ইসলামী শিক্ষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য
লিখেছেন: ' kawsartex' @ মঙ্গলবার, জানুয়ারি ১, ২০১৩ (১২:৩৯ পূর্বাহ্ণ)
ইলম আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো জ্ঞান বা শিক্ষা (Knowledge বা Education)। ইসলামী শিক্ষা তথা কুরআনী শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করে আল্লাহ তা‘আলা একদল লোককে এর জন্য নিয়োজিত হবার নির্দেশ দেন। ইরশাদ করেন,
”
[ فَلَوۡلَا نَفَرَ مِن كُلِّ فِرۡقَةٖ مِّنۡهُمۡ طَآئِفَةٞ لِّيَتَفَقَّهُواْ فِي ٱلدِّينِ وَلِيُنذِرُواْ قَوۡمَهُمۡ إِذَا رَجَعُوٓاْ إِلَيۡهِمۡ لَعَلَّهُمۡ يَحۡذَرُونَ ١٢٢﴾ [التوبة : ٢٢١]
‘অতঃপর তাদের প্রতিটি দল থেকে কিছু লোক কেন বের হয় না, যাতে তারা দীনের গভীর জ্ঞান আহরণ করতে পারে এবং আপন সম্প্রদায় যখন তাদের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে, তখন তাদেরকে সতর্ক করতে পারে, যাতে তারা (গুনাহ থেকে) বেঁচে থাকে।’ {সূরা আত-তাওবা, আয়াত : ১২২}”
পবিত্র কুরআনের বর্ণনাভঙ্গিতেও শিক্ষার অপরিসীম গুরুত্বের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যেমন নিচের আয়াতে আল্লাহ বলেন,
”
[ ٱلرَّحۡمَٰنُ ١ عَلَّمَ ٱلۡقُرۡءَانَ ٢ خَلَقَ ٱلۡإِنسَٰنَ ٣ عَلَّمَهُ ٱلۡبَيَانَ ٤ ﴾ [الرحمن: ١، ٤]
‘পরম করুণাময়। তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন। তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষ। তিনি তাকে শিখিয়েছেন ভাষা।’ {সূরা আর-রহমান, আয়াত : ১-৪}
”
আয়াতে করুণাময় মানুষকে দেয়া তাঁর তিনটি নেয়ামতের কথা বলেছেন। কুরআন শেখানো, মানুষকে সৃষ্টি করা এবং তাকে ভাষা শিক্ষা দেওয়া। সাধারণভাবে বললে বলা হত মানুষ সৃষ্টি করেছেন তারপর তাকে কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু মানুষ সৃষ্টি করার আগে কুরআন শিক্ষা দেয়ার কথা বলা থেকে এ ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, দয়াময় আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন তবে যারা কুরআন তথা কুরআনী শিক্ষা পায় নি তাদের যেন মানুষই গণ্য করেন নি তিনি।
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলছেন যে তিনি তাঁর রাসূলকে যে দায়িত্বগুলো দিয়ে প্রেরণ করেছেন তাঁর একটি হলো শিক্ষা বিতরণ করা এবং কুরআন শিক্ষা দেওয়া। ইরশাদ হয়েছে,
”
[ كَمَآ أَرۡسَلۡنَا فِيكُمۡ رَسُولٗا مِّنكُمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡكُمۡ ءَايَٰتِنَا وَيُزَكِّيكُمۡ وَيُعَلِّمُكُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَيُعَلِّمُكُم مَّا لَمۡ تَكُونُواْ تَعۡلَمُونَ ١٥١ ﴾ [البقرة: ١٥١]
‘যেভাবে আমি তোমাদের মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি তোমাদের মধ্য থেকে, যে তোমাদের কাছে আমার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে, তোমাদেরকে পবিত্র করে এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়। আর তোমাদেরকে শিক্ষা দেয় এমন কিছু যা তোমরা জানতে না।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৫১}
”
একই বিষয়ে অপর সূরায় বলা হয়েছে,
”
[هُوَ ٱلَّذِي بَعَثَ فِي ٱلۡأُمِّيِّۧنَ رَسُولٗا مِّنۡهُمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتِهِۦ وَيُزَكِّيهِمۡ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَإِن كَانُواْ مِن قَبۡلُ لَفِي ضَلَٰلٖ مُّبِينٖ ٢ ﴾ [الجمعة: ٢]
‘তিনিই উম্মীদের মাঝে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন তাদের মধ্য থেকে, যে তাদের কাছে তেলাওয়াত করে তাঁর আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করে এবং তাদেরকে শিক্ষা দেয় কিতাব ও হিকমাত। যদিও ইতঃপূর্বে তারা স্পষ্ট গোমরাহীতে ছিল।’ {সূরা আল-জুমুআ‘, আয়াত : ০২}
”
সুফয়ান ইবন উয়াইনা রহ. কে ইলমের মর্যাদা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, তোমরা কি আল্লাহর বাণীর প্রতি লক্ষ্য করো না তিনি তো কী দিয়ে শুরু করেছেন?
”
[ فَٱعۡلَمۡ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا ٱللَّهُ وَٱسۡتَغۡفِرۡ لِذَنۢبِكَ وَلِلۡمُؤۡمِنِينَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتِۗ وَٱللَّهُ يَعۡلَمُ مُتَقَلَّبَكُمۡ وَمَثۡوَىٰكُمۡ ١٩ ﴾ [محمد : ١٩]
‘অতএব জেনে রাখ, নিঃসন্দেহে আল্লাহ ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই। তুমি ক্ষমা চাও তোমার ও মুমিন নারী-পুরুষদের ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য। আল্লাহ তোমাদের গতিবিধি এবং নিবাস সম্পর্কে অবগত রয়েছেন।’ {সূরা মুহাম্মদ, আয়াত : ১৯}
”
এ আয়াতে আল্লাহ আমলের কথা বলেছেন ইলমের পরে।
ইলম হলো নূর, যা দিয়ে মানুষ নানা বিষয়ের হাকীকত ও তাৎপর্য দেখতে পায়। এ দৃষ্টি ঠিক চোখের দৃষ্টি নয়। বরং অন্তরচক্ষু। আল্লাহ বলেন,
”
[ أَفَلَمۡ يَسِيرُواْ فِي ٱلۡأَرۡضِ فَتَكُونَ لَهُمۡ قُلُوبٞ يَعۡقِلُونَ بِهَآ أَوۡ ءَاذَانٞ يَسۡمَعُونَ بِهَاۖ فَإِنَّهَا لَا تَعۡمَى ٱلۡأَبۡصَٰرُ وَلَٰكِن تَعۡمَى ٱلۡقُلُوبُ ٱلَّتِي فِي ٱلصُّدُورِ ٤٦ ﴾ [الحج : ٤٦]
‘তারা কি যমীনে ভ্রমণ করেনি? তাহলে তাদের হত এমন হৃদয় যা দ্বারা তারা উপলব্ধি করতে পারত এবং এমন কান যা দ্বারা তারা শুনতে পারত। বস্তুত চোখ তো অন্ধ হয় না, বরং অন্ধ হয় বক্ষস্থিত হৃদয়।’ {সূরা আল-হজ্জ, আয়াত : ৪৬}
”
এ জন্য আল্লাহ মানুষকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। একদল আলিম (জ্ঞানবান) অন্যদল অন্ধ (জ্ঞানহীন)। ইরশাদ হ,
”
[ ۞أَفَمَن يَعۡلَمُ أَنَّمَآ أُنزِلَ إِلَيۡكَ مِن رَّبِّكَ ٱلۡحَقُّ كَمَنۡ هُوَ أَعۡمَىٰٓۚ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَٰبِ ١٩ ﴾ [الرعد: ١٩]
‘যে ব্যক্তি জানে তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার প্রতি যা নাযিল হয়েছে, তা সত্য, সে কি তার মত, যে অন্ধ? বুদ্ধিমানরাই শুধু উপদেশ গ্রহণ করে।’ {সূরা আর-রা‘দ, আয়াত : ১৯}
”
ইলম মানুষের মধ্যে আল্লাহভীতি সৃষ্টি করে। আর আল্লাহভীতিই পারে মানুষকে যাবতীয় অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখতে। আল্লাহ বলেন,
”
[ وَمِنَ ٱلنَّاسِ وَٱلدَّوَآبِّ وَٱلۡأَنۡعَٰمِ مُخۡتَلِفٌ أَلۡوَٰنُهُۥ كَذَٰلِكَۗ إِنَّمَا يَخۡشَى ٱللَّهَ مِنۡ عِبَادِهِ ٱلۡعُلَمَٰٓؤُاْۗ إِنَّ ٱللَّهَ عَزِيزٌ غَفُورٌ ٢٨ ﴾ [فاطر: ٢٨]
‘আর এমনিভাবে মানুষ, বিচরণশীল প্রাণী ও চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যেও রয়েছে নানা বর্ণ। বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই আল্লাহকে ভয় করে। নিশ্চয় আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, পরম ক্ষমাশীল।’ {সূরা আল-ফাতির, আয়াত : ২৮}
”
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন,
”
[ قُلۡ ءَامِنُواْ بِهِۦٓ أَوۡ لَا تُؤۡمِنُوٓاْۚ إِنَّ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡعِلۡمَ مِن قَبۡلِهِۦٓ إِذَا يُتۡلَىٰ عَلَيۡهِمۡ يَخِرُّونَۤ لِلۡأَذۡقَانِۤ سُجَّدٗاۤ ١٠٧ ﴾ [الاسراء: ١٠٧]
‘বল, ‘তোমরা এতে ঈমান আন বা ঈমান না আন, নিশ্চয় এর পূর্বে যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে, তাদের কাছে যখন এটা পাঠ করা হয় তখন তারা সিজদাবনত হয়ে লুটিয়ে পড়ে।’ {সূরা বানী ইসরাঈল, আয়াত : ১০৭}
”
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
”
« مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِى الدِّينِ »
‘আল্লাহ যার মঙ্গল চান তাকে তিনি দীন সম্পর্কে প্রাজ্ঞতা দান করেন।’ [বুখারী : ৫৬৪৫; মুসলিম : ২৪৩৬]
”
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
”
«مَنْ جَاءَ مَسْجِدِي هَذَا ، لَمْ يَأْتِهِ إِلاَّ لِخَيْرٍ يَتَعَلَّمُهُ أَوْ يُعَلِّمُهُ ، فَهُوَ بِمَنْزِلَةِ الْمُجَاهِدِ فِي سَبِيلِ اللهِ ، وَمَنْ جَاءَ لِغَيْرِ ذَلِكَ ، فَهُوَ بِمَنْزِلَةِ الرَّجُلِ يَنْظُرُ إِلَى مَتَاعِ غَيْرِهِ »
‘যে ব্যক্তি আমার এ মসজিদে আসবে একমাত্র কল্যাণ অর্জনের জন্য যা সে শিখবে বা শেখাবে, সে আল্লাহর পথে মুজাহিদের স্তরে। আর যে এ ছাড়া অন্য উদ্দেশে আসবে, সে ওই ব্যক্তির স্তরে যে অন্যের বস্তুর প্রতি তাকায়।’ [ইবন মাজা : ৬৪৭২, হাদীসটি সহীহ সনদ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।]
”
প্রয়োজনীয় ইলম সবার জন্যই ফরয। আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
”
«طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ »
‘ইলম শিক্ষা করা প্রতিটি মানুষের ওপর ফরয।’ [ইবন মাজাহ্ : ২২৪]
”
শুধু তাই নয় আমরা দেখতে পাই, শেষ নবীর ওপর অবতীর্ণ প্রথম ওহীতেই বলা হয় ‘পড়’।
শেষ কথা:
শুধু শিক্ষা অর্জন বা জ্ঞানার্জন করলেই হবে না তা হতে হবে রব বা প্রতিপালক তথা আল্লাহকে সন্তুষ্টির নিমিত্তে। আমাদের গলদ আজ এখানেই। সবাই উপলব্ধি করছি পড়ার গুরুত্ব। সবাই গাইছি শিক্ষা ও বিদ্যার মাহাত্ম্য। অথচ এর সঠিক লক্ষ্যের কথা বেমালুম ভুলে যাচ্ছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীগুলোর দিকে তাকালেও আমরা এমন ধারণা পাই। আলহামদুলিল্লাহ, মুসলিম ভাই-বোনেরা এখনো একথা স্বীকার করেন যে, ইসলামেই শিক্ষার প্রতি সবচে বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আলবৎ ঠিক। একেবারে হক কথা। কিন্তু শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে আমরা যত বলছি, এর উদ্দেশ্য ও অর্জন নিয়ে ততটা বলছি না। এর ফলাফল নিয়ে ভাবছি না।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে উপকারী জ্ঞান শেখার এবং সে অনুযায়ী আমলের তাওফীক দিন। আমাদের সকলকে তাঁর দীনের ইলম প্রচারে খাদেম হিসেবে কবুল করুন। আমীন।
লেখকঃ আলী হাসান তৈয়ব, সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
alokitojibon.com