সৈয়দ কুতুব -এর বইয়ের প্রতি শারয়ী দৃষ্টিভঙ্গি- গ্রহণযোগ্য নাকি বাতিল?
লিখেছেন: ' Mahir' @ শনিবার, মার্চ ৪, ২০১৭ (২:০৭ অপরাহ্ণ)
ফাতওয়া ১০৭৩২৭ – সৈয়দ কুতুবের বইয়ের প্রতি শারয়ী দৃষ্টিভঙ্গি- গ্রহণযোগ্য নাকি বাতিল?
প্রশ্নঃ-
কিছু আলিম তার বিরুদ্ধে সতর্ক করা সত্বেও, আমরা কি সৈয়দ কুতুবের বই থেকে কি আমরা কিছু শিখতে পারি?
উত্তরঃ-
আলহামদুলিল্লাহ্।
উস্তাদ সৈয়দ কুতুব আলিম নন এবং হাদিস, ফিকাহ বা তাফসীর শাস্ত্রে তার অবদান নেই। বরং তিনি একজন শিক্ষিত লোক যে ইসলামকে ভালবাসত, রক্ষা করত আর উন্নীত করত, আর আমাদের কাছে মনে হয়েছে, তিনি ইসলামের জন্য জীবন দিয়েছেন-এবং আল্লাহ যেন তাঁকে শহীদদের মাঝে কবুল করেন।
সে অনেক বই লিখেছে, যার কিছুতে সে ভুল করেছে আবার কোথাও ঠিক করেছে। আলিমদের ক্ষেত্রে কেউ যদি আকীদাহ, হাদিস বা ফিকাহ শাস্ত্রে ভুল করে; আমরা মনে করি না যে কোন আলিম এই কথা বলেছে যে, তাদের কাছ থেকে জ্ঞান শিক্ষা করা একদম হারাম বা তাদের উদ্ধৃতি দেওয়া থেকে একদম বিরত থাকতে হবে। এটা সত্ত্বেও কিছু লোক তাদের বিশ্বাস ও মাযহাব গড়ে তুলেছে। যারা এর থেকে পার্থক্য করেছে তাদের প্রতি নিরপেক্ষ আহল-সুন্নাহ-এর দৃষ্টিভঙ্গির একটি উদাহরণ হল এটি।
উস্তাদ সৈয়দ কুতুব নিরপেক্ষ আহল-সুন্নাহ-এর দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে নন। যেহেতু আমরা দেখি যে, আমাদের যুগের আহল-সুন্নাহ-এর প্রতিনিধিরা তার [উস্তাদ সৈয়দ কুতুব] বইয়ের উক্ত অংশ থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছে, যে অংশ আকীদাহ বা আহল-সুন্নাহর নিয়মবিদ্যা সংক্রান্ত। উদাহরণস্বরূপ-
১.
শাইখ মুহাম্মাদ নাসির উদ্দীন আলবানী [রাহঃ] তার ‘মুখতাসার আল-‘আলুও’ গ্রন্থের ভূমিকায় প্রায় ৩ পৃষ্ঠা ব্যাপী উস্তাদ সৈয়দ কুতুবের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। আর তিনি এভাবে শুরু করেছেনঃ
“
মহান উস্তাদ সৈয়দ কুতুব [আল্লাহ তার উপর রহম করুক]…
”
শুধু একজন লোকের বই থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া, আর তার প্রশংসা করা এক নয়। বরং প্রশংসা আসে শাইখ মুহাম্মাদ নাসির উদ্দীন আলবানীর [আল্লাহ তার উপর রহম করুক] এই কথার মাধ্যমেঃ “উস্তাদ”, “মহান”, “আল্লাহ তার উপর রহম করুক”।
২.
শাইখ সালিহ আল-ফাওযান [রাহঃ] তার আত তাহক্বীক্বাত আল-মারদিয়া ফি’ল মাবাহিস আল-ফারদিয়া বইতে [পৃ. ২১-২৪] ৪ টি উদ্ধৃতি সৈয়দ কুতুবের বই থেকে দিয়েছেন।
দ্বিতীয়তঃ
আমাদের পক্ষপাত্বহীন আলিমরা ইসলামের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন এবং তা শিক্ষা দিয়েছেন, আর এই পক্ষপাত্বহীন দৃষ্টিভঙ্গির প্রচার করেছেন। এটা বলাই ন্যায়সঙ্গত যে, আমাদের উচিত সৈয়দ কুতুবের বই একদম পরিহার না করা; একইসাথে তার বইয়ের ভুলগুলো তুলে ধরা ধর্মীয় দায়িত্ব, যেন কেউ তার বই পড়ে হতভম্ব না হয়। কিন্তু এটা শুধু সৈয়দ কুতুবের জন্য নয়, বরং যারা আহল-সুন্নাহর অনুসারী তাদের জন্য। আমাদের আলিমরা যেকোন ব্যক্তির ভুলকে অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। স্থায়ী কমিটির আলিমরা এই বলে আহলে-সুন্নাহর অনেকের ভুলের বিরুদ্ধে ফাতয়া জারি করেছেন যে, তারা কিছু বিশ্বাস বুঝার ক্ষেত্রে তারা ভুল করেছেন।
কিন্তু অবাক করার মত বিষয় হল, আজকাল আহলে-সুন্নাতের কিছু অংশ সৈয়দ কুতুবের ভুলগুলো নিয়ে নেতৃস্থানীয় পণ্ডিতদের উদ্ধৃতি অতিমাত্রায় উল্লেখ করছে, আর ঐসকল আলিম ও ইমামরা তাদের নিজের শাইখদের ভুল নিয়ে যে কথা বলছে তা উপেক্ষা করছে। অতএব, তারা আলিমরা অন্যদের নিয়ে কি কথা বলেছেন তার কিছু গ্রহণ করে কিন্তু বাকিদের ক্ষেত্রে গ্রহণ করে না। কেউ যদি খেয়ালখুশি এবং ইচ্ছার অনুসরণের উদাহরণ দেখতে চায়, তবে এটা উত্তম উদাহরণ।
সৈয়দ কুতুবকে নিয়ে বিভিন্ন আলিমের মন্তব্য দেওয়া হল; প্রত্যেক ক্ষেত্রে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয়, সেটা হল আমাদের উচিত সুন্দর ও সঠিককে গ্রহণ করা এবং ভিত্তিহীন ও ভুলকে ত্যাগ করা; আর এটা শুধু সৈয়দ কুতুবের ক্ষেত্রেই নয়।
. শাইখ নাসির উদ্দীন আলবানী [রাহঃ] বলেনঃ
“লোকটি ‘আল-আদালাহ আল-ইজতিমাইয়াহ’ [সামাজিক বিচার] নামে একটি অকেজো বই রচনা করেছে, কিন্তু তার মা’আলিম ‘আলা আত-তারীক্ব [প্রস্তরফলক] কিছু মূল্যবান মত বহন করে।
[টেপ নং. ৭৮৪, সিলসিলা আল-হুদা ওয়ান নূর]
একই টেপে, শাইখ নাসির উদ্দীন আলবানী [রাহঃ] বলেনঃ
“আমি মনে করি, এই ব্যক্তি আলিম না, কিন্তু সে হকের কথা বলে-বিশেষ করে যখন সে জেলে ছিল- মনে হল তারা অনুপ্রাণিত হয়েছে”।
সে আরও বলেছেঃ
“এই ব্যক্তি আলিম না কিন্তু সে এমন কিছু লিখেছে যা হিদায়াতের নূর ও জ্ঞান প্রতিফলিত করে, যেমন কিছু শব্দাংশ ‘মানহাজ হায়াত’ [জীবনের পথ]। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের অনেক সালাফী ভাইয়েরা এই ধারণার অনুসরণ করে যে, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ হল জীবনের পথ”। তাঁকে নিয়ে আমার এটাই বলার ছিল”।
২.
শাইখ মুহাম্মাদ ইবন সালিহ আল-উসাইমীন [রাহঃ] কে জিজ্ঞাসা করা হয়ঃ
“সৈয়দ কুতুব এমন এক লোক যে এমন কিছু ধারণার সূত্রপাত করেছে যা মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে, কিন্তু লোকেরা তাঁকে নিয়ে বিভক্ত হয়েছে; কেউ তার প্রশংসা করে আর কেউ কঠোরভাবে সমালোচনা করে। আমরা চাই, শাইখ এই বিষয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করুক। এই লোকটির প্রতি মুসলিমের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হওয়া উচিত? কারন মুসলিম বিশ্বে তার প্রভাব আছে, আর সে অনেক বই এবং লেখনী রেখে গেছে। আমরা চাই, আপনি ব্যাপারটা নিয়ে কিছু বলুন”।
তার জবাবঃ
আমি মনে করি না, যুবকদের জন্য কোন বিশেষ ব্যক্তিকে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করা ঠিক, এটা সৈয়দ কুতুব হোক আর যে-ই হোক। বরং ইসলামী নীতি নিয়ে বিতর্কের দরকার। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের উচিত সৈয়দ কুতুব বা অন্যদের বিবৃতি পরখ করা, এবং বলাঃ এই মতটি কি সঠিক নাকি ভুল? আমাদের পরখ করা উচিত আর যদি সঠিক হয় তবে তা গ্রহণ করা উচিত, এবং যদি ভুল হয় তো বাদ দেওয়া উচিত। কিন্তু যুবকদের জন্য কোন বিশেষ ব্যক্তিকে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করা ঠিক না আর তা মারাত্মক ভুল।
সৈয়দ কুতুব অভ্রান্ত নয়, এবং তার চেয়ে বড় আলিমরাও অভ্রান্ত নয়, এবং তার চেয়ে খুদে আলিমরাও অভ্রান্ত নয়। যেকোন ব্যক্তির কথা গ্রহণযোগ্য বা প্রত্যাখ্যানযোগ্য হতে পারে, শুধু রাসুলুল্লাহ [সাঃ] ছাড়া। তাঁর [সাঃ] কথা সকল ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য।
সুতরাং আমি তরুনদের বলি যে, কোন বিশেষ ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে, তাদের তর্ক আর মতবিরোধ করা উচিত না, আর সে যে-ই হোক না কেন, পরিশেষে হয়তো দেখা যাবে যে, সে ঐ ব্যক্তির সঠিক ও নির্ভুল কথাও বাতিল করে দিয়েছে, অথবা সে ঐ ব্যক্তির ভুল ও ভিত্তিহীন কথা গ্রহণ করে ফেলেছে। অন্ধভাবে কারো পক্ষপাতিত্ব করা বা কারো বিপক্ষে যাওয়া খুবই বিপদজনক, সে হয়তো তাঁর অপছন্দের ব্যক্তিকে নিয়ে এমন কিছু বলবে যা ঐ ব্যক্তি বলে নি, অথবা সে ঐ লোকের কোন কথার ভুল ব্যাখ্যা করতে পারে ইত্যাদি, অথবা সে হয়তো ঐ লোকের কথা উপেক্ষা করবে অথবা ঐ লোকের ত্রুটিপূর্ণ কথা এমনভাবে ব্যাখ্যা করবে যেন সঠিক মনে হয়।
তাই আমি বলিঃ কাউকে নিয়ে আমাদের কথা বলা ঠিক না এবং কারো অন্ধ অনুসরণ করা উচিত না। সৈয়দ কুতুব চলে গেছে, আর আল্লাহ তাঁর বিচার করবেন, এবং এটা অন্য আলিমদের জন্যও সত্য।
সুতরাং আমাদের জন্য অবশ্যই যা সঠিক ও নির্ভুল তা গ্রহণ করতে হবে, এটা সৈয়দ কুতুব থেকে আসুক আর অন্য কেউ থেকে আসুক। আর ভুল ও ভিত্তিহীন কথা প্রত্যাখ্যান করতে হবে, এটা সৈয়দ কুতুব থেকে আসুক আর অন্য কেউ থেকে আসুক। আমাদের অবশ্যই ভুল ও ভিত্তিহীন ধারণা, তা মৌখিক হোক আর লিখিত হোক, প্রত্যাখ্যান করতে হবে, এটা যার কাছ থেকে আসুক না কেন।
আমার ভাইদের নিকট আমার উপদেশ এটাই। কোন বিশেষ ব্যক্তিকে ঘিরে আলোচনা বা বিতর্ক করা ঠিক না।
সৈয়দ কুতুবের ক্ষেত্রে, তাঁর উত্তরাধিকার [বই বা লেখনী] বিষয়ে আমার কাছে অন্যদের উত্তরাধিকারের মত; কারন এতে সঠিক-ভুল সব আছে, কারন কেউ অভ্রান্ত নয়। কিন্তু তাঁর কর্ম নাসির উদ্দীন আলবানীর মত নয়, তাদের মধ্যে পার্থক্য হল, আকাশ ও পৃথিবীর মত; আগে উল্লেখিত লোকটির বই সাধারণ, শিক্ষা, সাহিত্য নিয়ে কেন্দ্রিক; ইমাম নাসির উদ্দীন আলবানীর ন্যায় গভীর জ্ঞান তাঁর নেই।
অত: পর আমি মনে করি যে, সঠিক যে কারো কাছ থেকে গ্রহণ করা উচিত এবং যা যুক্তিবিরুদ্ধ তা যে কারো কাছ থেকে আসুক তা প্রত্যাখ্যাত হতে হবে। আমরা করা উচিত না – এবং প্রকৃতপক্ষে এটা আমাদের জন্য জায়েয নয় – ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে তর্ক ও মতবিরোধ করা অথবা ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে বিভক্ত বা ঐক্যবদ্ধ হওয়া।
আল্লাহ অধিক জানেন।
উৎসঃ https://islamqa.info/en/107327
[অনুবাদক- শাইখ মতিউর রহমান মাদানী ‘তিনটি মূলনীতি’ লেকচারে বলেন যে,
আরবের লোকেরা ফাতয়া দেবার যোগ্যতা যে রাখে তাঁকে আলিম মনে করে
। আর অন্যদের তালিবে ইলম বলে। এছাড়া ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল [রাহঃ] বলেন, “নিশ্চয়ই, যে আলেম হাদীছের যঈফ-ছহীহ ও নাসিখ-মানসুখ বুঝে না, তাকে আলিম বলা যাবে না“।
ইমাম ইসহাক্ব ইবনু রাওয়াহাহ একই কথা বলেন।
- আলবানী, ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব (রিয়াযঃ মাকতাবাতুল মা’আরিফ, ২০০০/১৪২১), ১০/৩৯, ভূমিকা দ্রঃ; আবু আব্দিল্লাহ আল হাকিম, মা’রেফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ৬০।
একারনে তাকে আলিম বলা হয় নি। তবে আমি মনে করি, আমাদের দেশের অধিকাংশ মুফতি তার সমপর্যায়ের না।
কিছু লোক বলে যে, আল্লামা নাসির উদ্দিন আলবানী [রাহঃ] সৈয়দ কুতুব-কে নিয়ে বাজে মন্তব্য করেছে। এই লিখাটি তাদের বোধদয়ের জন্য।
সৈয়দ কুতুবের ‘আল কুরআনের সৌন্দর্য’ এমন এক বই যা ঐসব লোকের যুক্তি বাতিল করে, যারা বলে যে-‘আল কুরআনের অনুরূপ গ্রন্থ লেখা সম্ভব। আর অনেক মনীষী বলেছে- কুরআন কোন অসাধারণ শিল্পগুণ ধারণ করে না’। আর বইটি সহজপাঠ্য। কাজেই কোন মনীষী কি বলেছে, তা না শুনে নিজেই পরখ করে দেখুন।
তার লিখা ‘তাফসির ফী যিলাযিল কুরআন’ যুবকদের জন্য পড়া জরুরি।]