ নির্দেশ যে ইবলিসের উপরও বর্তিয়েছিল, সেটা ইবলিস নিজেও স্বীকার করে নিয়েছিল। সে আল্লাহর কৈফিয়ত তলবের জবাবে একথা বলে নাই যে, নির্দেশ তো আমাকে দেন নাই, দিয়েছেন ফেরেশতাদেরকে।

তাছাড়া নির্দেশ পালনে তার অস্বীকৃতিও প্রমান করে যে, তাকেও সাজদা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। সে আল্লাহর নির্দেশ পালনে অস্বীকৃতি জানায় এবং যুক্তি প্রদর্শন করে। দেখুন আল্লাহ্র কৈফিয়ত তলবের জবাবে তার বক্তব্য :

قَالَ أَنَا خَيْرٌ مِّنْهُ ۖ خَلَقْتَنِي مِن نَّارٍ وَخَلَقْتَهُ مِن طِينٍ

অর্থ : সে (জবাবে) বললো : (আমি তাকে সাজদা করতে পারিনা, কারণ) আমি তার চাইতে উত্তম-শ্রেষ্ঠ। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন আগুন দিয়ে আর তাকে সৃষ্টি করেছেন কাদামাটি দিয়ে। (সূরা ৭ আ’রাফ: আয়াত ১২; সুরা ৩৮ সোয়াদ: আয়াত ৭৬)

قَالَ أَأَسْجُدُ لِمَنْ خَلَقْتَ طِينًا ؟

অর্থ : (জবাবে ইবলিস) বললো : আমি কি এমন একজনকে সাজদা করবো যাকে আপনি সৃষ্টি করেছেন কাদামাটি দিয়ে? (সূরা ১৭ ইসরা : আয়াত ৬১)

قَالَ لَمْ أَكُن لِّأَسْجُدَ لِبَشَرٍ خَلَقْتَهُ مِن صَلْصَالٍ مِّنْ حَمَإٍ مَّسْنُونٍ

অর্থ : সে বললো : গন্ধযুক্ত কাদার ঠনঠনে মাটি দিয়ে আপনি যে মানুষ সৃষ্টি করেছেন, আমি তাকে সাজদা করতে পারিনা। (সূরা ১৫ হিজর : আয়াত ৩৩)

এখন একথা দিবালোকের মতোই পরিষ্কার হয়ে গেলো, ইবলিস কোনো প্রকার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ছাড়াই একেবারে সহজ সরলভাবে বুঝে নিয়েছিল, সেও সাজদা করার নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। সুতরাং যার ব্যাপারে প্রশ্ন, তারই যখন কোনো প্রশ্ন নেই, তখন আমি আপনি প্রশ্ন তোলার কে?

৭. ইবলিস জেনে বুঝেই আল্লাহর হুকুম পালন করতে অস্বীকার করে

একথা পরিষ্কার, ইবলিসও সাজদা করার হুকুমের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। জেনে বুঝেই সে আল্লাহর আদেশ পালন করেনি এবং আল্লাহর আদেশ পালন করতে অস্বীকার করে। তার এই অস্বীকৃতির ধরণ কেমন ছিলো? এ প্রসঙ্গে দেখুন আল্লাহর বাণী :

أَبَىٰ وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ

অর্থ : সে (আল্লাহ্র নির্দেশমতো আদমকে সাজদা করতে) অস্বীকৃতি জানায়, অহংকার ও দাম্ভিকতা প্রদর্শন করে এবং কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। (সূরা ২ আল বাকারা : আয়াত ৩৪; সূরা ৩৮ সোয়াদ : আয়াত ৭৪)

أَبَىٰ أَن يَكُونَ مَعَ السَّاجِدِينَ

অর্থ : সে সাজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করে। (সূরা ১৫ হিজর : আয়াত ৩১)

كَانَ مِنَ الْجِنِّ فَفَسَقَ عَنْ أَمْرِ رَبِّهِ

অর্থ : সে ছিলো জিন প্রজাতির। সে তার প্রভুর নির্দেশ মান্য করতে অস্বীকার করে এবং সীমালংঘন করে। (সূরা ১৮ আল কাহাফ : আয়াত ৫০)

এখানে ইবলিসের সাজদা না করার ক্ষেত্রে অস্বীকৃতি, অহংকার-দাম্ভিকতা, কুফুরি এবং সীমালংঘনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। জেনে বুঝে হুকুম অমান্য করার ক্ষেত্রেই এ শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

৮. শয়তানের গুরুতর অপরাধ সমূহ

আদমকে সাজদা করার ব্যাপারে আল্লাহর হুকুম অমান্য করে শয়তান তার মর্যাদার আসনে থেকে এমন সব গুরুতর অপরাধ করে বসলো, যা চরম অমার্জিত ও ক্ষমাহীন। তার সেই গুরুতর অপরাধ সমূহ হলো :

১.সে আল্লাহ্র হুকুম পালন করতে অস্বীকার করে এবং

২.সে অহংকার, দাম্ভিকতা ও হঠকারীতা প্রদর্শন করে :

أَبَىٰ وَاسْتَكْبَرَ

অর্থ : সে আল্লাহর আদেশ পালন করতে অস্বীকার (refuse) করে, অহংকার-দাম্ভিকতা-হঠকারিতা প্রদর্শন করে। (সূরা ২ বাকারা : আয়াত ৩৪)

৩.সে আল্লাহর হুকুম অমান্য করে সীমালংঘন করে এবং অবাধ্য হয় :

فَفَسَقَ عَنْ أَمْرِ رَبِّهِ

অর্থ : সে তার প্রভুর হুকুম অমান্য করে সীমালংঘন করে । (সূরা ১৮ কাহাফ : ৫০)

৪.সে নিজেই নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করে :

قَالَ أَنَا خَيْرٌ مِّنْهُ

অর্থ : সে বলে : আমি তার (আদমের) চাইতে শ্রেষ্ঠ। (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ১২)

৫.সে অনুশোচনা করেনি; বরং নিজের হঠকারিতার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে :

قَالَ أَأَسْجُدُ لِمَنْ خَلَقْتَ طِينًا

অর্থ : সে বলে : আমি কি এমন একজনকে সাজদা করবো, যাকে তুমি সৃষ্টি করেছো কাদামাটি থেকে? (সূরা ১৭ ইসরা : আয়াত ৬১)

নিজের অবাধ্যতার পক্ষে সে আরো যুক্তি প্রদর্শন করে :

خَلَقْتَنِي مِن نَّارٍ وَخَلَقْتَهُ مِن طِينٍ

অর্থ: তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছো আগুন থেকে আর তাকে সৃষ্টি করেছো কাদামাটি থেকে। (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ১২)

قَالَ لَمْ أَكُن لِّأَسْجُدَ لِبَشَرٍ خَلَقْتَهُ مِن صَلْصَالٍ مِّنْ حَمَإٍ مَّسْنُونٍ

অর্থ: সে বলে : মানুষকে সাজদা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, যাকে তুমি সৃষ্টি করেছো শুকনো ঠনঠনে পঁচা মাটি থেকে। (সূরা ১৫ আল হিজর : আয়াত ৩৩)

৬.সে আল্লাহ্র হুকুমের বিপক্ষে যুক্তিবুদ্ধি প্রয়োগ করে : আল্লামা ইবনে জারির তাবারি এবং আল্লামা ইবনে কাছির তাঁদের তফসিরে উল্লেখ করেছেন, প্রখ্যাত তাবেয়ী মুফাস্সির হাসান বসরি রহ. বলেছেন :

قَاسَ اِبْلِيْسُ وَهُوَ اَوَّلَ مَنْ قَاسَ

অর্থ: ইবলিস তার যুক্তি বুদ্ধি প্রয়োগ করে (নিজেকে শ্রেষ্ঠ ধারণা করে) এবং ইবলিসই সর্বপ্রথম দলিল (evidence)-এর বিপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে।

প্রখ্যাত তাবেয়ী ইবনে সীরিন বলেন :

اَوَّلَ مَنْ قَاسَ اِبْلِيْسُ وَمَا عَبَدَتِ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ اِلاَّ بِالْمَقَائِسِ

অর্থ: (দলিল-প্রমাণের বিপক্ষে) সর্বপ্রথম যুক্তি বুদ্ধি প্রয়োগকারী হলো ইবলিস। আর যুক্তি বুদ্ধি প্রয়োগ করেই লোকেরা চন্দ্র সূর্যের উপাসনা করে।

আল্লামা ইবনে কাছির বলেন :

قَاسَ اِبْلِيْسُ قِيَاسًا فَاسِدًا فِىْ مُقَابَلَةِ النَّصِ

অর্থ: এভাবেই দলিল-প্রমাণ (evidence)-এর বিপক্ষে ইবলিস তার ভ্রান্ত যুক্তি বুদ্ধি প্রয়োগ করে।১

৭.সে কুফুরির পথকে আঁকড়ে ধরে : শয়তান ফেরেশতাদের সাথে অবস্থান করে ভালোভাবেই এ জ্ঞান অর্জন করেছিল যে, আল্লাহর হুকুম অমান্য করা মানেই কুফুরি। ফলে সে জেনে বুঝেই কুফুরির পথ অবলম্বন করে :

إِلَّا إِبْلِيسَ اسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ

অর্থ: তবে সাজদা করেনি ইবলিস। সে হঠকারিতা প্রদর্শন করে এবং কাফিরদের অন্তরভুক্ত হয়ে যায়। (সূরা ৩৮ সোয়াদ : আয়াত ৭৪ ; সূরা ২ বাকারা : আয়াত ৩৪)

৮.সে নিজের ভ্রষ্টতার জন্যে আল্লাহকে দায়ী করে : শয়তানের সবচেয়ে বড়, জঘন্য ও ঘোরতর অপরাধ হলো, সে যে উপরোক্ত অপরাধগুলো সংঘটিত করে ভ্রষ্টতার পথ অবলম্বন করলো, এজন্যে সে নিজের অপরাধ স্বীকার না করে আল্লাহকে দায়ী করে (নাউযুবিল্লাহ) :

قَالَ فَبِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيمَ

অর্থ: সে বলে, যেহেতু তুমি আমাকে ভ্রষ্টতা ও ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছো, সে জন্যে আমিও এখন থেকে তাদের (আদম সন্তানদের) বিপথগামী করার জন্যে তোমার সিরাতুল মুস্তাকিম-এ ওঁৎ পেতে বসে থাকবো। (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ১৬)

৯. চিরতরে ধিকৃত ও অভিশপ্ত হলো শয়তান

এসব গুরুতর অপরাধের ফলে শয়তান চিরতরে অভিশপ্ত হলো এবং অনিবার্যভাবে সাব্যস্ত হলো জাহান্নামের জ্বালানি :

قَالَ فَاخْرُجْ مِنْهَا فَإِنَّكَ رَجِيمٌ
وَإِنَّ عَلَيْكَ اللَّعْنَةَ إِلَىٰ يَوْمِ الدِّينِ

অর্থ : আল্লাহ বললেন : তুই এখান থেকে বের হয়ে যা, তুই ধিকৃত (outcust)। আর বিচার দিবস পর্যন্ত তোর উপর অভিশাপ (curse)। (সূরা ১৫ আল হিজর : আয়াত ৩৪-৩৫; সূরা ৩৮ সোয়াদ : আয়াত ৭৭-৭৮)

সাথে সাথে তাকে একথাও বলে দেয়া হলো :

فَاخْرُجْ إِنَّكَ مِنَ الصَّاغِرِينَ

অর্থ : বেরিয়ে যা, এখন থেকে তুই নিচুদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সূরা আ’রাফ : আয়াত ১৩)

قَالَ اخْرُجْ مِنْهَا مَذْءُومًا مَّدْحُورًا

অর্থ : তিনি বললেন : তুই ওখান থেকে বেরিয়ে যা অপমানিত ও ধিকৃত হয়ে।’ (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ১৮)

১০. আদম সন্তানদের আল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত করার অংগিকার

শয়তানকে চিরতরে ধিকৃত ও অভিশপ্ত ঘোষণা করার পর সে চিরতরে নিরাশ হয়ে গেলো। কিন্তু সে নিজের অপরাধের জন্যে নত না হয়ে আরো ঔদ্ধত্যে মেতে উঠলো। সে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা না করে আদম এবং আদম সন্তানদের বিপথগামী করার জন্যে কিয়ামত পর্যন্ত অবকাশ (সুযোগ) প্রার্থনা করলো :

قَالَ أَنظِرْنِي إِلَىٰ يَوْمِ يُبْعَثُونَ قَالَ إِنَّكَ مِنَ الْمُنظَرِينَ

অর্থ : সে বললো : ‘পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত আমাকে অবকাশ দাও।’ তিনি (আল্লাহ) বললেন : যা তুই অবকাশ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত। (আল কুরআন, সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ১৪-১৫; সূরা ১৫ হিজর : আয়াত ৩৬-৩৭; সূরা ৩৮ সোয়াদ : আয়াত ৭৯-৮০)

মহান আল্লাহ তাঁর নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তার সে প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন। আল্লাহ তার অবকাশ মঞ্জুর করার সাথে সাথে সে অংগিকার এবং চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করে বললো :

فَبِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيمَ ثُمَّ لَآتِيَنَّهُم مِّن بَيْنِ أَيْدِيهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ أَيْمَانِهِمْ وَعَن شَمَائِلِهِمْ ۖ وَلَا تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ شَاكِرِينَ

অর্থ : তুমি যেমন আমাকে বিপথগামী করেছো, তেমনি আমিও এখন থেকে তাদের (আদম ও তার সন্তানদের বিপথগামী করার জন্যে) তোমার সিরাতুল মুস্তাকিমে ওঁৎ পেতে বসে থাকবো। সামনে পেছনে, ডানে বাঁয়ে সবদিক থেকে তাদের ঘেরাও করে নেবো। ফলে তাদের অধিকাংশকেই তুমি কৃতজ্ঞ (তোমার অনুগত) পাবেনা। (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ১৬-১৭)

قَالَ فَبِعِزَّتِكَ لَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ ক্স إِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِينَ

অর্থ : সে (ইবলিস) বললো : আপনার ক্ষমতার শপথ (By your might) আমি তাদের সবাইকে পথভ্রষ্ট করে ছাড়বো, আপনার একান্ত অনুগত দাসদের ছাড়া। (আল কুরআন, সূরা ৩৮ সোয়াদ : আয়াত ৮২-৮৩)

ইবলিসের চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষিতে মহান আল্লাহ তাকে জানিয়ে দিলেন : তুই যাকে যাকে পারিস পদস্খলনের দিকে ডাক, অশ্বারোহী পদাতিক বাহিনীর আক্রমণ চালা, ধন সম্পদ সন্তান সন্তুতিতে তাদের সাথে শরিক হয়ে যা এবং তাদেরকে প্রতিশ্রুতির জালে আটকে ফেল- তোর সব প্রতিশ্রুতিই তো ধোকাবাজি আর প্রতারণা। জেনে রাখ :

إِنَّ عِبَادِي لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطَانٌ ۚ وَكَفَىٰ بِرَبِّكَ وَكِيلاً

অর্থ : আমার প্রকৃত দাসদের উপর তোর কোনো কর্তৃত্ব অর্জিত হবেনা। (হে মুহাম্মদ!) ভরসা করার জন্যে তোমার প্রভুই যথেষ্ট। (সূরা ১৭ ইসরা : আয়াত ৬৫)

আল্লাহ শয়তানকে আরো বলে দিলেন :

لَمَن تَبِعَكَ مِنْهُمْ لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنكُمْ أَجْمَعِينَ

অর্থ : আদম সন্তানদের মধ্যে যারাই তোর অনুসরণ করবে, তোর সাথে তাদেরকে দিয়ে আমি জাহান্নাম ভর্তি করবো। (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ১৮)

১১. ইবলিস সামনে পিছে, ডানে বামে থেকে আসবে -একথার অর্থ কী?

এটা ছিলো শয়তানের অংগিকার। আদম সন্তানদের বিপথগামী করার জন্যে সে সিরাতুল মুস্তাকিমের উপর ওঁৎ পেতে বসে থাকবে। সিরাতুল মুস্তাকিম হলো, মানুষের জন্যে আল্লাহ প্রদত্ত জীবন যাপনের সহজ-সরল সত্য পথ ইসলাম। অর্থাৎ সে মানুষকে ধোকা দেয়ার জন্যে ইসলামের রাজপথের উপর ওঁৎ পেতে বসে থাকার অংগীকার করে।

ইসলামের রাজপথে ওঁৎ পেতে বসে থেকে সে কী করবে? -যখনই কেউ ইসলামের রাজপথে পা বাড়াবে, তখনই তাকে চতুর্দিক থেকে ঘেরাও করে ফেলবে। সে এবং তার দলবল ঐ ব্যক্তিকে ধোকা, প্রতারণা ও প্ররোচনা দেয়ার জন্যে তার সামনে থেকে আসবে, পিছনে থেকে আসবে, ডানে থেকে আসবে, বামে থেকে আসবে।

ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন, শয়তান মানুষের সামনে থেকে আসবে মানে- আখিরাত সম্পর্কে তার মনে সংশয় সৃষ্টির চেষ্টা করবে। পেছনে থেকে আসবে মানে- পার্থিব জীবনের প্রতি তাকে আকৃষ্ট করবে। ডানে থেকে আসবে মানে- তার দীন সম্পর্কে তার মধ্যে নানা প্রশ্ন সৃষ্টি করে দেবে। বামে থেকে আসবে মানে- আল্লাহর হুকুম আহকাম অমান্য করাকে আনন্দের বিষয় বানিয়ে দেবে।’

খ্যাতনামা তাবেয়ী মুফাস্সির কাতাদা, ইবরাহিম নখয়ী, সুদ্দি এবং ইবনে জুরাইজ (রাহেমাহুমুল্লাহ) বলেছেন : ইবলিসের এ বক্তব্যের মর্ম অনেক গভীর। সে আদম সন্তানদের সামনে থেকে আসবে বলে বুঝাতে চেয়েছে, সে তাদের প্ররোচনা দিয়ে বলবে : পুনরুত্থান, জান্নাত, জাহান্নাম এগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই, এগুলো কিছুই ঘটবেনা। পেছনে থেকে আসবে মানে- সে পৃর্থিবীটাকে লোভনীয়, জমকালো ও মনোহরী করে মানুষের সামনে তুলে ধরবে এবং শুধু এটাকেই অর্জন ও ভোগ করার কাজে মনোনিবেশ করার আহবান জানাবে। ডানে থেকে আসার অর্থ- তার ভালো, উত্তম ও পূণ্য কর্মসমূহের দিক থেকে এসে সেগুলোকে তার কাছে নিষ্ফল কাজ হিসেবে তুলে ধরবে এবং সেগুলো থেকে তাকে নিরাশ ও নিস্পৃহ করে তুলবে। বামে থেকে আসবে মানে- তার মন্দ ও পাপ কর্মসমূহের দিক থেকে আসবে এবং সেগুলোকে তার কাছে চমৎকার, শোভনীয় ও আকর্ষণীয় করে তুলবে।২

এভাবে সামনে পেছনে, ডানে বামে থেকে এসে ইবলিস প্ররোচনার জালে মানুষকে ঘেরাও করে ফেলবে এবং আল্লাহ প্রদত্ত সিরাতুল মুস্তাকিমের উপর থেকে তাকে বিচ্যুত ও বিপথগামী করার প্রানান্তকর সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।

এ প্রসঙ্গে রসূলুল্লাহ সা.-এর একটি হাদিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ হাদিসে একটি রূপক উপমার মাধ্যমে তিনি সিরাতুল মুস্তাকিম থেকে মানুষের বিচ্যুত হবার পন্থা বর্ণনা করেছেন। হাদিসটি নাওয়াস ইবনে সামআন রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল সা. বলেছেন : আল্লাহ সিরাতুল মুস্তাকিমের একটি উপমা দিয়েছেন। (সেটি হলো:) একটি সোজা সরল সুদৃঢ় পথ। সেই পথের দুই ধারে রয়েছে দেয়াল। দেয়ালগুলোতে রয়েছে অনেক উন্মুক্ত দরজা। দরজাগুলোতে রয়েছে ঝালরের পর্দা। আর রাস্তার মাথায় আছেন একজন আহবায়ক। তিনি আহবান করে বলছেন : ‘হে মানুষ! তোমরা সবাই মিলে সোজা রাস্তার উপর দিয়ে এগিয়ে চলো, রাস্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়োনা।’ আরেকজন আহবায়ক আহবান করছে রাস্তার উপর থেকে। যখনই কোনো ব্যক্তি রাস্তার পার্শবর্তী দরজার পর্দা সরিয়ে ভেতরে তাকাতে বা ঢুকতে চায়, তখনই এই আহবায়ক তাকে সতর্ক করে বলে উঠে : ‘সাবধান! পর্দা সরাবেনা, পর্দা উন্মুক্ত করলে ধ্বংসে নিমজ্জিত হবে।’ (অতপর রসূলুল্লাহ সা. বললেন :) সরল পথটি হলো : ‘ইসলাম।’ দুই পাশের দেয়ালগুলো হলো : ‘আল্লাহর নির্ধারিত সীমানা।’ উন্মুক্ত দরজাগুলো হলো : ‘আল্লাহর নিষিদ্ধ পথ ও বিষয় সমূহ।’ রাস্তার মাথার আহবায়ক হলো : ‘আল্লাহ্র কিতাব (আল কুরআন)।’ রাস্তার উপরের আহবায়ক হলো : প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির অন্তরে অবস্থিত উপদেশ দাতা বা বিবেক।৩

ইসলামের সরল সঠিক রাজপথে ওঁৎ পেতে বসে থেকে মানুষকে প্রলুব্ধ ও বিভ্রান্ত করে দুই পাশের পাপের গলিতে ঢুকিয়ে দেয়াই শয়তানের কাজ।

১২. শয়তানের প্রতারণার পয়লা শিকার আদম আলাইহিস সালাম

আদমকে সৃষ্টি করার পর মহান আল্লাহ আদম থেকে বা আদমের পাজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করেন তাঁর স্ত্রী হাওয়াকে। তাদের বসবাস করতে দেন জান্নাতে। পৃথিবীতে খলিফা হিসেবে দায়িত্ব পালনের পূর্বে অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ লাভের উদ্দেশ্যেই তাদের কিছু কাল জান্নাতে রাখা হয়। একটি বৃক্ষের ফল ভক্ষণ ছাড়া জান্নাতে পানাহার ও চলা ফেরার অবাধ স্বাধীনতা তাদের দেয়া হয়।
শয়তান, তার দৃষ্টিতে যার কারণে সে চিরতরে অভিশপ্ত হলো, সেই আদমকেই সে তার টার্গেট বানায়। সে আদমকে প্রতারিত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আদমের কাছে গিয়ে হাযির হয়। সে তাঁদের কুমন্ত্রণা দিয়ে বলে :

مَا نَهَاكُمَا رَبُّكُمَا عَنْ هَـٰذِهِ الشَّجَرَةِ إِلَّا أَن تَكُونَا مَلَكَيْنِ أَوْ تَكُونَا مِنَ الْخَالِدِينَ

অর্থ : তোমাদের প্রভু যে তোমাদেরকে এ গাছটির কাছে যেতে নিষেধ করেছেন, তার কারণ হলো, তোমরা যেনো ফেরেশতা না হয়ে যাও, অথবা চিরদিন যেনো জান্নাতে থাকতে না পারো। (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ২০)

শয়তান নিজের এই বক্তব্যকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্যে কসম খেয়ে বলে :

وَقَاسَمَهُمَا إِنِّي لَكُمَا لَمِنَ النَّاصِحِينَ

অর্থ : এবং সে (ইবলিস) কসম খেয়ে তাদের বললো : আমি তোমাদের ভালো চাই, আমি তোমাদের কল্যাণকামী। (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ২১)

এভাবে প্ররোচনা দিয়ে ধীরে ধীরে সে তাদের দু’জনকে তার প্রতারণার জালে আটকে ফেলে। তাঁরা নিষিদ্ধ গাছের ফল ভক্ষণ করেন। এভাবে অসতর্ক হয়ে তাঁরা সাময়িকভাবে আল্লাহর হুকুম অমান্য করে বসেন :

فَدَلَّاهُمَا بِغُرُورٍ

অর্থ : এভাবে সে তাদের দুজনকে প্রতারণার মাধ্যমে বিভ্রান্ত করলো। (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ২২)

কিন্তু তাঁরা শয়তানের অনুকরণ করলেন না। শয়তান আল্লাহর হুকুম অমান্য করে অহংকার, হঠকারিতা এবং সীমালংঘনের দিকে অগ্রসর হয়। পক্ষান্তরে আদম ও হাওয়া আল্লাহর হুকুম অমান্য করার সাথে সাথে অনুতপ্ত হয়ে পড়েন। তাঁরা তওবা করেন, নিজেদের ভুল স্বীকার করেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করেন :

قَالَا رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنفُسَنَا وَإِن لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ

অর্থ : তারা প্রার্থনা করলো : আমাদের প্রভু! আমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় করে ফেলেছি। এখন তুমি যদি আমাদের ক্ষমা না করো এবং আমাদের প্রতি করূণা না করো, তবে তো আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে শামিল হয়ে যাবো! (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ২৩)

ফলে আল্লাহ পাক তাঁদের ক্ষমা করে দেন। তারা পবিত্র হয়ে যান।

১৩. মানুষকে বিপথগামী করার জন্যে শয়তানের কৌশল :

কুরআনের বর্ণনা মহান আল্লাহ মানুষকে কুমন্ত্রণা দেয়ার জন্যে শয়তানকে সুযোগ ও অবকাশ দিয়েছেন বটে; কিন্তু শয়তানের প্রতারণা ও বিভ্রান্তি থেকে আত্মরক্ষার জন্যে মানুষকে শয়তানি প্রতারণার যাবতীয় কুটকৌশল জানিয়ে দিয়েছেন এবং বাঁচার উপায় বলে দিয়েছেন। শয়তানি প্রতারণার কুটকৌশল সমূহ যেমন কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, তেমনি রসূলুল্লাহ সা. কুরআন উপস্থাপনের সাথে সাথে কুরআনের ব্যাখ্যা হিসেবে নিজের বাণীতেও সেগুলো জানিয়ে দিয়ে গেছেন। প্রথমে আমরা কুরআনে বর্ণিত শায়তানি প্রতারণার কুটকৌশল সমূহ এখানে উল্লেখ করছি :

১.শয়তান মানুষের মনে কুপ্ররোচনা সৃষ্টি করে :

يُوَسْوِسُ فِي صُدُورِ النَّاسِ

অর্থ : সে (খান্নাস হয়ে) কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে। (সূরা ১১৪ নাস : আয়াত ৫)

২.সে খান্নাসি কৌশল অবলম্বন করে :

مِنْ شَرِّ الْوَسْوَسِ الْخَنَّاسِ

অর্থ : ‘আমি আশ্রয় চাই খান্নাসের কুমন্ত্রণার ক্ষতি থেকে।’ অর্থাৎ সে এতোটা বদ যে, বারবার সামনে এসে কুমন্ত্রণা দেয় এবং পিছিয়ে যায়, বারবার প্রকাশ হয়ে কুমন্ত্রণা দেয় এবং গোপন হয়ে যায়। (সূরা ১১৪ আন্ নাস : আয়াত ৪)

৩.শয়তান মানুষকে প্রতিশ্র“তি দেয় এবং মানুষের মনে মিথ্যা আশা-বাসনা সৃষ্টি করে :

يَعِدُهُمْ وَيُمَنِّيهِمْ ۖ وَمَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطَانُ إِلَّا غُرُورًا

অর্থ : সে প্রতিশ্র“তি দেয় এবং মানুষের মনে মিথ্যা বাসনার সৃষ্টি করে। আসলে শয়তান তাদের যে ওয়াদা দেয় তা প্রতারণা মাত্র। (সূরা ৪ আন নিসা : আয়াত ১২০)

৪.শয়তান মানুষের মন্দ কাজকে তাদের কাছে শোভনীয় ও মনোহরী (fair seeming) করে তোলে :

وَزَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ فَصَدَّهُمْ عَنِ السَّبِيلِ

অর্থ : শয়তান তাদের মন্দ কাজসমূহকে তাদের দৃষ্টিতে চমৎকার ও মনোহরী করে তোলে এবং এভাবে তাদের সরল সঠিক পথ অবলম্বনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। (সূরা ২৯ আনকাবুত : আয়াত ৩৮)

৫.মানুয যেনো দান না করে সেজন্যে শয়তান মানুষকে দারিদ্রের ভয় দেখায় এবং কার্পণ্যে উদ্বুদ্ধ করে :

اَلشَّيْطَانُ يَعِدُكُمُ الْفَقْرَ وَيَأْمُرُكُم بِالْفَحْشَاءِ

অর্থ : শয়তান তোমাদের দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এবং কৃপণতার আদেশ করে। (সূরা ২ আল বাকারা : আয়াত ২৬৮)

৬.শয়তান মানুষকে মাদক, জুয়া, আস্তানা এবং ভাগ্য নির্ণয়ের খেলায় লিপ্ত করে :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

অর্থ : হে ঈমানওয়ালা লোকেরা! জেনে রাখো, মদ (মাদক), জুয়া, আস্তানা (বেদী), ভাগ্য নির্ণয়ের শর -এসবই শয়তানের নোংরা কর্ম। সুতরাং তোমরা এগুলো বর্জন করো, সফলতা অর্জন করবে। (সূরা ৫ আল মায়িদা : আয়াত ৯০)

৭.শয়তান মানুষের মধ্যে পারস্পারিক শত্র“তা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে :

إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَن يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَن ذِكْرِ اللَّهِ وَعَنِ الصَّلَاةِ ۖ فَهَلْ أَنتُم مُّنتَهُونَ

অর্থ: শয়তান মাদক ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মাঝে পারস্পরিক শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে চায় এবং আল্লাহর স্মরণ ও সালাত আদায়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে চায়। তবু কি তোমরা (এসব শয়তানি কর্ম থেকে) নিবৃত হবেনা। (সূরা ৫ আল মায়িদা : আয়াত ৯১)

৮.শয়তান সুদী কারবারে লিপ্ত করে :

الَّذِينَ يَأْكُلُونَ الرِّبَا لَا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ الَّذِي يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ

অর্থ: যারা সুদ খায়, তারা অবশ্যি ঐ ব্যক্তির মতো দাঁড়াবে, যাকে শয়তান তার স্পর্শ দ্বারা সুস্থ জ্ঞান-বুদ্ধি শূন্য করে দিয়েছে। (সূরা ২ আল বাকারা : আয়াত ২৭৫)

৯.শয়তান মানুষকে আল্লাহ সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত করে :

وَمِنَ النَّاسِ مَن يُجَادِلُ فِي اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّبِعُ كُلَّ شَيْطَانٍ مَّرِيدٍ

অর্থ: কতক লোক এমন আছে যারা অজ্ঞতা নিয়ে আল্লাহ সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত হয় এবং অনুসরণ করে প্রত্যেক বিদ্রোহী শয়তানের। (সূরা ২২ হজ্জ: আয়াত ৩)

১০.শয়তান মানুষকে অশ্লীল ও মন্দ কর্মে প্রলুব্ধ করে :

وَمَن يَتَّبِعْ خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ فَإِنَّهُ يَأْمُرُ بِالْفَحْشَاءِ وَالْمُنكَرِ

অর্থ: যে শয়তানের পদাংক অনুসরণ করে, সে জেনে রাখুক, শয়তান অশ্লীল ও মন্দ কর্মের আদেশ দেয় (প্রলুব্ধ করে)। (সূরা ২৪ আন নূর : আয়াত ২১)

১১.যারা হিদায়াতের পথ দেখতে পেয়েও তা পরিত্যাগ করে, শয়তান তাদের কাজকে শোভন করে দেখায় এবং তাদেরকে মিথ্যা আশা দেয় :

إِنَّ الَّذِينَ ارْتَدُّوا عَلَىٰ أَدْبَارِهِم مِّن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ الْهُدَى ۙ الشَّيْطَانُ سَوَّلَ لَهُمْ وَأَمْلَىٰ لَهُمْ

অর্থ: হিদায়াত সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত ও প্রমাণিত হবার পর যারা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, শয়তান তাদেরকে তাদের এ আচরণ শোভন ও চমৎকার করে দেখায় এবং তাদেরকে মিথ্যা আশা আকাংখায় লিপ্ত করে রাখে। (সূরা ৪৭ মুহাম্মদ : আয়াত ২৫)

১২.শয়তান মানুষকে কানকথায় লিপ্ত করে এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে সন্দেহ সৃষ্টি করে দেয় :

إِنَّمَا النَّجْوَىٰ مِنَ الشَّيْطَانِ لِيَحْزُنَ الَّذِينَ آمَنُوا

অর্থ: কানকানি ফিসফিসানি শয়তানের কাজ। সে এটা করায় মুমিনদের ব্যথিত করার জন্যে। (সূরা ৫৮ মুজাদালা : আয়াত ১০)

১৩.শয়তান মানুষের মন-মস্তিষ্কের উপর প্রভাব বিস্তার করে আল্লাহর কথা ভুলিয়ে দেয় :

اِسْتَحْوَذَ عَلَيْهِمُ الشَّيْطَانُ فَأَنسَاهُمْ ذِكْرَ اللَّهِ ۚ أُولَـٰئِكَ حِزْبُ الشَّيْطَانِ

অর্থ : শয়তান তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করে নিয়েছে; এভাবে সে তাদের ভুলিয়ে দিয়েছে আল্লাহর কথা। মূলত এরাই শয়তানের দলের লোক। (সূরা ৫৮ মুজাদালা : আয়াত ১৯)

১৪.শয়তান মানুষকে দিয়ে অপব্যয় এবং অপচয় করায় :

إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ ۖ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُورًا

অর্থ: যারা অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার প্রভুর প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ। (সূরা ১৭ ইসরা : আয়াত ২৭)

১৫.শয়তান মন্দ কাজে প্রবলভাবে প্রলুব্ধ করে :

أَلَمْ تَرَ أَنَّا أَرْسَلْنَا الشَّيَاطِينَ عَلَى الْكَافِرِينَ تَؤُزُّهُمْ أَزًّا

অর্থ: তুমি কি লক্ষ্য করোনি, আমি কাফিরদের জন্যে শয়তানদের ছেড়ে রেখেছি তাদেরকে মন্দ কাজে প্রলুব্ধ করার জন্যে? (সূরা ১৯ মরিয়ম : আয়াত ৮৩)

১৪. মানুষকে বিপথগামী করার জন্যে শয়তানের কৌশল :

রসূলুল্লাহ সা.-এর বাণীর আলোকে শয়তানের ধোকা, প্রতারণা ও বিভ্রান্তির কৌশল সম্পর্কে হাদিসে ব্যাপক বক্তব্য এসেছে। আমরা সেগুলোর সার সংক্ষেপ নিচে তুলে ধরছি :

১.শয়তান মানুষকে সালাতের মধ্যে অন্যমনস্ক করে তোলে। একথা ও কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সালাতের রাকাত সংখ্যা ভুলিয়ে দেয়।

২.হক কথা, সত্য কথা বলা থেকে বিরত রাখে। এরা হলো বোবা শয়তান।

৩.স্বামী স্ত্রীর গোপন বিষয় প্রকাশ করায় (স্ত্রীর মাধ্যমে এবং স্বামীর মাধ্যমে)। অশ্লীল কথা প্রকাশ করায়।

৪.দীন সম্পর্কে অজ্ঞ দীনদারদেরকে দীনদারির নাম করিয়ে শিরক, বিদআত ও আল্লাহর নাফরমানির কাজে লিপ্ত করিয়ে দেয়।

৫.কোনো ব্যক্তিকে মানুষের অজানা টুকিটাকি কথা ধরিয়ে দিয়ে সে ব্যক্তি গায়েব জানে বলে প্রচার করে এবং দীন সম্পর্কে অজ্ঞ ধর্মভীরুদেরকে বিভ্রান্ত করে।

৬.স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি করে ঝগড়া বিবাদ লাগিয়ে দেয়।

৭.মানুষের মধ্যে ঝগড়া ফ্যাসাদ ও হানাহানি উস্কে দেয়।

৮.মানুষের শরীরে উল্কি চিহ্ন লাগায়।

৯.মানুষকে দিয়ে অশ্লীল গান কবিতা লেখায় ও শোনায়।

১০.মানুষকে দিয়ে জ্যোতিষবিদ্যা শিখায় এবং মানুষকে জ্যোতিষীদের দারস্থ হতে উদ্বুদ্ধ করে।

১১.সে মানুষকে খাবার শুরুতে এবং অন্যান্য কাজে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে ভুলিয়ে দেয়।

১২.সে মানুষকে মাদক ও নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণে উদ্বুদ্ধ ও আসক্ত করে।

১৩.সে বিভিন্ন বাহানা, অজুহাত ও যুক্তি দেখিয়ে মানুষকে মিথ্যা কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করে।

১৪.গোসলখানা সহ মানুষের গোপনীয় স্থানে গিয়ে মানুষকে মন্দ চিন্তা ও অশ্লীল কাজে উদ্বুদ্ধ করে।

১৫.অসৎ নারীদেরকে সে ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করে।

১৬.সে মানুষকে বাদ্যযন্ত্রের প্রতি আসক্ত করে তোলে।

১৭.হাট, বাজার ও বাণিজ্যিক শহরগুলোকে সে তার ধোকা, প্রতারণা ও প্রলুব্ধকরণের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে।

১৮.সে অপচয় ও অপব্যয়ে উদ্বুদ্ধ করে।

১৯.ভালো কাজে ব্যয়ের ক্ষেত্রে সে কৃপণ হতে উদ্বুদ্ধ করে।

২০.সে মানুষকে আত্মহনন ও ধ্বংসাত্মক কাজে উদ্বুদ্ধ ও আসক্ত করে।

২১.সে মানুষের মনে আল্লাহ সম্পর্কে প্রশ্ন সৃষ্টি করে দেয়।

২২.সে ফজর নামাযের সময় আরামে ঘুম পাড়িয়ে রাখার চেষ্টা করে।

২৩.সে সালাতে, সভায়-বৈঠকে এবং কর্মস্থলে মানুষের হাই তোলার ব্যবস্থা করে।

২৪.সে মানুষকে বিভ্রান্তিকর ভয়ানক স্বপ্ন দেখায়।

২৫.সে অজ্ঞ লোকদেরকে স্বপ্নে এসে বলে : আমি আল্লাহর রসূল বলছি, তুমি এই কাজ ঐ কাজ করো।

২৬.সে মানুষকে উলঙ্গ করায় এবং সেসব দৃশ্য দেখে অট্টহাসি হাসে।

২৭.সে ফাসিক লোকদেরকে দিয়ে মুমিন মুসলিমদের গালাগাল করায়।

২৮.সে অসতর্ক নামাযীদের অন্যমনস্ক করে এদিকে সেদিকে তাকাতে উদ্বুদ্ধ করে।

২৯.শয়তান চুরি করতে উদ্বুদ্ধ করে এবং চুরি শিখায়।

৩০.শয়তান সুযোগ পেলে শিশুদের ক্ষতি করে, বিশেষ করে সাঁঝের বেলায়।

৩১.শয়তান মানুষের মনে কু-ধারণা সৃষ্টি করে দেয়।

৩২.শয়তান মানুষকে রাগান্বিত করে তোলে। ক্রোধ সৃষ্টি করে দেয়।

৩৩.সুযোগ পেলে সে মানুষকে পাগল ও অজ্ঞান করে ছাড়ে।

৩৪.সে প্রমাণিত সত্যের বিপক্ষে মানুষকে যুক্তি ও বুদ্ধির অনুসরণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। সে কুতর্কে লিপ্ত করিয়ে দেয়।

৩৫.সে মিথ্যা চালবাজির খবর ও গুজব ছড়িয়ে দেয়।

৩৬.সে মানুষকে, বিশেষ করে যুবক যুবতীদেরকে বেহুদা ও নিষ্ফল কাজে ব্যস্ত রাখে এবং সুফলদায়ক কাজ থেকে গাফিল করে রাখে।

১৫. আল কুরআন : শয়তানের সবচেয়ে বড় জ্বালার কারণ

আল কুরআন নাযিল হবার পর কিয়ামত পর্যন্ত একমাত্র কুরআন মজিদই মানবজাতির হিদায়াত ও মুক্তির সন্ধান লাভের মূল উৎস। তাই আল কুরআন থেকে এবং কুরআন অনুধাবন, অনুসরণ ও বাস্তবায়ন থেকে মানব সমাজকে দূরে রাখার জন্যেই নিয়োজিত থাকে শয়তান, তার দলবল ও চেলা চামুন্ডাদের সর্বাধিক চেষ্টা। তাদের ধোকা, প্ররোচনা, প্রলোভন, বিভ্রান্তি সৃষ্টি ও প্রতারণার জাল বিস্তার প্রধানত মানুষকে কুরআন থেকে দূরে রাখার জন্যেই নিয়োজিত থাকে। সে জন্যেই মহান আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন :

فَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآنَ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

অর্থ: যখনই তুমি আল কুরআন অধ্যয়নের সংকল্প করবে, তখন ধিকৃত অভিশপ্ত শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় চেয়ে নিও। (সূরা ১৬ আন নহল : আয়াত ৯৮)

এ আয়াতের তফসির প্রসঙ্গে বিখ্যাত তফসির তাফহীমুল কুরআনে বলা হয়েছে :
“এর মর্ম কেবল এতটুকুই নয় যে, মুখে শুধুমাত্র اَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ উচ্চারণ করলেই হয়ে যাবে। বরং সেই সাথে কুরআন পড়ার সময় যথার্থই শয়তানের বিভ্রান্তিকর প্ররোচনা থেকে মুক্ত থাকার বাসনাও পোষণ করতে হবে এবং কার্যত তার প্ররোচনা থেকে নিষ্কৃতি লাভের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। ভুল ও অনর্থক সন্দেহ-সংশয়ে লিপ্ত হওয়া যাবেনা। কুরআনের প্রত্যেকটি কথাকে তার সঠিক মর্মের আলোকে দেখতে হবে। নিজের মনগড়া মতামত বা বাইরে থেকে আমদানি করা চিন্তার মিশ্রণে কুরআনের শব্দাবলীর এমন অর্থ করা যাবেনা, যা আল্লাহর ইচ্ছা ও উদ্দেশ্যের পরিপন্থি। সাথে সাথে মানুষের মনে এ চেতনা এবং উপলব্ধিও জাগ্রত থাকতে হবে যে, মানুষ যাতে কুরআন থেকে কোনো পথ নির্দেশনা লাভ করতে না পারে সে জন্যেই শয়তান সবচেয়ে বেশি তৎপর থাকে। এ কারণে মানুষ যখনই এ কিতাবটির প্রতি মনোনিবেশ করে, তখনি শয়তান তাকে বিভ্রান্ত করার এবং পথ নির্দেশনা লাভ থেকে বাধা দেবার এবং তাকে ভুল চিন্তার পথে পরিচালিত করার জন্যে উঠে পড়ে লাগে। তাই এ কিতাবটি অধ্যয়ন করার সময় মানুষকে অত্যন্ত সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে, যাতে শয়তানের প্ররোচনা ও সূক্ষ্ম অনুপ্রবেশের কারণে সে এ হেদায়েতের উৎসটির কল্যাণকারিতা থেকে বঞ্চিত না হয়ে যায়। কারণ, যে ব্যক্তি এ কিতাব থেকে সঠিক পথের সন্ধান লাভ করতে পারেনি, সে অন্য কোথাও থেকে সৎপথের সন্ধান পাবেনা। আর যে ব্যক্তি এ কিতাব থেকে ভ্রষ্টতা ও বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে দুনিয়ার অন্য কোনো জিনিস তাকে বিভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতার হাত থেকে রক্ষা করতে পারবেনা। এ আয়াতটি একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে নাযিল করা হয়েছে। সে উদ্দেশ্যটি হচ্ছে এই যে, সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে এমন সব আপত্তির জবাব দেয়া হয়েছে যেগুলো মক্কার মুশরিকরা কুরআন মজিদের বিরুদ্ধে উত্থাপন করতো। তাই প্রথমে ভূমিকা স্বরূপ বলা হয়েছে, কুরআনকে তার যথার্থ আলোকে একমাত্র সে ব্যক্তিই দেখতে পারে, যে শয়তানের বিভ্রান্তিকর প্ররোচনা থেকে সজাগ-সতর্ক থাকে এবং তা থেকে নিজেকে সংরক্ষিত রাখার জন্যে আল্লাহর কাছে পানাহ্ চায়। অন্যথায় শয়তান কখনো সোজাসুজি কুরআন ও তার বক্তব্যসমূহ অনুধাবন করার সুযোগ মানুষকে দেয়না।”১১

১৬ . শয়তান ইসলামের অনুসারীদের বিরুদ্ধে তার ভক্ত বন্ধুদের লেলিয়ে দেয়:

যেসব লোক ইসলামের প্রচলন, অনুসরণ ও বাস্তবায়নকে পছন্দ করেনা, শয়তান তাদের বন্ধু হয়ে যায়। সে তাদেরকে ইসলামের অনুসারীদের শত্র“তা ও বিরুদ্ধাচরণে উস্কে দেয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন :

وَإِنَّ الشَّيَاطِينَ لَيُوحُونَ إِلَىٰ أَوْلِيَائِهِمْ لِيُجَادِلُوكُمْ ۖ وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ

অর্থ: নিশ্চয়ই শয়তানরা তাদের বন্ধুদেরকে তোমাদের সাথে বিবাদে লিপ্ত হতে (**) অহি করে (উস্কে দেয়)। তোমরা যদি তাদের আনুগত্য করো, তবে অবশ্যি তোমরা মুশরিক হয়ে যাবে। (সূরা ৬ আল আনআম : আয়াত ১২১)

প্রত্যেক নবী ও তাঁর খাঁটি অনুসারীদের বিরুদ্ধেই জিন শয়তান ও মানুষ শয়তান দুশমনিতে লিপ্ত হয়েছে। তারা পরস্পরকে নবী ও নবীর অনুসারীদের বিরুদ্ধে দুশমনি করতে উস্কে দেয়, লেলিয়ে দেয় :

وَكَذَ‌ٰلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِينَ الْإِنسِ وَالْجِنِّ يُوحِي بَعْضُهُمْ إِلَىٰ بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُورًا

অর্থ: এভাবে আমরা প্রত্যেক নবীর বিরুদ্ধে মানুষ শয়তান ও জিন শয়তানদের শত্রুতা করার অবকাশ দিয়েছি। তারা পরস্পরকে মনোহরী কথা বলে প্রতারণার উদ্দেশ্যে লেলিয়ে দেয়। (সূরা ৬ আল আনআম : আয়াত ১১২)

১৭. শয়তান আল্লাহর নাফরমানি করিয়ে এবং হানাহানি বাধিয়ে দিয়ে কেটে পড়ে:

শয়তান মানুষের বন্ধু ও কল্যাণকামী সেজে মানুষকে প্ররোচনা দেয়। আর শয়তানের প্ররোচনায় প্রভাবিত হয়ে কেউ যখন আল্লাহর হুকুম অমান্য করে এবং অপরাধ সংঘটিত করে বসে, তখন শয়তান তাকে ফেলে কেটে পড়ে :

كَمَثَلِ الشَّيْطَانِ إِذْ قَالَ لِلْإِنسَانِ اكْفُرْ فَلَمَّا كَفَرَ قَالَ إِنِّي بَرِيءٌ مِّنكَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ فَكَانَ عَاقِبَتَهُمَا أَنَّهُمَا فِي النَّارِ

অর্থ: তাদের উপমা হলো শয়তান। শয়তান মানুষকে (প্ররোচনা দিয়ে) বলে : ‘কুফুরি (আল্লাহর হুকুম অমান্য) করো।’ অতপর সে যখন কুফুরি করে বসে, তখন শয়তান তাকে বলে : ‘তোমার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নাই, আমি তো আল্লাহ রব্বুল আলামীনকে ভয় করি।’ ফলে উভয়ের পরিণতিই হবে জাহান্নাম। (সূরা ৫৯ হাশর : আয়াত ১৬-১৭)

শয়তান কিভাবে পরস্পরের মধ্যে বিবাদ ও হানাহানি উস্কে দিয়ে কেটে পড়ে, কুরআন মজিদে আরেক স্থানে মহান আল্লাহ সেকথা এভাবে উল্লেখ করেছেন :

وَإِذْ زَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ وَقَالَ لَا غَالِبَ لَكُمُ الْيَوْمَ مِنَ النَّاسِ وَإِنِّي جَارٌ لَّكُمْ ۖ فَلَمَّا تَرَاءَتِ الْفِئَتَانِ نَكَصَ عَلَىٰ عَقِبَيْهِ وَقَالَ إِنِّي بَرِيءٌ مِّنكُمْ إِنِّي أَرَىٰ مَا لَا تَرَوْنَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ ۚ وَاللَّهُ شَدِيدُ الْعِقَابِ

অর্থ: স্মরণ করো, শয়তান তাদের দুষ্টকর্মসমূহ তাদের কাছে চমৎকার ও শোভনীয় করে তুলে ধরেছিল। সে (বদরযুদ্ধ উপলক্ষে কুরাইশদের বলেছিল : ‘(ঝাপিয়ে পড়ো ওদের বিরুদ্ধে), আজ কোনো মানুষই তোমাদের উপর বিজয়ী হবেনা। আমি তোমাদের পাশেই থাকবো।’ তারপর উভয় দল যখন পরস্পরের সম্মুখীন হলো, সে পেছন দিক থেকে কেটে পড়লো এবং তাদের (তার অনুসারী কুরাইশদের) বললো : ‘তোমাদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি এমন কিছু দেখতে পাচ্ছি যা তোমরা দেখতে পাওনা। আমি আল্লাহকে ভয় করি। আর আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।’ (সূরা ৮ আল আনফাল : আয়াত ৪৮)

১৮. কিয়ামতের দিন মানুষের উদ্দেশ্যে শয়তানের শেষ বিবৃতি

কিয়ামতের দিন আল্লাহর বিচার ফায়সালা শেষ হবার পর আল্লাহর অনুমতি নিয়ে অভিশপ্ত শয়তান মানুষের উদ্দেশ্যে একটি বিবৃতি প্রদান করবে। মানুষকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে কুরআনে সে বিবৃতিটি উল্লেখ করা হয়েছে :

وَقَالَ الشَّيْطَانُ لَمَّا قُضِيَ الْأَمْرُ إِنَّ اللَّهَ وَعَدَكُمْ وَعْدَ الْحَقِّ وَوَعَدتُّكُمْ فَأَخْلَفْتُكُمْ ۖ وَمَا كَانَ لِيَ عَلَيْكُم مِّن سُلْطَانٍ إِلَّا أَن دَعَوْتُكُمْ فَاسْتَجَبْتُمْ لِي ۖ فَلَا تَلُومُونِي وَلُومُوا أَنفُسَكُم ۖ مَّا أَنَا بِمُصْرِخِكُمْ وَمَا أَنتُم بِمُصْرِخِيَّ ۖ إِنِّي كَفَرْتُ بِمَا أَشْرَكْتُمُونِ مِن قَبْلُ ۗ إِنَّ الظَّالِمِينَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

অর্থ: যখন আল্লাহর বিচার ফায়সালা শেষ হবে, তখন শয়তান (একটি বিবৃতি দিয়ে) বলবে : আল্লাহ তোমাদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা-ই ছিলো সত্য প্রতিশ্রুতি। আমিও তোমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, কিন্তু আমি তোমাদেরকে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছি। তোমাদের উপর তো আমার কোনো কর্তৃত্ব ছিলনা; আমি তো কেবল তোমাদের আহবান করেছি, আর তোমরা আমার আহবানে সাড়া দিয়েছিলে। সুতরাং তোমরা আমার প্রতি দোষারোপ করোনা; বরং তোমরা নিজেদেরকেই তিরস্কার করো। আমি (আল্লাহর শাস্তি থেকে) তোমাদের রক্ষা করতে পারবোনা, আর তোমরাও আমাকে রক্ষা করতে পারবেনা। ইতোপূর্বে তোমরা যে আমাকে আল্লাহর শরিক ও সমকক্ষ বানিয়ে নিয়েছিলে আমি সেটা (সে মর্যাদা) অস্বীকার করছি। নিশ্চয়ই যালিমদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” (সূরা ১৪ ইবরাহিম : আয়াত ২২)

১৯. শয়তান কাদের বিপথগামী করে এবং সে কাদের বন্ধু ও অভিভাবক?

আমরা এখানে আল কুরআনের কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করছি। এ আয়াতগুলো থেকে পরিষ্কার হয়ে যাবে শয়তান কাদেরকে বিপথগামী করে। সে কাদের অভিভাবকত্ব করে এবং কারা তার ভক্ত বন্ধু ও অনুসারী? মহান আল্লাহ বলেন :

هَلْ أُنَبِّئُكُمْ عَلَىٰ مَن تَنَزَّلُ الشَّيَاطِينُ – تَنَزَّلُ عَلَىٰ كُلِّ أَفَّاكٍ أَثِيمٍ – يُلْقُونَ السَّمْعَ وَأَكْثَرُهُمْ كَاذِبُونَ

অর্থ: (হে মানুষ!) আমি কি তোমাদের সংবাদ দেবো, শয়তানরা কাদের উপর নাযিল হয় (কাদের ঘাড়ে চেপে বসে)? -তারা চেপে বসে ঘোরতর মিথ্যাবাদী পাপাসক্তদের ঘাড়ে; যারা কান পেতে থাকে এবং মিথ্যা কথা ছড়ায়। (সূরা ২৬ আশ্ শোয়ারা : আয়াত ২২১-২২৩)

أَلَمْ تَرَ أَنَّا أَرْسَلْنَا الشَّيَاطِينَ عَلَى الْكَافِرِينَ تَؤُزُّهُمْ أَزًّا

অর্থ: তুমি কি দেখোনা, আমি শয়তানদের ছেড়ে রেখেছি; তারা কাফিরদের উপর সওয়ার হয় এবং তাদেরকে মন্দ কর্মে প্রলুব্ধ করে? (সূরা মরিয়ম : ৮৩)

وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ الَّذِي آتَيْنَاهُ آيَاتِنَا فَانسَلَخَ مِنْهَا فَأَتْبَعَهُ الشَّيْطَانُ فَكَانَ مِنَ الْغَاوِينَ – وَلَوْ شِئْنَا لَرَفَعْنَاهُ بِهَا وَلَـٰكِنَّهُ أَخْلَدَ إِلَى الْأَرْضِ وَاتَّبَعَ هَوَاهُ -

অর্থ: তুমি তাদেরকে ঐ ব্যক্তির বৃত্তান্ত পড়ে শুনাও : যার কাছে আমি আমার আয়াত পাঠিয়েছিলাম; কিন্তু সে তা বর্জন করে। অতএব শয়তান তার পেছনে লাগে এবং সে বিপথগামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। আমি চাইলে তা (আমার আয়াত) দ্বারা তাকে উচ্চ মর্যাদা দান করতে পারতাম; কিন্তু সে (তা বর্জন করে) দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়ে এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। (সূরা ৭ : ১৭৫-১৭৬)

إِنَّمَا سُلْطَانُهُ عَلَى الَّذِينَ يَتَوَلَّوْنَهُ وَالَّذِينَ هُم بِهِ مُشْرِكُونَ

অর্থ : শয়তান তো কেবল তাদের উপরই কর্তৃত্ব ও আধিপত্য করে, যারা তাকে বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে, আর যারা আল্লাহর সাথে শরিক করে। (সূরা ১৬ আন নহল : আয়াত ১০০)

وَلِتَصْغَىٰ إِلَيْهِ أَفْئِدَةُ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ وَلِيَرْضَوْهُ وَلِيَقْتَرِفُوا مَا هُم مُّقْتَرِفُونَ

অর্থ: যারা আখিরাতে বিশ্বাস করেনা, তাদেরকে নিজের প্রতি অনুরক্ত ও পরিতুষ্ট করা এবং নিজেরা যেসব অপকর্ম করে, তাদেরকে দিয়েও সেসব অপকর্ম করানোর উদ্দেশ্যেই শয়তান কুমন্ত্রণা দেয়। (সূরা আনআম : আয়াত ১১৩)

لِّيَجْعَلَ مَا يُلْقِي الشَّيْطَانُ فِتْنَةً لِّلَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ وَالْقَاسِيَةِ قُلُوبُهُمْ

অর্থ: তিনি এমনটি করেন শয়তানের উদ্ভাবিত সন্দেহকে ঐসব লোকদের জন্যে ফিতনা (পরীক্ষা) বানানোর জন্যে, যাদের অন্তরে রয়েছে ব্যধি এবং যারা পাষন্ড। (সূরা ২২ আল হজ্জ : আয়াত ৫৩)

وَمَن يَعْشُ عَن ذِكْرِ الرَّحْمَـٰنِ نُقَيِّضْ لَهُ شَيْطَانًا فَهُوَ لَهُ قَرِينٌ – وَإِنَّهُمْ لَيَصُدُّونَهُمْ عَنِ السَّبِيلِ وَيَحْسَبُونَ أَنَّهُم مُّهْتَدُونَ – حَتَّىٰ إِذَا جَاءَنَا قَالَ يَا لَيْتَ بَيْنِي وَبَيْنَكَ بُعْدَ الْمَشْرِقَيْنِ فَبِئْسَ الْقَرِيْنُ – وَلَن يَنفَعَكُمُ الْيَوْمَ إِذ ظَّلَمْتُمْ أَنَّكُمْ فِي الْعَذَابِ مُشْتَرِكُونَ – أَفَأَنتَ تُسْمِعُ الصُّمَّ أَوْ تَهْدِي الْعُمْيَ وَمَن كَانَ فِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ -

অর্থ: যে কেউ আল্লাহর যিকর (কুরআন এবং আল্লাহর ইবাদত) থেকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে, আমরা তার সাথি-বন্ধু হিসেবে শয়তানকে নিয়োগ করি। তখন তারাই ঐ লোকদেরকে আল্লাহর পথে চলা থেকে বিরত রাখে; অথচ তারা মনে করে তারা সঠিক পথেই চলছে। অবশেষে যখন (কিয়ামতের দিন) আমার কাছে উপস্থিত হবে, তখন সে শয়তানকে বলবে : ‘হায়, (পৃথিবীতে) আমার ও তোমার মধ্যে যদি পূর্ব-পশ্চিমের দূরত্ব থাকতো।’ কতইনা নিকৃষ্ট সাথি এই শয়তান। (তখন তাদের বলা হবে :) আজ তোমাদের অনুতাপ তোমাদের কোনো কাজেই আসবেনা। যেহেতু তোমরা তো যুলুম-সীমালংঘন করে এসেছো, তাই তোমরা সকলেই আযাবের শরিকদার। (হে নবী!) তুমি কি শুনাতে পারবে বধিরকে? কিংবা পথ দেখাতে পারবে কি অন্ধকে? আর ঐ ব্যক্তিকে যে সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত? (সূরা ৪৩ যুখরুফ : আয়াত ৩৬-৪০)

অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন : “তুমি কি তাদের প্রতি লক্ষ্য করোনি, যারা আল্লাহর গযব প্রাপ্ত লোকদের (ইহুদি ও অন্যান্যদের) বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে? আসলে এরা তাদের দলভুক্তও নয়, তোমাদের দলভুক্তও নয়। তারা জেনে শুনেই মিথ্যা শপথ করে ………….।”

অতপর এ লোকদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন :

اسْتَحْوَذَ عَلَيْهِمُ الشَّيْطَانُ فَأَنسَاهُمْ ذِكْرَ اللَّهِ ۚ أُولَـٰئِكَ حِزْبُ الشَّيْطَانِ ۚ أَلَا إِنَّ حِزْبَ الشَّيْطَانِ هُمُ الْخَاسِرُونَ

অর্থ: “শয়তান তাদের উপর প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তার করে নিয়েছে। ফলে সে তাদের ভুলিয়ে দিয়েছে আল্লাহর স্মরণ। এরাই শয়তানের দল। সাবধান হও, শয়তানের দল অবশ্যি পরাস্ত-ক্ষতিগ্রস্ত হবে।” (সূরা ৫৮ মুজাদালা : আয়াত ১৪-১৯)

শয়তান কাদের বিপথগামী করে? কাদের উপর আধিপত্য করে? কাদের উপর প্রভাব বিস্তার করে? কাদেরকে ধোকা ও প্রতারণার জালে আবদ্ধ করে রাখে? কোন্ ধরনের লোকেরা তার সাথি-বন্ধু? শয়তানই বা কাদের বন্ধু, কাদের অভিভাবক? কাদের পরিচালক? উপরোল্লেখিত আয়াত সমূহের আলোকে এসব প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত জবাব হলো ঐসব লোকদের :

১.যারা মিথ্যাবাদী, মিথ্যা কথা বলে এবং ছড়ায়।

২.যারা পাপকর্ম করে বেড়ায়, যারা পাপাসক্ত।

৩.যারা গোপন কথা শুনে, রঙ ছড়িয়ে গোপন কথা প্রচার করে।

৪.যারা কুফুরি এবং আল্লাহদ্রোহীতায় লিপ্ত।

৫.যারা আল্লাহর আয়াত ও হুকুম বিধান জানতে পেরেও বর্জন করে।

৬.যারা দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়ে এবং আখিরাতের চাইতে দুনিয়াকে অগ্রাধিকার দেয়।

৭.যারা প্রবৃত্তি তথা কামনা বাসনার অনুসরণ করে, আত্মার দাসত্ব করে।

৮.যারা শয়তানকে সাথি, বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে এবং শয়তানের তাবেদারি করে।

৯.যারা শিরক-বিদআতে লিপ্ত হয়।

১০.যারা আখিরাতের প্রতি উদাসীন, যারা আখিরাতে বিশ্বাস করেনা।

১১.যারা শয়তানের কুমন্ত্রণায় তার প্রতি অনুরক্ত, পরিতুষ্ট হয় এবং তার প্ররোচনায় কুকর্মে লিপ্ত হয়।

১২.যাদের অন্তরে ব্যাধি (মোনাফেকি, বিদ্বেষ, কুধারণা, অহংকার) আছে।

১৩.যারা পাষন্ড, যাদের অন্তর মানবতাবোধ ও দয়ামায়া শূন্য।

১৪.যারা কুরআন থেকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে, কুরআন অনুধাবন ও অনুসরণ করেনা।

১৫.যারা আল্লাহর ইবাদতের ব্যাপারে গাফিল।

১৬.যারা সব কাজে আল্লাহকে স্মরণ করেনা।

১৭.যারা ভ্রান্ত পথে চলেও ঠিক পথে আছে বলে মনে করে, যারা সত্য মিথ্যা ও ন্যায় অন্যায় যাচাই করেনা।

১৮.যারা সত্যকে শুনার ও বুঝার ক্ষেত্রে বধিরের মতো ভূমিকা পালন করে।

১৯.সত্যকে দেখা ও মূল্যায়ণ করার ক্ষেত্রে অন্ধের মতো ভূমিকা গ্রহণ করে।

২০.যারা ইহুদি, (খৃষ্টান) ও আল্লাহর গযবে নিমজ্জিত লোকদের বন্ধু, পৃষ্ঠপোষক ও অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে।

২১.যারা মিথ্যা শপথ করে, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়।

২২.যারা শয়তানের দলভুক্ত হয়েছে।

-এসব লোকদের ঘাড়েই সওয়ার হয় শয়তান। সে তাদের গলায় রশি আর নাকে লাগাম লাগিয়ে ঘুরাতে থাকে আল্লাহদ্রোহীতা ও পাপ পংকিলতার অলিতে গলিতে। তাদের চোখে সে পার্থিব জীবনকে করে তোলে কেবলই ভোগের বস্তু। তাদের প্রতিটি অপকর্মকেই তাদের সামনে তুলে ধরে চমৎকার ও শোভনীয় করে। অবশেষে তাদেরকে সে উপযুক্ত করে গড়ে তুলে জাহান্নামে তার শরিকদার হিসাবে।

২০.শয়তান কাদের উপর কর্তৃত্ব চালাতে পারেনা?

শয়তান সব মানুষের উপর কর্তৃত্ব ও আধিপত্য চালাতে পারেনা। যারা খাঁটি ঈমানদার, আল্লাহর নিষ্ঠাবান দাস, যারা আল্লাহর পথে অটল অবিচল থাকে, যারা নির্ভীক -আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করেনা এবং যারা সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা করে, শয়তান তাদের উপর কর্তৃত্ব চালাতে পারেনা। দেখুন মহান আল্লাহর বাণী :

إِنَّ عِبَادِي لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطَانٌ ۚ وَكَفَىٰ بِرَبِّكَ وَكِيلًا

অর্থ : আমার যারা নিষ্ঠাবান দাস নিশ্চয়ই তাদের উপর তোর কোনো প্রকার কর্তৃত্ব- আধিপত্য চলবেনা। (হে মুহাম্মদ!) উকিল হিসেবে আল্লাহ্ই তোমার জন্যে যথেষ্ট। (সূরা ১৭ ইসরা : আয়াত ৬৫)

إِنَّهُ لَيْسَ لَهُ سُلْطَانٌ عَلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَعَلَىٰ رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ

অর্থ: জেনে রাখো, যারা ঈমান আনে, ঈমানের পথে চলে এবং তাদের মহান প্রভু আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে, তাদের উপর শয়তানের কোনো প্রভাব, আধিপত্য ও কর্তৃত্বই চলেনা। (সূরা ১৬ আন নহল : আয়াত ৯৯)

إِنَّ الَّذِينَ اتَّقَوْا إِذَا مَسَّهُمْ طَائِفٌ مِّنَ الشَّيْطَانِ تَذَكَّرُوا فَإِذَا هُم مُّبْصِرُونَ

অর্থ : যারা সতর্ক সচেতন লোক, শয়তানের পক্ষ থেকে যখনই তারা কোনো কুচিন্তা, কুমন্ত্রনা ও প্ররোচনা অনুভব করে, তখনই তারা আল্লাহকে স্মরণ করে এবং সাথে সাথে তাদের চোখ খুলে যায়, তারা সজাগ সতর্ক হয়ে যায় এবং সত্য পথ ও সঠিক কর্মপন্থা স্পষ্টভাবে দেখতে পায়। (সূরা ৭ আ’রাফ : ২০১)

قَالَ رَبِّ بِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأُزَيِّنَنَّ لَهُمْ فِي الْأَرْضِ وَلَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ – إِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِينَ – قَالَ هَـٰذَا صِرَاطٌ عَلَيَّ مُسْتَقِيمٌ – إِنَّ عِبَادِي لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطَانٌ إِلَّا مَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْغَاوِينَ – وَإِنَّ جَهَنَّمَ لَمَوْعِدُهُمْ أَجْمَعِينَ

অর্থ: ইসলিস বললো : ‘হে প্রভু! আপনি যেহেতু আমাকে বিপথগামী করলেন, তাই পৃথিবীতে আমি মানুষের কাছে তাদের পাপ কর্মসমূহকে শোভনীয় ও চমৎকার করে তুলবো এবং আমি তাদের সবাইকে বিপথগামী করে ছাড়বো- কেবল তাদের মধ্যকার ঐলোকদের ছাড়া, যারা আপনার মনোনীত নিষ্ঠাবান সুপথ প্রাপ্ত।’ আল্লাহ বললেন : হ্যা, এটাই আমার কাছে পৌছার সরল সঠিক পথ -নিষ্ঠার সাথে সরল সঠিক পথে চলা আমার দাসদের উপর তোর কোনো প্রভাব-কর্তৃত্ব-আধিপত্য চলবেনা; তবে বিপথগামীদের যারা তোর অনুসরণ করবে, তাদের কথা ভিন্ন। জাহান্নামই তাদের সবার প্রতিশ্র“ত আবাস। (সূরা ১৫ আল হিজর : আয়াত ৩৯-৪৩)

إِنَّ الشَّيْطَانَ لَكُمْ عَدُوٌّ فَاتَّخِذُوهُ عَدُوًّا ۚ إِنَّمَا يَدْعُو حِزْبَهُ لِيَكُونُوا مِنْ أَصْحَابِ السَّعِيرِ – الَّذِينَ كَفَرُوا لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيدٌ ۖ وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَهُم مَّغْفِرَةٌ وَأَجْرٌ كَبِيرٌ -

অর্থ : শয়তান তোমাদের চিরশত্রু ; সুতরাং তাকে শক্র হিসেবে গ্রহণ। সে তো তার দলকে (অনুসারীদেরকে) জাহান্নামী হবার দিকেই দাওয়াত দেয় (প্রলুদ্ধ করে)। যারা তার দাওয়াতে (প্ররোচনায় পড়ে) কুফুরির পথ অবলম্বন করে, তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি। আর যারা ঈমান আনে এবং আমলে সালেহ করে (ঈমানের পথে চলে এবং পূণ্য কর্ম করে) তাদের জন্যে রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার। (সূরা ৩৫ ফাতির : আয়াত ৬-৭)

وَإِمَّا يَنزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ ۖ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ

অর্থ: তুমি যদি শয়তানের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার প্ররোচনা অনুভব করো, তবে সাথে সাথে তার থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাও। তিনি সর্বশ্রোতা এবং সর্বজ্ঞানী। (সূরা ৪১ হামিম আস্সাজদা : আয়াত ৩৬)

শয়তান কোন্ ধরনের লোকদের উপর কর্তৃত্ব এবং আধিপত্য চালাতে পারেনা, উল্লেখিত আয়াতগুলো থেকে তার একটা সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। সংক্ষেপে সাজিয়ে বললে বলা যায় যে, শয়তান যাদের উপর তার কর্তৃত্ব, আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তার করতে পারেনা, তারা হলো :

১. যারা আল্লাহর নিষ্ঠাবান দাস। যারা আল্লাহর আনুগত্য ও দাসত্বে এবং তাঁর ইবাদতে নিষ্ঠাবান।

২. যারা আল্লাহকে নিজেদের উকিল (তত্ত্বাবধায়ক) হিসেবে গ্রহণ করে।

৩. যারা ঈমান আনে এবং ঈমানের পথে চলে।

৪. যারা আল্লাহর উপর ভরসা ও তাওয়াক্কুল করে।

৫. যারা শয়তান থেকে আত্মরক্ষার ব্যাপারে সদা সতর্ক ও সচেতন থাকে।

৬. যারা ভ্রান্ত পথ থেকে সঠিক পথকে পৃথক করে দেখার ও বুঝার জ্ঞান রাখে।

৭. যারা শয়তানের প্ররোচনা অনুভব করার সাথে সাথে আল্লাহকে স্মরণ করে।

৮. যারা হিদায়াতের পথকে তথা সঠিক সরল পথকে আকঁড়ে ধরে রাখে।

৯. যারা শয়তানকে শত্রু হিসেবে জানে, শত্রু হিসাবে গ্রহণ করে।

১০. যারা ঈমান ও আমলে সালেহ’র পথ গ্রহণ করে।

১১. যারা শয়তানের প্ররোচনা অনুভব করার সাথে সাথে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে।

এইসব লোকদের উপরই ইবলিস শয়তান কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনা। তাদের উপর আধিপত্য ও কর্তৃত্ব খাটাতে পারেনা। বরং শয়তান তাদেরকে ভয় পায়।

২১.শয়তানের ব্যাপারে মহান আল্লাহর মর্মস্পর্শী উপদেশ:

এযাবতকার আলোচনা থেকে পরিষ্কার হলো, মানুষের মূল দুশমন হলো শয়তান। সে মানুষের স্বঘোষিত সুস্পষ্ট দুশমন। তার সর্বসাধনা হলো, মানুষকে আল্লাহর অবাধ্য বানিয়ে জাহান্নামের পথে পরিচালিত করা। এ উদ্দেশ্যে সে মানুষের বিরুদ্ধে ধোকা, প্রতারণা ও বিভ্রান্তির জাল বিস্তার করে। অপরদিকে মানুষও অজ্ঞতা, অন্ধতা, অহমিকা, লোভ লালসা, কামনা বাসনা ও দুনিয়ার মোহের কারণে শয়তানের প্রতারণা ও বিভ্রান্তির জালে আটকা পড়ে।

মানুষ যেনো সতর্ক হয়, শয়তানের প্রতারণার জালে আঁটকা না পড়ে, সে উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ কুরআন মজিদে মানুষকে অনেক মর্মস্পর্শী উপদেশ দিয়েছেন। শয়তানের ব্যাপারে মহান আল্লাহর কয়েকটি উপদেশ উল্লেখ করা হলো :

يَا بَنِي آدَمَ لَا يَفْتِنَنَّكُمُ الشَّيْطَانُ كَمَا أَخْرَجَ أَبَوَيْكُم مِّنَ الْجَنَّةِ يَنزِعُ عَنْهُمَا لِبَاسَهُمَا لِيُرِيَهُمَا سَوْآتِهِمَا ۗ إِنَّهُ يَرَاكُمْ هُوَ وَقَبِيلُهُ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ ۗ إِنَّا جَعَلْنَا الشَّيَاطِينَ أَوْلِيَاءَ لِلَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ

অর্থ: হে আদম সন্তান! শয়তান যেনো তোমাদেরকে তেমনিভাবে ফিতনায় না ফেলে, যেমন করে সে তোমাদের আদি পিতা মাতাকে জান্নাত থেকে বের করেছিল এবং তাদের শরীর থেকে তাদের পোষাক খসিয়ে ফেলেছিল, যাতে তাদের লজ্জাস্থান একে অপরের সামনে খুলে যায়। সে এবং তার সাথি তোমাদেরকে এমন জায়গা থেকে দেখতে পায় যেখান থেকে তোমরা তাকে দেখতে পাওনা। যারা ঈমান আনেনা তাদের জন্যে আমি শয়তানদের অলি (অভিভাবক) বানিয়ে দিয়েছি। (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ২৭)

إِنَّ عِبَادِي لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطَانٌ إِلَّا مَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْغَاوِينَ  وَإِنَّ جَهَنَّمَ لَمَوْعِدُهُمْ أَجْمَعِينَ  لَهَا سَبْعَةُ أَبْوَابٍ لِّكُلِّ بَابٍ مِّنْهُمْ جُزْءٌ مَّقْسُومٌ  إِنَّ الْمُتَّقِينَ فِي جَنَّاتٍ وَعُيُونٍ  ادْخُلُوهَا بِسَلَامٍ آمِنِينَ  وَنَزَعْنَا مَا فِي صُدُورِهِم مِّنْ غِلٍّ إِخْوَانًا عَلَىٰ سُرُرٍ مُّتَقَابِلِينَ  لَا يَمَسُّهُمْ فِيهَا نَصَبٌ وَمَا هُم مِّنْهَا بِمُخْرَجِينَ نَبِّئْ عِبَادِي أَنِّي أَنَا الْغَفُورُ الرَّحِيمُ  وَأَنَّ عَذَابِي هُوَ الْعَذَابُ الْأَلِيمُ 

অর্থ : নিশ্চয়ই যারা আমার নিষ্ঠাবান দাস তাদের উপর তোর কোনো আধিপত্য খাটবেনা। তোর কর্তৃত্ব শুধু ঐ সব ভ্রষ্ট লোকদের উপরই চলবে, যারা তোকে মেনে চলে। তাদের সবার জন্যে দোযখের শাস্তির ওয়াদা রইলো, যার রয়েছে সাতটি দরজা। প্রতিটি দরজার জন্যে তাদের মধ্য থেকে একটি অংশকে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। অপরদিকে মুত্তাকি (সতর্ক) লোকেরা থাকবে বাগানে ও ঝরণাসমূহের মধ্যে। তাদেরকে বলা হবে, ‘তোমরা এতে শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে প্রবেশ করো।’ তাদের অন্তরে একে অপরের প্রতি কোনো প্রকার কুন্ঠাভাব থাকলে তা আমি দূর করে দেবো। তারা ভাই ভাই হয়ে সামনা-সামনি আসনে বসবে। যেখানে কোনো রকম কষ্ট তাদের স্পর্শ করবেনা এবং সেখান থেকে তাদেরকে বেরও করে দেয়া হবেনা। (হে নবী!) আমার দাসদের জানিয়ে দাও আমি ক্ষমাশীল ও মেহেরবান, কিন্তু সেই সংগে আমার আযাবও ভয়ানক যন্ত্রণাদায়ক। (সূরা ১৫ হিজর : আয়াত ৪২-৫০)

وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ كَانَ مِنَ الْجِنِّ فَفَسَقَ عَنْ أَمْرِ رَبِّهِ ۗ أَفَتَتَّخِذُونَهُ وَذُرِّيَّتَهُ أَوْلِيَاءَ مِن دُونِي وَهُمْ لَكُمْ عَدُوٌّ ۚ بِئْسَ لِلظَّالِمِينَ بَدَلًا 

অর্থ : স্মরণ করো, যখন আমি ফেরেশতাদের বলেছিলাম, ‘আদমকে সাজদা করো,’ তখন তারা সাজদা করলো, কিন্তু ইবলিস করলোনা। সে ছিলো জিন। সে তার প্রভুর হুকুম অমান্য করলো। তোমরা কি আমাকে বাদ দিয়ে তাকে ও তার বংশধরদেরকেই তোমাদের অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করবে? অথচ তারা তোমাদের দুশমন। এটা কতইনা মন্দ বদল, যা যালিমরা (আল্লাহর বদলে) গ্রহণ করেছে। (সূরা ১৮ আল কাহাফ : আয়াত ৫০)

وَقُل لِّعِبَادِي يَقُولُوا الَّتِي هِيَ أَحْسَنُ ۚ إِنَّ الشَّيْطَانَ يَنزَغُ بَيْنَهُمْ ۚ إِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلْإِنسَانِ عَدُوًّا مُّبِينًا 

অর্থ: (হে নবী!) আমার নিষ্ঠাবান দাসদের বলে দাও, তারা যেনো এমন কথা বলে যা খুব ভালো। আসলে শয়তানই মানুষের মধ্যে কুমন্ত্রণা দিয়ে ফাসাদ সৃষ্টি করে। নিশ্চয়ই শয়তান মানুষের জন্যে প্রকাশ্য দুশমন। (সূরা ১৭ ইসরা : ৫৩)

সূরা আন্ নিসায় মহান আল্লাহ বলেন : আল্লাহ শুধু শিরকের গুনাহ্ই মাফ করেন না, এছাড়া আর সব গুনাহ্ই মাফ করেন, যার বেলায় তিনি ইচ্ছা করেন। যে আল্লাহর সাথে শরিক করে সে তো গুমরাহিতে বহুদূর চলে গেছে। ওরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে দেবীদের মা’বুদ বানায়। আর ওরা ঐ বিদ্রোহী শয়তানকে মা’বুদ বানায়, যার উপর আল্লাহ লা’নত করেছেন। (ওরা ঐ শয়তানকে মেনে চলে) যে আল্লাহকে বলেছিল, ‘আমি তোমার বান্দাহদের মধ্য থেকে এক নির্দিষ্ট হিস্যা দখল করেই ছাড়বো। (সে আরো বলেছিল) অবশ্যি আমি তাদেরকে গুমরাহ করবো, আশার ছলনায় ভুলাবো, তাদের আমি হুকুম করবো এবং আমার হুকুম মতো তারা পশুর কানে ছিদ্র করবে, আমি তাদেরকে হুকুম করবো এবং তারা আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে বিকৃতি ঘটাবে। যে কেউ আল্লাহ্র বদলে শয়তানকে অলি বানাবে, সে সুস্পষ্ট ক্ষতির মধ্যে পড়বে। শয়তানতো তাদের সাথে ওয়াদা করে এবং তাদেরকে আশা দিয়ে ভুলায়। অথচ শয়তানের ওয়াদা ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। এদের ঠিকানা হলো দোযখ, যেখান থেকে মুক্তির কোনো উপায় ওরা পাবেনা। আর যারা ঈমান আনবে এবং নেক আমল করবে তাদেরকে আমি এমন বাগানে দাখিল করবো, যার নিচে নদী সমূহ প্রবহমান থাকবে এবং তারা সেখানে থাকবে চিরকাল। এটা আল্লাহর খাঁটি ওয়াদা। আর আল্লাহর চেয়ে নিজের কথায় আর কে বেশি সত্যবাদী হতে পারে? (সূরা ৪ আন নিসা : আয়াত ১১৬-১২২)

وَلَقَدْ ذَرَأْنَا لِجَهَنَّمَ كَثِيرًا مِّنَ الْجِنِّ وَالْإِنسِ ۖ لَهُمْ قُلُوبٌ لَّا يَفْقَهُونَ بِهَا وَلَهُمْ أَعْيُنٌ لَّا يُبْصِرُونَ بِهَا وَلَهُمْ آذَانٌ لَّا يَسْمَعُونَ بِهَا ۚ أُولَـٰئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ ۚ أُولَـٰئِكَ هُمُ الْغَافِلُونَ 

অর্থ : অনেক জিন ও মানুষকেই আমি দোযখের জন্যে সৃষ্টি করেছি। (কারণ,) তাদের দিল আছে, কিন্তু তা দ্বারা তারা চিন্তা করেনা। তাদের চোখ আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা দেখেনা। তাদের কান আছে, কিন্তু তার সাহায্যে তারা শুনেনা। তারা পশুর মতো; বরং তার চেয়েও অধম। এরাই ঐ সব লোক যারা গাফলতির মধ্যে পড়ে আছে। (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ১৭৯)

আল্লাহ পাক সূরা আল ফুরকানে বলেন : ঐদিন একটি মেঘ আসমানকে ভেদ করে এগিয়ে আসবে এবং ফেরেশতাদের একের পর এক নাযিল করা হবে। সেদিন সত্যিকারের কর্তৃত্ব হবে শুধু রহমানের। কাফিরদের জন্যে সে দিনটি হবে বড়ই কঠিন। যালিম লোকেরা সেদিন নিজেদের দু’হাত কামড়াতে কামড়াতে বলবে: হায় আমার দুর্ভাগ্য! আমি যদি রসূলের সাথে এক পথে চলতাম! হায় আমার পোড়া কপাল! আমি যদি অমুক লোকটিকে বন্ধু না বানাতাম! তারই ধোকায় পড়ে আমি ঐ উপদেশ মেনে চলিনি, যা আমার কাছে এসেছিল। মানুষের জন্যে শয়তান বড়ই বিশ্বাসঘাতক। (সূরা ২৫ ফুরকান : আয়াত ২৫-২৯)

الَّذِينَ آمَنُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ۖ وَالَّذِينَ كَفَرُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ الطَّاغُوتِ فَقَاتِلُوا أَوْلِيَاءَ الشَّيْطَانِ ۖ إِنَّ كَيْدَ الشَّيْطَانِ كَانَ ضَعِيفًا 

অর্থ : যারা ঈমান এনেছে, তারা আল্লাহর পথে লড়ে যায়, আর যারা কুফরি করেছে তারা লড়াই করে তাগুতের পথে। তাই শয়তানের সাথিদের বিরুদ্ধে লড়ে যাও। জেনে রাখো, শয়তানের চাল বড়ই দুর্বল। (সূরা ২ নিসা : আয়াত ৭৬)

২২. শয়তানের কুমন্ত্রণা ও বিভ্রান্তি থেকে বাঁচার উপায় : কুরআনের বাণী

কুরআন মজিদে শয়তানের কুমন্ত্রণা ও বিভ্রান্তি থেকে আত্মরক্ষার উপায় বলে দেয়া হয়েছে। সেসব উপায় ও প্রক্রিয়া অবলম্বন করলেই শয়তানের প্রতারণা থেকে আত্মরক্ষা করা সম্ভব। সেগুলো হলো :

১.শয়তানের প্ররোচনা অনুভব করলেই আল্লাহর আশ্রয় চাইতে হবে :

وَإِمَّا يَنزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ ۚ إِنَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

অর্থ : যদি কোনো সময় শয়তান তোমাকে উস্কানি দেয় তাহলে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাও। তিনি সবকিছু শুনেন ও জানেন। (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ২০০)

২. শয়তানের প্ররোচনা অনুভব করার সাথে সাথে আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে :

إِنَّ الَّذِينَ اتَّقَوْا إِذَا مَسَّهُمْ طَائِفٌ مِّنَ الشَّيْطَانِ تَذَكَّرُوا فَإِذَا هُم مُّبْصِرُونَ

অর্থ : যারা সতর্ক-মুত্তাকি, শয়তানের কারণে কোনো মন্দ ভাব তাদের মনে জাগার সাথে সাথেই তারা সাবধান সতর্ক হয়ে যায়। তখন তারা স্পষ্ট দেখতে পায় (তাদের জন্যে সঠিক পথ কোনটি)। (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ২০১)

৩. শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় চেয়ে কুরআন পাঠ শুরু করতে হবে :

فَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآنَ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ 

অর্থ : যখন তোমরা কুরআন পড়তে শুরু করো তখন ধিকৃত শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও।১ (সূরা ১৬ নহল : আয়াত ৯৮)

৪. শয়তানকে দুশমন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে :

إِنَّ الشَّيْطَانَ لَكُمْ عَدُوٌّ فَاتَّخِذُوهُ عَدُوًّا 

অর্থ : নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের দুশমন। তাই তোমরাও তাকে তোমাদের দুশমন হিসেবে গ্রহণ করো। (সূরা ৩৫ ফাতির : আয়াত ৬)

৫. শয়তানের প্ররোচনা থেকে সবসময় এভাবে দোয়া করতে থাকুন :

رَّبِّ أَعُوذُ بِكَ مِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ  وَأَعُوذُ بِكَ رَبِّ أَن يَحْضُرُونِ 

অর্থ : প্রভু! শয়তানের প্ররোচনা থেকে আমি তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। প্রভু! আমি তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি আমার নিকট তাদের (শয়তানদের) উপস্থিতি থেকে। (সূরা ২৩ আল মুমিনূন : আয়াত ৯৭-৯৮)

২৩.শয়তানের প্রতারণা ও বিপথগামিতা থেকে রক্ষা পাওয়ার কৌশল- হাদিসের আলোকে:

১. রাতে ঘুম থেকে জেগে আল্লাহকে স্মরণ করুন এবং অযু করে নামায পড়ুন : আবু হুরায়রা রা. বলেন, রসূলুল্লাহ সা. বলেছেন : রাতে যখন তোমরা ঘুমিয়ে পড়ো, তখন শয়তান এসে তোমাদের প্রত্যেকের শিয়রে বসে এবং তোমাদের মাথার শেষাংশে তিনটি গিরা দেয় এবং প্রতিটি গিরায় এই বলে ফু দিয়ে দেয় : ‘রাত এখনো অনেক বাকি, ঘুমিয়ে থাকো।’ তখন ঐ ব্যক্তি যদি রাতে জেগে উঠে এবং আল্লাহকে স্মরণ করে২, তাতে একটি গিরা খুলে যায়। তারপর যদি উঠে অযু করে, তখন আরেকটি গিরা খুলে যায়। অতপর যদি নামায পড়ে, তখন (শয়তানের) সবগুলো গিরাই খুলে যায়। ফলে সুন্দর, পবিত্র ও উৎফুল্ল মনে এই ব্যক্তির দিবসের শুভ সূচনা হয়। আর সে যদি এ কাজগুলো না করে, তবে কলুষ মন আর অলস দেহে এ ব্যক্তির দিবসের সূচনা হয়। (সহীহ আল বুখারি : সৃষ্টির সূচনা অধ্যায়, শয়তান ও তার বাহিনীর কর্মপদ্ধতি অনুচ্ছেদ, হাদিস নম্বর ৩০২৮)

২. যখন ঘুমাতে যাবেন আয়াতুল কুরসি পড়ুন : আবু হুরায়রা রা. বলেন, রসূলুল্লাহ সা. আমাকে রমযানের যাকাত (সদাকুতল ফিতর) পাহারার দায়িত্বে নিয়োগ করেন। আমি পাহারারত থাকাকালেই এক আগন্তুক দু’হাত ভরে খাদ্যসমাগ্রী নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আমি তাকে ধরে ফেললাম। বললাম, তোমাকে আমি রসূলুল্লাহ সা.-এর কাছে হাযির করবো। তখন সে বললো, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি তোমাকে মোক্ষম একটি বিষয় শিখিয়ে দেবো। সে বললো : তুমি যখন ঘুমানোর জন্যে বিছানায় যাবে, তখন আয়াতুল কুরসি পড়ে নেবে। তাতে সর্বদা আল্লাহ তোমাকে হিফাযত করবেন এবং সকাল হওয়া পর্যন্ত কোনো শয়তান তোমার কাছেও ঘেষতে পারবেনা।’ –
ঘটনাটি আমি রসূলুল্লাহ সা.কে অবহিত করলাম, তিনি বললেন : সে ছিলো শয়তান। সে (ছাড়া পাওয়ার জন্যে) তোমাকে সত্য বিষয়টি বলেছে, অথচ সে ডাহা মিথ্যাবাদী। (সহীহ আল বুখারি : সৃষ্টির সূচনা অধ্যায়, শয়তান ও তার বাহিনীর কর্মপদ্ধতি অনুচ্ছেদ, হাদিস নম্বর ৩০৩৩)

৩. আল্লাহ সম্পর্কে প্রশ্ন সৃষ্টি হলে ‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ্ শাইতানির রাজিম’ বলুন : আবু হুরায়রা রা. বলেন, রসূলুল্লাহ সা. বলেছেন : তোমাদের একেক জনের কাছে শয়তান এসে বলবে এটা কে সৃষ্টি করেছে, ওটা কে সৃষ্টি করেছে? শেষ পর্যন্ত বলবে : আল্লাহকে কে সৃষ্টি করেছে? এখান পর্যন্ত আসলেই তুমি বলবে ‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ্ শাইতানির রাজিম -আমি ধিকৃত শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাই।’ -তারপর নিবৃত্ত হয়ে যাবে- আর সম্মুখে অগ্রসর হবেনা। (সহীহ আল বুখারি : সৃষ্টির সূচনা অধ্যায়, শয়তান ও তার বাহিনীর কর্মপদ্ধতি অনুচ্ছেদ, হাদিস নম্বর ৩০৩৪)

৪. সন্ধ্যায় শিশুদের ঘরে রাখুন, আল্লাহর নাম নিয়ে দরজা বন্ধ করুন : জাবির রা. বলেন, রসূলুল্লাহ সা. বলেছেন : সন্ধ্যা নেমে এলে তোমরা তোমাদের শিশুদের ঘরে রাখো। কারণ এসময় শয়তানরা ছড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যা শেষ হলে (প্রয়োজনে) তাদের বাইরে যেতে দিতে পারো। বিসমিল্লাহ বলে ঘরের দরজা বন্ধ করো। বিসমিল্লাহ বলে বাতি নেভাও। বিসমিল্লাহ বলে পানির পাত্র ঢেকে রাখো। বিসমিল্লাহ বলে খাবার পাত্র ঢেকে রাখো। ঢাকার কিছু না পেলে যৎসামান্য কিছু হলেও উপরে দিয়ে রাখো। (সহীহ আল বুখারি : সৃষ্টির সূচনা অধ্যায়, শয়তান ও তার বাহিনীর কর্মপদ্ধতি অনুচ্ছেদ, হাদিস নম্বর ৩০৩৮)

৫. কারো মনে সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে- এমন বিষয়গুলো স্পষ্ট করে বলে দিন : উম্মুল মুমিনিন সুফিয়া বিনতে হুয়াই রা. বলেন : রসূলুল্লাহ সা. মসজিদে ই’তেকাফরত ছিলেন- এমতাবস্থায় একরাত্রে আমি তাঁর সাথে সাক্ষাত করতে গেলাম এবং কিছু প্রয়োজনীয় কথা বললাম। অতপর আমি ঘরে ফেরার সময় রসূলুল্লাহ সা. আমাকে এগিয়ে দিতে উঠে এলেন। এসময় দুজন আনসার সাহাবি ওখান দিয়ে অতিক্রম করছিল। তারা আল্লাহর রসূলকে দেখেই দ্রুত হাঁটতে লাগলো। তখন রসূলুল্লাহ সা. তাদের বললেন : ‘একটু থামো, এহলো আমার স্ত্রী সুফিয়া বিনতে হুয়াই।’ এ কথা শুনে তারা বললো : ‘সুবহানাল্লাহ, হে আল্লাহর রসূল! আমরা কি আপনার ব্যাপারে অন্য কিছু ধারণা করতে পারি? তখন রসূলুল্লাহ সা. বললেন : শোনো, শয়তান রক্তের মতোই মানুষের ধমনীতে প্রবাহিত হয়। আমার আশংকা হয়েছিল, সে তোমাদের অন্তরে কোনো কুধারণা সৃষ্টি করে দেয় নাকি। (সহীহ আল বুখারি : সৃষ্টির সূচনা অধ্যায়, শয়তান ও তার বাহিনীর কর্মপদ্ধতি অনুচ্ছেদ, হাদিস নম্বর ৩০৩৯)

৬. রাগান্বিত হলে ‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ্ শাইতানির রাজিম’ বলুন : সুলাইমান বিন সুরাদ বলেন, একবার আমি রসূলুল্লাহ সা.-এর কাছে বসা ছিলাম। এসময় দুজন লোক পরস্পরকে গালাগাল করছিল। রাগে তাদের একজনের চেহারা লাল হয়ে গেলো এবং গলার রগ ফুলে উঠলো। তখন রসূলুল্লাহ সা. বললেন : আমি এমন একটি বাক্য জানি, এ ব্যক্তি যদি সেটি উচ্চারণ করে, তবে তার রাগ পড়ে যাবে। সে যদি বলে : “আউযুবিল্লাহি মিনাশ্ শাইতানির রাজিম- আমি ধিকৃত শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাই”, তবে তার রাগ পড়ে যাবে।৩ (সহীহ আল বুখারি : সৃষ্টির সূচনা অধ্যায়, শয়তান ও তার বাহিনীর কর্মপদ্ধতি অনুচ্ছেদ, হাদিস নম্বর ৩০৪০)

৭. সারাদিন শয়তান থেকে রক্ষাকারী একটি বাক্য :

لاَ اِلٰهَ الاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَه لَه الْمُلْكُ وَلَه الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْئٍ قِدِيْر

অর্থ: “আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি এক, তাঁর কোনো অংশীদার ও সমকক্ষ নেই, সমস্ত কর্তৃত্ব তাঁর, সমস্ত প্রশংসা তাঁর এবং তিনি সর্বশক্তিমান।”
-যে ব্যক্তি দিনে শতবার এই বাক্যটি উচ্চারণ করবে, সে দশজন মানুষকে গোলামির বন্ধন থেকে মুক্ত করার সমপরিমাণ পুরস্কার লাভ করবে, তার জন্যে শতটি পূণ্য লেখা হবে, তার শতটি পাপ মুছে দেয়া হবে এবং এ বাক্যটি সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত ঐদিন তার জন্যে প্রতিরক্ষা বুহ্য রচনা করবে। (সহীহ আল বুখারি : সৃষ্টির সূচনা অধ্যায়, শয়তান ও তার বাহিনীর কর্মপদ্ধতি অনুচ্ছেদ, হাদিস নম্বর ৩০৫১)

৮. শয়তানকে নিজের থেকে দূরে রাখার কৌশল: আনাস রা. বলেন, রসূলুল্লাহ সা. বলেছেন: কেউ যদি ঘর থেকে বের হবার সময় নিম্নোক্ত কথাগুলো বলে, তখন (আল্লাহর পক্ষ থেকে) তাকে বলা হয় : ‘তোমাকে সঠিক পথ দেখানো হবে, আল্লাহ তোমার জন্যে যথেষ্ট হবেন এবং তোমাকে নিরাপদ রাখা হবে।’ অতপর শয়তান তার থেকে দূরে চলে যায়। তারা পরস্পরকে বলে: তুমি কিভাবে ওর উপর প্রভাব বিস্তার করবে, যাকে সঠিক পথ দেখানো হয়েছে, আল্লাহ যার জন্যে যথেষ্ট হয়েছেন এবং যাকে নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে? সেই কথাগুলো হলো :

بِسْمِ اللهِ تَوَكَّلْتُ عَلَى اللهِ لاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ اِلاَّ بِا للهِ

অর্থ: ‘আমি আল্লাহ্র নামে আরম্ভ করছি এবং আল্লাহ্র উপর তাওয়াক্কুল করছি। আল্লাহ ছাড়া কারো কোনো শক্তি ক্ষমতা নেই।’ (তিরমিযি, আবু দাউদ, নাসায়ী)

৯. শয়তানকে আপনার ঘরে ঢুকতে এবং আহারে অংশ নিতে দেবেন না : জাবির রা. বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সা.কে বলতে শুনেছি : শয়তানরা তোমাদের ঘরের সদর (আগ) দরজায় ওঁৎ পেতে বসে থাকে। সে এই সংকল্প নিয়ে বসে থাকে যে, তোমাদের কেউ যখন ঘরে প্রবেশ করবে, সেও তার সাথে ঘরে প্রবেশ করবে এবং তার খাবার গ্রহণে অংশগ্রহণ করবে। যখন কোনো ব্যক্তি আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে ঘরে প্রবেশ করে এবং আল্লাহর নাম নিয়ে খেতে আরম্ভ করে, তখন (ওঁৎ পেতে থাকা) শয়তান তার সাথিদের বলে : ‘এ ঘরে আজ তোমাদের রাত্রিযাপন হলোনা এবং রাতের খাবারও জুটলোনা।’ আর কোনো ব্যক্তি যখন আল্লাহর নাম উচ্চারণ ছাড়াই ঘরে প্রবেশ করে, শয়তান তার সাথিদের বলে : ‘যাও, আজ এ বাড়িতেই তোমরা রাত কাটাবে।’ অতপর ঐ ব্যক্তি যদি আহার গ্রহণকালেও আল্লাহর নাম উচ্চারণ না করে, তখন শয়তান তার সাথিদের বলে : এ বাড়িতেই আজ তোমরা রাত কাটানোর এবং খানা খাবার সুযোগ পেলে। (সহীহ মুসলিম, সুনানে আবু দাউদ)

১০. দীনের সঠিক ও যথার্থ জ্ঞানার্জন করুন : শয়তানের প্রতারণা ও বিভ্রান্তি থেকে আত্মরক্ষা করার সবচেয়ে বড়, কার্যকর ও মোক্ষম হাতিয়ার হলো, দীন সম্পর্কে, ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ও যথার্থ জ্ঞানার্জন করা। কুরআন সুন্নাহর সঠিক জ্ঞান রাখেন এমন লোকদের শয়তান ভয় পায় এবং খুব কমই তাদের প্রতারিত করতে পারে। কারণ,

ক. যিনি সঠিক পথ জানেন, আসল জিনিস চেনেন, তাকে কেউ ভুল পথে নিতে পারেনা এবং মেকি জিনিস গছাতে পারেনা।

খ. তিনি যদি কখনো ভুল করেও ফেলেন, তিনি তা বুঝতে পারেন। ফলে তিনি তওবা করেন, অনুতপ্ত হন এবং ভুল শুধরে নেন।

গ. তাঁর সংগি-সাথি এবং আশে পাশের লোকদের তিনি সব সময় জ্ঞান দান করনে, তাদের উপদেশ নসিহত করেন, তাদের ভুল শুধরে দেন এবং শয়তানের বিভ্রান্তি থেকে তাদের সতর্ক রাখেন। এসব কারণেই রসূলুল্লাহ সা. বলেছেন :

فَقِيْهٌ وَاحِدٌ اَشَدٌّ عَلَى الشَّيْطَانِ مِنْ اَلْفِ عَابِدٍ

অর্থ: দীনের সঠিক ও যথার্থ জ্ঞানের অধিকারী একজন সমুঝদার ব্যক্তি শয়তানের জন্যে হাজার (অজ্ঞ) ইবাদতগুজারের চাইতেও ভয়াবহ। (ইবনে মাজাহ)

সমাপ্ত

Processing your request, Please wait....
  • Print this article!
  • Digg
  • Sphinn
  • del.icio.us
  • Facebook
  • Mixx
  • Google Bookmarks
  • LinkaGoGo
  • MSN Reporter
  • Twitter
৫০৫ বার পঠিত
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (ভোট, গড়: ৪.০০)

৫ টি মন্তব্য

  1. আরে সর্বনাশ , এটাতো বিশাল পোস্ট । সিরিজ আকারে দিলে ভালো করতেন । এত বড় পোস্ট ব্লগে কেউ সাধারনত পড়ে না ।

  2. একসাথে অনেক তথ্যের সমাবেশ, আইডিয়া ভালই।
    পড়তে গিয়ে বার বার ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলাম, হয়তো শয়তান পাশেই ছিল।
    আমি আমার শয়তানকে মু’মিন বানিয়ে দিতে চাই – কিভাবে সম্ভব?

    جزاك الله

    হাফিজ

    @হাসান আল বান্না,

    আমি আমার শয়তানকে মু’মিন বানিয়ে দিতে চাই – কিভাবে সম্ভব?

    আগে নিজেকে শক্তিশালী মুমিন বানাতে হবে , তারপরে শয়তানকে শিক্ষা দেয়ার ব্যাপারটা আসবে :)

  3. বার বার ক্লান্ত হয়ে পড়লাম

  4. কষ্ট করে লেখাটি পড়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ। (F).। আর নিজ শয়তানকে মুমিন বানাতে হলে আমার মতে সঠিক নিয়তে এলেম অনুযায়ী আমল করতে হবে, সর্বদা আল্লাহর জিকির করতে হবে ও সৎলোকের সহবৎ অবলম্বন করতে হবে।