উলামায়ে দেওবন্দের অবদান ও আমাদের প্রত্যাশা
লিখেছেন: ' guest' @ রবিবার, অক্টোবর ৭, ২০১২ (১:২৩ অপরাহ্ণ)
উলামায়ে দেওবন্দের অবদান উল্লেখ করা আমার জন্য সহজ নয়। লিখতে গেলে বহু পৃষ্ঠা লিখতে হবে, বহু সময় লাগবে। ইতিহাস সম্পর্কে অনেক জ্ঞানও লাগবে। আমার অতটা নেই। আমি শুধু দুটি মুসলিম সংখ্যালঘু অঞ্চলের মুসলমানদের অতীত ও বর্তমান অবস্থার কথা বলব যেখানে মুসলমানরা একসময় অনেক প্রভাবশালী ছিল। যারা বুঝার তারা এতেই বুঝবে। যারা ইচ্ছাকৃত ভাবে না বুঝবে তাদের বুঝানোর জন্য হাজার ভলিউমও বৃথা।
এক হল আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশ। আরেক হল পুর্ব ইউরোপ। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমান শাসকরা প্রায় ১২০০ বছর শাসন করেছে। বিভিন্ন সময় এখানে মুসলমানের সংখ্যা কম বেশী হয়েছে। সর্বশেষ যখন মুসলমানরা এখানে শাসন কতৃত্ব হারায় তখন এ অঞ্চলের মুসলমানের সংখ্যা ২০-২২% ছিল বলে ধারণা করা হয়। এখন এই সংখ্যা ৩০-৩৫% এর মধ্যে অবশ্য কাদিয়ানী ও শিয়ারাও আছে। পক্ষান্তরে পূর্ব ইউরোপে মুসলমানদের শাসন কাল নির্ধারণ করা কিছুটা কঠিন, কেননা মুসলমানরা সেখানকার বিভিন্ন অঞ্চল বিভিন্ন সময় কাল ধরে শাসন করেছে। যেমন তুরস্ক, সাইপ্রাস, আজারবাইজান সেই খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগ থেকেই। আবার কিছু কিছু এলাকাতে ১০০ বছর ধরে মুসলমানদের রাজত্ব ছিল। পুর্ব ইউরোপের দেশ গুলো মোটামুটি তুরস্ক, সাইপ্রাস, আরজারবাইজান, আর্মেনিয়া, জর্জিয়া, ইউক্রেন, বাসনিয়া, বুলগেরিয়া, গ্রিস, আলবেনিয়া, কসোভো, সার্বিয়া, স্লোভেনিয়া, মন্টিনিগ্রো, মেসিডোনিয়া, রাশিয়ার বেশ কিছু অংশ। এর মধ্যে তুরস্ক ও আজারবাইজানে প্রায় ৯৮% মুসলমান তবে কট্টর ধর্মনিরপেক্ষ আলাভীরা সহ। তুরস্কের এরা ২৫% আজারবাইজানে ৮০% আলাভী আছে। এছাড়া অন্যান্য দেশগুলোতে মুসলমানের সংখ্যা, কসোভোতে ৯৫% আলবেনিয়াতে ৯০% বসনিয়াতে ৫০% মেসিডোনিয়াতে ৩৫% সাইপ্রাসে ৩০% বুলগেরিয়া, জর্জিয়া, মন্টেনিগ্রো ও রাশিয়াতে ২০% সার্বিয়ায় ২% এ সংখ্যা অবশ্য কসোভো স্বাধীন হয়ে যাবার পর, এবং স্লোভেনিয়াতে ৪% মুসলমান আছেন, আর আর্মেনিয়াতে একসময় প্রচুর মুসলমান থাকলেও এখন তা ১% এর কম। মোটামুটি এ পুরো অঞ্চলে ১৫%-২০% এর মত মুসলমান এখন আছেন। তবে এসংখ্যা নমুনা ও জরিপ ভিত্তিক। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশী হতে পারে। এদেশ গুলো ১৯২৩ সালে তুর্কি খেলাফত বিলুপ্ত হবার আগ পর্যন্ত (কম বেশী) মুসলমানদের শাসনাধীন ছিল। ধারণা করা হয় সে সময় নাগাদ এখানে ৪৫-৫০% মুসলমান বাস করতেন। এপর ৭০-৮০ বছরের জন্য এখানে কমিউনিজমের অভিশাপ নেমে আসে। এই বছর গুলোতে মুসলমানদের ভাগ্যে কি ঘটে ছিল তা জানা যায় না। কোন সংবাদ মাধ্যমেও এদের খবর আসে নি। আর কোন ইতিহাসও সেভাবে পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয় বেশ বড় একটা অংশ শহীদ হয়েছেন, কিছু নাস্তিক বা ধর্মান্তরিত হয়েছেন, কিছু হিজরত করে আরব ও পার্শবর্তী মুসলমান দেশে চলে গিয়েছেন। কিছু বিভিন্ন অকমিউনিস্ট দেশগুলো যেমন আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানী ইত্যাদি দেশ গুলোতে চলে গিয়েছেন। আর যারা রয়ে গেছেন তাদের মধ্যে মুসলমানিত্ব অবশ্য খুব কমই রয়ে গেছে। প্রায় সবটাই হারিয়ে গেছে। তারা শুধু পরিচয় দেয় মুসলমান হিসেবে। অনেকে অবশ্য তাও দিতে চায় না। এছাড়া তাদের চলা ফেরা, জীবন যাপন পদ্ধতি, বিয়ে শাদী, চিন্তা ভাবনা, পোষাক আষাক, কালচার কোন দিকে দিয়ে মুসলমান হিসেবে চেনার কোন উপায় নেই। বিভিন্ন মুসলিম অকেশনে এই সব দেশের বাইরের মুসলমানদেরই শুধু কিছু কর্মকান্ড নজরে আসে, যাদের বেশীর ভাগই নওমুসলিম অথবা আরব বা উপমহাদেশীয় আভিবাসী। আজ অবস্থা তো এই, অধিকাংশ মানুষ জানেও না যে এসব দেশে এত এত মুসলমান আছেন। মানুষ ইউরোপের মুসলমান বলতে শুধু ফ্রান্স, ইংল্যান্ড আর জার্মানীর অভিবাসী মুসলমানদেরই বুঝে। অথচ এসব এলাকায় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলমানরা বসবাস করে আসছেন।
পক্ষান্তরে আমাদের উপমহাদেশে ১৭৫৭ সালের পর থেকেই মুসলমানদের তেমন কোন রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক প্রভাব ছিল না। আর ১৭৯৯ সালের মহীশুরের সিংহ টিপু সুলতানের পরাজয়ের মাধ্যমে চুড়ান্ত ভাবে হাত ছাড়া হয়ে যায় শাসন ক্ষমতা। এরপর মুসলমানদের ইতিহাস শুধু অপমান, লাঞ্ছনা, অত্যাচার আর গনহত্যার ইতিহাস। এর আগে মুসলমানদের প্রতি জনপদে মাদ্রাসা ছিল। এসব মাদ্রাসা সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় চলত। আর বড় বড় জায়গীর ছিল এসব মাদ্রাসার নামে। এ দিয়েই এর খরচ চলত। কারও কাছে হাত পাততে হত না এসব মাদ্রাসার। কাউকে পাত্তা দেয়ার দরকার পড়ত না। কাউকে বেতন দিয়েও পড়তে হত না। ইংরেজরা একে একে সব মাদ্রাসা ধ্বংস করে। একের পর এক উলামাকেরাম বলা চলে যাকে যেখানে যেভাবে পেয়েছে কোন ধরণের অভিযোগ বা বিচার ছাড়াই নিত্য নতুন প্রক্রিয়ার প্রাণদন্ড দিতে ছিল। লোমহর্ষক সব উপায়ে শাস্তি দিতে থাকে। এসব অত্যাচারের মাত্রা এত বেশী ছিল যে, এর বিবরণ মানুষের কাছে অতিরঞ্জন বলে মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা এটাই ছিল। মুসলমানদের জমিজমা কেড়ে নিয়ে ভূমিদাস বানানো হয়। মুসলমানদের দৈনন্দিন আমাল ও অভ্যাসেও বাঁধা দেয়া হয়। দাঁড়িও উপর উচ্চ হারে কর বসানো হয়। মুসলমানদের ঈমান ও আকীদাহ ধ্বংস করার জন্য সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন ফেরকার জন্ম দেয়া হয়। একই সাথে বিভিন্ন ভাবে ভুল বুঝিয়ে অনেক সরলমনা মুসলমানদের খৃষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করে। এর সাথে পর্তুগিজ ও ফরাসী দস্যুদের অত্যচার তো ছিলই। এদেশীয় হিন্দুদেরও মুসলমানদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা ও ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করে বিবাদ বাঁধিয়ে দেয়া হয়।
এরই প্রেক্ষাপটে কিছু উলামাকেরাম অন্তরালে চলে যান। আর প্রত্যন্ত এক গ্রামে এক মাদ্রাসা গঠন করেন। যে গ্রামের নাম দেওবন্দ। দেওবন্দ মাদ্রাসা তাই নতুন কিছু নয়। নতুন কোন সম্প্রদায় বা নতুন কোন আকীদাও নয়। নতুন কোন ধারাও নয়। ফেরকাও নয়। বরং উপমাহাদেশের ইসলামের ধারাবাহিকতাই দেওবন্দ মাদ্রাসা। অবশ্য এরপর থেকে উপমহাদেশের ইসলামের ইতিহাস আর দেওবন্দের ইতিহাস সমার্থক। কেননা উলামায়ে দেওবন্দ অনেক কষ্ট কুরবানী, ত্যাগ তিতিক্ষা, কৌশল প্রয়োগ করে এখানে ইসলামের ধারাবাহিকতা টিকিয়ে রেখেছেন। বলতে পারেন মহানবী স. এর মক্কার জীবনের এক প্রতিচ্ছাবি ছিল দেওবন্দের শুরু দিকের সময় গুলো। পরবর্তীতে দেওবন্দী উলামাদের উপরও চলে ইংরেজদের লোমহর্ষক সব অত্যাচার। দেওবন্দের প্রথম ছাত্র মাওলানা মাহমুদুল হাসানকে মাল্টায় নির্বাসনে পাঠানো হয়। ইতিহাস বলে খাব্বাব রা. এর মত অত্যাচার চলে তার উপর সেখানে। আজকের গুয়েনতামো বে এর জেলখানার কথা শুনেই আমরা অবাক হই। সারা দুনিয়ার কাফেররা পর্যন্ত সোচ্চার। কিন্তু মাল্টার জেলখানার তুলনায় গুয়েন্তামো বে অনেক আরামের জায়গা। এভাবে দুশো বছর অত্যাচার চলে। আসল ব্যাপার হল ইংরেজরা চেয়েছিল ইসলাম মিটে যাক। ইসলাম মেটানোর জন্য সম্ভাব্য যত পদ্ধতি তাদের জানা ছিল সবই তারা প্রয়োগ করেছিল। কিন্তু এই সব মহান আলেমদের কুরবানী এ অঞ্চলে মুসলমানদের সংখ্যা তো বাড়িয়েছেই, আজও এখানে নবীজি সুন্নত ১০০% পালন করার জন্য আগ্রহী মানুষে অভাব হয় না। নবীজির শানে বেয়াদবী প্রতিবাদে জীবন দেয়ার জন্যও মানুষের অভাব নেই এখানে।
পূর্ব ইউরোপে এমন টা হয় নি, কেন না ওখানে দেওবন্দ ছিল না। এজন্যই মাত্র আশি বছরেই ইসলামের নাম বাদে সবই মিটে গেছে। এমন কি যে তুরস্ক একসময় পুরো মুসলিম জাহানের নেতৃত্ব দিয়েছিল তারা আজ ধর্ম নিরপেক্ষতার নেতৃত্ব দিচ্ছে।
পূর্ব ইউরোপ আর ভারতীয় উপমাহাদেশের ইসলামের অতীত ও বর্তমানের তুলনাই দেওবন্দের ভুমিকা তুলে ধরার জন্য যথেষ্ট।
বুঝতেই পারছেন দেওবন্দীদের প্রতি আমাদের প্রত্যাশার পারদও অনেক উঁচুতে। যেখানে আশা বেশী থাকে, সেখানে আশাভঙ্গের বেদনাও বেশী থাকে। আমরা চাই আজও সেই কুরবানী বজায় থাকুক। আজও সেই কুরবানীর চাহিদা আছে। বরং আরও বেশী। আমরাও আপনাদের সাথে আছি। আমাদের ঢারা শহরেও তাঁদের অবদান কম নয়। এখানে মাজার ও মিলাদের অবস্থাই এর প্রমাণ। আলহামদুলিল্লাহ ঢাকা শহরে কোন মাজার বা মিলাদ নেই। হ্যাঁ অল্প কিছু আছে ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য যে, দেখ এক সময় এরা দোর্দান্ড প্রতাপে বিদ্যমান ছিল কিন্তু উলামায়ে দেওবন্দের ভূমিকায় তারা আজ কোনঠাঁসা। আজও তাঁরা চাইলে, পদক্ষেপ হাতে নিলে আমাদের ঢাকা শহর থেকে বদদ্বীনীর বাকি নমূনাগুলোও খতম করতে পারেন।
আমরা তাঁদের স্বর্ণালী পদক্ষেপের অপেক্ষায় থাকলাম।