চিত্রা এক্সপ্রেসে একরাত
লিখেছেন: ' হাফিজ' @ শুক্রবার, ডিসেম্বর ১, ২০১৭ (১০:২৯ পূর্বাহ্ণ)
হঠাৎ জরুরি কাজে খুলনা যেতে হবে। চিত্রা এক্সপ্রেস ট্রেনে একটি টিকিট কাটলাম। কেবিন ক, বার্থ নং ৬। তারিখ ২৮/১১/২০১৭, সন্ধ্যায় ৭ টায় ঢাকা থেকে ছেড়ে ভোর ৫/৬ টায় খুলনায় পৌঁছে। কেবিনে ঢুকে দেখলাম একজন মুরুব্বি বসে আছেন। দুই সিট এর কেবিন। তার অর্থ আর কেউ আসবে না।
বয়স্ক ভদ্রলোকটি যাবেন যশোর , আমি খুলনা। এর অর্থ ওনাকে রাত্র ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে যশোরে নামতে হবে।
ভদ্রলোকটি বললেন “আপনাকে দেখে ভালোই লাগলো, চিন্তা করছিলাম দুষ্ট পোলাপান আবার ওঠে কিনা।” আমি ওনার কথা শুনে হেসে ফেললাম। উনি বললেন “একবার ইন্ডিয়া যাবার সময় কিছু দুষ্ট ছেলেপেলে উঠেছিল, পরে অনেক সমস্যা হয়। ”
কিছুক্ষন আলাপ আলোচনার পর দুইজন একসাথে চা খেলাম। উনি রাত্রের খাবারও খেলেন। আমি এশার নামাজ কেবিনে পড়লাম। উনি বললেন “আমি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা” , ওনার পাশ আছে এবং টিকিট এ কিছু সুবিধা পেয়ে থাকেন। আরো বললেন “আমি আপনাকে আমার জীবনের কিছু ঘটনা শুনাই।”
একটু কেমন যেন লাগলো, কেবিনে আর কেউ নেই এটাও একটা টেনশনের বিষয়। বর্তমানে সবকিছুতেই কেমন যেন একপ্রকার সন্দেহ ও ভয় কাজ করে। ছোটবেলার একটি মুভির কথা মনে পড়লো Murder On The Orient Express. ১৯৮৬ কিংবা ১৯৮৮ সালে আমরা স্কুলে থাকতে দেখেছিলাম। ট্রেনে একটি খুন হয়, যেটা তার সহকর্মীরা করেন। পরে একজন গোয়েন্দা সেটার তথ্য উদ্ঘাটন করেন। এই ভদ্রলোক যদি কিছু করেন? এটা মনে হতে নিজের মনেই আবার ভাবলাম বাবার বয়সী একজন মুরুব্বীকে সন্দেহ করা ঠিক হচ্ছে না। মাথায় গোলমাল হলো নাকি? অবশ্য সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলো সমস্ত মাথার গোলমাল নাকি পেটের গোলমাল থেকে শুরু হয়। হবে হয়তো। আমিও হালকা খাবার খেয়ে নিলাম।
উনি বলা শুরু করলেন ” আমি বিয়ে করার পর আমার বাচ্চা হচ্ছিলো না। খুব মানসিক কষ্টে ছিলাম। আমি দ্বিতীয় বিয়ে করলাম আর একটি সন্তানের আশায়। আমার ২য় পক্ষের একটি পুত্র সন্তান হলো। এরই মধ্যে আমার শ্যালক এর স্ত্রী হঠাৎ আত্মহত্যা করলেন আর রেখে গেলেন ছোট্ট একটি মেয়ে। তাদের এই মেয়েকে দেখার কেউ ছিল না। আমার প্রথম স্ত্রী রাজি হলো তার দেখাশোনার সমস্ত দায়িত্ব নেবার। আমি মেয়েটিকে পালক নিলাম। আমি তাকে নিজের সন্তানের মতোই দেখতাম। অসম্ভব মায়া করতাম তাকে।”
উনি বলতে থাকলেন “আমার ২য় পক্ষে পরপর ২ ছেলে হলো। আশ্চর্যের বিষয় বহুদিন পর প্রথম পক্ষ আবার conceive করল, এবার হলো মেয়ে। অর্থাৎ প্রথম পক্ষের ১ মেয়ে, ১ পালক মেয়ে আর ২য় পক্ষের ২ ছেলে।”
“আমার পালক মেয়ের বিয়ের বয়স হয়ে গিয়েছিলো। জীবনের একটি বড়ো ভুল তখন করলাম। সে যে আমার পালক মেয়ে সেটা গোপন করে আমি তাকে বিয়ে দিলাম। আমি তাকে আলাদাভাবে আমার সন্তান ছাড়া অন্য কিছু চিন্তা করিনি। বিয়ে দেবার ১ থেকে দেড় বছর পর শশুড়বাড়ির মানুষ জানতে পারে সে আমার পালক মেয়ে। তারা অত্যাচার শুরু করে দেয়। এর মধ্যে আমার ২য় পক্ষের ছোট ছেলে আস্তে আস্তে খারাপ লাইন এ চলে যেতে থাকে। সে ড্রাগস এবং মাস্তানিতে জড়িত হয়ে পরে। ”
“আমার পালক মেয়ে একদিন আমার বাসায় আসলো। শশুরবাড়ি মানুষের অত্যাচারে কাহিনী শুনে আমি তাকে বললাম মা, তুমি আর ওই বাড়িতে যেয়ো না। আমি তোমাকে অন্য জায়াগায় বিয়ে দেব। তার কষ্ট দেখে আমি তাকে অনেক নিষেধ করলাম স্বামীর বাড়িতে যেতে। আমার নিষেধ সত্ত্বেও সেই রাত্রে সে চলে গেলো। পরের দিন খবর পেলাম মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। কষ্টে আমার বুক ভেঙে গেলো। তাকে কোনোদিন আমি পালক মেয়ে ভাবিনি। মেয়েটা যে কেন সেদিন আত্মহত্যা করলো? আমার দুঃখের জীবন শুরু হলো।”
আমি ভদ্রলোকের দিকে চেয়ে রইলাম। তার চেহারার মাঝে সরলতা ও সততা দেখতে পেলাম।
উনি বলতে লাগলেন “মেয়েটি মারা গেলো। আমার প্রথম পক্ষের একমাত্র যে মেয়েটি ছিল তার একটি অসুখ ধরা পড়লো। আমি অনেক চিকিৎসা করলাম। কোনোমতেই রোগটি ভালো হচ্ছিলো না। মালেনজাইটিস রোগ। ঢাকায় এনে অনেক চিকিৎসা করার পরও তার রোগ ভালো হলো না। সেই মেয়েটিও অনেক কষ্ট করে মারা গেলো।” উনার কথা শুনতে শুনতে তলস্তয় এর একটি উপন্যাসের কথা মনে পড়লো। উপন্যাসের নাম “ক্রোয়াটজাট সোনাটা”। সম্পূর্ণ উপন্যাসটি একটি ট্রেনের ঘটনা। উপন্যাসের নায়ক একটি ট্রেনের কামরায় ভ্রমণ করার সময় একজন অসুথ্থ ব্যক্তি তাকে তার জীবনের করুন একটি কাহিনী বলেন। সেই করুন কাহিনী নিয়েই তলস্তয়ের বিখ্যাত উপন্যাস “ক্রোয়াটজাট সোনাটা”।
আমি ভদ্রলোকের নাম জিজ্ঞেস করলাম। উনি বললেন ড: নূর হোসেন , প্যারামেডিকেল ট্রেনিং করা আছে। গ্রামে ডাক্তারি প্রাকটিস করেন। উনি বলতে লাগলেন “আমার দুই ছেলের এর মধ্যে বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো। তাদের দুইজনের বাচ্চা হয়ে গেলো।” (আমার ঠিক মনে নেই ওনার কয়জন নাতি নাতনির কথা উনি বলেছিলেন) বড়ো ছেলের সাথে যে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলাম সেই বৌ-মা খুব সুন্দরী ছিল। তার এলাকায় অনেকেই তাকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিচ্ছিলো। আমাদের পরিবারের সাথে বিয়ে দেবার কারণে অনেকেই আমার বড়ো ছেলের শত্রু হয়ে গেলো। আমার বড়ো ছেলে মাঝে মাঝেই বলতো আব্বা এরা হয়তো আমাকে একসময় মেরে ফেলবে”
আবার উনি বলতে লাগলেন “আমার ছোট ছেলেটি আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যেতে লাগলো। আমার লাইসেন্স করা বন্ধুক ছিল। আমি মুক্তিযোদ্ধা। কখন রাগের মাথায় তাকে খুন করে ফেলি এইজন্য বন্ধুক সরকারের কাছে জমা দিঁয়ে আসলাম।” সেই ছেলে যেহেতু সন্ত্রাসী কাজে জড়িত হয়ে গেলো তার শত্রুও অনেক তৈরী হতে লাগলো। এর মধ্যে কয়েকবন্ধু মিলে তারা “বাওর” (এই অঞ্চলে বাওর বলা হয় হাওর এর চেয়েও বড়ো জলাশয়কে) অঞ্চলে নৌকা নিয়ে ভ্রমণ করতে গেলো। সে বুঝতে পারেনি এটা ছিল চক্রান্ত। আসলে তারা প্ল্যান করেছিল তাকে খুন করার। একটি নির্দিষ্ট জায়গায় যেয়ে তারা কয়েকজন মিলে তাকে গভীর পানিতে ফেলে দিলো। এটা ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। সেখানে সাঁতার কাটা সম্ভব ছিল না। সে মারা গেলো। আমরা সন্ধ্যার দিকে খবর পেলাম।
আমার বড়ো ছেলে তখন এক অফিসে চাকরি করে। সে তার অফিস থেকে ছোট ভাই এর মৃত্যুর খবর শুনে তার কর্মস্থল থেকে তাড়াতাড়ি যশোর স্টেশনে নেমে পরে। (আমার ঠিক মনে নেই উনি বড়ো ছেলের অফিস কোন জায়গায় বলেছিলেন) আমাদের বাড়ি গ্রামের দিকে। স্টেশনে কয়েকজন পরিচিত মানুষের দেখা মিলে যারা তাকে অপেক্ষা করতে বলে। যেহেতু আমাদের গ্রামের বাড়িতে সরাসরি যাবার কোনো যানবাহন নেই তাই তাদের কথার ওপর নির্ভর করে সে অপেক্ষা করতে থাকে যানবাহনের জন্য । আসলে তারা ছিল তার ওয়াইফ এর গ্রামের বাড়ির লোক, যারা তার বৌকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো। তারা বহুদিন চেষ্টা করার পর এই সুযোগকে কাজে লাগায়। সম্পূর্ণ জিনিষটা কিভাবে তারা করেছিল আমরা শুধু ধারণা করতে পারি, আসল ঘটনা আল্লাহ জানেনচ পরেরদিন আমরা ট্রেন লাইন এর ওপর আমার বড়ো ছেলের লাশ পাই। পরীক্ষায় দেখা গেছে তাকে গলা টিপে মেরে ফেলা হয়েছিল। মাত্র ৬/৭ ঘন্টার ব্যবধানে আমার ২ ছেলেকে আমি হারাই। তাদের মা এরপর পাগল হয়ে যায়। আমার ৪ সন্তানের মধে্য কেউ আর জিবিত নেই”
এইটুক শোনার পর আমি আর ওনাকে কোনো প্রশ্ন করিনি। আমি আর কিচ্ছু জানতে চাইনি। রাত্রে সাড়ে ৩টার সময় শব্ধে ঘুম ভেঙে গেলো। জেগে দেখি উনি গোছগাছ করছেন যেহেতু একটু পরেই যশোর স্টেশন-এ নামতে হবে। বাহিরে ফজর এর আজান হলো। স্টেশনে ট্রেন থামার পর আমার কাছে বিদায় নিয়ে উনি নেমে পড়লেন। বাহিরে অন্ধকার। শুধু স্টেশন এর অল্প আলোতে হালকা সবকিছু দেখা যাচ্ছে।
আমি জানালার বাহিরে তাকালাম। উনি একহাতে ব্রিফকেস ধরে আছেন। আর ডান হাতে ধরে আছেন আমার দেয়া একটি বই “এসো চিরশান্তির পথে”। অন্ধকারে উনি আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেলেন।
খুবই করুণ কাহীনি । আল্লাহ তাকে মানসিক শান্তি প্রদান করুন।