ফুজায়েল ইবনে আয়াজ (রহঃ) ও তৎকালীন বাদশাহ
লিখেছেন: ' হাফিজ' @ বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ৭, ২০১৯ (৮:৩৯ পূর্বাহ্ণ)
ইরাকের বাদশাহ ছিলেন হারুন-আর-রশিদ। তিনি তার উজিরকে বললেন “আমাকে একজন মুত্তাকী-পরহেজগার আল্লাহ্ভক্ত ব্যাক্তির কাছে নিয়ে চল।”
উজির বাদশাহকে ফুজায়েল ইবনে আয়াজ (রহঃ) এর বাড়ি নিয়ে গেলেন এবং দরজায় আঘাত করলেন।
ফুজায়েল: কে তুমি? কে দরজায় আঘাত করছো?
উজির: আমিরুল মুমিনীন এসেছেন।
ফুজায়েল: তার সাথে আমার কি দরকার? দয়া করে আমার সময় নষ্ট করোনা।
উজির: আমিরের অনুগত্য করা অপরিহার্য।
ফুজায়েল: আমাকে বিরক্ত করোনা।
উজির: আমাদেরকে অনুমতি দাও। অন্যথায় আমরা জোরপূর্বক প্রবেশ করবো।
ফুজায়েল: তোমাদের অনুমতি নেই। আর অনুমতি ছাড়া যদি প্রবেশ করতে চাও সেটা তোমাদের ব্যাপার।
শ্রদ্ধেয় পাঠক, চিন্তা করুন কতটুকু আল্লাহ-ভীতি থাকলে একজন ব্যাক্তি এমন নির্ভিক আর সাহিসী কথা বলতে পারেন। দেশের প্রধান যদি আমাদের কাছে এভাবে আসতো তাহলে নিশ্চয়ই আমরা প্রচন্ড খুশি হতাম। মনে মনে ভাবতাম এবার আমাদের ভাগ্যের দুয়ার খুলে গেলো। তাকে ফিরিয়ে দেয়া তো দূরের কথা উল্টো হয়তো বলতাম “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আপনি কষ্ট করে এসেছেন কেন? আমাকে খবর দিলেই তো পারতেন।”
দুনিয়াত্যাগী বাদশাহ ফুজায়েল ইবনে আয়াজ দুনিয়ার বাদশাহকে বললেন “তোমাদের অনুমতি নেই। আর অনুমতি ছাড়া যদি প্রবেশ করতে চাও সেটা তোমাদের ব্যাপার।”
এটা বলার পরও তারা উভয়ই ঘরে প্রবেশ করলেন। ফুজায়েল ইবনে আয়াজ (রহঃ) বাতি নিভিয়ে দিলেন যাতে তার দৃষ্টি বাদশাহ হারুন-ওর-রশিদ এর ওপর না পরে। ঘরটি অন্ধকার হয়ে গেলো। এরমধ্যে হারুন-ওর-রশিদ কোনোমতে ফুজায়েল ইবনে আয়াজ (রহঃ) এর হাত ধরে ফেললেন।
ফুজায়েল ইবনে আয়াজ (রহঃ) বললেন: কি নরম এই হাত, আহঃ যদি জাহান্নাম থেকে এটা রক্ষা পেতো?”
এটা বলে ফুজায়েল নামাজ পড়া শুরু করলেন। হারুন-ওর-রশিদ ক্রন্দন করতে থাকলেন। ফুজায়েল ইবনে আয়াজ (রহঃ) এর নামাজ পড়া শেষ হলে হারুন-ওর-রশিদ তাকে আরো কিছু উপদেশ দেবার জন্য অনুরোধ করলেন।
ফুজায়েল ইবনে আয়াজ (রহঃ): আপনার পিতা/পূর্ব পুরুষ রসূলের চাচা ছিলেন। আব্বাস (রাদি) একবার রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে বললেন, “আমাকে একটি শহরের শাসক বানিয়ে দিন।” রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন “আমি তোমাকে তোমার নফসের শাসক বানিয়ে দিলাম।” সহস্র মানুষ যদি তোমার অনুগত হয় এর চেয়ে উত্তম তোমার নফস যদি আল্লাহর অনুগত হয়। কিয়ামত দিবসে দুনিয়ার রাজত্ব দুঃখের কারণ হবে।
হারুন-ওর-রশিদ : আরো কিছু বলুন।
ফুজায়েল ইবনে আয়াজ (রহঃ): উমর ইবনে আব্দুল আজিজ (রহঃ) যখন খলিফা হলেন, তখন আলেমদের বললেন “আমি খেলাফতের সাথে জড়িত হয়ে গেছি, আমাকে আপনারা সঠিক পথ প্রদর্শন করুন।”
তারা বললো, “আপনি যদি কিয়ামতের দিন মুক্তি চান, বয়স্ক মুসলিমদের সাথে আপনার নিজের পিতামাতার মত ব্যবহার করুন, তরুণদের সাথে আপন ভাই এর মতো, শিশুদের সাথে আপনার নিজ সন্তানের মতো আর নারীদের সাথে নিজ মাতা এবং বোন এর মতো ব্যবহার করুন।”
হারুন-ওর-রশিদ: আরো কিছু বলুন।
ফুজায়েল ইবনে আয়াজ (রহঃ): নেককার ব্যাক্তি এবং ভাইদের প্রতি সদয় হোন। আমি ভয় পাই আপনার সুন্দর চেহারা হয়তো জাহান্নামে প্রবেশ করবে। সেখানে এই চেহারা কুৎসিত আকার ধারণ করবে।”
হারুন-ওর-রশিদ:আরো কিছু বলুন।
ফুজায়েল ইবনে আয়াজ (রহঃ): আল্লাহকে ভয় করুন। তার মুখোমুখি হবার জন্য প্রস্তুত গ্রহণ করুন। আল্লাহ আপনাকে আপনার প্রতিটি বিষয়ের জন্য প্রশ্ন করবেন। এমনকি একজন বৃদ্ধা মহিলা আপনার রাজত্বে ক্ষুদার্থ অবস্থায় নিদ্রিত হলেও। কিয়ামতের দিন সে আপনার হাত ধরে আল্লাহর দরবারে সুবিচার প্রার্থনা করবেন।
প্রিয় পাঠক, চিন্তা করুন। এই কথাগুলো বলছেন এমন একজন ব্যাক্তি যিনি একসময় ছিল ডাকাতদলের সর্দার। একটি মাত্র আয়াত শ্রবণ করে তিনি তার জীবনকে কিভাবে পরিবর্তন করে ফেলেছিল সেটা আমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়। আমরা প্রতিনিয়ত আল কোরানের শত শত আয়াত শ্রবণ করছি যেগুলো আমাদের কান পর্যন্ত প্রবেশ করলেও হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছেনি। হৃদয় স্পর্শ করলেও আমরাও আমাদের জীবনকে রসূলের সুন্নতের রঙে রাঙিয়ে নিতে পারতাম।
“যারা মুমিন, তাদের জন্যে কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবর্তীর্ণ হয়েছে, তার কারণে হৃদয় বিগলিত হওয়ার সময় আসেনি? তারা যেন তাদের মত না হয়, যাদেরকে পূর্বে কিতাব দেয়া হয়েছিল। তাদের উপর সুদীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হয়েছে, অতঃপর তাদের অন্তঃকরণ কঠিন হয়ে গেছে। তাদের অধিকাংশই পাপাচারী।
(৫৭) সূরা আল হাদীদ-(মদীনায় অবতীর্ণ – আয়াত নং-১৬)
ফুজায়েল ইবনে আয়াজ (রহঃ) এর এই কথাগুলো শ্রবণ করে হারুন-ওর-রশিদ ক্রন্দন করতে করতে অচেতন এর মত হয়ে গেলেন। তার উজির বললো “যথেষ্ট হয়েছে, আপনি তো বাদশাহকে মেরে ফেলবেন”
ফুজায়েল ইবনে আয়াজ (রহঃ):”হে হামান্, আমি তাকে মেরে ফেলেনি, বরং তুমি এবং তোমার সঙ্গীসাথী তাকে মেরে ফেলেছো। হামান্ পথভ্রষ্ট ফেরাউনের উজির ছিল। এর মধ্যে হারুন-ওর–রশিদ কিছুটা চেতনা ফিরে পেয়ে ফুজায়েল এর কথা শুনতে পেলেন। খলিফা উজিরকে বললেন “তুমি কি শুনেছ সে তোমাকে হামান্ বলেছে এর অর্থ আমাকে ফেরাউন এর সাথে তুলনা করেছে।”
তখন খলিফা ফুজায়েল এর দিকে চেয়ে বললেন “হজরত আপনার কি কোনো ঋণ আছে?”
ফুজায়েল: আমি আল্লাহর নিকট ঋণী।
হারুন-ওর-রশিদ: আমি বুঝতে চেয়েছি মানুষের নিকট আপনি ঋণী কিনা?
ফুজায়েল: আল্লাহর আমার প্রতি অসংখ্য নেয়ামতের মধ্যে এটাও একটি নিয়ামত যে আমার কোনো ঋণ নেই।
হারুন-ওর-রশিদ ১০০০ হাজার স্বর্ণমুদ্রার একটি থলে তার সম্মুখে দিয়ে বললেন আমি এটা হালাল উপায়ে অর্জন করেছি। উত্তরাধিকার সূত্রে এই সম্পদ আমার মায়ের মাধ্যমে আমার নিকট পৌঁছেছে। আপনি এটা গ্রহণ করুন।
আমরা হলে তখন মনে মনে ভাবতাম, হাদিয়া নেয়া সুন্নত। এটা নিশ্চয়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। খেয়াল করুন ফুজায়েল ইবনে আয়াজ তখন কি বললেন।
ফুজায়েল ইবনে আয়াজ (রহঃ) বললেন, “আফসোস, আমার নসিহত আপনার কোনো কাজেই এলো না। এটা বিস্ময়কর যে আমি আপনাকে মুক্তির দিকে আহবান করছি অথচ আপনি আমাকে ধ্বংসের দিকে আহবান করছেন, এই সম্পদ বরং তাদেরকে দেয়া উচিত যারা এরা প্রকৃত হকদার।
ফুজায়েল ইবনে আয়াজ (রহঃ) তখন হারুন-ওর-রশিদ কে চলে যেতে বললেন। তিনি তাদেরকে বাহির করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। খলিফা উজিরকে বললেন – হ্যা- এরাই হল প্রকৃত মুত্তাকী এবং পরহেজগার”
বর্তমানের রাজা-বাদশাহ হলে নিশ্চয়ই এ কথা বলতেন না। সেক্ষেত্রে এই দিনই হয়তো হতো ফুজায়েল এর শেষ দিন।
তখনকার দিন এর সাধারণ, আবেদ, আলেম, বাদশাহ সকলেই ছিলেন আল্লাহমুখী।