তালেবান বন্দিনী
লিখেছেন: ' হাফিজ' @ মঙ্গলবার, জুন ২০, ২০১৭ (৩:৩০ অপরাহ্ণ)
ইভান রিডলি। ব্রিটিশ নাগরিক, পেশায় সাংবাদিক, Sunday Express, England. ২০০১ সালে টুইন টাওয়ার ধ্বংশের পর সানডে এক্সপ্রেস থেকে তাকে পাঠানো হয় আফগানিস্হানে সংবাদ সংগ্রহের জন্য। একজন মহিলা সাংবাদিক হিসেবে যেটা খুবই ঝুকিপূর্ণ। পাকিস্হানের বর্ডার হয়ে ছদ্যবেশ ধারণ করে আফগানিস্হানে প্রবেশ করার পর হঠাৎ করে বোরকার ভিতর থেকে তার ক্যামেরা প্রকাশ হয়ে পড়লে তালিবানদের হাতে ধরা পড়েন। বন্দি থাকা অবস্হায় অসংখ্যবার তিনি তালেবানদের দিকে থুথু নিক্ষেপ করেন। কিন্ত তালেবানরা কোন প্রতিশোধ নেয়নি । ১০ দিন তালিবানদের হাতে বন্দি থাকার পর সারা বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে তালিবানরা তাকে মুক্ত করে দেন, কোনো মুক্তিপণ ছাড়া। Release Paper -এ মোল্লা ওমরের সিগনেচার ছিল যেখানে বলা ছিল ” ইভান রিডলিকে মানবতার খাতিরে মুক্তি দেয়া হোলো” । ইভান রিডলি বন্দি থাকা অবস্হায় তালিবানদের কথা দেন, মুক্ত হলে সে ইসলাম বিষয়ে পড়াশোনা করবেন। তিনি তার কথা রাখেন। ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা করার পর ২০০৩ সালে সারা বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে ইভান রিডলি ইসলাম গ্রহন করেন।
প্রাথমিক জীবন:
প্রথম জীবনে ইভান রিডলি ছিলেন প্রচন্ড বেপরোয়া। Continuous মদ খাওয়ার জন্য মায়ের সাথে বিরোধ লেগেই থাকতো । রিস্ক নিতে ভালোবাসতেন । মাত্র ৪০ বছর বয়সের মধে ৩ টি বিয়ে ও ছাড়াছাড়ি । তার মধ্য একজন স্বামী প্যালেস্টানিয়ান ও একজন ইসরায়েলি । এখানেও বৈচিত্র। Chain Smoker। ইসলাম গ্রহনের পর পরিবারের সাথে সমস্যা তৈরী হলেও মা খুব খুশি হন যেহেতু মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন ।
তালেবানদের হাতে ধরা পড়ার বর্ণনা:
“আমিও ঠিকমতো গাধার পিঠে বসার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করি। সামনের দিকে ঝুকে লাগাম ধরতে গেলে ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখা গলায় ঝোলানো আমার ক্যামেরাটা বাইরে বেরিয়ে আসে। ব্যাস এক তালেবান সৈন্যের চোখ পড়ে ক্যামেরার দিকে । চিৎকার করে আমার দিকে আসতে আসতে আমাকে গাধার পিঠ থেকে নেমে আসতে নির্দেশ দেয়।
সৈন্যটির চেহারা আমি কোনোদিন ভুলবো না। আমাকে গ্রেপ্তার অথবা হত্যার উদ্দেশ্য ছিল, এ জন্য নয়। তার চোখটা ছিল সবুজাভ পান্নার মতো । এমন চোখের মণি আমি কোনো দিন দেখিনি। অদ্ভুত মনে হতে পারে। সৈন্যটির বেক্তিত্বে আমি কিছুক্ষণের জন্য মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ছিলাম।” ….
“যদিও তালেবানদের নিষ্ঠুরতার কথা সর্বজনবিদিত, তবুও ওরা আমার সাথে সন্মানসুচক ব্যবহার করেছে। এই কথা হয়ত অনেকেরই পছন্দ হবে না।”
বন্দি ইভান রিডলিকে নিয়ে আমেরিকার ঘৃণ্য চক্রান্ত
আমেরিকা প্রচার করার চেষ্টা করে ইভান গোয়েন্দা গুপ্তচর। এই কারণে তার কিছু ছবি বিকৃত করে প্রচার করার চেষ্টা করেন ইভানের ইরানে যাতায়াত ছিল। আমেরিকা চাচ্ছিল তালেবানরা তাকে মেরে ফেলুক। এতে সারা বিশ্বকে বোঝাতে সুবিধা হতো তালেবানরা কত নৃশংস এবং এই কারণেই তারা বোমা ফেলছে। শুনুন তার কথায় “পুরো ঘটনার পিছনে রয়েছে আমেরিকার হাত। একটা কফিনে করে যদি আমার মরদেহ পৌছাত, তাহলে ঐ আদিম যুগীয় বর্বরদের সমূলে ধ্বংশ করে দিতে বোমা হামলার সমর্থনে জনমত তৈরী হোতো।” …. “ভাগ্য ভালো, তালেবান গোয়েন্দারা কিছুটা হলেও বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে। সম্ভবত তালেবান গোয়েন্দারা বুঝতে পেরেছিলেন, পশ্চিমা শক্তি তাদের বিরেদ্ধে কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। তাই সবাইকে অবাক করে দিয়ে যেদিন ইংগ মার্কিন বাহিনী কাবুলে ৫০টি ক্রুজ মিসাইল দিয়ে আঘাত হানে, ঠিক তার পরদিনই মোল্লা ওমর মানবতার খাতিরে আমাকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন । এটা ছিল পশ্চিমা নেতাদের প্রতি একচোখা আধ্যাত্নিক এই নেতার ব্যংগাত্যক সম্মান প্রদর্শন।”
“তালেবানরা আমার সংগে ভালো ব্যবহার করেছে। এর জন্য আমি কৃতজ্ঞ । ওরা চাইলে আমার নখ উপড়ে ফেলতে পারত, বৈদ্যুতিক শক দতে পারত, ঠান্ডা পানিতে চুবিয়ে মারতে পারত কিংবা করতে পারত যৌন নিপীরণ। এসব করলে হয়ত ওনেক (পশ্চিমা ) নারীর মনের আশা পুরণ হত।”
একজন ক্যাব চালক
ইভান রিডলি তার বইতে বলেন, একবার লন্ডনের এক ক্যাব চালক আমাকে চিনতে পেরে বললো “তুমিই তো তালেবানদের হাতে বন্দী হয়েছিলে, তাই না”? আমি হ্যা সূচক ভংগিতে মাথা নাড়ালাম। ও পাল্টা প্রশ্ন করলো “ওরা কি তোমাকে ধর্ষণ করেছে?” । আমার উত্তর শুনে অবিশ্বাসের ভংগিতে তাকাল একবার । সে বলল যে সুযোগ পেলে নাকি চালক নিজেই এর সদ্ব্যবহার করত। আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না।”
In the hand of Taliban
ইভান রিডলি যে বই লিখেছেন তার নাম “In the hand of Taliban” , সম্প্রতি তার অনুবাদ হয়েছে। অনুবাদ করেছেন আবরার হামীম। সেই বই থেকে নিম্নে কিছু উদ্ধৃতি দেয়া হোলো:-
“তালেবানদের হাতে ধরা পড়ার অভিজ্ঞতা আমার অন্তরে স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাসকে পুনরুজ্জীবিত করেছে।
“অনর্থক যুদ্ধ, অনর্থক সংঘর্ষ, অনর্থক দারিদ্র। বোমা বানানোর পিছনে কারি কারি অর্থ ব্যায় না করে উচিত ছিল ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেয়া” ।
“পাকিস্হানিদের আমার খুব ভালো লাগে। তারা খুবই সাহায্যপ্রবণ।”
“পশ্চিমাদের কাছে যতই অশোভন মনে হোক না কেনো, পাকিস্হানে আমি যার সংগেই কথা বলেছি, অধিকাংশ বেক্তি এই পাশবিকতাকে দুর্ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন” ( অর্থাৎ তারা – ৯/১১ কে সমর্থন করেনি )
“আফগানদের ভাড়া করা যায় কিন্তু তাদের ক্রয় করা যায় না” ।
“এদের আতিথিয়তার কোনো তুলনা নাই। এদের খুব বেশী সম্পদ নেই। যৎসামান্য যা-ই রয়েছে, তা-ই আমার জন্য ব্যয় করতে উদগ্রীব”
ইসলাম ধর্ম গ্রহণ:
তালেবানদের হাতে বন্দী থাকা অবস্হায় ইভান রিডলিকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার জন্য বলা হয়েছিল কিন্তু তিনি সেটা প্রত্যাখান করেন। এর পরিবর্তে কথা দেন মুক্ত হবার পর সে ইসলাম/কোরান নিয়ে পড়াশোনা করবেন। তিনি তার কথা রেখেছিলেন। কোরানের মধ্যে তিনি তালেবানদের বিভিন্ন কর্মকান্ড যেগুলো তার পছন্দ হয়নি, সেগুলোর সন্ধান করেন। কিন্ত আশ্চর্য হন এই দেখে যে, এগুলোর কোনোটাই কোরানে নেই। বরং তিনি মনে করেন “কোরান হোলো নারীদের জন্য আদর্শ (মাগনা কার্টা)” । তিনি বলেন “কোরানে এটা পরিস্কার যে, আধ্যাত্নিক, শিক্ষা এবং বিবিধ বিষয়ে নারী পুরুষকে কোরানে সমান অধিকার দেয়া হয়েছে । সবাই ভুলে যায় যে ইসলাম পুর্ণাংগ, কিন্তু মানুষ নয় ” । ২০০৩ সনের মাঝামাঝিতে উনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি দাবি করেন তার নতুন বিশ্বাস তার ভংগুর পারিবারিক জীবনকে সহায়তা করেছে এবং পৃথিবীর মধ্যে সবচে সুন্দর পরিবার গঠনে সহায়তা করেছে।
সাম্প্রতিক কার্যক্রম:
ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর তিনি ইরাক, ইসরায়েল, আফগানিস্হান, চেচেনিয়া, কাশ্মির, উযবেকিস্হান, নারিদের অধিকার, War on Terror ইত্যাদি বিষয়ে US, Australia, South Africa, Middle East সহ বিভিন্ন দেশে বক্তব্য দিয়ে থাকেন। স্বভাবতই ইভান রিডলি হাইপার Active । এখেত্রেও তার ব্যতিক্রম নন। এ পর্যন্ত তিনি ৩টি বই লিখেছেন ১। In the hand of Taliban ২। Ticket To Paradise ৩। Torture Does it work? আফগানিস্হান বিষয়ে তিনি BBC তে রেডিও প্রগ্রাম প্রচার করেন। পরবর্তিতে আল জাজিরা চেনেলে এ যোগ দেন এবং সেখানে বনিবনা না হওয়ায় তাকে টারমিনেট করা হয়। আল জাজিরার বিরূদ্ধে তিনি case করে জিতে নেন ২১ লাখ টাকা। এই অল্প পরিসরে তার বহুমুখী কর্মকান্ড নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব নয়। আগ্রহী পাঠক দেখতে পারেন https://en.wikipedia.org/wiki/Yvonne_Ridley
উপসংহার:
লেখা শেষ করছি ইভান রিডলির In the hand of Taliban বই-এ আফগানিস্হান সম্বন্ধে তার অনুভূতি দিয়ে–
“ভ্রমন করতে গিয়ে প্রথিবীর অনেক দেশ আর শহরের প্রেমে পড়েছি। নিউ ইয়র্ক শহর কখনো ঘুমায় না। সর্বদাই একটি উত্তেজনা বিরাজ করে। রোমের রসুঘরের সুগন্ধের লোভ সামলানো কঠিন। ভেনিসের সৌন্দর্য হা হয়ে দেখতে হয় আর প্যারিস পরিচ্ছন্ন ও সাজানো গোছানো ।
কিন্তু বুনো প্রাকৃতিক আর দুর্ধষ্য আফগানিস্তান আমার হ্রদয় চুরি করেছে।”
অনেক আগে আমাদের দেশের এক লেখক সৈয়দ মুজতবা আলি আফগানিস্তান সম্বন্ধে কালজয়ী বই লেখেন “দেশে-বিদেশে” । বিদায় নেবার সময় তার আফগানিস্তানের চির সহচর, সুখ দু:খের সাথী আবদুর রহমান সমন্ধে বলেন “”বহুদিন ধরে সাবান ছিল না বলে আব্দুর রহমানের পাগড়ি ময়লা। কিন্তু আমার মনে হল চতুর্দিকের বরফের চেয়ে শুভ্রতর আবদুর রহমানের পাগড়ি, আর শুভ্রতম আব্দুর রহমানের হৃদয়।” ………”আফগানিস্তানকে আমি কখনও পর ভাবিনি”।
বি:দ্র: ইভান রিডলির সমস্ত কমেন্ট আবরার হামিমের অনুবাদ থেকে নেয়া।
REFERENCE:
1. IN THE HAND OF TALIBAN, WRITER: IVAN RIDLEY, TRANSLATOR: ABRAR HAMIM
2. https://en.wikipedia.org/wiki/Yvonne_Ridley
3. http://www.emel.com/article?id=3&a_id=1681
4. http://news.bbc.co.uk/2/hi/uk_news/1570394.stm