লগইন রেজিস্ট্রেশন

ইসলামীরাষ্ট্রে অমুসলিমদের মর্যাদা এবং নিরাপত্তাব্যবস্থা !!

লিখেছেন: ' জুলকারনাইন সাবাহ' @ শনিবার, জুন ১৪, ২০১৪ (৬:৩১ পূর্বাহ্ণ)

ইসলামীরাষ্ট্রে অমুসলিমদের অবস্থান কী হবে কিংবা তাদের ধর্ম-কর্ম পালন করতে দেয়া হবে কিনা, এমন নেগেটিভ প্রচারণা ও ধ্যানধারণা ইদানিং উদ্দেশ্যমূলকভাবেই কিছু স্বার্থান্বেষী চালিয়ে থাকে। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে- অমুসলিমদের মাঝে ইসলামী রাষ্ট্রুসম্পর্কে ভীতি সৃষ্টি করে ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষেপিয়ে তোলা।

বিশেষত তাদের মুল টার্গেট হচ্ছে-ইসলামী আন্দোলন। তাদের মনে রাখা উচিৎ যাদের আদর্শই হলো ইসলাম, যদি তাদের দ্বারা আল্লাহ কখনো ইসলাম কায়েমের সুযোগ এদেশে দেয়, তবে তারা তা-ই করবে যা করেছেন নবী সাঃ এবং খোলাফায়ে রাশেদাসহ তার সাহাবীরা রাঃ।

যদিও নবী সাঃ এর শাসনামলে বা চার খলিফার যুগে অমুসলিমদের কখনোই দ্বিতীয়শ্রেণীর নাগরিক বানানো হয়নি কিংবা তাদের ধর্মপালনে বাধা দূরে থাক সহযোগিতাই করা হয়েছে। এই ইতিহাস আমরা মুসলিমরাই ভুলে গেলে বা সঠিকভাবে না জানলে অমুসলিমদের তো আরো না জানাই স্বাভাবিক? ফলে এমন উল্টাপাল্টা মিথ্যাপ্রচারণায় তারা ইসলামী রাষ্ট্রসম্পর্কে ভুল বুঝতেই পারেন, এতে তাদের দোষ দেয়া যায় না মোটেই।

ইসলামীশাসন বা ইসলামীরাষ্ট্র সম্পর্কে অজ্ঞতা
দেখা যায়, মুসলিম নামধারী হয়েও কেউ কেউ অমুসলিমদের মতোই নানা প্রশ্ন তুলে লিখে যাচ্ছেন যে, এদেশে ইসলাম কায়েম করতে হলে অমুসলিমদের সমান অধিকার, রাষ্ট্রের শাসনকার্যে অংশীদারিত্ব কিংবা তাদের ইসলামী আন্দোলনে পদ-পদবী প্রদান না করলে ইসলাম কায়েম হবেনা। আসলে এসব লোকের মতে, ইসলাম কায়েম করতে হলে অমুসলিমদের সাথে আঁতাত করেই তবে এগুতে হবে, নতুবা কখনোই ইসলাম কায়েম হতে পারে না।

তাদের আগে নিজেদেরই জানা উচিৎ সমানাধিকার কী এবং বাস্তবে সবাইকে একটা রাষ্ট্র সমানাধিকার দিতে পারে কিনা এবং তার নজির পৃথিবীর কোথাও কি আছে? সমানাধিকার হচ্ছে-আপেক্ষিক একটা বিষয়, যা লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ, জাতি, পেশা, ব্যক্তি ও সামজিক মর্যাদা, চাকরিগত অবস্থান ইত্যাদি নির্বিশেষে নির্ধারিত হয়ে থাকে। মানুষ হিসেবে সবাই কিছু বিষয়ে কমন সমানাধিকার পেলেও উপরোক্ত ফারাকের কারণে অধিকারের কিছু বৈষম্য থাকবেই যেমনঃ আমাদের সংবিধানে চাকরিগত সমানাধিকারের কথা বলা হলেও যারা অনগ্রসর তাদের কোটা পদ্ধতি এখনো আছে, যা পরস্পরবিরোধী।

আবার চাকরিতে নারী-পুরুষের পদবীগত ফারাককে কি বৈষম্য বলা যাবে যদিও সবাই এমএ পাশ করা? সবাইকে প্রথমশ্রেণীর চাকরিতে নিয়োগ করা, ধর্মনির্বিশেষে ইসলামের বা হিন্দুধর্মের বিধান চাপিয়ে দেয়া কি সমানাধিকার নাকি জুলুমের পর্যায়ে পড়ে?

ইসলামী রাষ্ট্রযন্ত্রে অমুসলিমদের অংশীদারীত্ব দেয়া এক জিনিস আর তাদের সাথে আঁতাত করে বা হাত মিলিয়ে বা তাদের কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও ইসলাম কায়েম করা আরেকটি বিতর্কিত বিষয়। কিন্তু আদতে এভাবে ছলে-বলে-কৌশলে ইসলামীরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কি খুবই জরুরি নাকি ইসলামসম্মত? তাদের ভাবটা এমনি যে, ইসলাম কায়েম না করতে পারলেই যেনো ইসলামের পথে চালিত জীবনও সম্পূর্ণ বৃথা হয়ে যাবে।

তাদের মতলবটা যেনো এমন, নবীর কাছে একদল কাফের প্রস্তাব দেয় এই বলে-হে মুহাম্মদ, এসো আমরা ঝগড়া-ফ্যাসাদ ছেড়ে একটা সমঝোতা করি। আমরা আমাদের ধর্মে কিছু ছাড় দেই তুমিও কিছু ছাড় দাও। আমাদের কিছু রজম-রেয়াজ তুমি পালন করো-আমরাও তোমার ধর্মের কিছু বিধান পালন করি।

এরপরই আল্লাহ সুরা কাফিরুন নাজিল করে নবীকে বলতে বললেন যে, হে কাফিরগণ-আমি ইবাদাত করিনা তোমরা যার উপাসনা করো; আর তোমরাও তার ইবাদাত করোনা, আমি যার ইবাদাত করি। আর আমি তার ইবাদাত করবো না, যার ইবাদাত তোমরা করছো; তোমরাও তার ইবাদাত করবে না, যার ইবাদাত আমি করছি। সুতরাং তোমাদের দীন তোমাদের জন্য এবং আমার দীন আমার জন্য।

তাহলে কী বুঝলাম? বাতিল বা অমুসলিমদের সাথে আপস করে কি ইসলাম কায়েম করা জায়েজ? তাহলে তো তার নবুয়তের শুরুতেই কাফেরদের প্রস্তাতাবমতো, আরবের সুন্দরী নারীপ্রাপ্তির পাশাপাশি আরবের রাষ্ট্রপ্রধান হবার সুযোগ হাতছাড়া করা মহানবীর মারাত্মক ভুল ছিলো! এই নামধারী মুসলিমদের আরো ধারণা এই যে-ইসলামী আন্দোলন করা মানেই ইসলাম কায়েম করার বাধ্যবাধকতায় আবদ্ধ হওয়া, অন্যথায় ইসলামীরাষ্ট্র কায়েম করতে না পারাটাই যেনো মুসলিমজীবনের আসল ব্যর্থতা। আসলে কি বিষয়টা কি তা-ই?

ইসলাম কায়েমের আন্দোলন করা ফরজ হলেও ইসলাম কায়েম না করে মৃত্যুবরণ করাটা কিন্তু ফরজ নয়। তাইতো আল্লহ বলেন-হে মুমিনগণ তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো। অর্থাৎ আমৃত্যু পরিপূর্ণ ইসলাম মেনে চলার কাজটাই শুধু ফরজ, এতে ইসলাম কায়েম হোক বা না হোক-সেটা আল্লাহরই দায়িত্ব বলে আল্লাহ নিজেই ঘোষণা করেছেন।

ন্যায়প্রতিষ্ঠায় মুসলিম-অমুসলিম ঐক্য জায়েজ
আবু বকর রাঃ এর খিলাফতের সময় থেকেই মুসলিমরা নিকটবর্তী নির্যাতিত অমুসলিম জনপদের আহবানে যুগপতভাবে অত্যাচারী পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যের সীমান্ত আক্রমণ করে। একে একে তাদের অসাধারণ সব বিজয়ও আসতে থাকে। পরাজিত জনপদের খৃষ্টানরা স্বভাবতই মুসলিমদের নিকট থেকে স্বজাতিনিগ্রহের প্রায়চিত্তস্বরূপ তাদের ওপর বর্বরোচিত অত্যাচারের আশংকাই করছিলো।

কিন্তু তারা অবাক হয়ে দেখলো, কোন অত্যাচার তো মুসলিমরা করলোই না বরং সকল আইনপ্রয়োগের বেলাতেও মুসলিম-অমুসলিমনির্বিশেষে কোন ভেদাভেদও তারা করছে না। অন্যায়ভাবে কোন অমুসলিমের কানাকড়ি সম্পদও কেউ গ্রাস করে না বা করতেও দেয়না, কেউ তাদের ধর্মপালনে বাধা দেয় না, জোর করে কাউকে মুসলিম বানানোও হয়না।

কেবলমাত্র জিজিয়া করের বিনিময়ে তারা নিজেদের পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সবই পাচ্ছে। এই অভূতপূর্ব ইনসাফ রোমান ও পারস্য কেনো, সারাপৃথিবীই কম দেখেছিলো। ফলে সে সকল যুবকরাই সাহাবাদের বা তাবেয়ীদের কাছে এসে স্বেচ্ছায় ইসলামগ্রহণ করছিলো যাদের বাবা-চাচারা যুদ্ধের ময়দানে সাহাবাদের হাতে নিহত হয়েছিলো।

আবু বকর রাঃ এর খিলাফতকালে খালিদ বিন ওয়ালিদ এবং উমার রাঃ এর সময় আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ এর নেতৃত্বে মুসলিমদের অসাধারণ সব বিজয় আল্লাহ্‌ দান করেন রোমানদের বিপক্ষে। হিমস ছিলো এশিয়ান অঞ্চলে রোমান খৃষ্টানদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি। আবু উবাইদাহ ৬৩৪ সালে হিমস জয় করেন। জয়ের পর মুসলিমরা জিজিয়ার বিনিময়ে অমুসলিমদের সকল অধিকার নিশ্চিত করলো।

হিমসবাসী দেখলো সমঅধিকার ও ইনসাফের শাসন কাকে বলে। তবে বছরখানিকের মাথায় রোমান সম্রাট বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে মুসলিমদের চুড়ান্ত আঘাত করতে আসে। কৌশলগত কারণে মুসলিমবাহিনী হিমস থেকে বেরিয়ে গিয়ে মোকাবেলার কৌশল নেয়।

হিমস ছাড়ার আগে মুসলিমবাহিনী বিগত সময়ের সকল জিজিয়া ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত জানায় হিমস শহরের খৃষ্টাননেতাদের। বিস্মিত হয় নগরবাসী, এও কি কখনো সম্ভব? খৃষ্টাননেতারা জিজ্ঞেস করলো, “যা আপনারা নিয়েছেন তা আবার ফেরত দিচ্ছেন কেনো?”

আবু উবাইদাহ উত্তর করলেন, “তোমাদের কাছ থেকে জিজিয়া আমরা নিয়েছিলাম ইসলাম নির্ধারিত কিছু শর্তের বিপরীতে, যার ভেতর ছিলো তোমাদের নিরাপত্তাপ্রদান। আজ আমরা তোমাদের নিরাপত্তা দিতে পারছি না। আর তাই এই জিজিয়া নিজেদের কাছে রাখার কোন অধিকারও আল্লাহ্‌ আমাদের দেননি।

কৃতজ্ঞ চোখগুলোর সামনে দিয়ে চুলচেরা হিসাবে সকল জিজিয়া ফেরত দিয়ে মুসলিমবাহিনী হিমস ছাড়লো। আবু উবাইদাহ রাঃ একই নির্দেশ দিলেন অন্যান্য কমান্ডারদেরও। এভাবে সিরিয়ার যে সকল স্থান মুসলিমবাহিনী ত্যাগ করলো, তাদের সবার জিজিয়া ফেরত দেয়া হলো। কিন্তু লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হলো যে, খ্রিস্টানরা আফসোস করে মুসলিমদের বললো, স্বজাতির নিপীড়নের চেয়ে তাদের কাছে বরং বিজাতীয় মুসলিমের শাসনই বেশী প্রিয়।

ইসলামীরাষ্ট্রের জিম্মায় অমুসলিমদের নিরাপত্তাবিধান ফরজ
সুতরাং ইসলামীরাষ্ট্রের অধীন অমুসলিম এলাকা যদি অন্য কোন শত্রু বা সামরিক শক্তিদ্বারা আক্রান্ত হয়, তাহলে মুসলিমদের সেই অমুসলিম ভূমি উদ্ধারের জন্যে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে পবিত্র কুরআনে।

আমি তাঁকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এর জিম্মিদের (অর্থাৎ জিম্মাধীন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়) বিষয়ে ওয়াসিয়াত করছি যে, তাদের সাথে কৃত অঙ্গীকার যেন পুরা করা হয়। (তারা কোন শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে) তাদের পক্ষাবিলম্বে যেন যুদ্ধ করা হয়, তাদের শক্তি সামর্থ্যের অধিক জিযিয়া (কর) যেন চাপানো না হয়। সহীহ বুখারি (ইফা) অধ্যায়ঃ ৫০/ আম্বিয়া কিরাম (আঃ) হাদিস নাম্বার: ৩৪৩৫

মুসলিমদের জাকাত এবং অমুসলিমদের জিজিয়া কর
ইসলামীরাষ্টে মুসলিমরাও ফ্রি বসবাসের সুযোগ পায় না বরং নিজেদের হাজারো ইবাদাতের পাশাপাশি তাদের বাধ্যতামূলকভাবে ফসল ও সম্পদের ওপর ২।৫০% হারে বার্ষিক যাকাত দিতে হয়, যা তাদের ঈমানের সাথে সম্পর্কিত। বাস করতে হলে দেশের সরকার নির্ধারিত ভূমিকর, নানারকম ট্যাক্সসহ আরো কতো কিছুই থাকে, যা বর্তমানে মুসলিম-অমুসলিম সবার জন্যই সমভাবে প্রযোজ্য হয়। এতে কেউ কি কখনো আপত্তি করে বা জুলুম বা অপমানজনক মনে করে। কিংবা এতে কি নাগরিকত্বের মানের হেরফের ঘটে? অথচ ইসলামীরাষ্টে অমুসলিমদের ওপর শুধু জিজিয়াকর ব্যতীত আর কোনো করারোপের নির্দেশ বা বাধ্যতা নেই!!

হযরত আবু বকর (রা) বলেনঃ আল্লাহর কসম! যে ব্যক্তি নামায ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে আমি অবশ্যই তার সাথে লড়াই করবো। কারণ যাকাত হচ্ছে সম্পদের হক। আল্লাহর কসম, তারা যদি আমাকে উটের একটি বাচ্চা দিতেও অস্বীকার করে যা তারা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট দিত, তবে আমি তাদের এ অস্বীকৃতির জন্য তাদের সাথে লড়াই করবো।

নামাজ আদায় করা যেমন অবশ্য কর্তব্য, যাকাত আদায় করাও অবশ্য কর্তব্য।যাকাত আদায় না করলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পর্যন্ত ঘোষণা করা হয়েছে। আর এটি মোট সম্পত্তির ২.৫%। (সহিহ আত্ তিরমিজি :: অধ্যায় ৭ :: হাদিস ৬২০)

আলী (রা) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেনঃ ঘোড়া ও গোলামের সদকা (যাকাত) আমি ক্ষমা করেছি, কিন্তু প্রতি চল্লিশ দিরহাম রূপার ক্ষেত্রে এক দিরহাম সদকা (যাকাত) আদায় কর। কিন্তু একশত নব্বই দিরহামে কোন সাদকা নেই। যখন তা দু’ইশত দিরহামে পৌঁছবে তখন তাতে পাঁচ দিরহাম সাদকা দিতে হবে। -সহীহ্, ইবনে মা-জাহ (১৭৯০)

এভাবেই সম্পত্তির ২.৫% শতাংশ দিয়ে দেয়া বাধ্যতামূলক। সুতরাং উন্নত বিশ্বের প্রতিটা মানুষ যখন যাকাত দিতে যাবে তখনই দারিদ্রের অবস্থান হবে জাদুঘরে।

মুসলিমদের যাকাতের ক্ষেত্রে যখন এই অবস্থা, তখন ইসলামীরাষ্ট্রে অমুসলিমদের সার্বিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তাস্বরূপ তাদের জিম্মাদারীর স্বার্থে কেবল জিজিয়া কর প্রদানই বাধ্যতামূলক মাত্র। তাও সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, শুধু যুদ্ধে গমনোপযোগী সবল পুরুষদের ছাড়া।

অথচ দেখুন স্বাধীন দেশ আমেরিকায় শুধুমাত্র ২০০ ধরনের কর রয়েছে । মোবাইলে ১০০ টাকার কথা বললেই আমাদের দেশে ১৫ টাকা কর দিতে হয়। প্রায় সকল কিছুতে ১০০ টাকায় ১৫ টাকা মূসক দিতে হয়! আয়ের উপর কর থেকে এককেজি মিষ্টিতেও কর! ৩৩ ডলারের কিছু কিনলেই ৫ ডলার মূল্য সংযোজন কর!

ইসলামীরাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার ও মর্যাদা
আবদুল্লাহ ইবন মুহাম্মদ নুফায়লী (র.) মু’আয (রা) থেকে বর্ণিত । রাসূলুল্লাহ (সা) যখন মু’আয (রা)-কে ইয়ামনে প্রেরণ করেন, তখন তাঁকে এরূপ নির্দেশ দেন যে, প্রত্যেক অমুসলিম প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির নিকট হতে এক দীনার অথবা এক দীনার মূল্যের মু’আফিরী নামক কাপড়, যা ইয়ামনে উৎপন্ন হয় জিযিয়া হিসাবে গ্রহণ করবে।” একই কথা আছে – জিহাদের বিবরণ অধ্যায় ১১ বুলুগূল মারাম ১৩২২[1][/b]

মালিক (রঃ) বললেন : প্রচলিত সুন্নত হইল, অমুসলিম আহলে কিতাব নারী ও শিশুদের ওপর জিয্য়া ধার্য হইবে না। যুবকদের নিকট হইতেই কেবল জিযিয়া আদায় করা হইবে। কারণ স্বীয় অঞ্চলে বসবাস করা এবং শত্রু হইতে রক্ষা করার ভিত্তিতেই তাহাদের উপর জিয্য়া ধার্য করা হইয়াছিল। অমুসলিম বাসিন্দাদের পশুপাল, ফল এবং কৃষিক্ষেত্রে কোনরূপ যাকাত ধার্য করা যাইবে না। এমনিভাবে অমুসলিম নাগরিকদিগকে তাহাদের পৈতৃক ধর্মে প্রতিষ্ঠিত থাকিতে দেওয়া হইবে এবং তাহাদের ধর্মীয় বিষয়ে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করা যাইবে না।

মুসলিমদের যুদ্ধে অমুসলিমদের পাঠানো নিষিদ্ধ
শুধুমাত্র অমুসলিম যুবকদের উপর এই কর ধার্য হবে।এখানে যুবক বলতে শুধুমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে নিজ ভূমির প্রতিরক্ষা করার সামর্থ্যবানদের কথা বলা হয়েছে। এটা ২০-৩০ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে ধরা হয়।জিজিয়া দেয়ার শর্তই হচ্ছে-অমুসলিম যুবকদের যুদ্ধে যাবার কোন বাধ্যবাধকতা, ঝুঁকি এবং প্রয়োজন নেই।কারণ এর বিনিময়ে তাদের থেকে জিযিয়া কর নিয়ে নেয়া হচ্ছে। মাসিক ৫ ডলারের বিনিময়ে তারা তাদের প্রতিরক্ষার নিশ্চয়তা পাচ্ছে। এছাড়া এদের উপর আর কোন কর আরোপ করা নিষিদ্ধ।

অমুসলিম যুবক ছাড়া অন্যরা জিজিয়াকরমুক্ত
অমুসলিম যুবক ছাড়া আর কারো উপর ধার্য করা যাবে না। নারী , শিশু, বৃদ্ধ , প্রতিবন্ধী এবং অন্যান্য সবাই এর আয়তামুক্ত থাকবে। এদের উপর জিজিয়া ধার্য করা যাবে না। তাহলে ইসলামে অমুসলিমদের এই ব্যতিক্রমী সুবিধাগত মর্যাদা কি দ্বিতীয়শ্রেণীর নাগরিকের পর্যায়ে পড়ে নাকি মুসলিমদের তুলনায় অনেক ভালো?

মুয়াত্তা মালিক :: যাকাত অধ্যায় ১৭ হাদিস ৬২২ এ উল্লেখ আছে– আহলে কিতাব এবং অগ্নি উপাসক অর্থাৎ অমুসলিম যিম্মী বাসিন্দাদের পশুপাল, ফল এবং কৃষিক্ষেত্রে কোনরূপ যাকাত ধার্য করা যাইবে না। অর্থাৎ এরা কোন যাকাত দিবে না। বিনিময়ে মুসলিমরা ২.৫% যাকাত দেবে। যে যাকাত নারী থেকে শুরু করে বৃদ্ধও দিতে হবে বাধ্যতামূলক। ইসলামী সমাজে যাকাত না দিলে কঠোর শাস্তি রয়েছে।

মুয়াত্তা মালিক :: যাকাত অধ্যায় ১৭ হাদিস ৬২২ এ উল্লেখ আছে– অমুসলিম যিম্মী নাগরিকদিগকে তাহাদের পৈতৃক ধর্মে প্রতিষ্ঠিত থাকিতে দেওয়া হইবে এবং তাহাদের ধর্মীয় বিষয়ে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করা যাইবে না। (সহিহ বুখারী :: খন্ড ৪ :: অধ্যায় ৫৩ :: হাদিস ৩৯১)

কাইস ইবন হাফস (র) আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) থেকে বর্ণিত, নবী সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি কোন যিম্মিকে (জিম্মাধীন বা যাদের উপরে জিজিয়া নেয়া হবে) হত্যা করে, সে জান্নাতের ঘ্রাণ পাবে না। আর জান্নাতের ঘ্রাণ চল্লিশ বছরের দুরত্ব থেকে পাওয়া যাবে।

মুয়াত্তা মালিক :: যাকাত অধ্যায় ১৭ হাদিস ৬২২ এ উল্লেখ আছে–সুতরাং যতদিন তাহারা (অমুসলিমগণ) ইসলামীরাষ্ট্রের সন্ধিকৃত এলাকায় বসবাস করিবে, তাহাদের উপর জিযিয়া ব্যতীত আর কিছুই ধার্য হইবে না।

তবে জিজিয়া করের হার সম্পর্কে কুরআনে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। বলা হয়েছে , জিযিয়া কর আদায় কর। আমরা মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনে দেখতে পাই– তিনি অমুসলিম সবল অধীনস্থদের উপর কোন হারে জিযিয়া আদায় করেছেন। একটি অমুসলিম দেশের শুধুমাত্র সামরিকক্ষেত্রে সবল পুরুষদের ওপর এই কর নেয়া হত, এছাড়া অন্য কোন নাগরিকদের ওপর এই কর নেয়া কঠোরভাবে নিষেধ। এই হারটি হল– বাৎসরিক মাত্র ১ দীনার। সে হিসেবে, এটি মাসিক প্রায় বর্তমান ডলার হিসেবে ৫ ডলার পড়ত, যা মাথাপিছু আয়ের গড়ে ০.০৫% পর্যন্ত পড়তো।

মুহাম্মদ সাঃ ইয়ামানের অমুসলিম নাগরিকদের উপরে সর্বমোট বাৎসরিক ১ দিনার আদায়ের নির্দেশ দেন অথবা সমমূল্যের এক ধরনের কাপড় জিযিয়া কর হিসেবে ধার্য করতে বলেন। (সুনান আবু দাউদ :: কর, খাজনা, অনুদান ও প্রশাসনিক দায়িত্ব ২০ : হাদিস নং ৩০৩৮)

আজকালকার মূর্খ মুসলিম এবং বিভ্রান্ত কিছু গবেষক সুরা তাওবার কথা টেনে এনে অমুসলিমদের বিভ্রান্ত করেন এ বলে যে, এই সুরায় অমুসলিমদের জোরপূর্বক হত্যার কথা বলা হয়েছে। আসলে এই আয়াতগুলি সেসময়ের আরবে সন্ধিরত মুশরিকরা যখন সন্ধি-শর্ত ভঙ্গ করে,তখন তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহ যুদ্ধের ডাক দেন। আর সেটা শুধু সে সময়ের মুশরিকদের উপরেই প্রযোজ্য ছিলো। যেমন কিছু আয়াতে বলা হয়েছে – নবীর দরজায় করাঘাত ব্যতীত ঢুকো না। সেইসব আয়াত এখন অকার্যকর। কারণ সেগুলো শুধু সে সময়ের।

সূরা তাওবার প্রথম দুটি আয়াত হচ্ছে –“সম্পর্কচ্ছেদ করা হলো আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে সেই মুশরিকদের সাথে, যাদের সাথে তোমরা চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলে। অতঃপর তোমরা পরিভ্রমণ কর এদেশে চারমাসকাল। আর জেনে রেখো, তোমরা আল্লাহকে পরাভূত করতে পারবে না, আর নিশ্চয়ই আল্লাহ কাফেরদিগকে লাঞ্ছিত করে থাকেন।( ৯:১-২)

একই সুরার একটা আয়াত নিয়ে তারা প্রোপাগান্ডা চালায় –“তোমরা যুদ্ধ কর আহলে-কিতাবের ঐ লোকদের সাথে, যারা আল্লাহ ও রোজ হাশরে ঈমান রাখে না, আল্লাহ ও তাঁর রসূল যা হারাম করে দিয়েছেন তা হারাম করে না এবং গ্রহণ করে না সত্য ধর্ম, যতক্ষণ না করজোড়ে তারা জিযিয়া প্রদান করে। ”সুরা তাওবা ২৯ নং আয়াত।

অথচ এটা ছিল শুধু সে সময়ের জন্যে কারণ এর আগের আয়াতই হচ্ছে ২৮ নং আয়াত “হে ঈমানদারগণ! মুশরিকরা তো অপবিত্র। সুতরাং এ বছরের পর তারা যেন মসজিদুল-হারামের নিকট না আসে। আর যদি তোমরা দারিদ্রে আশংকা কর, তবে আল্লাহ চাইলে নিজ করুনায় ভবিষ্যতে তোমাদের অভাবমুক্ত করে দেবেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।”

সে সময়ের সন্ধিচুক্তি ভঙ্গকারীদের কথাই বলা হচ্ছে। এই আয়াতকে অপব্যাখ্যাকারীদের মনে রাখা উচিৎ যে, ইসলাম অমুসলিমদের ধ্বংস করতে বলেনা বরং কুরআন বলে–দ্বীনের ব্যাপারে কোন জোর-জবরদস্তি নেই (২:২৫৬)

ধর্মের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি এবং তোমাদেরকে দেশ থেকে বহিষ্কৃত করেনি, তাদের প্রতি সদাচরণ ও ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদেরকে ভালবাসেন। (৬০/৮)

আল্লাহ্ কেবল তাদের সন্বন্ধে তোমাদের নিষেধ করছেন যারা ধর্মের কারণে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে ও তোমাদের বাড়িঘর থেকে তোমাদের তাড়িয়ে দিয়েছে এবং পৃষ্ঠপোষকতা করেছে তোমাদের বহিষ্কারের ব্যাপারে, যে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতবে আর যে কেউ তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতবে তারাই তো তবে স্বয়ং অন্যায়কারী। (৬০:৯)

অতঃপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তোমার কর্তব্য তো কেবল সুস্পষ্ট বাণী পৌঁছে দেয়া মাত্র। বানী পৌঁছে দিয়ে শক্তি-প্রয়োগ চলে না।আমাদের এর বেশি কাজ নেই , শক্তি প্রয়োগ পরের কথা। তবে কেউ আক্রমণ করলে প্রতিহত করা ইসলামে দায়িত্ব। (১৬:৮২)

তোমার পালনকর্তার পথের দিকে আহবান কর প্রাজ্ঞতা, বিচক্ষণতা ও ভাল উপদেশ শুনিয়ে এবং তাদের সাথে আলোচনা কর উত্তম পন্থায়। (১৬:১২৫)

Processing your request, Please wait....
  • Print this article!
  • Digg
  • Sphinn
  • del.icio.us
  • Facebook
  • Mixx
  • Google Bookmarks
  • LinkaGoGo
  • MSN Reporter
  • Twitter
৫৮৭ বার পঠিত
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (ভোট, গড়: ৫.০০)

১ টি মন্তব্য

  1. লেখার জন্য ধন্যবাদ।