লগইন রেজিস্ট্রেশন

দৈশিক জাতীয়তাবাদ ও বৈশ্বিক উম্মাহ-চেতনা ১

লিখেছেন: ' kawsartex' @ মঙ্গলবার, এপ্রিল ২৪, ২০১২ (৬:২৬ অপরাহ্ণ)

published by a-haque on Sat, 01/28/2012 – 08:08

১  এই লেখা সহজ ও সহজের

জাতীয়তাবাদ পানির মতো সহজ এবং বরফের মতো কঠিন একটি বিষয়। জাতীয়তাবাদের ধারণা সর্বজনীন, কিন্তু তত্ত্ব বিজ্ঞজনীন। এর তাত্ত্বিক রূপ ও মূল্য নিয়ে গভীর কৌতূহল, কিঞ্চিৎ পড়াশোনা ও সামান্য চিন্তাভাবনা আমার আছে। কিন্তু এইটুকু দিয়ে বিজ্ঞজনকে তত্ত্ব বোঝানো যেমন সম্ভব নয়, তেমনি তার দরকারও নেই। বিজ্ঞ মানুষেরা যে বহুকিছু জানেন ও বোঝেন, এটা খুব ভালো; তবে খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেননা তাঁরা সমাজে গরিষ্ঠ নন, লঘিষ্ঠ। বিজ্ঞের তত্ত্বজ্ঞানের চে’ সমাজে যারা গরিষ্ঠ, সেই সহজ লোকদের সরল সত্যজ্ঞান বেশি গুরুত্বপূর্ণ; কারণ তারা সমাজ বদলায়, নির্ণয় করে সমাজ-চারিত্র। ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের দীর্ঘ ঐতিহাসিক কালক্রমে জাতীয়তাবাদ নিয়ে অনেককিছুই ঘটে গেছে: রাজনীতিবিদরা তর্ক করেছেন, পণ্ডিতরা বিশ্লেষণ করেছেন, চিন্তাবিদ লেখকরা বই লিখেছেন। সেসব রচনাবলি মননশীল পাঠকদের। আমার এই ক্ষুদ্র নিবন্ধের নিবেদন একান্তই আমজনতার কাছে, যাঁরা তেল-নুন আর ধর্মকর্ম নিয়ে সাদাসিধে জীবনযাপন করেন।

২  জাতীয়তাবাদ বোঝার দরকার কী?

আসুন তাহলে, বিসমিল্লাহ্ বলে শুরু করা যাক। মুশকিল হলো, এই শুরুতেই তর্ক উঠতে পারে। আপনি আপত্তি করতে পারেন: ‘বিসমিল্লাহ্ বলে কেন শুরু করবো? হরি হরি বা হলি কাউ বললে কী সমস্যা?’
দুঃখিত। সম্ভাবনার হিসেবে ধরে নিয়েছিলাম আমার পাঠক মুসলিম। আসল কথা হলো, আপনি তা-ই বলবেন যা বলতে আপনার জাতীয়তা সায় দেয়।

মোটকথা, ঠিক এ মুহূর্তে আপনি এবং আমি, আমরা দু’জন দরোজা ধাক্কা দিয়ে শুরুতেই বিষয়টির অন্দরমহলে ঢুকে পড়েছি। আমরা বুঝতে পারছি— আমাদের বলা, ভাবা, করা সবকিছুতেই জাতীয়তা আছে। কাজেই জাতীয়তা বোঝার দরকারও আছে। একমত?

৩  জাতীয়তাবাদের অর্থ

দুনিয়ায় এখন সাত শো কোটি মানুষ। সবাই এক রকম নয়। একত্রেই বাস করছি এই উপগ্রহে, কিন্তু আমরা এক নই। আমাদের অনেক ধর্ম, বিভিন্ন বিশ্বাস, বিচিত্র মূল্যবোধ। আমরা সবাই সবার কথা বুঝি না, কারণ আমাদের ভাষা এক নয়। ইচ্ছেমতো যে-কোনো জায়গায় ঘরবাড়ি বেঁধে বসবাস শুরু করতে পারি না, কারণ সব দেশ স্বদেশ নয়। আমাদের গায়ের রঙ ভিন্ন ভিন্ন: কেউ সাদা, কেউ কালো, কেউ তামাটে। গঠনেও বিস্তর বৈচিত্র: কেউ খাটো, ফর্সা, চ্যাপ্টা নাক, পাতলা ঠোঁট, ছোট ছোট চোখ; আবার বহু মানুষ দীর্ঘাঙ্গী, খাড়া নাক, কোঁকড়ানো চুল। আমরা অনেক মানুষ, আমরা অনেক রকম।

এই সমস্ত ‘রকম’ এর মধ্য থেকে কী কী গুণে কারা কারা প্রায় এক রকম, তা দেখে এই ‘এক রকম’ লোকজনকে চিহ্নিত করা হয়। তারপর এদেরকে বলা হয় জাতি। জাতি থেকে এসেছে জাতীয়, জাতীয়তা, জাতীয়তাবাদ। জাতি অর্থ সামলক্ষণিক শ্রেণী, প্রায় এক রকম অনেক মানুষের সমষ্টি। আর জাতীয়তাবাদ মানে স্বজাতিপ্রেম, জাতির স্বরূপ ও স্বার্থ নিয়ে চিন্তাভাবনা।

৪  জাতীয়তার তর্কিত উপাদান

নিগ্রো বললে আমরা এমন জাতির লোক বুঝি, যাদের গায়ের রঙ ডেকচির তলার মতো কুচকুচে কালো। যাদের গায়ের রঙ শ্বেত অর্থাৎ সাদা, তাদেরকে বলি শ্বেতাঙ্গ। এখানে তফাত তৈরি করা হয়েছে গায়ের রঙ দেখে। শুধু গায়ের রঙ কালো বলে শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদেরকে শত শত বছর ধরে নির্যাতন করে আসছে। গাত্রবর্ণ দিয়ে মানুষকে দু’ ভাগে ভাগ করে তৈরি এই জাতীয়তার ইতিহাস কেবলই অত্যাচারের ইতিহাস। আমাদের জানা অতীতের মধ্যে ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ সা. প্রথম ব্যক্তি, যিনি এই অন্যায় রুখে দাঁড়ালেন প্রবলভাবে, স্থূল গাত্রবর্ণের অমানবিক ভেদরেখা তিনি মুছে দিতে সক্ষম হলেন। কৃষ্ণাঙ্গ বিলালকে সম্মানিত করে তিনি মনুষ্যত্বের মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। ইসলামের এই মহৎ শিক্ষার আলো ক্রমে ধর্মনির্বিশেষে মুসলিম জাহান ছাড়িয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে পৃথিবীময়। ফলে কমে আসছে বর্ণবাদ। এ উত্তরণের আধুনিক প্রান্তে এসে অবশেষে একজন কৃষ্ণাঙ্গ আজ মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধান, যিনি একজন কালো পুরুষ ও এক সাদা নারীর শঙ্কর সন্তান।

এভাবে, ইংরেজ জাতি বলে আমরা সেই জাতিকে বুঝাই, যারা ইংরেজি ভাষায় কথা বলে। এখানে জাতি গঠনের উপাদান হয়েছে ভাষা। হয়েছে মানে ধরে নেয়া হয়েছে, যদিও তা প্রকৃত অর্থে পৃথক কোনো জাতি বুঝায় না। বুঝায় ইংরেজিভাষী জনগোষ্ঠি। তাত্ত্বিকভাবে ভাষা দিয়ে জাতিগঠনের চেষ্টা ব্যর্থ চেষ্টা এবং যৌক্তিক ভুল। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জন্মসূত্রে এই ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার গর্বিত মালিক। কিন্তু তত্ত্ব হিসেবে আমরা এ জাতীয়তা মানি না। কারণ স্রেফ ভাষার একতা অনেককে এক করে ধরে রাখতে পারে না। কীভাবে — উদাহরণ দিই।

জয় গোস্বামী কলকাতাবাসী। আমার মতো তিনিও বাংলায় লেখেন, বাংলা বলেন। ভাষার ঐক্যে আমরা দু’জনই এক, বাঙালি। ভাষার এই মিল মান্য বটে, তবে এই মিল দিয়েই সাময়িক জনমিল ঘটলেও স্থায়ী মনোমিলের যুক্তি মেলে না। ভাষা এক বলেই তাই তাঁকে আমার জাতীয় ভাই, বন্ধু বা আপনজন বলে মেনে নিতে পারি না, যদিও মানুষ হিসেবে তিনি আমার কাছের এবং সেটি অন্য বিবেচনা। তাঁকে স্বজাতীয় স্বীকার করতে না-পারার কারণ অনেক। আমরা একে অপরের কাছে যেতে পাসপোর্ট লাগবে। রেস্তোরাঁয় একসঙ্গে খেতে বসে আমি যদি গোমাংসের অর্ডার দিই, তাহলে গোস্বামী টেবিল ছেড়ে উঠে গিয়ে বেসিনে হড়হড় করে বমি করবেন। তিনি আমাকে হুইস্কি অফার করলে আমি আস্তাগফিরুল্লাহ বলে মুখ ফিরিয়ে নেবো। এভাবে চলাফেরা, নৈতিকতা, বোধ-বিশ্বাস সবকিছুতেই আমরা দু’জন দুই মেরুর। আমাদের মুখের ভাষায় মিল, কিন্তু বুকের ভাষায় মিল নেই। সম্পর্ক মূলত হৃদয়ঘটিত বলে, মুখের মিলে শেষ পর্যন্ত জীবনে জীবন মেলানো যায় না। বৈপরিত্যটা অন্তর্গত, আর ঐক্য বাইরের। ভেতর-বাহিরের দ্বন্দ্বে ভেতরে ভেতরে আমরা বন্ধ হয়ে থাকি। সহাবস্থান তাই সহবোধ দেয় না। এ আড়ষ্টতা নিয়ে হৃদ্যতা গড়ে ওঠা কি সহজ? কীভাবে আমি ও তিনি জাতি-বিবেচনায় এক হবো?

একটু আগে যে- রাজনৈতিক দলটির উদাহরণ দিলাম, তারা চোখ-কান বন্ধ করে ‘বাঙালি বাঙালি’ বলে চিৎকার করেই যাচ্ছে। দুনিয়াজুড়ে ভারতের নাগরিককে ভারতীয়, রাশিয়ার রুশ, ইংল্যান্ডের ইংলিশ, মিশরের মিশরি, পাকিস্তানের নাগরিককে পাকিস্তানি বলা হচ্ছে, কিন্তু আওয়ামী লীগের মুখে কখনোই ‘বাংলাদেশি’ শব্দটি শোনা যায় না। কারণ ‘তালাক’ বললে যেমন স্ত্রীবিয়োগ ঘটে, তেমনি বাংলাদেশি বললে আওয়ামী লীগত্ব নষ্ট হয়।

জাতীয়তা নির্ণয়ের তৃতীয় উপাদান জমির চৌহদ্দি, অর্থাৎ ভৌগোলিক সীমানা। এ নিয়ে বেশি কিছু বলবার নেই। কারণ জমি মেপে মানুষের প্রকৃতি-বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করবার চেষ্টা ধানগাছ চিরে তক্তা বানাবার মতোই হাস্যকর। যে- ভূমিতে ভূমিষ্ঠ হয়েছি, সে যদি হয় জন্মভূমি, আর জন্মভূমি হবার কারণেই বিশেষ ভূমির প্রতি আমার যদি বিশেষ টান বোধ করবার কথা থাকে, তবে তো আঁতুড়ঘরের ওই স্থানটুকু বড়ই সঙ্কীর্ণ! এইটুকুন জায়গাকে দর্শন ‘দেশ’ বলতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান তা মানবে না। সে তর্ক আপাতত থাক, আশু ঝামেলা হলো, আমি কেন আমার কয়েক বর্গ ফুটের জন্মস্থানকে না বুঝিয়ে ‘জন্মভূমি’ বলে কয়েক হাজার বর্গ মাইল বুঝাচ্ছি? কোন্ কারণের আকর্ষণে ক্ষুদ্র ভূ-টুকরো মাইল মাইল ছড়িয়ে গেলো? কারণ কোনো একটা আছে। সেটাই দরকার। কারণ ওই কারণটা দিয়ে একইভাবে আমি আমার হাজার মাইল আয়তনের জন্মদেশের সীমানাকে পৃথিবীর প্রান্তসীমা অবধি ছড়িয়ে নেবো। ঠিক তখন আরো চমৎকার একটা কারণের জন্ম হবে, যার সাহায্যে আমি চমৎকৃত হয়ে আবিষ্কার করবো যে, আমার জন্মদেশটা আসলে বিশ্বদেশ, আর আমি একজন বিশ্বনাগরিক।

বস্তুত, বিশ্বাস ও জীবনধারার দুস্তর দূরত্ব নিয়ে শারীরিকভাবে কেউ কাছে থাকলেই বা নির্দিষ্ট কোনো সীমারেখার ভেতরে অবস্থান করলেই সে আমার সঙ্গে একই জাতিসত্তার অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে, এ কোনো যুক্তির কথা নয় বরং নিছক আবেগ। এ আবেগ বাস্তবতা উপেক্ষা করে নিজের দেশকে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ দেশ বলে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে এবং দেশ ও জাতির প্রতি বিদ্বেষ সঞ্চার করে। কবি বলেছিলেন, আপনাকে বড় বলে বড় সেই নয়। কিন্তু নিজেকে বড় ও গৌরবান্বিত ভাবার মধ্যে যে এক ভীষণ রকম স্বাদ আছে, তা সবাই জানে বলে কাউকে বলতে হয় না। জাতীয়তাবাদীরা সেরা জাতি, তাদের নিজের দেশ ‘সকল দেশের সেরা’। হিটলার এটা খুব চমৎকার বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, জার্মান রক্ত হলো পৃথিবীর সবচে’ অভিজাত রক্ত। চেম্বারলেনের কথায়, যা-কিছু ভালো তা অবশ্যই জার্মান, অ-জার্মান মানেই খারাপ। কপালে খারাপি ছিলো জার্মানদের, তাই খারাপদের হাতে খুব খারাপভাবেই তারা মার খেয়েছিলো। ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদ আসলে দৈশিক অহংবোধ। সাম্রাজ্যবাদীরা আরবদের মাথার ভেতর এই অহমিকা ঢুকিয়ে দিয়েছিলো। ফলে তারা ভাবলো, ইসলামের জন্ম হলো আমাদের দেশে, ইসলামের নবী-কিতাব আমাদের ভাষায়, অথচ ইসলামী খিলাফাতের কেন্দ্র আরবের বাইরে অনারব কনস্ট্যান্টিনোপলে, এটা তো অপমানজনক। তারা তাদের জাতীয়তাবাদ নিয়ে হামলা করলো উসমানী খিলাফাতে, খিলাফাত গেলো ভেঙে। সেই সঙ্গে আদর্শবাদী মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের শক্তিও খানখান হয়ে গেলো। সাম্রাজ্যবাদীরা চেপে বসতে লাগলো মুসলিম দেশগুলোর ঘাড়ের ওপর। আমাদের দেশেও আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ আমদানি হয়েছে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এ নিয়ে গর্বের সঙ্গে রাজনীতি করছে।

কিন্তু আসল কথা হলো, নাগরিকত্ব বা রাষ্ট্রীয় পরিচয় আর জাতীয়তা আদৌ এক জিনিস নয়। মতি মিয়া রতনপুর গ্রামে বাস করেন – এখানে রতনপুর যেমন তাঁর গ্রামের ঠিকানা; তেমনি তিনি বাংলাদেশে বসবাস করেন, এর অর্থ হলো বাংলাদেশ তাঁর রাষ্ট্রীয় ঠিকানা। মতি মিয়া বিদেশ গেলে এই ঠিকানা কাজে লাগবে। দেশে যেহেতু বিদেশিরা বেড়াতে বা কাজ করতে আসে, তাই মাঝেমধ্যে দেশেও তাঁকে বলতে বা লিখতে হতে পারে যে তিনি একজন বাংলাদেশি। এই দেশীয় পরিচয় আর স্বকীয় জাতীয়তা এক জিনিস নয়। সাধারণ বুদ্ধিতেই দু’য়ের পার্থক্য বুঝা যায়। কিন্তু অসৎ রাজনীতিবিদরা দলীয় সুবিধা নিতে সহজ সরল জনগণকে ভুল বুঝাতে চেষ্টা করেন। তাঁরা জনগণের স্বকীয় সংস্কৃতি, গৌরবময় ঐতিহ্য, পররাষ্ট্রের নিগ্রহের প্রতিশোধ, দেশপ্রেম ইত্যাদি ক্ষুদ্র আঞ্চলিক আবেগকে উস্কে দিয়ে দেশীয় পরিচয়ই মানুষের মৌলিক পরিচয় এমন ধারণা জনমানসে প্রতিষ্ঠা করতে চান। এ চেষ্টা অতীতে যেমন ছিলো, আজও আছে। ভারতে হিন্দু কর্তৃক নির্যাতিত সংখ্যালঘু মুসলিমদের জন্যে নিরাপদ ও স্বায়ত্তশাসিত পৃথক ভূখণ্ডের দাবিতে স্বাধীন পাকিস্তান আন্দোলনের সময় মুসলিম জনগণের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে প্রবলভাবে এই চেষ্টা শুরু হয়েছিলো। সে দেশে ১৮৮৫ ঈসায়ীতে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারের স্বার্থরক্ষার লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকারেরই সরাসরি উদ্যোগে অ্যালান অকটেভিয়ান হিউমের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় সর্বভারতীয় কংগ্রেস, যা পরে দু’টি ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। একটি ধারা ছিলো যথারীতি ব্রিটিশ সমর্থক। অন্যটি ছিলো উগ্র হিন্দুত্ববাদী নেতা লালা লাজপৎ রাই-এর অধীনে – গোঁড়া, সাম্প্রদায়িক, মুসলিমবিদ্বেষী এবং ভারতকে নিরঙ্কুশ রামরাজ্য বানানোর যুদ্ধে শপথবদ্ধ। অতএব কোনো দিক থেকেই ভারতের নির্যাতিত সংখ্যালঘু মুসলিমদের জাতীয় অস্তিত্ব ও স্বার্থের সঙ্গে কংগ্রেসের কোনো সুসম্পর্ক থাকার কথা ছিলো না। কিন্তু অতি কৌশলে এ দলটি ইসলামী খিলাফা ও মুসলিম উম্মাহ্-চেতনায় উজ্জীবিত স্বাধীনতাকামী মুসলিমদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করতে সমর্থ হয় (পরে অবশ্য অসৎ ও অযোগ্য নেতৃত্বের কারণে পাকিস্তান স্বাধীন হলেও ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠতে ব্যর্থ হয়, সেটি এখানে আলোচ্য নয়) এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে কতিপয় মুসলিম রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃস্থানীয় লোক এদের চক্রান্তের শিকার হয়ে হিন্দু-মুসলিম মিলনের ফাঁকা বুলি আওড়াতে শুরু করেন। সঙ্কীর্ণ আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের দূষিত ধারণাকে ইসলামীকরণ করবার চেষ্টা করেন। তাঁরা বলেন: কোনো জনগোষ্ঠীর জাতীয়তা নির্ণয়ের মাপকাঠি ধর্ম নয় বরং ভৌগোলিক সীমারেখা। তাই ভারতের হিন্দু-মুসলিম ধর্ম-সংস্কৃতিনির্বিশেষে আমরা সবাই এক জাতি। তাঁরা এ ধারণার নাম দেন ‘মুত্তাহিদা ক্বাওমিয়্যাত’ বা ‘একজাতিতত্ত্ব’। পরিস্থিতির প্রয়োজনে অমুসলিমদের সঙ্গে মুসলিমদের সাময়িক রাজনৈতিক চুক্তির কথা আর হিন্দু-মুসলিম মিলে একই জাতিসত্তা গঠনের কথা এক কথা নয়। এ দ্বিতীয় কথাটি নিয়েই আমাদের কথকতা। কেননা তা সরাসরি কুরআন-হাদীসবিরোধী, তবু খামাখাই কেউ কেউ এসব স্পষ্ট জাহিলি জাতীয়তা-আঞ্চলিকতার ফ্যাসাদকে ইসলামসিদ্ধ প্রমাণ করতে চেষ্টা করছেন। অথচ কুরআন বলছে, বংশীয় আভিজাত্য, গোত্রপ্রীতি, ভাষাগত বিভক্তি, আঞ্চলিক সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবাদ – এ সবই যুলম। হাদীসের ভাষায় এগুলো জাহিলিয়্যাত। তাত্ত্বিক আলিমদের মতে শয়তানি চিন্তা। সাম্প্রতিক আলিম লেখক সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী জাতীয়তাবাদকে ‘জাহিলি যুগের ভ্রান্ত ধর্ম’-এর সঙ্গে তুলনা করে জাতীয়তাবাদীদেরকে সে ধর্মের ‘পূজারী’ বলে মন্তব্য করেছেন। মাফ করবেন, অনিচ্ছাসত্ত্বেও এ উদ্ধৃতিটুকু:

“এই উদার প্রগতির যুগেও এমন অনেক ধর্মের সাক্ষাত মেলে যেসব ধর্মের আকীদা-বিশ্বাস ও শিক্ষামালা খুবই হাস্যকর যা তার অনুসারীদের নির্বোধ ও চেতনাহীন পশুর মত জোয়ালে বেঁধে রেখেছে এবং তাদেরকে নিজেদের বুদ্ধি-বিবেচনা ও চিন্তা-ভাবনা করে কাজ করার অনুমতি দেয় না। এরপর এমন কিছু ধর্ম ও বিধি-ব্যবস্থাও আছে যেগুলো ধর্ম নামে কথিত হবার উপযোগী নয় বটে, কিন্তু আপন নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতার আওতায়, স্বীয় অপরিসীম শক্তি ও সরকারের মধ্যে এবং আপন অনুসারীদের অন্ধ আনুগত্য ও ভক্তির আবেগাতিশয্যে প্রাচীন ধর্মগুলো থেকে কোনক্রমেই কম নয়। এগুলো সেইসব রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক দর্শন যেগুলোর ওপর আজকে মানুষ ঠিক তেমনি বিশ্বাস পোষণ করছে যেমনটি আগে বিভিন্ন ধর্ম ও জীবনদর্শনের ওপর পোষণ করতো। এগুলো হচ্ছে এ যুগের জাতীয়তাবাদ, ভৌগোলিক ও আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজবাদ বা সমাজতন্ত্র সমূহবাদ ইত্যাদি। এসব নতুন ধর্ম নিজেদের একচোখা নীতি, সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও হৃদয়হীনতার ক্ষেত্রে প্রাচীন জাহিলী যুগের বিভিন্ন ধর্ম ও মাযহাবের চাইতেও এক ডিগ্রী বেশি।”
——— আবুল হাসান আলী নদভী; ‘মুসলমানদের পতনে বিশ্ব কী হারালো?’; মুহাম্মদ ব্রাদার্স, ঢাকা; ২০০৪; পৃষ্ঠা ৩১৫।

আমাদের আলোচিত তিনটি ছাড়া জাতীয়তা নির্ধারণের উপাদান হিসেবে নৃতাত্ত্বিক গঠন ও ব্যবহারিক সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের কথাও উল্লেখ করা হয়ে থাকে, তবে তা আলোচনার পূর্ণতার উদ্দেশ্যেই। আদতে এ দু’টো বিবেচ্য হিসেবে অপেক্ষাকৃত অধিকতর বিস্তৃত ও জটিল এবং গুরুত্বের দিক থেকে গৌণ। তাই আমরা এখন ফিরে যাবো আলোচনার মূলে এবং দেখবো জাতীয়তার উপাদান হিসেবে কুরআন কোন্ মৌলিক বিষয় ও বৈশিষ্ট্য স্থির করেছে, তাঁর অনুসারীদের কাছে এ সংক্রান্ত চিন্তার কী নীতি ও পদ্ধতি উপস্থাপন করেছে এবং রাসূল সা. তাঁর একনিষ্ঠ অনুসারী সাহাবী ও তাঁর প্রিয় উম্মাহকে কী শিক্ষা দিয়ে গিয়েছেন।

৫  ইসলামে জাতীয়তার উপাদান ও ধরন

ইসলাম মানে শান্তির জন্যে মহান আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ, অস্তিত্ব-চেতনা-সম্পদ সবকিছু নিয়ে আত্মসমর্পণ। সর্বান্তকরণে মেনে নেয়া যে আল্লাহ্ই একমাত্র মা’বূদ ও বিধানদাতা। যে- ব্যক্তি আল্লাহ্কে একমাত্র স্রষ্টা ও উপাস্য বলে স্বীকার করলো, কিন্তু তাঁকে সর্বোচ্চ হুকুমকর্তা বলে মেনে নিতে রাজি হলো না– সে মুয়াহহিদ (একেশ্বরবাদী) হতে পারে, কিন্তু মুসলিম নয়। প্রকৃত মুসলিম তার জীবন-মরণের সকল বিষয়ে একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যে অবিচল। এই অবিচল বিশ্বাসী ও একনিষ্ঠ আদর্শবান মানুষদেরই সম্মিলিত নাম ‘মুসলিম উম্মাহ্’ বা মুসলমান জাতি। এরা পরস্পর ভাই ভাই। এদের ভ্রাতৃত্ব রক্তসম্পর্কের চে’ মযবুত, আত্মীয়তা-সম্পর্কের চে’ ঘনিষ্ঠ। এদের বিশ্বাস, আদর্শ, ভালোবাসা ও কল্যাণকামিতায় তৈরি জাতিসত্তাগত বাঁধন চির-অটুট, অবিচ্ছেদ্য। রাসূল সা. বলেছেন: সমস্ত মুসলিম একটি দেহের মতো, এর যে- কোনো অঙ্গে আঘাত লাগলে সারা দেহই ব্যথিত হয়। বিভিন্ন দেশ-ভাষা-বর্ণ-গোত্র-সংস্কৃতির অসংখ্য মানুষ ইসলামের ছায়াতলে এসে এই জাতিসত্তায় মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলো। প্রাণখোলা আল্লাহ্ভক্তি ও উদার মানবপ্রেমের বন্যায় খড়কুটোর মতো ভেসে গিয়েছিলো জাহিলী বংশগরিমা ও আঞ্চলিক বিভক্তি। আল-উখুয়্যাহ ফিল্লাহ-এর মহা আহবানে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আল্লাহর সৈনিক হিসেবে এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছিলেন কুরাইশ বংশের হামযা, গিফারী গোত্রের আবূ যার, পারস্যদেশের সালমান, হাবশার বিলাল ও রোমের সুহাইব প্রমুখ দূরত্বজয়ী মানুষেরা। বস্তুত মানুষের জন্যে বিশ্বাস ও আদর্শের চে’ শক্ত আর কোনো ঐক্যসূত্র যে নেই, ইসলাম এর বাস্তব প্রমাণ ও বেনজির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। মদীনার মুসলিমগণ তাঁদের দূরাগত বিদেশি ভাইদেরকে নিজেদের সবকিছুতে সমান মালিকানা উপহার দিয়ে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। মহানবী সা. ও তাঁর সাহাবা কিরাম কুরআনের বৈশ্বিক চেতনা অনুযায়ী মুসলিম জাতির অধিবাসকে কোনো স্থির-নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে সীমিত করেন নি, কখনো আঞ্চলিক বিভক্তি স্বীকার করেন নি। এক দেহের মতো এ জাতিকে তাঁরা এক দেহের মতোই অবিভাজ্য রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। দিন দিন নতুন অঞ্চল বিজিত হচ্ছিলো এবং ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছিলো নববী রাষ্ট্র, একসময় জাযিরাতুল আরব ছাড়িয়ে পারস্য, আফ্রিকা, রোমসহ আধা দুনিয়া মুসলিমদের পদানত হয়। তখনও রাষ্ট্র একটাই ছিলো– অর্ধ জাহান নিয়ে এক ইসলামী রাষ্ট্র। ইসলামের আদর্শিক দার্শনিক তাৎপর্য সম্পর্কে যাঁদের ধারণা আছে, তাঁরা বুঝতে পারেন যে পুরো দুনিয়া মুসলিম করায়ত্ত হলেও রাষ্ট্র একটাই থাকতো– এক দুনিয়া, এক জাতি, এক দেশ। আজকের পৃথিবীতে এতো মুসলিম, কিন্তু তাঁদের অধিকাংশ নববী আদর্শ থেকে বিচ্যূত, ফলে শতধাবিভক্ত। কুরআনের পরিবর্তে আজ আমাদের মাথার ভেতরে ভূগোল ঢুকে পড়েছে, সেই ভূগোল দিয়ে আমরা কেবলই পরস্পরের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর নির্মাণ করছি।

Processing your request, Please wait....
  • Print this article!
  • Digg
  • Sphinn
  • del.icio.us
  • Facebook
  • Mixx
  • Google Bookmarks
  • LinkaGoGo
  • MSN Reporter
  • Twitter
১০১ বার পঠিত
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars ( ভোট, গড়:০.০০)