রমজান মাসের ফজীলত, করণীয় ও বর্জনীয়
লিখেছেন: ' হাফিজ' @ বুধবার, মে ১০, ২০১৭ (১২:১২ অপরাহ্ণ)
রমজান মাসের ফজীলত, করণীয় ও বর্জনীয়
তায়েফে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম যখন দ্বিন প্রচার করতে গেলেন তখন তায়ফবাসী পাথর মেরে ওনাকে রক্তাক্ত করে দিলেন। হযরত জীবরিল (আ:) দুপাহাড়কে একত্রিত করে তায়েফবাসীকে ধংস করে দেয়ার অনুমতি চাইলেন। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বললেন, “হে আল্লাহ, তাদেরকে হেদায়েত দান করুন”। আর একবার হযরত জীবরিল (আ ) বললেন “যে রমজান মাস পেয়েও তার গোনাহ ক্ষমা করে নিতে পারল না সে ধংস হোক”। এটা শুনে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বললেন “আমীন”।তায়েফবাসী যারা ছিল কাফের, তাদের জন্য বদদোয়া করলেন না, অথচ মুসলমানদের জন্য রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বদদোয়া করলেন। এটা কেনো? একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বোঝা যাক-মনে করুন একটি ১৫,১৬ বছরের ছেলেকে আপনি ৫ + ৫ কত হয় জিগ্যেস করলেন, সে যদি না পারে তখন আপনি অবশ্যই আশ্চর্য হবেন এবং তাকে তিরস্কার করবেন, এমন সহজ একটি যোগ না পারার কারণে। রমজান মাসের এমন ফজীলত এবং আল্লাহর এত অসীম রহমত নাজীল হয় যে, এরপরও কেউ যদি তার গোনাহ মাফ করে নিতে না পারে, তাহলে সে-ও তেমন তিরস্কারে যোগ্য, যেমন যোগ্য একটি ১৫, ১৬ বছরের ছেলে ৫ + ৫ কত সেটা যদি না বলতে পারার কারণে । হযরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানী (রহ:) তার মকতুবাতে বলেন, রমজান মাসে যে রহমত নাজীল হয় তার তুলনায় অন্যান্য মাসের নাজিলকৃত রহমত, সমুদ্রের তুলনায় এক ফোটা পানির মতো। এই কারণে সমস্ত আসমানী কিতাব নাজিল হয়েছে রমজান মাসে। এই মাসে কোনো নফল করলে সেটা ফরজের সমান সওয়াব, আর কোনো ফরজ করলে সেটা ৭০ গুণ সওয়াব। পূর্ববর্তি মুত্তাকী, আল্লাহওয়ালা গণ একজন আর একজনকে প্রশংসা করার সময় বলতেন, সেই ব্যক্তি এতগুলো রমজান পেয়েছে তার জীবনে, এটাই তার গ্রহনযোগ্যতার প্রমান, সোবহানাল্লাহ। হাদিস শরীফে এসেছে, রসুলুল্লাহ দোয়া করতেন “হে আল্লাহ, রজব ও শাবান মাসে আমাদের জন্য বরকত দান করুন এবং আমাদেরকে রমজান পর্যন্ত পৌছিয়ে দিন”। এ মাসটি কত বরকতময় যে তা পাবার জন্য আল্লাহর রসুল পর্যন্ত দোয়া করতেন। সুবহানা্ল্লাহ আল্লাহ-তাআলা ক্বোরআন কারীমায় বলেন –
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পার।
(সুরাহ বাকারাহ: ১৮৩)
উপরের আয়াতে আল্লাহতাআলা বলেন, রোজা এই কারণে ফরজ করা হয়েছে যাতে আমরা পরহেজগার, মুত্তাকী হতে পারি। আর পরহেজগার হবার জন্য প্রথম গোনাহ পরিত্যাগ করতে হবে, তারপর নেকী বেশী বেশী করে করতে হবে।
গোনাহ বর্জন
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেন “অনেকে রোজার দ্বারা ক্ষুধার্ত এবং তৃষনার্ত ছাড়া অন্য কিছুই লাভ করেনা। অন্য এক হাদিস শরীফে বলেন “যে গর্হিত কথাবর্তা এবং পাপ কাজ পরিত্যাগ করতে পারেনা, আল্লাহ সুবহানাহু তাআলার তার খাবার এবং পানীয় ত্যাগ করায় কোনো প্রয়োজন নেই। অর্থ্যাৎ তার রোজা গ্রহণীয় নয়। সহীহ আল বুখারী (ভলি:৩, হাদিস:১২৭) সবরকম গোনাহ থেকে বেচে থাকতে হবে। এর মধ্যে আর একটি ভয়াবহ গোনাহ হোলো গীবত। গীবতে একটি ঘটনা নীচে বলা হোলো: গীবত থেকে বেচে থাকা: রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর যুগে দুই মহিলা রোজা রাখল। রোযায় তাদের এত কষ্ট হোলো যে, তারা মৃত্যুর মুখোমুখী হোলো। রসুলুল্লাহ এর খেদমতে বিষয়টি জানানো হলে তিনি তাদের কুলি করতে বললেন। তারা কুলি করলে তাদের মুখ থেকে ছোটো গোস্তের টুকরা বের হোলো। তারা আশ্চর্য হয়ে বলল, আমরা তো কোনো পানাহারই করিনি। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বললেন, মুলত তোমরা রোজা রেখে অন্যের গীবত করেছ। আর গীবত হোলো মৃত ভাইয়ের গোস্ত খাওয়া। বর্তমানে আমাদের এমন অব্হা যে, চুপ থাকলে সওয়াব হয়, আর কথা বললে গীবত করি। অনেকে তো এটাকে গোনাহ মনে করি না। সাধারন মুসলমান থেকে শুরু করে আলেমগণ পর্যন্ত এই গোনাহে লিপ্ত। গীবতে আর একটি ভয়াবহ দিক হোলো, আপনি যার গীবত করছেন, তার গোনাহ গুলো আপনার আমলনামায় চলে আসবে আর আপনার নেকীগুলো তার আমলনামায় চলে যাবে। এমনি আমাদের আমল কত কম, এরপর যদি নেকগুলো চলে যায়, তাহলে আফসোসের বিষয়। হযরত শেখ শাদী (রহ:) ছোটকালে তার বাবার সাথে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তেন। একদিন তিনি তার পিতাকে বললেন আব্বা বাসার অন্যান্যরা কিন্তু তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ছে না। তার পিতা বললেন, “তারা তোমার চেয়ে উত্তম, আরো ভালো হোতো তুমি যদি নামাজ না পড়ে তাদের মতো ঘুমিয়ে থাকতে।” শেখ শাদি (রহ:) এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন “তারা ঘুমিয়ে আছে অথচ কারো গীবত করছে না , যেটা তুমি করছ”। ভাবলে অবাক হতে হয়, কত সতর্ক ছিলেন তারা। আজ আমরা সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ মনে করে গীবত করি। যেটাও শয়তানের ধোকা।
অন্যান্য গোনাহ
আসুন এই রোজায় সমস্ত গোনাহ থেকে তওবা করে ফেলি। মনে করি এটাই আমাদের শেষ রোজা। যারা মোবাইলে গান শোনেন তারা অন্তত এই মাসটা গান বন্ধ রাখুন, এর পরিবর্তে কোরআন তেলাওয়াত, হামদ, কাসিদা শুনুন ।যাদের বাজারে দোকান আছে, অন্তত এই মাসের সম্মানে টেলিভিশন বন্ধ রাখুন, গান বন্ধ রাখুন। হয়ত এর ওসীলায় আল্লাহ তাআলা আপনাকে/আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। গোনাহ সব সময় বড় ভাবুন, কোনো গোনাহ-ই ছোটা না। আশরাফ আলী থানভী (রহ:) বলেন, কেউ কি কখনও বলে এটা ছোট আগুন ওটা বড় আগুন। ছোট হোক, বড় হোক পুড়িয়ে ধংস করার জন্য এক শলতে আগুনই যথেষ্ট। তেমনি গোনাহ ছোট হোক বা বড় হোক সব ক্ষতিকর। একবার এক বুজুর্গ ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে যাবার সময় দেখলেন এক ব্যক্তি বসে বসে কাদছেন। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে সেই ব্যক্তি বললেন অনেক আগে এই জায়গায় আমি একটি গোনাহ করেছিলাম, সেই কথা মনে করে কাঁদছি। সুবহানাল্লাহ। একেই বলে প্রকৃত খোদাভীতি। আরা আমাদের অবস্হা এমন, গোনাহ করে গর্ব করে বেড়াই। একটি জিনিস মনে রাখবেন, খাবার থেকে বিরত রাখা নিজেকে সহজ, কিন্তু গোনাহ থেকে নিজেকে বিরত রাখা খুবই কঠিন। আর যদিও গোনাহ থেকে নিজেকে বিরত রাখা সহজ হয়, অন্তরকে আল্লাহ ছাড়া সমস্ত কিছু থেকে বিরত রাখা আরো কঠিন
নেকী অর্জন
সারা বছর আমরা আমাদের জন্য ব্যয় করছি, একটি মাস না হয় আল্লাহর জন্য ব্যয় করলাম । মহিলারা জিকির করতে করতে সেহরী, ইফতার তথা সবসময় খাবার রান্না করতে পারেন পুরুষরা জিকির করতে করতে ফসল কাটবেন অফিসে চাকরী করতে পারেন। এতে আমাদের কাজও সমাধা হবে, সাথে সওয়াবও পেতে থাকব। কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ বললে, সম্পূর্ণ কাজটি তাহলে সওয়াবের মধে গন্য হবে।
নেককারদের আমল
আসুন আমরা দেখি আগেকার মুত্তাকী, পরহেজগার ব্যক্তিগণ কিভাবে নিজের জীবন অতিবাহিত করতেন। ইমাম আবু ইউসুফ (রহ:) ছিলেন প্রধান বিচারপতি অথচ দৈনিক ২০০ রাকাত নফল নামাজ পড়তেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ:) রোজার মাসে দিনে এক খতম, রাতে তাহাজ্জুদে ১ খতম এবং তারাবীতে ৩ খতম অর্থ্যাৎ রোজার মাসে আনুমানিক ৬৩ বার কোরআন খতম দিতেন। হযরত আলী কুরাইশি (রহ:) মাঠে কাজ করতে যেতেন আর মুখে মুখে জিকির করতেন। এভাবে প্রতিদিন উনি ৭০ হাজার বার আল্লাহর জিকির করতেন ।জান্নাতে মুমিনদের একমাত্র আফসোস থাকবে একটি বিষয় নিয়ে, দুনিয়াতে জিকির ছাড়া যে সময় অতিবাহিত করেছে শুধুমাত্র সেই সময়টা নিয়ে ।আল্লামা শারানী (রহ:) বলেন, আমরা এমন পুণ্যবাণদের দেখা পেয়েছে যারা রোযার মাসে হাসি-তামাশা থেকেও নিজেকে বিরত রাখত।
নিজেকে জিজ্ঞেস করুন?
চলুন নিজের হিসেব নেয়া যাক। আমাদের রোজা কি অবস্হায় আছে? আসলেও কি আল্লাহর কাছে গ্রহনযোগ্য হচ্ছে? ইমাম গাজ্জালী (রহ:) এর এই বিশ্লেষন খুব মনোযোগ দিয়ে পড়লে আমরা নিজেরাই নিজেদের রোজাকে মুল্যায়ন করতে পারব। ইমাম গাজ্জালী (রহ:) বলেন রোজা ৩ প্রকার ১। সাধারণের রোজা: সাধারণ মুসলিমগণ যে রোজা রাখে, খাবার, পানীয় এবং স্ত্রী-মিলন থেকে বিরত রাখা। ২। যোগ্য ব্যক্তির রোজা বা কতিপয় মুসলিমের রোজা: এই ক্ষেত্রে উপরের বিষয়টি ছাড়াও হাত, পা, দৃষ্টি এমন সমস্ত জিনিসকে গোনাহ থেকে বিরত রাখে। অর্থ্যাৎ চোখের গোনাহ পর-নারী, পর-পুরুষকে দেখা, মুখের গোনাহ যেমন গীবত করা ইত্যাদি থেকে নিজেকে বিরত রাখা। ৩। সর্বোচ্চ পর্যায়ের রোজা: এই ক্ষেত্রে সে ১ম ও ২য় সবকিছু পালন তো করেই, নিজের মনকে সমস্ত খারাপ চিন্তা থেকে বিরত রাখে এবং শুধু আল্লাহর দিকে নিমগ্ন রাখেন। এটা খুবই কঠিন, যেটা একমাত্র নবী, রসুল, সর্বোচ্চ পর্যায়ের যারা মুত্তাকী তারাই এটা পালন করতে পারেন। এখন আমরা নিজেকে প্রশ্ন করি। ওপরের ৩টি শর্ত মেনে আমরা কি আমাদের রোজা পালন করি??
উপসংহার
মনে রাখবেন, বাহিরে মসজিদ নির্মান করা সহজ, কিন্ত অন্তরে মসজিদ নির্মান করা খুবই কঠিন। এর জন্য অলীতে গলীতে এত মসজিদ হবার পরও আমাদের অন্তর মসজিদের মতো পবিত্র হচ্ছে না, সবসময় গীবত, কলহ, বিবাদ লেগেই আছে। এক মুহুর্ত অবহেলা করবেন না। এমনও হতে পারে আমি হাসি-তামাশায়, গোনাহের কাজে লিপ্ত আছি অথচ আমার কাফনের কাপড়ে দোকানে এসে গেছে। মানুষ আমার জানাজা নামাজ পড়ার আগে, আসুন আমরা আমাদের নামাজ পড়া শুরু করে দেই। আসুন এই রমজানেই সেটা করি। আল্লাহ তাআলা আমাদের আমল করার তৌফিক দান করুন। আমীন তথ্যসূত্র: ১। সীরাতুল আউলিয়া – আল্লামাহ ওহহাব শারাণী (রহ:) ২। খুতবাতে যুলফিকার – মাওলানা যুলফিকার আহমাদ (দা:বা:) ৩। মকতুবাত শরীফ- মোজাদ্দেদ আল ফেসানী (রহ) ৪। সহীহ আল বুখারী ৫। রোজা বিষয়ক লেখা – ইমাম গাজ্জালী (রহ:)
জাযাকাল্লাহ