ফিরোজ দাইলামী রাযি. ও ভণ্ডনবীর ছিন্ন মস্তক!
লিখেছেন: ' এম এম নুর হোসেন' @ সোমবার, সেপ্টেম্বর ৫, ২০১১ (১২:৫৩ অপরাহ্ণ)
বিচিত্র এই পৃথিবী! বিচিত্র এই পৃথিবীর মানুষ!! সর্বযুগে, সর্বকালেই পৃথিবীতে ছিল দু’ধরনের মানুষ, এখনো আছে। থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত। একদল মানুষ যা পায় তা নিয়েই খুশি। খোদায়ী ফয়সালায় তারা সন্তুষ্ট। তাদের অন্তরে বেশি পাওয়ার লোভ নেই। নেই পদ কিংবা পদবীর কোনো লালসাও।
আরেক দল মানুষ আছে যাদের চাহিদার কোনো শেষ নেই। চাওয়ার কোনো সমাপ্তি নেই। আশারও কোনো অন্ত নেই। তারা যত পায় তত চায়! একটু পেলে আরেকটু পেতে চায়। একটু দিলে আরেকটু নিতে চায়। ক্বানাআত বা অল্পেতুষ্টির গুণ অর্জন করেনি তারা। খোদায়ী ফয়সালায়ও তারা সন্তুষ্ট নয়। এসব মানুষের অন্তরে কখনোই শান্তি আসে না। আর সফলতা খুব কমই তাদের পদচুম্বন করে!
বনু মাদলাজ গোত্রের সর্দার আসওয়াদ আনাসী। সে ছিল উপরিউক্ত দু’শ্রেণী মানুষের দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। কারণ তার চাওয়ার কোনো শেষ ছিল না। চাহিদার কোনো অন্ত ছিল না।
কোনো গোত্রের সর্দার হওয়া তো চাট্টিখানি কথা নয়! সাধারণ কোনো ব্যাপার নয়!! গোত্রের লোকেরা গোত্র-প্রধানের কথায় উঠাবসা করে। তার নির্দেশকে অম্লান বদনে মেনে নেয়। যে কোনো ব্যাপারে গোত্র-প্রধানের ফয়সালাই হয় চূড়ান্ত। একজন মানুষের জন্য এ এক বিরাট পাওয়া, বিরাট সম্মান!
কিন্তু আসওয়াদ আনাসী শুধু গোত্রপতি হয়েই সন্তুষ্ট নয়। সে আরো কিছু হতে চায়। আরো সম্মান পেতে চায়। আরো অধিক মানুষের প্রভুত্ব লাভ করতে চায়! চায় অসংখ্য-অগনিত মানুষ তার কথায় উঠাবসা করুক। তার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকুক।
আসওয়াদ আনাসী ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছিল বটে। কিন্তু ঈমানের আলোকরশ্মিতে আলোকিত হয়নি তার পাপিষ্ট হৃদয়। তাই এক সময় সে ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে যায়। নাউযুবিল্লাহ!
আসওয়াদ চিন্তা করল, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবী হওয়ার কারণে তাঁর কত সম্মান, কত ইজ্জত! লক্ষাধিক সাহাবী তার কথায় হাসিমুখে প্রাণ বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত! সবাই তাকে ভক্তি করে। পরম বিনয়ী ভাব নিয়ে তার সামনে উপবিষ্ট হয়!
সম্মানলোভী ও পদলিপ্সু এ লোকটি প্রতিদিন এসব কথা চিন্তা করে। ভাবে, আমি যদি নবী হতে পারি, তবে তো আমার অবস্থাও এমন হবে! আমিও তো এতো ইজ্জত-সম্মানের অধিকারী হতে পারব। তাই একদিন তার মাথায় সত্যি সত্যি নবী হওয়ার খাহেশ চেপে বসে। বলে, হ্যাঁ, আমিও নবী হবো! আমারও উম্মত থাকবে!! মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হবেন মক্কা-মদীনার নবী। আর আমি হবো ইয়ামেনের নবী! আমারও হাজার হাজার অনুসারী হবে, ভক্ত-অনুরক্ত হবে। হাতের ইশারায় আমার নির্দেশ নির্দ্বিধায় পালন করবে।
তখন ছিল দশম হিজরী। নবী হওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় আসওয়াদ আনাসী। নবুওয়তের সিঁড়ি বেয়ে নেতৃত্বের শীর্ষে পৌঁছার একটি অদম্য ইচ্ছা তার মাথায় ভন ভন করছিল সারাণ। কিন্তু সে সাহস পাচ্ছিল না। মাঝে মধ্যে সংকল্পের তীব্রতায় তার চেহারা কঠিন হয়ে ওঠত। কিন্তু পরিবেশ-পরিস্থিতি তখন পক্ষে না থাকায় সে দমে যেত এবং সুযোগের অপোয় থাকত।
আসওয়াদ আনাসীকে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হলো না। নবুওয়াত দাবীর মোক্ষম সুযোগ সে পেয়ে গেল। একদিন সংবাদ পেল, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যু শয্যায় শায়িত। এই সংবাদে সে দারুণ খুশি হলো। তদুপরি সে একথাও জানতে পারল যে, ইয়ামেনের প্রবল প্রতাপশালী মুসলিম শাসক বাযান কিছুদিন পূর্বে ইন্তেকাল করেছে। তার পুত্র শাহর এখন ইয়ামেনের শাসনকর্তা। কিন্তু পিতার স্থানটি ওর দ্বারা যথাযথ পূরণ হয়নি। কারণ পিতার সেই যোগ্যতা ওর মধ্যে ছিল না। তাই আসওয়াদ ভাবল, এই সুযোগে যদি ইয়ামেনে আক্রমণ করা যায় তাহলে শাহর তা কোনো অবস্থাতেই প্রতিরোধ করতে পারবে না। বাহ! পরিবেশ-পরিস্থিতি সবই অনুকূলে। নবুওয়াত দাবীর এই তো সূবর্ণ সুযোগ! সুতরাং আর দেরী করা যায় না!!
সত্যি সত্যি আসওয়াদ নবুওয়াতের দাবী করে বসে! নিজেকে নবী বলে ঘোষণা দেয়। বলে, আমি আল্লাহর প্রেরিত নবী। তোমরা আমার কথা শোনো ও মানো।
গোত্রীয় ভালোবাসায় গোত্রের প্রায় সমস্ত লোক তার অনুগত হয়ে যায়। তাছাড়া আশে পাশের আরো কিছু লোক তাকে নবী বলে মেনে নেয়। তাতে তার দল দেখতে না দেখতেই বেশ ভারী হয়ে ওঠে!
কিছুদিন পর আসওয়াদ আনাসী সবার অলক্ষে তার ভক্ত-বাহিনী নিয়ে ইয়ামেনের রাজধানী সানআ আক্রমণ করে। শাহরকে হত্যা করে। রাজপ্রাসাদ দখল করে নেয়। শাহরের স্ত্রী ছিল অপরূপ সুন্দরী। নাম– আযাদ। ওর নযরকাড়া রূপে বিমুগ্ধ হয়ে আসওয়াদ তাকে হত্যা করল না। বরং নিজের শয্যাশায়ীনী রূপে গ্রহণ করল।
আসওয়াদের ক্ষমতা এখন মজবুত। ইতোমধ্যে সে সম্ভাব্য সকল বিদ্রোহীকে নির্মূল করেছে। বারবার অভিযান চালিয়ে পার্শ্ববর্তী অনেক এলাকায় বিজয়ের নিশান উড়িয়েছে। ফলে অল্পদিনের মধ্যে তার ক্ষমতার পরিধি বিস্তৃর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। সেই সাথে কয়েকগুণ বেড়ে গেছে তার ভক্ত-অনুরক্তের সংখ্যা।
এদিকে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনের বেলাভূমিতে পৌঁছে গেছেন। এমতাবস্থায় আসওয়াদের এই অপকীর্তির কথা শুনে দারুণ মর্মাহত হলেন তিনি। তাঁর চিরসুন্দর উজ্জ্বল মুখখানি ছেয়ে গেল চিন্তার একখণ্ড মেঘে। ভাবলেন ইয়ামেনে আক্রমণের কথা। ভাবলেন আসওয়াদ আনাসীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার কথা।
হ্যাঁ, ইয়ামেনে তিনি আক্রমণ করবেন। আসওয়াদ আনাসীকে উপযুক্ত শাস্তি দিবেন। বুঝিয়ে দিবেন, নবুওয়াত দাবীর নির্মম পরিণতি।
মৃত্যুশয্যায় শায়িত থেকেই নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আক্রমণের পরিকল্পনা ঠিক করতে লাগলেন। চিন্তা করতে লাগলেন কীভাবে কি করা যায়? কাকে এই অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া যায়?
ফিরোজ দাইলামী রাযি. ইয়ামেনের এক জানবাজ সাহাবী। রাজ-পরিবারের যোগ্য সন্তান। দূরদর্শী ও সাহসী। কুসুমের কোমলতা আর বজ্রের কাঠিন্য মিশে আছে তাঁর চরিত্রে। তিনি সত্যের ব্যাপারে যেমন আপোষহীন-অবিচল, তেমনি মিথ্যার বিরুদ্ধে বজ্রকঠিন!
হঠাৎ নবীজির মানসপটে ভেসে ওঠল ফিরোজ দাইলামী রাযি. এর কথা। তিনি দেরী না করে তাঁর কাছে চিঠি পাঠালেন। একই রকম চিঠি পাঠালেন আরো দশজনের কাছে। চিঠিতে লেখা ছিল, যে কোনো কৌশলে হোক, আসওয়াদ আনাসীর এই ফিতনাকে অঙ্কুরেই দাফন করে দিতে হবে। আল্লাহর উপর ভরসা করে তোমরা এগিয়ে যাও। ইনশাআল্লাহ বিজয় তোমাদের পদচুম্বন করবে।
চিঠি পাঠ করা মাত্র ফিরোজ দাইলামী রাযি.-এর রক্ত গরম হয়ে ওঠল। তিনি কঠিন প্রতিজ্ঞা করলেন। বললেন, মানুষের ঈমান নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে ওকে আর সুযোগ দেওয়া হবে না! যে কোনো মূল্যে শয়তানের এই চেলাকে হত্যা করতে হবে। বুঝিয়ে দিতে হবে নবী দাবীর মজা!
রাজধানী সানআয় আসওয়াদ আনাসীর আক্রমণ ছিল অতর্কিত। তাই সানআর সৈন্যরা ওদেরকে প্রতিহত করতে পারেনি। সানআর অনেক লোক বাধ্য হয়ে আসওয়াদকে বাহ্যিকভাবে নবী বলে স্বীকার করেছিল সত্য, কিন্তু তাদের অন্তরে ছিল ঈমান। তারা বিশ্বাস করত, আসওয়াদ নবী নয়। সে একজন ভণ্ড ও প্রতারক। তাই তারা আসওয়াদের কবল থেকে মুক্তির পথ খুঁজছিল।
ফিরোজ দাইলামী রাযি. ছিলেন ঐসব লোকদেরই একজন যারা বাহ্যিকভাবে আসওয়াদ আনাসীকে মেনে নেওয়ার ভাব দেখালেও অন্তর দিয়ে মোটেও মেনে নেয়নি। তাই শুরু থেকেই তিনি এই ভণ্ড নবীকে উপযুক্ত শায়েস্তা করতে সুযোগ খুঁজছিলেন। এবার যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চিঠি তাঁর হাতে পৌঁছল তখন তাঁর সেই ইচ্ছা আরো তীব্র আকার ধারণ করল।
ভণ্ডনবী আসওয়াদের প্রধান সেনাপতি ছিল কায়েস ইবনে আবদে গাউস। কায়েস ছিল যুদ্ধ-বিদ্যায় দারুণ পারদর্শী। তার সফল নেতৃত্বের কারণেই প্রতিটি যুদ্ধে আসওয়াদের বাহিনী বিজয় লাভ করেছে এবং তার ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছার পর আসওয়াদ তার প্রধান সেনাপতি কায়েসের সাথে দুর্ব্যবহার করতে শুরু করে। শুধু তাই নয়, ধীরে ধীরে অবস্থাটা এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায় যে, যেকোনো সময় আসওয়াদের পক্ষ থেকে কায়েসের মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ আসতে পারে। কায়েস অস্থির হয়ে পড়ে। দুশ্চিন্তা তাকে ঘিরে ধরে চারিদিক থেকে।
কায়েসের এ অস্থিরতার খবর হযরত ফিরোজ দাইলামী রাযি. আঁচ করতে পারলেন। মনে মনে ভাবলেন, যদি এই সুযোগে কায়েসকে হাত করা যায়, তাহলে আসওয়াদকে দুনিয়া থেকে বিদায় করা যথেষ্ট সহজ হবে। তাই তিনি চাচাত ভাইকে নিয়ে কায়েসের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং মনের গতি প্রকৃতি বুঝে এক পর্যায়ে তার হাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চিঠি তুলে দেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চিঠি পেয়ে কায়েসের চোখ-মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এই সুযোগে হযরত ফিরোজ দাইলামী রাযি. তার কাছে সাহায্য কামনা করেন। কায়েস রাজি হয়। সবশেষে সিদ্ধান্ত হয়, রাজপ্রাসাদেই আসওয়াদকে হত্যার পথ খুঁজে বের করতে হবে। এ ব্যাপারে আযাদের সাহায্য নেওয়া হবে। পাঠককে আগেই বলা হয়েছে যে, আযাদ হলো ঐ নারী যার স্বামী– শাহরকে হত্যা করে আসওয়াদ তাকে জোরপূর্বক বিয়ে করেছে।
হযরত ফিরোজ দাইলামী রাযি. বলেন, এরপর আমি রাজপ্রাসাদের দিকে ছুটলাম। একটা আবেগ, একটা তাড়না আমাকে ঝড়ের বেগে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমি যেহেতু রাজপরিবারের লোক সে কারণে রাজপ্রাসাদের যে কোনো জায়গায় আমার অবাধ বিচরণ ছিল। আমি যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারতাম। যাহোক যেতে যেতে আমি বোন আযাদের একান্ত কামরায় গিয়ে তার সাথে সাক্ষাৎ করলাম। কুশলাদি বিনিময়ের পর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হলো। এর মাঝে আমি আসওয়াদ আনাসী সম্পর্কে তার মনোভাব বুঝে ফেললাম। দেখলাম, আসওয়াদ সম্পর্কে তার মনোভাব মোটেই ইতিবাচক নয়।
আমি এই সুযোগকে হাতছাড়া করলাম না। বলেই ফেললাম, বোন! তুমি জানো এই লোকটি আমাদের কী সর্বনাশ করে চলেছে। সে তোমার স্বামী ও নেতৃস্থানীয় লোকদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। নারীদেরকে অপমানিত করেছে। এই দেখো আল্লাহর রাসূলের চিঠি আমার কাছে এসে পৌঁছেছে। তাঁর নির্দেশ হলো, আমরা যেনো এই ফেতনাকে সমূলে উৎখাত করি। বোন, এবার তুমিই বলো, এ ব্যাপারে তুমি আমাদের কী সাহায্য করতে পারো?
আমার কথা শুনে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠল আযাদ। হৃদয়কোণে জেগে ওঠল মুক্তির আশা। উচ্ছ্বাসভরা কণ্ঠে বলল, আমি তোমাদের সব রকম সাহায্য করতে প্রস্তুত। বলো, তোমরা আমার কাছে কী ধরনের সাহায্য চাও?
আমি কম্পিত কণ্ঠে বললাম, তাকে ইয়ামেন থেকে তাড়িয়ে দিতে চাই।
আযাদ বলল, না, আমি এতটুকু সাহায্যে সন্তুষ্ট নই! আমি তোমাদেরকে আরো বেশী সাহায্য করতে চাই। আমি চাই, এই পাষণ্ডকে তোমরা হত্যা করো। এর জন্য যে ধরনের সাহায্য তোমরা চাও, আমি দিতে প্রস্তুত।
তার কথা শুনে আমার হৃদয়ে আনন্দের জোয়ার বইতে থাকে। তাই আনন্দভরা কণ্ঠে বললাম, আমি তো তা-ই চাচ্ছিলাম, কিন্তু তুমি আবার কী মনে করো, সে ভয়ে বলিনি।
আমার কথার মাঝেই তার ঠোঁটের কোণে হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে পড়ল। বলল, আল্লাহর কসম, যিনি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন। আমি ইসলাম ধর্মে কখনো বিন্দুমাত্র সন্দেহ করিনি। আর আসওয়াদের মতো অধম ও নিকৃষ্ট লোক দুনিয়াতে আর কেউ নেই। প্রথম যেদিন তাকে দেখেছি, সেদিনই আমি বুঝতে পেরেছি যে, সে পাপিষ্ঠ, নরাধম, প্রতারক, মিথ্যাবাদী ও ভণ্ড!
আমি বললাম, তুমি তো তার স্ত্রী! তুমিই বলো কীভাবে তাকে হত্যা করা সম্ভব।
সে বলল, আসওয়াদ খুব হুঁশিয়ার লোক। মানুষের চেহারা দেখেই সে মনের কথা বুঝতে পারে। তাই তাকে হত্যা করা কঠিন।
এতটুকু বলে সে চিন্তার জগতে হারিয়ে গেল। অল্পক্ষণ পরে বলল, ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে হত্যা করা সহজ হবে। কিন্তু পাহারাদারদের নিচ্ছিদ্র বেষ্টনী ভেদ করে তার কাছে পৌঁছাও অসম্ভব। তবে একটি কাজ করা যায়। তোমরা তোমাদের কোনো বিশ্বস্ত লোককে শ্রমিকের বেশে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। আমি তাকে দিয়ে সুযোগ মতো সুড়ঙ্গ তৈরীর জন্য বাউণ্ডারী দেয়ালের কিছু অংশ অবশিষ্ট রেখে বাকিটুকু কাটিয়ে রাখব। যাতে রাতের বেলা তোমরা এসে সামান্য আঘাত করতেই তা সুড়ঙ্গ পথে পরিণত হয়ে যায়।
আমি এ সুড়ঙ্গ পথের ব্যবস্থা এমন এক জায়গায় করব, যেখানে প্রহরীরা ভুলেও যায় না। তাছাড়া এটি হবে আমাদের শয়ন কক্ষে একেবারে কাছে। তোমরা ঐ করে পেছন দিক দিয়ে প্রবেশ করবে। সাথে অস্ত্র আনার প্রয়োজন নেই। আমিই তোমাদের জন্য অস্ত্রের ব্যবস্থা করে রাখব।
এই নিখুঁত পরিকল্পনা শুনে আমি বেশ খুশি হলাম। বললাম, বাহ! দারুণ চমৎকার তোমার বুদ্ধি। খুব সুন্দর তোমার পরিকল্পনা!! আল্লাহ পাক আমাদের অভিযানকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কামিয়াব করুন।
আমি আযাদের কাছে আরো কিছুণ থাকলাম। এবং ছোটখাটো আরো কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করে রাজপ্রাসাদ থেকে ফিরে এলাম।
খানিক বাদে একটি নির্জন কে অন্যান্য মুসলমান ভাইদের সাথে মিলিত হলাম। বললাম, হে মুসলিম ভাইগণ! আসওয়াদ আনাসী শয়তানের দোসর তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সে আমাদের ঈমান নিয়ে খেলা করছে। তার খপ্পরে পড়ে অসংখ্য মানুষ জাহান্নামী হচ্ছে। আমাদের আর বসে থাকলে চলবে না। এই দেখো, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চিঠি। তাঁর কড়া নির্দেশ হলো, যে করেই হোক এই শয়তানকে হত্যা করে ইয়ামেনের মাটিকে পবিত্র করতে হবে।
আমার কথায় উপস্থিত সকলের ধমনীতে উষ্ণ রক্তের স্রোত বইতে লাগল। সবাই প্রতিজ্ঞা করল, যেভাবেই হোক আমরা এই শয়তানকে দুনিয়া থেকে বিদায় করবই। আমি তাদেরকে পরিকল্পনার কথা বিস্তারিত খুলে বললাম। সেই সাথে এও বললাম, তোমরা আগামীকাল অস্ত্রসজ্জিত অবস্থায় প্রাসাদের বাইরে কোনো নিরাপদ স্থানে অবস্থান নেবে। যদি ভোররাতে রাজপ্রাসাদ থেকে আযানের আওয়াজ ভেসে আসে তাহলে মনে করবে, আমরা সফল হয়েছি। তখন তোমরা এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়বে।
রাতের অন্ধকার নেমে এল চারিদিকে। ক্রমেই তা আরো ঘনিভূত হলো। সর্বত্র ঘুটঘুটে অন্ধকারের ছড়াছড়ি। অনন্ত আকাশের কোটি কোটি তারকা যেন বৈচিত্রময় এই পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আছে। যেনো তারা শয়তানের মূর্ত প্রতীক আসওয়াদ আনাসীর পতন উপভোগ করতে উদগ্রীব!
পূর্ব নির্ধারিত সময়ে আমি আমার দুই সাথীকে নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছলাম। পা ফেলছিলাম বড়ো সতর্কতার সাথে। বোন আযাদ পরিকল্পনা অনুযায়ী সুড়ঙ্গ করার কাজটি প্রায় নব্বই ভাগ এগিয়ে রেখেছিল। বাকী দশভাগ আমরা অল্প সময়ের মধ্যে সমাপ্ত করে ভিতরে প্রবেশ করি। দেখি, নির্ধারিত স্থানে অস্ত্রশস্ত্র সবই প্রস্তুত। আমরা মুহূর্তকাল দেরী করলাম না। খাপখোলা শাণিত তরবারী হাতে তুলে নিলাম। তারপর ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গেলাম আরো সামনে।
যেতে যেতে আসওয়াদের কামরার সামনে গিয়ে দেখলাম, বোন আযাদ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমাদের দেখেই তাঁর হৃদয় খুশিতে ভরে ওঠল। তার ইশারায় আমরা কামরায় প্রবেশ করলাম। শয়তানটি তখন নাক ডেকে ঘুমুচ্ছিল।
কামরায় জ্বলছিল হালকা আলোর প্রদীপ। সেই আলোতে আমার তরবারিটি ঝলমল করে ওঠল। সময় নষ্ট করলাম না। শয়তানটির কণ্ঠনালী বরাবর প্রচণ্ড আঘাত হানলাম। এক আঘাতে পাপিষ্ঠের মস্তকটি দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দূরে ছিটকে পড়ল। রক্তে ভেসে গেল গোটা কামরা।
প্রহরীরা আওয়াজ শুনে লণ্ঠন নিয়ে ছুটে এল। হাতে খোলা তরবারী। চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। বোন আযাদ তখন দরজায় দাঁড়িয়ে। চেহারায় মুচকি হাসি!
প্রহরীরা কামরার কাছে এসে ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, কামরায় এ কিসের আওয়াজ?
বোন তখন কঠিন কণ্ঠে জবাব দিল, যা! দূর হ এখান থেকে!! দেখছিস না অহী অবতীর্ণ হচ্ছে!!!
মুহূর্তে চুপসে গেল প্রহরীদের আগ্রহ। দ্বিতীয়বার কোনো প্রশ্ন করার সাহস তারা পেল না। নতশিরে অদৃশ্য হয়ে গেল যার যার পথে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা ভোর পর্যন্ত প্রাসাদের অভ্যন্তরে লুকিয়ে রইলাম।
শেষ রাতে আমি রাজপ্রাসাদের এক উঁচু প্রাচীরে দাঁড়িয়ে সুউচ্চ কণ্ঠে আযান দিলাম। সেই সাথে বললাম, আসওয়াদ আনাসী কাজ্জাবুন— আসওয়াদ আনাসী মিথ্যাবাদী।
আমার আযানের ধ্বনি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তেই বাইরে অবস্থানরত মুসলমানগণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রাজপ্রাসাদের দিকে এগিয়ে এল। ওদেরকে প্রতিহত করার জন্য প্রহরীরাও সশস্ত্রে ছুটে এল। উভয় দল কাছাকাছি চলে এসেছে। এখনই ঝাঁপিয়ে পড়বে একদল আরেক দলের উপর। ঠিক এমন সময় আমি আসওয়াদ আনাসীর ছিন্ন মস্তকটি দুই দলের মধ্যবর্তী স্থানে ছুঁড়ে মারলাম।
ভণ্ড ও প্রতারক নবীর ছিন্ন মস্তক দেখে মুসলমানগণ দারুণ খুশি হলো। আর প্রহরীরা ভূত দেখার মতো চমকে ওঠল। সেই সাথে শেষ হয়ে গেল ওদের মনোবল। এই সুযোগে মুসলমানগণ বীর বিক্রমে ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এবং সূর্যোদয়ের পূর্বেই রাজপ্রাসাদসহ বিশাল এলাকা দখল করে নিল।
আমাদের এই অভাবনীয় বিজয় দেখে চারিদিক থেকে মানুষের ঢল নেমে এল। সকালের মিষ্টি রোদে দাঁড়িয়ে আমাদের বিজয় দারুণভাবে তারা উপভোগ করল।
আল্লাহ ও রাসূলের শত্র“, দীনের দুশমন আসওয়াদ আনাসী মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করেছে, আজ থেকে তার ভণ্ডামী চিরতরে খতম হয়েছে– এ সংবাদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পৌঁছানোর জন্য সঙ্গে সঙ্গে মদীনায় দূত পাঠানো হলো। কিন্তু দূত যেদিন মদীনায় পৌঁছল, তার আগের দিনই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়া থেকে বিদায় নেন। তবে যে রাতে আসওয়াদ আনাসীকে হত্যা করা হয়েছিল, সে রাতে অসুস্থ নবীজির ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ একটি হাসির রেখা ফুটে ওঠেছিল। উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম সেই হাসি দেখে আনন্দিত হয়েছিলেন। সেই সাথে জিজ্ঞেস করেছিলেন হাসির কারণ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত জীবরাঈলের মাধ্যমে এ সংবাদ জানতে পেরে জবাবে বলেছিলেন, আজ রাতে রাজ পরিবারের এক অকুতোভয় সৈনিক ভণ্ডনবী আসওয়াদ আনাসীকে হত্যা করেছে।
সাহাবায়ে কেরাম তখন বিনীত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! সেই ভাগ্যবান লোকটির নাম কি? জবাবে তিনি বলেছিলেন, তাঁর নাম ফিরোজ দাইলামী। সে সফল হয়েছে।
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! বর্তমান পৃথিবীতে এক ভণ্ডনবী– গোলাম আহমদের বেশকিছু অনুসারী রয়েছে। ওদেরকে কাদিয়ানী বলা হয়। ইহুদি-খৃস্টানরা ওদের পৃষ্ঠপোষকতা করে। ওরা নিজেদেরকে মুসলমান বলে দাবী করে। অথচ তারা যে অমুসলিম-কাফের তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তাই আসুন, ওদের থেকে আমরা দূরে থাকি এবং ওদের পাতানো ফাঁদ থেকে সহজ-সরল মুসলমানদেরকে ফিরিয়ে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করি। আল্লাহ পাক আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন।
মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম [লেখক, হৃদয় গলে সিরিজ]
শুকরিয়া, গুরুত্বর্পূণ্য লেখা।
@জাহিদ, শুকরিয়া।
প্রহরীরা আওয়াজ শুনে লণ্ঠন নিয়ে ছুটে এল। হাতে খোলা তরবারী। চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। বোন আযাদ তখন দরজায় দাঁড়িয়ে। চেহারায় মুচকি হাসি!
প্রহরীরা কামরার কাছে এসে ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, কামরায় এ কিসের আওয়াজ?
বোন তখন কঠিন কণ্ঠে জবাব দিল, যা! দূর হ এখান থেকে!! দেখছিস না অহী অবতীর্ণ হচ্ছে!!!
মুহূর্তে চুপসে গেল প্রহরীদের আগ্রহ। দ্বিতীয়বার কোনো প্রশ্ন করার সাহস তারা পেল না। নতশিরে অদৃশ্য হয়ে গেল যার যার পথে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা ভোর পর্যন্ত প্রাসাদের অভ্যন্তরে লুকিয়ে রইলাম।
একজন মহিলার বীরত্ব র্পূণ্য কথা জালিমেরা চুপ হয়ে গেল।আর আজ আমাদের মা-বোনদের ভূমিকা কি?
আল্লাহ পাক আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন।
@sowkat_a007, শুকরিয়া, আমিন।
@জাহিদ,
আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পুরূষ বা নারী কাউকেই মুসলিম উম্মার প্রতি তাদের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেয় না।
লেখাটি শেয়ার করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
@মুসাফির, শকরিয়া,
আবারো ফিরোজ দাইলামী রাযি.- এর উত্তরসূরীরা ঈমানের শক্তি জ্বলে উঠতে হবে।
পোষ্টের জন্য ধন্যবাদ
@আবদুস সবুর, আবারো ফিরোজ দাইলামী রাযি.- এর উত্তরসূরীরা ঈমানের শক্তি জ্বলে উঠতে হবে।
শুকরিয়া।
@বেদুইন,