লগইন রেজিস্ট্রেশন

আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআ : পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য

লিখেছেন: ' এম এম নুর হোসেন' @ সোমবার, মার্চ ১২, ২০১২ (১২:৪৪ অপরাহ্ণ)

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
প্রতি মাসে কোনো না কোনো বিষয়ের উপর মুহাযারার (বিষয়ভিত্তিক আলোচনার) চেষ্টা করা হয়। আজকের মজলিসের আলোচ্য বিষয়, ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য’। আল্লাহ রাববুল আলামীন যদি তাওফীক দেন তাহলে কিছু আলোচনা হবে।
হাদীস শরীফে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাজাতপ্রাপ্ত দলের বৈশিষ্ট্য ও মানদন্ড উল্লেখ করেছেন। সেই মানদন্ড ও তার বাস্তব প্রয়োগ সম্পর্কে আলোচনা করার ইচ্ছা আছে। এতে বোঝা যাবে কারা সেই বৈশিষ্ট্যের ধারক ও সেই মানদন্ডে উত্তীর্ণ। আর কারা তা ধারণে ব্যর্থ এবং কোথায় কোথায় ব্যর্থ।
আলোচনার প্রেক্ষাপট
গত শনিবার দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জে একটি মজলিস হয়েছিল। কথা ছিল, মুনাযারা বা বহছের মজলিস হবে। কিন্তু দুই দলের এক দল উপস্থিত না হওয়ায় বহসের মজলিস হয়নি। তবে একে কেন্দ্র করে বড় সমাবেশ হয়েছিল। অনেক তালিবুল ইলম, বিভিন্ন মাদরাসার মুদাররিস এবং আশপাশ থেকে অনেক সাধারণ মানুষ একত্র হয়েছিলেন। ওখানে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনার সুযোগ হয়। কিন্তু যতটা বিস্তারিতভাবে, আরো দলিল-প্রমাণের উদ্ধৃতি সহকারে আলোচনার প্রয়োজন ছিল তখন সময় ও পরিবেশ না থাকায় তা হয়ে উঠেনি। আমাদের মনে হয়েছে, আমরা ঐ আলোচনা তালিবুল ইলম ভাইদের জন্য আরো বিশদভাবে করি। কারণ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা দলিল-প্রমাণের সাথে ভালোভাবে বুঝে নেওয়া সবার জন্য জরুরি।
কারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআ নামের অধিকারী
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআ অর্থ যারা সুন্নাহ ও জামাআকে ধারণ করে। শুধু দাবি করলেই এ নামের অধিকারী হওয়া যায় না। যারা মৌলিকভাবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আদর্শ অনুসরণ করে, কিন্তু কোথাও কোথাও বিচ্যুত হয়ে যায়, তো যে অংশে বিচ্যুত হল সে অংশে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, ততটুকুর মধ্যে সে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর অন্তর্ভুক্ত নয়।
আরেকজন মৌলিকভাবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আদর্শের উপর নেই, কিন্তু আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর একটি গুণ বা বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে আছে তাহলে ততটুকুর মধ্যে সে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর অনুসারী। তবে এভাবে শুধু একটি বা দুটি বৈশিষ্ট্যের দ্বারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআ উপাধি অর্জন করা যাবে না।
আজকাল এই কথাটা আমাদের চিন্তায় থাকে না। হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.
ما أنا عليه وأصحبابي
হাদীসটির ব্যাখ্যায় এ কথাটা বলেছেন। খুতবাতে হাকীমুল উম্মতে আছে। ইবনে রজব হাম্বলী রাহ.ও ‘জামেউল উলূমি ওয়াল হিকাম’ কিতাবে (পৃষ্ঠা : ৩২০, হাদীস : ২৭)
عليكم بسنتي হাদীসটির ব্যাখ্যায় তা লিখেছেন।
থানভী রাহ. বলেছেন, আকাইদ, মুয়ামালা, মুয়াশারা, এভাবে দ্বীনের সকল ক্ষেত্রে আপনাকে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আদর্শের উপর থাকতে হবে। আপনি যদি শুধু আকীদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আদর্শের উপর থাকেন, অন্যান্য বিষয়ে না থাকেন তাহলে আপনাকে কামিল সুন্নী বলা হবে না। সুতরাং এই চিন্তা ভুল যে, ইনতিসাব ও সম্বন্ধ হলেই সব হয়ে গেল বা উসূল ও আকাইদের ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আদর্শ অনুসরণ করলেই সবকিছুর মধ্যে তাদের অনুসরণ হয়ে গেল কিংবা এক অংশে অনুসরণ হলেই সব অংশে অনুসরণ হয়ে গেল ইত্যাদি। এগুলো ভুল চিন্তা।
তেমনি যে বা যারা উসূল ও আকীদার ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আদর্শের উপর নেই তবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর একটি গুণ তার বা তাদের মধ্যে আছে, এই গুণটিকে অস্বীকার করাও ভুল। তো প্রথমে আমাদেরকে মানদন্ডটি ভালোভাবে বুঝতে হবে এবং বাস্তব জীবনে তা অনুসরণের চেষ্টা করতে হবে।
নামের শেষে নিসবত লাগানো কি জরুরি
আমাদের ইনতিসাব ও সম্বন্ধ দারুল উলূম দেওবন্দের সাথে। কারণ আমাদের সকল উস্তাদ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দারুল উলূম দেওবন্দের ফয়েযপ্রাপ্ত। আমাদের তালীম-তরবিয়ত হয়েছে আকাবিরে দেওবন্দের হাতে। কিন্তু এ কারণে নামের শেষে দেওবন্দী লাগাতে হবে এটা জরুরি নয়। আমাদের আকাবির তা জরুরি মনে করতেন না। হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রাহ.কে ‘থানভী’ বলা হয়। কারণ তার বাড়ি থানাভবনে। রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রাহ.-যিনি দারুল উলূম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন, তাঁকে গাঙ্গুহী বলা হয়। কারণ তাঁর বাড়ি গঙ্গোহ গ্রামে। কাসেম নানুতুবী রাহ.কে ‘নানুতুবী’ বলা হয়। কারণ নানুতা তাঁর বাড়ি। তেমনি ইয়াককুব নানুতুবী রাহ.। মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রাহ.কে ‘দেওবন্দী’ বলা হয়। কারণ তার বাড়ি দেওবন্দে। মুফতী শফী রাহ. দেওবন্দী। কারণ তাঁর বাড়ি দেওবন্দ। এরপরেও তিনি অনেক সময় এ নিসবত লিখতেন না। তিনি বলতেন, আমার বাড়ি দেওবন্দ, পড়েছিও দেওবন্দে। তাহলে দুই দিক থেকে আমি দেওবন্দী। মাদরাসার দিকে নিসবত করেও দেওবন্দী বলতে পারি। আমার বাড়ি দেওবন্দ এ হিসেবেও দেওবন্দী বলতে পারি। এরপরেও এ নিসবত আমার পছন্দ নয়। কারণ অনেকে এ নিসবতের অপপ্রয়োগ করে। এ নিসবতগুলো তো আসাবিয়ত ও সাম্প্রদায়িতকার জন্য নয়। শুধু নিসবতের দ্বারা কোনো কিছু সাব্যস্ত হয় না, আবার কোনো কিছুর বিলোপও ঘটে না। অনেকে নিসবত থেকে আসাবিয়ত ও সাম্প্রদায়িকতার দুর্গন্ধ পায়। অথচ যিনি নিসবত ব্যবহার করেছেন তার চিন্তার সুদূর প্রদেশেও এই নাপাকী ছিল না।
হযরত যে কখনো দেওবন্দী লিখতেন না তা নয়। তবে অধিকাংশ সময় লিখতেন না। লিখলেও শুধু এজন্য লিখতেন যে, দেওবন্দ তাঁর বাড়ি এবং দেওবন্দ মাদরাসায় তিনি পড়াশোনা করেছেন।
কারো অন্যায় যেন আমাদেরকে না-ইনসাফীর উপর উদ্বুদ্ধ না করে
আমাদের সমাজে আরেকটি ভুলও ব্যাপকভাবে হয়। তা হচ্ছে, কুরআন মজীদের এই শিক্ষার উপর মযবুতীর সাথে না থাকা-
لا يجرمنكم شنآن قوم على ان لا تعدلوا اعدلوا هو اقرب للتقوى.
এ আয়াতের শিক্ষা হল, কারও অন্যায় ও শত্রুতা যেন আমাদেরকে না-ইনসাফীতে প্ররোচিত না করে।
এটা কোনো কথা হয় না যে, অমুক আমাকে গালি দিয়েছে, আমিও তাকে গালি দিব। অমুক আমাকে গোমরাহ বলেছে, আমিও তাকে গোমরাহ বলব। অমুক আমাকে বেদআতী বলেছে, আমিও তাকে বেদআতী বলব। অমুক আমাকে কাফির বলেছে, আমিও তাকে কাফির বলব। অমুক আমাকে ইংরেজের দালাল বলেছে আমিও তাকে ইংরেজের দালাল বলব। অমুক আমাকে ইহুদি-খৃস্টানের দালাল বলেছে, আমিও তাকে ইহুদি-খৃস্টানের দালাল বলব। এটা শরীয়তের শিক্ষা না। আল্লাহর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সুন্নাহ না। কুরআনের শিক্ষা হল-
ادفع بالتى هى احسن
হাঁ, এক জায়গায় আছে-
لا يحب الله الجهر بالسوء من القول الا من ظلم وكان الله سميعا عليما
এ আয়াতে মযলুমকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এখান থেকে একটা সুযোগ সীমিত পর্যায়ে বের হয়। তবে সীমা লঙ্ঘন করা যাবে না। না-ইনসাফী করা যাবে না। কেউ যদি ভুল পথে চলে, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর নীতি ও আদর্শের উপর না থাকে, এমনকি ইসলামের উপরও না থাকে, (নাউযুবিল্লাহ, নাউযুবিল্লাহ) তার ক্ষেত্রেও আমি ইনসাফ থেকে সরতে পারি না, তার উপর জুলুম করতে পারি না। তার সাথে আমার আচরণ হবে ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ অনুযায়ী। এটা আমাদেরকে মনে রাখতে হবে। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন। আমীন।
আজকের মূল বিষয় আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য। এ বিষয়ে কিছু কথা বলার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ রাববুল আলামীন সহীহ বলার তাওফীক নসীব করুন। আমীন।
আলোচনার ভিত্তি কী হবে
এই পুরো আলোচনার ভিত্তি হবে কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতু রাসূলিল্লাহ। আমরা আলোচনা শুরু করব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি প্রসিদ্ধ হাদীস দ্বারা, যে হাদীসটি দ্বীনের একটি বুনিয়াদী নীতির বাহক। হাদীসটি সুনান, মাসানীদ ও সিহাহ কিতাবসমূহে রয়েছে।
সিহাহ শব্দটি সহীহ শব্দের বহুবচন। যেসব কিতাবের সংকলকগণ শুধু সহীহ হাদীস সংকলনের নীতি গ্রহণ করেছেন সেসব কিতাবকে ‘সহীহে মুজাররাদ’-এর কিতাব বলা হয়। ‘সিহাহ সিত্তা’ শব্দটির সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। এখানেও সিহাহ শব্দটি সহীহ-এর বহুবচন।
সিহাহ সিত্তা বা হাদীসের প্রসিদ্ধ ছয় কিতাবের প্রতিটির সকল হাদীস সহীহ-এই ধারণা ঠিক নয়। সুনানে ইবনে মাজাহসহ সুনানের অন্যান্য কিতাবে সহীহ-হাসানের বাইরে বিভিন্ন প্রকারের যয়ীফ হাদীসও রয়েছে।
তেমনি এ ধারণাও ঠিক নয় যে, এই ছয় কিতাবের বাইরে আর কোনো ‘সহীহ’ কিতাব নেই। এই ছয় কিতাবের বাইরে আরো ‘সহীহ’ কিতাব রয়েছে, যার সংকলকগণ শুধু সহীহ বা হাসান হাদীস সংকলনের নীতি গ্রহণ করেছেন। যেমন-মুয়াত্তা ইমাম মালেক ইবনে আনাস (মৃত্যু : ১৭৯ হিজরী), কিতাবুল আছার ইমাম আবু হানীফা (মৃত্যু : ১৫০ হি.) সহীহ ইবনে খুযায়মা (মৃত্যু : ৩১১ হিজরী) , সহীহ ইবনে হিববান (মৃত্যু : ৩৫৪ হিজরী)। সহীহ হাদীস সংকলনের উদ্দেশ্যে এই কিতাবগুলো লেখা হয়েছে। তেমনি যিয়াউদ্দীন আলমাকদেসীও এই নীতি গ্রহণ করেছেন। সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিমের উপর যারা ‘মুস্তাখরাজ’ লিখেছেন, তাদের অনেকেরই এই নীতি ছিল। তদ্রূপ এই দুই কিতাবের উপর যেসব ‘মুসতাদরাক’ লেখা হয়েছে তার অনেকগুলোতেই এই নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।
আপনারা জানেন, ‘মুসতাদরাক’ বলা হয় বিশেষ ধরনের হাদীসের কিতাবকে। যেসব সহীহ ও হাসান হাদীস কিংবা প্রমাণ হিসেবে সরাসরি গ্রহণযোগ্য বা শাওয়াহেদ ও সমর্থক বর্ণনার সাথে গ্রহণযোগ্য যেসব হাদীস সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে সংকলিত হয়নি সেসব হাদীস যেসব গ্রন্থে সংকলন করা হয় তাকে ‘মুসতাদরাক আলাস সহীহাইন’ বলে।
এ রকম একটি প্রসিদ্ধ ‘মুসতাদরাক’ হচ্ছে হাকিম আবু আবদুল্লাহ (মৃত্যু : ৪০৫ হিজরী) সংকলিত মুসতাদরাক। এতে অনেক সহীহ হাদীস রয়েছে। তবে এটি স্বীকৃত কথা যে, তিনি যেসব হাদীস সংকলন করেছেন বা যেগুলোকে সহীহ বলেছেন তার সবগুলো বাস্তবেও সহীহ এমন নয়। তবে এতে এমন অনেক হাদীস রয়েছে, যা বুখারী-মুসলিম বা তাদের কোনো একজনের শর্তে উত্তীর্ণ। হাফেয ইবনে হাজার রাহ. ‘আননুকাত’ কিতাবে এমন হাদীসের সংখ্যা হাজার খানেক বলেছেন। যদ্দুর মনে পড়ে, نحو ألف শব্দ সেখানে আছে।
তো আমি এখন যে হাদীসটি পড়ব তা সুনান-মাসানীদসহ অনেক কিতাবে আছে। এমনকি সহীহ শিরোনামে সংকলিত কোনো কোনো কিতাবেও আছে। যেমন, সহীহ ইবনে হিববানে হাদীসটি আছে। আমি এখন ইমাম বুখারী রাহ. ও ইমাম আবু দাউদ রাহ.সহ আরো অনেক ইমামের উস্তাদ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ.-এর সংকলিত ‘মুসনাদ’ থেকে হাদীসটি পড়ছি।
আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ. বলেন-
حدثنا الوليد بن مسلم، حدثنا ثور بن يزيد، حدثنا خالد بن معدان قال : حدثنا عبد الرحمن بن عمرو السلمي وحجر بن حجر قالا : أتينا العرباض بن سارية وهو ممن نزل فيه، ولا على الذين إذا ما أتوك لتحملهم قلت لا أجد أحملكم عليه فسلمنا وقلنا : أتيناك زائرين وعائدين ومقتبسين، فقال عرباض : صلى بنا رسول الله صلى الله عليه وسلم الصبح ذات يوم، ثم أقبل علينا، فوعظنا موعظة بليغة ذرفت منها العيون، ووجلت منها القلوب، فقال قائل : يا رسول الله! كأن هذه موعظة مودع، فماذا تعهد إلينا؟ فقال : أوصيكم بتقوى الله، والسمع والطاعة، وإن كان عبدا حبشيا، فإنه من يعش منكم بعدي فسيرى اختلافا كثيرا. فعليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين، تمسكوا بها، وعضوا عليها بالنواجذ، وإياكم ومحدثات الأمور، فإن كل محدثة بدعة وكل بدعة ضلالة.
হাদীস : ১৭১৪৫, ২৮/৩৭৫; মুয়াসসাসাতুর রিসালা থেকে প্রকাশিত শায়খ শুয়াইব আলআরনাউত ও তাঁর সঙ্গীদের তাহকীককৃত (সম্পাদিত নুসখা)।
এরপর আরো দুটি সনদ রয়েছে। ১৭১৪২ নং রেওয়াতের টীকায় শায়খ শুয়াইব আলআরনাউত ও তাঁর সঙ্গীরা উক্ত হাদীসের বিভিন্ন রেওয়াত, সমর্থক বর্ণনা ও তাখরীজসহ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
মূল হাদীসের তরজমা
ইরবায ইবনে সারিয়া রা. বলেন, একদিন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিয়ে ফজরের নামায পড়লেন। এরপর আমাদের দিকে ফিরে এক সারগর্ভ বক্তৃতা করলেন। এতে আমাদের চোখ অশ্রুসজল হল এবং হৃদয় ভীতকম্পিত হল। একজন আরজ করলেন, আল্লাহর রাসূল! এ যেন বিদায়কালের উপদেশ। আপনি আমাদের (আরো) কী অসীয়ত করছেন? আল্লাহর রাসূল বললেন, তোমাদেরকে অসীয়ত করছি আল্লাহকে ভয় করার এবং আমীর হাবাশী গোলাম হলেও তার আনুগত্য করার। কারণ আমার পর তোমাদের যারা বেঁচে থাকবে তারা বহু ইখতিলাফ দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার সুন্নাহ ও আমার হেদায়েতের পথের পথিক খলীফাগণের সুন্নাহকে সর্বশক্তি দিয়ে ধারণ করবে। আর সকল নবউদ্ভাবিত বিষয় থেকে দূরে থাকবে। কারণ সকল নবউদ্ভাবিত বিষয় বিদআত। আর সকল বিদআত গুমরাহী।
হাদীসের ব্যাখ্যা
আল্লাহর রাসূলের বয়ান থেকে সাহাবায়ে কেরামের মনে হয়েছে, এটি তাঁর বিদায়ী বয়ান। তাই তাঁরা কিছু মৌলিক নীতি চেয়েছেন, যা তাঁর অনুপস্থিতে আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করবে। জওয়াব থেকে বোঝা যাচ্ছে, তাঁরা একটি মানদন্ড চেয়েছেন, যার দ্বারা দ্বন্দ ও মতভেদের ক্ষেত্রে ফয়সালা করা যাবে। আল্লাহর রাসূল বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা আমার পর বেঁচে থাকবে তারা বহু ইখতিলাফ দেখতে পাবে।’
এখানে ইখতিলাফটা ব্যাপক। যে কোনো ধরনের ইখতিলাফ হতে পারে। ইখতিলাফ যখন হবে তখন করণীয় কী? আল্লাহর রাসূল বললেন, ‘আমার সুন্নাহ ও আমার হেদায়েতপ্রাপ্ত খলীফাগণের সুন্নাহকে সর্বশক্তি দিয়ে ধরে রাখবে। অর্থাৎ যে সরল পথ ও উজ্জ্বল আদর্শের উপর তোমাদেরকে রেখে যাচ্ছি এর উপর অটল-অবিচল থাকতে চাইলে আমার সুন্নাহ এবং রাশেদ ও মাহদী খলীফাগণের সুন্নাহকে আকড়ে ধরে রাখবে। এরপর বলেছেন, ‘নবআবিষ্কৃত বিষয়াদি থেকে দূরে থাকবে।’
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের হাদীসে আছে-
من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد
যে আমাদের এই বিষয়ে (দ্বীন ও শরীয়তে) নতুন কিছুর উদ্ভব ঘটায় তা পরিত্যাজ্য।
এ হাদীসের আলোকে উপরের হাদীসের অর্থ হয়, দ্বীনের নামে যা কিছু প্রচার করা হবে অথচ তা দ্বীন হওয়ার কোনো দলিল নেই, তা পরিত্যাজ্য। এ হাদীসে وكل بدعة ضلالة পর্যন্ত আছে। অর্থাৎ সকল বিদআত গোমরাহী। সহীহ মুসলিমে জাবির রা.-এর হাদীসে আরেকটি কথা আছে। তা হল-وكل ضلالة في النار অর্থাৎ সকল গোমরাহীর ঠিকানা জাহান্নাম।
হাদীসের মান
হাদীসটি সহীহ। পরিভাষায় ‘সহীহ’ ও ‘হাসান’ বলে যে পার্থক্য করা হয় তা একটি পারিভাষিক পার্থক্য। উসূলে হাদীস অনুযায়ী দু ধরনের হাদীসই দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য। মূলত তা সহীহ হাদীসেরই দুটি স্তরের নাম। ‘সহীহ’ প্রথম স্তরের। ‘হাসান’ দ্বিতীয়
স্তরের, তবে এর দ্বারাও শরীয়তের আহকাম ও বিধান প্রমাণ হয়। আমাদের আলোচিত হাদীসটি পরিভাষার দিক থেকেও সহীহ। আবার সাধারণ সহীহ নয়; বরং ঐ প্রকারের সহীহ, যাকে পরিভাষায় الصحيح المتلقى بالقبول বলে। অর্থাৎ আহলে ইলম ও আহলুল হাদীসের মাঝে যেটি সহীহ হওয়ার বিষয়ে কোনো মতভেদ নেই, সকলেই যাকে শরীয়তের সূত্র হিসেবে গ্রহণ করেছেন-এটি এমন পর্যায়ের সহীহ হাদীস।
দেখুন, আমি যে ‘আহলুল হাদীস’ শব্দটি বললাম এর অর্থ হাদীসশাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ মনীষীবৃন্দ, যারা নকদে হাদীস ও নকদে ইসনাদ তথা হাদীসের সনদ-মতন বিচারের শাস্ত্রসমূহের পারদর্শী। এটিই এ শব্দের পুরনো ব্যবহার। যাই হোক, এটা এখন আলোচ্য বিষয় নয়।
ইমাম আবু নুয়াইম আলআসফাহানী রাহ. (মৃত্যু : ৪৩০ হিজরী)-এর মন্তব্য
ইমাম আবু নুয়াইম রাহ. সহীহ মুসলিমের উপর ‘মুসতাখরাজ’ লিখেছেন। ঐ কিতাবের ভূমিকায় তিনি এ হাদীস সহীহ হওয়ার বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁর আরেকটি কিতাব ‘কিতাবুয যুআফা।’ এটি মূলত ‘আলমুসতাখরাজ’-এর মুকাদ্দামা, যা আলাদাভাবে ছাপা হয়েছে বা তিনি নিজেই আলাদা করে সংকলন করেছেন। এতেও এ হাদীস সহীহ হওয়ার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তার আলোচনাটি পড়ছি :
هذا حديث جيد من صحيح حديث الشاميين، وهو وإن تركه الإمامان محمد بن إسماعيل البخاري ومسلم بن الحجاج فليس ذلك من جهة انكسار منهما له، فإنهما رحمهما الله قد تركا كثيرا مما هو بشرطهما أولى وإلى طريقتهما أقرب، وقد روى هذا الحديث عن العرباض بن سارية ثلاثة من تابعي الشام معروفين مشهورين.
এ আরবী পাঠে ‘ইনকিসার’ শব্দটি ছাপার ভুল। সঠিক পাঠ হল ‘ইনকার’। ইবনে রজব হাম্বলী রাহ. আবু নুয়াইম রাহ.-এর হাওয়ালায় ‘জামিউল উলুমি ওয়াল হিকাম’ কিতাবে এই ইবারত উদ্ধৃত করেছেন। তাতে ‘ইনকিসার’ এর পরিবর্তে ‘ইনকার’ শব্দ আছে।
ইমাম আবু নুয়াইম বলেন, এটি একটি ‘জাইয়েদ’ হাদীস, যা শামের রাবীদের সূত্রে বর্ণিত সহীহ হাদীসের অন্যতম। ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাইল বুখারী ও ইমাম মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ যদিও হাদীসটি তাঁদের কিতাবে আনেননি, তবে তা হাদীসটিকে সহীহ মনে না করার কারণে নয়। তাঁরা তো এমন অনেক হাদীস ছেড়ে দিয়েছেন যেগুলো তাদের সংকলিত হাদীস থেকেও- তাঁদের নীতি ও মানদন্ডের অধিক নিকটবর্তী। এ হাদীসটি ইরবায ইবনে ছারিয়া রা. থেকে বর্ণনা করেছেন শামের প্রসিদ্ধ ও বিখ্যাত তিনজন তাবেয়ী।
এরপর একটু সামনে গিয়ে এ হাদীসের নির্দেশনা সম্পর্কে বলেন-
فتلقت الهداة العقلاء وصية نبيهم صلى الله عليه وسلم بالقبول ولزموا التوطن على سنته وسنة الهداة المرشدة من الخلفاء، فلم يرغبوا عنه بل علموا أن الثبوت عليه غير ممكن إلا بتتبع ما سنه عليه السلام وسنه بعده أئمة الهدى الذين هم خلفائه في أمته فتركوا الاشتغال بهواجس النفوس وخواطر القلوب، وما يتولد من الشبهات التي تولد آراء النفوس وقضايا العقول خوفا من أن يزيغوا عن المحجة التي فارقهم عليها رسول الله صلى الله عليه وسلم الذي شبه ليلها بنهارها مع ما جاءهم عن الله تعالى من الوعيد البليغ المصرح بنفي الإيمان عما خالفه عليه السلام أوطعن على أحكامه ولم تطب نفسه بالتسليم له. انتهى (المستخرج على صحيح المسلم)
অর্থাৎ তো হেদায়েতের দিশারী প্রাজ্ঞজনরা তাঁদের নবীর এই অসীয়তকে শিরোধার্য করেছেন এবং তাঁর সুন্নাহ ও খলীফাগণের সুন্নাহর উপর নিজেদেরকে আবদ্ধ রেখেছেন, যারা ছিলেন হেদায়েতপ্রাপ্ত ও হেদায়েতের দিশারী। তা থেকে বিমুখ হননি। বরং তারা নিশ্চিত জেনেছেন যে, আল্লাহর রাসূল যে সুন্নাহ জারি করেছেন এবং তাঁর পর হেদায়েতের ইমামগণ যে সুন্নাহ জারি করেছেন, যাঁরা ছিলেন উম্মতের মাঝে তাঁরই উত্তরসূরী, তা অন্বেষণ করা ছাড়া দ্বীনের উপর অবিচল থাকা সম্ভব নয়। সুতরাং তারা মনের খেয়াল, মস্তিষ্কের কল্পনা এবং বুদ্ধি ও প্রবৃত্তির মত ও মতবাদ থেকে জন্ম নেওয়া সংশয় ও বিভ্রান্তিতে আত্মনিয়োগে করেননি। ঐ উজ্জ্বল রাজপথ থেকে বিচ্যুত হওয়ার ভয়ে, যার উপর দাড় করিয়ে আল্লাহর রাসূল তাদের থেকে বিদায় নিয়েছেন। উপরন্তু আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে এসেছে ঈমান হারা হওয়ার কঠিন হুঁশিয়ারি তাদের জন্য, যারা আল্লাহর রাসূলের বিরোধিতা করে, তাঁর বিধি বিধানের নিন্দা করে কিংবা তাঁর প্রতি আত্মসমর্পিত হতে বিরত থাকে।-আলমুসতাখরাজ ১/৩৭
এটি দ্বীনের একটি বুনিয়াদী হাদীস এবং সর্বসম্মতভাবে সহীহ। অথচ এই বুনিয়াদী হাদীসটি সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিমে নেই। এ কারণে কোনো হাদীস শুধু ঐ দুই কিতাবে না থাকলে তা হাসান বা যয়ীফ মনে করা সম্পূর্ণ ভুল। এ হাদীস একটি স্পষ্ট উদাহরণ যে, সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের বাইরেও সহীহ হাদীস আছে।
তেমনি যারা মনে করেন, সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ছাড়া কোথাও সহীহ হাদীস নেই। থাকলেও তা দ্বিতীয় পর্যায়ের সহীহ হাদীস-তাদের ধারণাও ভুল। কেননা ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম সকল সহীহ হাদীস সংকলনের ইচ্ছাও করেননি। এ কথা তাঁরা স্পষ্ট ভাষায় বলে গেছেন। বিভিন্ন সনদে তাঁদের এই কথা বর্ণিত আছে। খাত্তাবী রাহ. সহীহ বুখারীর ভাষ্যগ্রন্থের ভূমিকায় তা উদ্ধৃত করেছেন। আরো অনেকেই উল্লেখ করেছেন।
তো এই হাদীসের মান বিষয়ক আলোচনায় আমরা একটি সুন্দর ফায়দাও পেলাম। তা হচ্ছে কোনো সহীহ হাদীস সহীহাইনে না থাকলে এ আপত্তি করা যাবে না যে, কেন তা ঐ দুই কিতাবে নেই!
তো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর পরিচয় ও বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে এটি বুনিয়াদী হাদীস। এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ইখতিলাফ হলে আমার সুন্নাহ ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহকে ধারণ করবে। তাহলে বুঝা গেল, নাজাতপ্রাপ্ত দলের একটি মানদন্ড সুন্নাহ, অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ।
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর দ্বিতীয় রোকন ‘আলজামাআ’। এটিও হাদীস শরীফে আছে। এ সংক্রান্ত হাদীসটি সুনানে আবু দাউদ, মুসনাদে আহমদ ও সুনানে দারেমী ইত্যাদি কিতাবে আছে। সুনানে আবু দাউদ ও মুসনাদে আহমদে হাদীসটি যেভাবে আছে তা হল-
عن أبي عامر عبد الله بن لحي قال : حججنا مع معاوية بن أبي سفيان، فلما قدمنا مكة قام حين صلى صلاة الظهر، فقال : إن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : إن أهل الكتابين افترقوا في دينهم على ثنتين وسبعين ملة، وإن هذه الأمة ستفترق على ثلاث وسبعين ملة، يعني الأهوءا، كلها في النار إلا الواحدة، وهي الجماعة … انتهى.
আবু আমির আবদুল্লাহ বলেন, আমরা মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান রা.-এর সাথে হজ্ব করলাম। যখন মদীনায় এলাম যোহরের নামাযের পর তিনি দাঁড়ালেন এবং বললেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পূর্বের দুই কিতাবধারী সম্প্রদায় তাদের ধর্মে বায়াত্তর মিল্লাতে বিভক্ত হয়েছিল। আর এই উম্মত বিভক্ত হবে তেয়াত্তর মিল্লাতে। অর্থাৎ নিজস্ব খেয়াল-খুশির অনুসারী বিভিন্ন দল। সবগুলো দল জাহান্নামী হবে একটি ছাড়া। আর সেটি হচ্ছে ‘আলজামাআ’।-মুসনাদে আহমদ ২৮/১৩৪ (মুয়াসসাসাতুর রিসালা থেকে প্রকাশিত শায়খ শুআইব আলআরনাউত কর্তৃক সম্পাদিত নুসখা), হাদীস : ১৬৯৬৭; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪৫৯৭
হাদীসটির মান
এ হাদীস সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেছেন-
الحديث صحيح مشهور في السنن والمسانيد، كسنن أبي داود والترمذي والنسائي وغيرهم
অর্থ : হাদীসটি সহীহ। এটি সুনান ও মাসানীদের কিতাবের মশহূর হাদীস। আবু দাউদ, তিারমিযী, নাসায়ী ও অন্যান্যদের সুনানে তা আছে।-মাজমুউল ফাতাওয়া ৩/৩৪৫
জামে তিরমিযীতে হাদীসটির পাঠ এই-
تفترق أمتي على ثلاث وسبعين ملة، كلهم في النار إلا ملة واحدة، قالوا : من هي يا رسول الله؟ قال : ما أنا عليه وأصحابي.
অর্থাৎ আমার উম্মত তিয়াত্তর মিল্লাতে বিভক্ত হবে। একটি ছাড়া বাকি সবগুলোই যাবে জাহান্নামে। সাহাবীরা জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহর রাসূল! সেই এক দলে কারা থাকবেন? বললেন, মা আনা আলাইহি ওয়া আসহাবী। অর্থাৎ যারা আমার ও আমার সাহাবীদের আদর্শের উপর থাকবে।-জামে তিরমিযী ২/৯২, হাদীস : ২৮৩২
ইমাম তিরমিযী রাহ. বলেছেন-
هذا حديث حسن غريب مفسر لانعرفه مثل هذا إلا من هذا الوجه
অর্থ : এটি হাসান, গরীব ও মুফাসসার হাদীস; হাদীসটি এভাবে শুধু এই সূত্রেই আমরা পাই।-জামে তিরমিযী ২/৯২, হাদীস : ২৮৩২
ما أنا عليه وأصحابي অর্থাৎ নাজাতপ্রাপ্ত তারা, যারা ঐ পথে আছে, যে পথে আমি ও আমার সাহাবীরা রয়েছি। এখানে ‘মা’ দ্বারা সুন্নাহকে নির্দেশ করা হয়েছে। তাহলে এই হাদীসে ‘মা-আনা আলাইহি’ শব্দে তাই বলা হয়েছে, যা আগের হাদীসে ‘আলাইকুম বিসুন্নাতী’ শব্দে বলা হয়েছিল। অর্থাৎ আমার সুন্নাহকে ধারণ কর।
তাহলে আমরা দুটি বিষয় পেলাম : ১. সুন্নাহ তথা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ, যা সাহাবায়ে কেরামের সুন্নাহও বটে। ২. জামাআ।
আসসুন্নাহ ও আলজামাআ শব্দের বিশ্লেষণ
ইবনে তাইমিয়া রাহ. ‘‘মিনহাজুস সুন্নাতিন নাবাবিয়্যাহ’’ কিতাবে এক প্রসঙ্গে এবং তাঁর ফাতাওয়ায় বিভিন্ন প্রসঙ্গে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর নীতি-আদর্শ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
‘‘মিনহাজুস সুন্নাহ’’য় হযরত বলেছেন-
ومن العجب أن الرافضة تثبت أصولها على ما تدعيه من النص والإجماع، وهم أبعد الأمة عن معرفة النصوص والإجماعات والاستدلال بها بخلاف السنة والجماعة (وفي نسخة ن و ب بخلاف أهل السنة والجماعة).
فإن السنة تتضمن النص والجماعة تتضمن الإجماع، فأهل السنة والجماعة هم المتبعون للنص والإجماع. انتهى
অর্থ : আশ্চর্যের বিষয় এই যে, রাফেজীরা তাদের নীতি ও উসূল প্রমাণ করে-তাদের দাবী অনুসারে-নস ও ইজমা থেকে! অথচ এরা হচ্ছে নস ও ইজমাকে জানা এবং তা দ্বারা দাবি প্রমাণের ক্ষেত্রে উম্মাহর সুদূরতম দল। পক্ষান্তরে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআ হচ্ছে নস ও ইজমার অনুসারী। ‘সুন্নাহ’ নসকে ধারণ করে আর ‘জামাআ’ ধারণ করে ইজমাকে।-মিনহাজুস সুন্নাতিন নাবাবিয়্যাহ ফী নাকযি কাওলিশ শীআতিল কাদীমাহ ৬/৪৬৬ (নতুন সংস্করণ, পুরাতন সংস্করণ ৩/৭৩)
জামাআর দুটি দিক রয়েছে : ১. নিছক দ্বীনী বিষয়ে জামাআ। এটি হচ্ছে ইজমা। ইবনে তাইমিয়া রাহ. এর উপরোক্ত বক্তব্যে ‘আলজামাআ’র ব্যাখ্যায় ইজমার কথা এসেছে।
২. জামাআর আরেকটি দিক হচ্ছে উম্মতে মুসলিমার সামাজিক একতা ও রাজনৈতিক ঐক্য। এটিও এখানে আছে। বরং আলজামাআর প্রথম অর্থ এটিই। অনেক হাদীসে এ বিষয়টির কথা বলা হয়েছে। যেমন, এ হাদীসে-
عليكم بالجماعة، فإنه من شذ شذ في النار.
তেমনি মিল্লাতে বিভক্ত হওয়ার হাদীসটি আল্লামা হিবাতুল্লাহ আললালকায়ী রাহ. ‘‘উসূলুল ইতিকাদ’’ কিতাবে হাসান সনদে উল্লেখ করেছেন। তাতে নাজাতপাপ্ত দলের পরিচয় هى الجماعة এর পরিবর্তে আছে السواد الأعظم অর্থাৎ ‘সর্ববৃহৎ দল’। এসব হাদীসে ‘আলজামাআ’ শব্দের দ্বিতীয় দিকটিও রয়েছে।
কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে-
ومن يشاقق الرسول من بعد ما تبين له الهدى ويتبع غير سبيل المؤمنين …
এখানে ‘ছাবীলুল মুমিনীন’ মানে উম্মতের সর্বসম্মত পথ, বিধানের বিষয়ে উলামায়ে উম্মতের ইজমা ও উম্মতের সামাজিক ও রাজনৈতিক একতা ও ঐক্যবদ্ধতা সবকিছুই এর অন্তর্ভুক্ত।
শুধু সমাজ ও রাজনীতির দিক থেকেই নয়; বরং বংশ, পরিবার, সহকর্মী, সফরসঙ্গী, প্রতিবেশী এক কথায় সবার সাথে সর্বত্র একতা ও ঐক্যবদ্ধতা ইসলামে কাম্য। এজন্য ইসলাম আত্মীয় সম্পর্ক বজায় রাখাকে ফরয এবং আত্মীয়তা ছিন্ন করাকে হারাম ঘোষণা করেছে। সমাজের সকল শ্রেণী ও ব্যক্তির অধিকার নির্ধারণ করেছে এবং তা বিনষ্ট করাকে হারাম করেছে। ব্যক্তি থেকে সমাজ-প্রতিটি স্তরে পরস্পর বিবাদ-বিসংবাদকে হারাম করেছে। সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে হারাম করেছে এবং একে সবচেয়ে ঘৃণ্য ও জঘন্য ঘোষণা করেছে। কোথাও তিনজন মানুষ একত্রিত হলেও তাদের জামাতবদ্ধ না থাকাকে নাজায়েয ঘোষণা করেছে।
ইজতিমা ও জামাতদ্ধতার এসব বিধান বিভিন্ন পর্যায়ে আলজামাআরই অন্তর্ভুক্ত।
তাহলে আমরা বুঝলাম, ‘আলজামাআ’তে দুটো বিষয় রয়েছে : এক. ইজমা, দুই. মুসলমানদের সামাজিক ও রাজনৈতিক একতা ও ঐক্যবদ্ধতা। এই দুইটি যারা অক্ষুণ্ণ রাখবে তারা হবে ‘আহলুল জামাআ’।
অতএব আহলুসু সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ তারাই, যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, খুলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবায়ে কেরামের সুন্নাহর অনুসরণ করে এবং মুসলমানদের ইজমা ও ইজতিমাকে রক্ষা করে। ইজমা অর্থ দ্বীনী বিষয়ে মনীষীদের ঐক্য আর ইজতিমা দ্বারা উদ্দেশ্য হল উম্মাহর সামাজিক-রাজনৈতিক ঐক্য।
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ নামটি এখনের নয়। সাহাবায়ে কেরামের যামানা থেকে চলে আসছে। কখনো পুরো নাম উল্লেখ করা হত, কখনো সংক্ষেপে শুধু আহলুস সুন্নাহ বলা হত। সূরা আল ইমরানের ১০৬ নং আয়াতের তাফসীরে ইবনে আববাস রা. থেকে পুরা নাম বর্ণিত হয়েছে। আয়াতটি হল-
يوم تبيض وجوه وتسود وجوه
ইবনে আববাস রা. বলেন-
تبيض وجوه أهل السنة والجماعة، وتسود وجوه أهل البدعة والفرقة
-তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/৫৮৪
ইবনে তাইমিয়া রাহ.-এর মাজমুআতুল ফাতাওয়ায়ও তা আছে। (দেখুন : ৩/২৭৮)
উল্লেখ্য, আয়াতের পূর্বাপর যদিও মুমিন ও কাফির সম্পর্কে তবে এখানে অন্যরা শামিল হবে না তা নয়। তাফসীরকে সংকীর্ণ করা যায় না, এর ব্যাপকতা অক্ষুণ্ণ রাখতে হয়।
এ নামটি সংক্ষিপ্তভাবেও বিভিন্ন স্থানে উল্লেখিত হয়েছে। যেমন সহীহ মুসলিমের মুকাদ্দমায় ইবনে সীরীন রাহ.-এর বক্তব্যে এসেছে। তিনি বলেন-
لم يكونوا يسألون عن الإسناد، فلما وقعت الفتنة قالوا : سموا لنا رجالكم فينظر إلى أهل السنة فيؤخذ حديثهم أو ينظر إلى أهل البدع فلا يؤخذ حديثهم.
মোটকথা আজকে আমরা সালাফ থেকে নাজাতপ্রাপ্ত ও সুপথপ্রাপ্ত দলের পুরো নাম পেলাম। অপর পক্ষের পূর্ণ নাম হল, আহলুল বিদআতি ওয়াল ফুরকা। সাধারণত শুধু নামের প্রথম অংশ উল্লেখ করে আমরা আহলুল বিদআ বা বিদআতী বলি, যা সুন্নাহ ত্যাগের কারণে হয়। অপর অংশ আহলুল ফুরকা বা ফেরকাবাজ সাধারণত বলি না, যা জামাআ ত্যাগের কারণে হয়।
মনে রাখতে হবে, সুন্নাহ ও জামাআ একটি অপরটির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কারো মনে হতে পারে, কোনো দলের মাঝে জামাআ না থাকলেও সুন্নাহ থাকতে পারে। তাদের নাম হতে পারে-আহলুস সুন্নাতি ওয়াল ফুরকা। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব নয়। কারণ ফুরকা বা বিভেদ হচ্ছে মারাত্মক সুন্নাহ পরিপন্থী বিষয়। কাজেই বিভেদ সৃষ্টিকারী কখনো সুন্নাহর অনুসারী নয়। তেমনি বিদআতী হয়ে জামাআ রক্ষাকারী কি হতে পারে? পারে না। কারণ বিদআতীর চরিত্রই হচ্ছে সুন্নাহ অনুসারীদেরকে লক্ষ্যবস্ত্ত বানানো। তো সুন্নাহ ত্যাগের কারণে এক বিভেদ তো প্রথমেই তৈরি করেছে, এখন সুন্নাহর অনুসারীদেরকে টার্গেট করে আরো বিভেদের জন্ম দিচ্ছে।
মোটকথা সুন্নাহ ও জামাআ একট অপরটির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
উক্ত মাপকাঠির আলোকে সকল ইখতিলাফী মাসায়েল বিচার করব
এখন যারা যে বিষয়ে ইখতিলাফ করবে সেটা আমরা বিচার করব সুন্নাহ ও ইজমার আলোকে। যারা সুন্নাহ ও ইজমার উপর থাকবে তারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর অন্তর্ভুক্ত।
কেউ মৌলিকভাবে নেই, আংশিকভাবে আছে সেটাও। আমরা অস্বীকার করব না। তবে শুধু আংশিকভাবে থাকলে এই নামের অধিকারী হবে না।
কিছু উদাহরণ
এখন আমরা কিছু উদাহরণ দিব। বর্তমান সময়ে যেসব বিষয়ে বিবাদ-বিসংবাদ হয়, সেসব বিষয়ে উপরোক্ত মাপকাঠির আলোকে দেখব-আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর নীতি ও আদর্শের উপর কারা আছে, কারা নেই। সব বিষয় নিয়ে তো আলোচনা করা সম্ভব নয়। দু একটি বিষয় আলোচনা করব।
প্রথম উদাহরণ : তারাবীর রাকাত-সংখ্যা
প্রতি বছরই লিফলেট বিলি করা হয়
তারাবীর নামায আট রাকাত, বিশ রাকাত নয়। ঐ বন্ধুরা বিশ রাকাতকে অস্বীকার করে। অনেকে বিদআত বলে। আমি কোনো সাম্প্রদায়ের নাম নিচ্ছি না। আর ‘আহলে হাদীস’ শব্দটি বলি না দুই কারণে। প্রথমত এ নাম সহীহ নয়। এটি কোনো ফের্কা বা সম্প্রদায়ের নাম হতে পারে না। ‘আহলুল হাদীস’ মানে হাদীস বিশারদ মনীষী। দ্বিতীয়ত এ নামে একটি সম্প্রদায় প্রসিদ্ধ হয়ে যাওয়ার পরও বলি না। কারণ তাদের মধ্যেও অনেক ফের্কা রয়েছে। আমি বলব, আহলে হাদীসরা বলে। প্রশ্ন হবে, আহলে হাদীসের কোন ফের্কা বলে? তাদের মাঝেও ফের্কা আছে, এই দেশেই অনেক ফের্কা আছে।
পাকিস্তানেরগুলো মিলালে তো আরো অনেক হবে। তাদের কোনো কোনো ফের্কা মনে করে, আট রাকাত শেষ করে নবম রাকাতের তাকবীর বলার সাথে সাথে পেছনের সব নামায নষ্ট হয়ে যাবে! আশ্চর্য কথা! এটা কোন প্রকারের সুন্নাহ!!
যাই হোক, এ কারণে আমি নাম নিচ্ছি না। আর নাম নেওয়ার প্রয়োজনও নেই। আমার কাজ হল ভুলটা ধরিয়ে দেওয়া এবং সহীহটা বলা।
যাদের মাঝে এত ফের্কা, আমি বুঝি না, তারা কোন মুখে বলে, মাযহাবের কারণে ফের্কা হয়েছে। আর তা থেকে বাঁচার জন্য তারা ‘আহলে হাদীস’ হয়েছে। অথচ মাযহাব ও ফের্কা এক কথা নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস অনুযায়ী একটি দল নাজাত পাবে। সেটি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআ। এই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর চারটি ফিকহী মাসলাক হল, হানাফী, মালেকী, শাফেয়ী ও হাম্বলী। এটি হচ্ছে ফিকহ তথা শরীয়তের বিধিবিধান আহরণ ও সংকলনের ক্ষেত্রে চিন্তা-গবেষণার চারটি ঘরানা। বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলেও প্রতিটিই সুন্নাহ ও জামাআর ধারক এবং একে অপরের স্বীকৃতি দানকারী। পক্ষান্তরে আহলে হাদীসদের অবস্থা অত্যন্ত কঠিন। তাদের কোনো কোনো ফের্কা একে অপরকে কাফির বলে। একজন গায়রে মুকাল্লিদ আলিম ছিলেন ছানাউল্লাহ অমৃতসরী রাহ.। জ্ঞান-গরিমায় অনেক গায়রে মুকাল্লিদ থেকে তাঁর অবস্থান ভালো ছিল। দ্বীনের অনেক নেক কাজ করেছেন। তবে তারও ভুল আছে তা আমি অস্বীকার করছি না। অথচ তাদেরই একজন তাঁর বিরুদ্ধে কিতাব লিখেছে। কিতাবটির নামের শুরু অংশ মনে আসছে না। শেষাংশটা এরূপ-
في كفر ثناء الله بجميع اصول لا إله إلا الله
এ ধরনের কঠিন কঠিন কথা তাদের এক ফের্কা অপর ফের্কা সম্পর্কে বলে। সব ফের্কা নয়। তো যখন একে অপরকে বিদআতী বলে, ফাসিক বলে, এমনকি কাফির পর্যন্ত বলে তখন বুঝতে হবে, এটা বৈচিত্র নয়, বিভেদ। চিন্তার ঘরানা নয়, বাস্তবেই ফের্কা। আর যারা এ রকম বলবে না, যেমন চার মাযহাবের কেউ একে অপরকে এরূপ বলে না তারা বাস্তবে ফের্কা নয়; বরং শাখাগত বিষয়ে মতের বৈচিত্র বা মতপার্থক্য। এখানে এটুকুই বললাম। অন্য মজলিসে বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
বিশ রাকাত সুন্নতে মুতাওয়ারাসা দ্বারা প্রমাণিত
সুন্নাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকার সুন্নাতে মুতাওয়ারাছা। একটি সহীহ হাদীসে যে সুন্নাহ পেলাম সেটিও সুন্নাহ, আর যা মৌখিক বর্ণনার পাশাপাশি যুগ যুগ ধরে চলে আসছে, প্রত্যেক প্রজন্ম তার পূর্বের প্রজন্ম থেকে গ্রহণ করেছে, এভাবে অবিচ্ছিন্ন কর্মধারার মাধ্যমে নবী-যুগ থেকে বা খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগ থেকে চলে আসছে তা হচ্ছে সুন্নতে মুতাওয়ারাছা।
আমরা যে ‘মুতাওয়াতির’ পড়েছি এরই একটি বিশেষ প্রকার এই সুন্নতে মুতাওয়ারাছা। ২০ রাকাত তারাবীর নামায সুন্নতে মুতাওয়ারাছার অন্তর্ভুক্ত। এর বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠেছে অনেক পরে। ১২শ বছর পর। তখন গায়রে মুকাল্লিদদেরই এক আলেম, যিনি অন্তত এ বিষয়ে গায়রে মুকাল্লিদ হননি, গোলাম রাসূল ছাহেব এর প্রতিবাদ করেছিলেন। ১২৯০ হিজরীতে তিনি ‘রিসালায়ে তারাবীহ’ নামে একটি পুস্তিকা লেখেন। এতে আট রাকাতের মতবাদ খন্ডন করে বিশ রাকাত তারাবীর সপক্ষে লেখেন। ঐ পুস্তিকায় অন্যান্য দলিলের পাশাপাশি উম্মতের এই সম্মিলিত ও অবিচ্ছিন্ন কর্মধারাও তিনি উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে মাসিক আলকাউসারে বিস্তারিত লেখা হয়েছে। পরে তা আলাদা পুস্তিকা আকারেও প্রকাশিত হয়েছে এবং ‘‘নবীজীর নামাযে’’র শেষেও সংযুক্ত হয়েছে।
বিশ রাকাত তারাবী খুলাফায়ে রাশেদীনসহ অন্যান্য সাহাবার সুন্নাহ
বিশ রাকাত তারাবী সুন্নাতুল খুলাফা দ্বারা প্রমাণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে, প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা.-এর খেলাফত-আমলে এবং ওমর রা.-এর খেলাফতের প্রথম দিকে তারাবীর নামায ছোট ছোট জামাতে হত। ফরয নামাযের মতো এক ইমামের পিছনে তারাবীর নামায আদায়ের ইহতিমাম ছিল না।
রমযানের এক রাতে মসজিদের বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট তারাবীর জামাত দেখে হযরত ওমর রা.-এর মনে হল, সকল নামাযীকে এক ইমামের পিছনে একত্র করে দেওয়া উচিত। তখন তিনি এই আদেশ জারি করেন এবং উবাই ইবনে কাবকে ইমাম বানিয়ে দেন।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ২০১০
এই রেওয়ায়েতটি সনদের দিক থেকে ‘সহীহ’ ও বিষয়বস্ত্তর দিক থেকে ‘মুতাওয়াতির’।
বলাবাহুল্য, উবাই ইবনে কাব রা. বিশ রাকাত পড়াতেন। (দেখুন : মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ২/২৮৫)
এ বিষয়ে ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেন-
إنه قد ثبت أن أبي بن كعب كان يقوم بالناس عشرين ركعة في قيام رمضان ويوتر بثلاث.
এটা প্রমাণিত যে, উবাই ইবনে কা’ব রা. লোকদের নিয়ে রমযানের রাতে বিশ রাকাত পড়তেন এবং তিন রাকাত বিতর আদায় করতেন।-মাজমুউল ফাতাওয়া ২৩/১১২
২০ রাকাত সম্পর্কে তিনি বলেছেন-
ثبت من سنة الخلفاء الراشدين وعمل المسلمين.
এটি খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ ও মুসলিম উম্মাহর কর্মধারা দ্বারা প্রমাণিত।
দেখার বিষয় এই যে, তখন বিশ রাকাত তারাবীর মুসল্লি কারা ছিলেন। মুহাজির, আনসার ও বদরী সাহাবাসহ বিপুল সংখ্যক সাহাবী তখন মুসল্লী ছিলেন। এটি সাহাবীদের শেষ যমানার ঘটনা নয়; বরং দারুল খিলাফায় মসজিদে নববীতে বিপুল সংখ্যক সাহাবীর উপস্থিতিতে এটি হয়েছে। হযরত জাবির রা.-এর উপস্থিতিতে হয়েছে, যার উদ্ধৃতিতে বর্ণিত একটি মুনকার রেওয়ায়েত দ্বারা ঐ বন্ধুরা আট রাকাত প্রমাণ করতে চায়। আম্মাজান আয়েশা সিদ্দীকা রা.-এর উপস্থিতিতে হয়েছে, যার থেকে বর্ণিত তাহাজ্জুদ বিষয়ক একটি হাদীস দ্বারা আট রাকাত প্রমাণের চেষ্টা করা হয়। তিনি মসজিদে নববীর পাশে নিজ হুজরাতেই ছিলেন। কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করেননি।
দেখুন, ২০ রাকাত তারাবী অস্বীকার করলে রাকাত-সংখ্যার ক্ষেত্রে অনিবার্যভাবে সুন্নাতুর রাসূল থেকেও বিচ্যুত হতে হবে।
এর কারণ দুটি : প্রথমত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ নিঃসন্দেহে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে গৃহিত। কারণ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে ‘রাশিদ ও মাহদী’ তথা হেদায়েতের পথের পথিক বলেছেন। আর হেদায়েতের পথের পথিক তারাই, যারা সদা সর্বদা বিদআত থেকে মুক্ত। সুতরাং দ্বীনের বিষয়ে তারা নিজেদের পক্ষ থেকে কোনো বিধান আবিষ্কার করতে পারেন না।
আরো লক্ষ্য করুন, হাদীসের শেষে আছে
عليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين … وإياكم ومحدثات الأمور
অর্থাৎ আমার সুন্নাহ ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহকে ধারণ কর আর বিদআত থেকে বেঁচে থাক। সুতরাং যেটা খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ তা কখনো বিদআত হবে না। বেদআত এর বিপরীত জিনিস।
সুতরাং অনিবার্যভাবে খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহর সূত্র হবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ। সেই সূত্র আমাদের জানা থাকতেও পারে, না-ও থাকতে পারে। সুতরাং সুন্নাতুল খুলাফাকে অস্বীকার করা মানে সুন্নাতুর রাসূলকে অস্বীকার করা। এ হল এক কারণ।
দ্বিতীয় কারণ এই যে, তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নেওয়া হয়, খুলাফায়ে রাশেদীনের এই সুন্নাহর সূত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ নয়। এটি তাঁরা ইজতিহাদের ভিত্তিতে করেছেন তাহলে এখানে দুটো অবস্থা হতে পারে : সব সাহাবা সম্মিলিতভাবে করেছেন। তাহলে সেটা হবে ইজমায়ে সাহাবা। আর সাহাবাদের ইজমা তো অনেক উপরের বিষয়, আল্লাহর রাসূল তো উম্মাহর ইজমার উপরও আমল করতে বলেছেন। সুতরাং এক্ষেত্রেও সুন্নাতুল খুলাফাকে অস্বীকার করার অর্থ সুন্নাতুর রাসূলকে অস্বীকার করা।
আর যদি ধরে নেই, সকল সাহাবা একমত ছিলেন না, এটি শুধু খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ। তাহলেও আমাদেরকে তা অনুসরণ করতে হবে। কারণ সুন্নাতুল খুলাফাকে আঁকড়ে ধরার আদেশ স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে করেছেন। কেউ যদি সুন্নাতুল খুলাফার বিরুদ্ধাচরণ করে তাহলে عليكم بسنتي … এ হাদীসেরও বিরুদ্ধাচরণ হবে এবং সুন্নাতুল খুলাফা ত্যাগ করার সাথে সাথে সুন্নাতুর রাসূলও ত্যাগ করা হবে।
বিশ রাকাত তারাবী কি উমর রা.-এর যমানা থেকে শুরু হয়েছে
অনেকের ধারণা, বিশ রাকাত তারাবী উমর রা.-এর যমানা থেকে শুরু হয়েছে। এর আগে তা ছিল না। এ ধারণা ভুল। কারণ হযরত ওমর রা. শুধু আলাদা আলাদা তারাবীর জামাতকে একত্র করেছেন, তারাবীহর রাকাত-সংখ্যার বিষয়ে তাঁর কোনো পদক্ষেপ ছিল না। মুসনাদে আবদ ইবনে হুমাইদ ও যিয়াউদ্দীন মাকদেসীর কিতাবুল মুখতারায় পুরো ঘটনা আছে, যার সারসংক্ষেপ হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগ থেকে উমর রা.-এর খিলাফতের শুরু ভাগ পর্যন্ত মসজিদে নববীতে তারাবীর ছোট ছোট জামাত হত। উমর রা. দেখলেন এতে কিছুটা অসুবিধা হয়। কারণ মসজিদে নববী তখন এত প্রশস্ত ছিল না। এক জামাতের আওয়াজ অপর জামাতের জন্য অসুবিধা সৃষ্টি করত। কেউ কিছুক্ষণ এক জামাতে নামায পড়ে অন্য জামাতে চলে যেত। এ ধরনের কিছু অসুবিধা হত। তাই উমর রা. সকলকে এক জামাতের অধীনে করে দিলেন এবং উবাই ইবনে কাব রা.কে ইমামতির নির্দেশ দিলেন। (দেখুন : আলআহাদীসুল মুখতারাহ ১/৩৮৪; তাসদীদুল ইসাবা ৮০; কানযুল উম্মাল ৮/৪০৮, হাদীস : ৩৪৭১)
তাহলে দেখা যাচ্ছে, উমর রা. যা করেছেন তা ছিল একটি ব্যবস্থাপনার বিষয়, বিধানের বিষয় নয়। অথচ রেওয়ায়েতে এটিও আছে যে, উবাই ইবনে কাবকে যখন উমর রা. আদেশ করলেন তখন তিনি বললেন-
يا أمير المؤمنين! هذا شيء لم يكن!
আমীরুল মুমিনীন! এভাবে এক জামাতে তারাবী পড়ার নিয়ম তো আগে ছিল না।
উমর রা. তাকে বুঝানোর পর তিনি সম্মত হন।
চিন্তা করুন, একটি ব্যবস্থাপনার বিষয়ে উবাই ইবনে কাব রা. আপত্তি করেছেন। অথচ তারাবীর রাকাত-সংখ্যা তো ব্যবস্থাপনার বিষয় নয়, শরীয়তের বিধান। যদি প্রথম থেকে অন্য কোনো রীতি থাকত, যেমন ধরুন আট রাকাতের নিয়ম যদি চলে আসত, আর এখন নতুন করে ২০ রাকাত শুরু হচ্ছে তাহলে যিনি একটি ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আপত্তি করেছেন তিনি শরীয়তের বিধানের বিষয়ে কী করতেন? কিন্তু না উবাই ইবনে কাব আপত্তি করেছেন, না মুহাজির, আনসার কোনো সাহাবী আপত্তি করেছেন। সুতরাং পরিষ্কার বোঝা যায়, বিশ রাকাত তারাবী তাদের মাঝে পূর্ব থেকেই চলে এসেছে এবং এটিই ছিল আল্লাহর রাসূলের শিক্ষা।
আরো চিন্তা করুন, রাকাত-সংখ্যার বিষয়টি ‘মুদরাক বিল কিয়াস’ বা কিয়াস ও ইজতিহাদের ভিত্তিতে সাব্যস্ত করার মতো বিষয় নয়। তাছাড়া কোনো বিশুদ্ধ বর্ণনায় নেই যে, উমর রা. তারাবীর রাকাত-সংখ্যার বিষয়ে পরামর্শ করেছেন। অথচ বিধান ও ব্যবস্থাপনা দু ধরনের বিষয়েই পরামর্শ করা ছিল তাঁর সাধারণ রীতি। তো কোনো পরামর্শ ছাড়া কিভাবে সকল সাহাবী বিশ রাকাতের বিষয়ে একমত হয়ে গেলেন? কোনো সন্দেহ নেই, তাদের এই ঐক্যমতের পিছনে সূত্র হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষা ও নির্দেশনা। তাঁদের কাছে আল্লাহর নবীর বিধান যদি হত আট রাকাত তারাবী তাহলে না উবাই ইবনে কা’ব ২০ রাকাত পড়াতেন, না মুহাজির ও আনসারী কোনো সাহাবী চুপ থাকতেন। এই বাস্তবতা কেন ঐ বন্ধুদের বুঝে আসে না তা আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন।
এ বিষয়ে তারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর সাথে নেই
এই মাসআলায় তারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআ-এর পথে/মাসলাকের উপর নেই। এ বিষয়ে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর দুটি রোকনই তাদের হাতছাড়া হয়েছে। প্রথম রোকন ছিল সুন্নাহ। এটি যে হাতছাড়া হয়েছে তা তো স্পষ্ট। দ্বিতীয় রোকন ছিল জামাআ। এটিও তাদের হাতছাড়া হয়েছে। কারণ তারা বিশ রাকাতকে অস্বীকার করে ইজমার সর্বোচ্চ প্রকার তথা খুলাফায়ে রাশেদীন, মুহাজির ও আনসার সাহাবা, বদর ও বাইআতে রিদওয়ানে অংশগ্রহণকারী সাহাবায়ে কেরামের ইজমার বিরোধিতা করেছে। উপরন্তু সুন্নাহ ও ইজমার অনুসারীদের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে মুসলমানদের একতা বিনষ্ট করছে। ফিতনা-ফাসাদ ছড়াচ্ছে। অথচ এ বিষয়ে তাদের কাছে কোনো দলিল নেই। সর্বসাকুল্যে তাদের পুঁজি হচ্ছে, একটি মুনকার বর্ণনা, একটি তাহাজ্জুদের হাদীস আর কিছু মা’লুল রেওয়ায়েত। যদি বিষয়টি এমন হত যে, উভয় দিকে দলিল আছে তাহলেও বিশকে অস্বীকার করার অবকাশ ছিল না। অথচ তারা তা-ই করছে এবং মুসলমানদের ঐক্য নষ্ট করছে। সুতরাং দ্বিতীয় রোকনের উপরও তারা নেই।
সারকথা, তারাবীর রাকাতসংখ্যায় তারা সুন্নাহ ও জামাআ দুটো থেকেই বিচ্যুত।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)

Processing your request, Please wait....
  • Print this article!
  • Digg
  • Sphinn
  • del.icio.us
  • Facebook
  • Mixx
  • Google Bookmarks
  • LinkaGoGo
  • MSN Reporter
  • Twitter
১৪৪ বার পঠিত
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (ভোট, গড়: ৩.৬৭)

১ টি মন্তব্য