পৃথিবী গোল হওয়ার ইজমা
লিখেছেন: ' Mahir' @ বুধবার, ডিসেম্বর ২০, ২০১৭ (১২:৩৯ পূর্বাহ্ণ)

১১৯৭ হিজরি/১৭৮২-৩ খ্রিস্টাব্দে হাদি ইস্ফাহানির কৃতিত্ব সমেত প্রচলিত গোলাকার গঠনে নির্মিত একটি বৃহৎ ইরানি ব্রাস ভূগোলক, ভূগোলকটিতে নির্দেশক চিহ্ন, ব্যক্তিত্ব ও জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক প্রতীকসহ বিস্তারিত বিবরণ খচিত রয়েছে।
অনেকেরই মনে প্রশ্ন জাগে যে, উলামা পৃথিবীর আকৃতি নিয়ে কি বলেছেন? এদেশের নাস্তিকরা একতরফাভাবে শুধু ঐসকল মুফাসসিরদের কথাই উল্লেখ করে থাকে,যারা তাদের ইজতিহাদে সামান্য ভুল করেছেন আর পৃথিবীকে সমতল বলেছেন। বস্তুত, আল্লাহ তা’আলা সরাসরি কুরআন মাজীদে পৃথিবীকে গোল বলেন নি। কারন, আমাদের পিতৃপুরুষরা যেহেতু পৃথিবীকে সমতল ভাবত, সেহেতু হঠাত করেই পৃথিবীকে গোলক বলে দিলে আমাদের পিতৃপুরুষরা হয়তো শয়তানের ধোঁকায় পড়ে ইসলাম ত্যাগ করত, আর আমরা শান্তির ধর্মে জন্ম নেয়ার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারতাম না। তাই আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন কিছু কৌশল গ্রহণ করেছেন। তিনি কিছু ইঙ্গিতের দ্বারা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, পৃথিবী গোলক। কুরআনের অনেক কথাই উপযুক্ত সময়ের আগে অনুধাবন করা যায় না। বিশেষ করে কিয়ামাতের আয়াতগুলো সঠিক সময়ের আগে সঠিকভাবে অনুধাবন করা প্রায় অসম্ভব। একইভাবে, আধুনিক যুগ আসার আগেই পৃথিবীর আকার নিয়ে কুরআনের ইঙ্গিতগুলো অনুধাবন করা সম্ভব হয় নি। আগের পোস্টে আমি সেই আয়াতগুলো উল্লেখ করেছিলাম যা সমতল পৃথিবীর সকল মডেল বাতিল করে। এই পোস্টে আমরা পৃথিবীর গোলক আকৃতি নিয়ে উলামার মতগুলো উল্লেখ করব।
একাধিক বিশেষজ্ঞ পৃথিবীর গোলক হওয়ার পক্ষে ইজমা উল্লেখ করেছেন। উদাহরণস্বরূপঃ
وقال أبو محمد ابن حزم رحمه الله : ” مطلب بيان كروية الأرض :
قال أبو محمد وهذا حين نأخذ إن شاء الله تعالى في ذكر بعض ما اعترضوا به ، وذلك أنهم قالوا : إن البراهين قد صحت بأن الأرض كروية ، والعامة تقول غير ذلك ، وجوابنا وبالله تعالى التوفيق : أن أحداً من أئمة المسلمين المستحقين لاسم الإمامة بالعلم رضي الله عنهم لم ينكروا تكوير الأرض ، ولا يحفظ لأحد منهم في دفعه كلمة ، بل البراهين من القرآن والسنة قد جاءت بتكويرها … ” وساق جملة من الأدلة على ذلك “الفصل في الملل والأهواء والنحل” (2/78) .আবু মুহাম্মাদ ইবনে হাযম [রাহঃ] ৯৯৪ খ্রিস্টাব্দ] বলেনঃ পৃথিবী গোল হওয়ার পক্ষের দলিল হলঃ
আবু মুহাম্মাদ বলেনঃ আমরা পৃথিবীর গোল হওয়ার বিপক্ষের কিছু দলিল নিয়ে আলোচনা করব। পৃথিবীর গোল হওয়ার পক্ষে স্পষ্ট দলিল রয়েছে, কিন্তু সাধারণ মানুষেরা অন্যরকম বলে। আমাদের জবাব হল-আল্লাহ সকল ক্ষমতার উৎস- ইমাম বলে অভিহিত করার যোগ্যতা রাখে এবং জ্ঞানী এমন কোন বিশিষ্ট মুসলিম পৃথিবীর গোল হওয়ার ব্যাপারটি অস্বীকার করেন নি, এবং তাদের থেকে অস্বীকার করার জন্য কোন বর্ণনা পাওয়া যায় নি। বরং, কুরআন ও সুন্নাহ থেকে বর্ণিত যে,এটা গোল… এবং তিনি এর পক্ষে দলিল দেন।[ইবনু হাযম, আল-ফিছাল ফিল মিলাল ওয়াল আহ-ওয়া আল মিলাল ২/৭৮ ‘পৃথিবী গোলাকার হওয়া’ অনুচ্ছেদ]
পৃথিবীর গোল হওয়ার ব্যাপারের দলিল হলঃ আল্লাহ বলেন,
يُكَوِّرُ اللَّيْلَ عَلَى النَّهَارِ وَيُكَوِّرُ النَّهَارَ عَلَى اللَّيْلِ ‘তিনিই দিবসের উপর রাত্রিকে এবং রাত্রির উপর দিবসকে আবেষ্টনকারী বানিয়েছেন’ (যুমার ৫)
ইবনে হাযম দলিল হিসাবে উপরের আয়াতটি উল্লেখ করেন।
ইমাম আবু ইয়ালা [রাহঃ] বলেন, “মুসলিমদের ঐক্যমতে পৃথিবী গোল”। [ত্বাবাক্বাত আল-হাম্বলী]
সম্ভাব্য অপযুক্তিঃ তারা গোল বলেছেন, গোলক বলেন নি।
জবাবঃ এসব হল শব্দের মারপ্যাঁচ। আমরাও কথায় কথায় পৃথিবীকে গোল বলি, গোলক বলি না। তারা গোল বলতে গোলকই বুঝিয়েছেন। এর প্রমাণ হল-
ইবনে হাযম অন্যত্র বলেন, “পৃথিবীর গোলক হওয়াই সুপ্রসিদ্ধ…এর প্রমাণ হল সূর্য পৃথিবীর বিশেষ স্থানের উলম্ব বরাবর থাকে”। [ আল ফাসল ফীল মিলাল, ২য় খন্ড, ৯৮ পৃ.]
ইবনে তাইমিয়া বলেনঃ আকাশের সকল বস্তুই গোল- যেহেতু সকল জ্যোতির্বিদ ও গণিতবিদরা এটাই বলেন। আবুল হুসাইন ইবনে আল-মুনাদি [রাহঃ], আবু মুহাম্মাদ ইবনে হাযম [রাহঃ], আবুল ফারাজ ইবনে আল জাওযীর মতো মুসলিম মনীষীদের মতামত হলঃ মুসলিম উলামা এব্যাপারে সহমত। বস্তুত, আল্লাহ তা’আলা বলেন, তিনিই সৃষ্টি করেছেন রাত্রি ও দিন এবং সূর্য ও চন্দ্র। সবাই ফালাকে বিচরণ করে। [ সূরা ২১ আয়াত ৩৩] ইবনে আব্বাস [রাঃ] বলেন, ফালাক মানে চড়কা [সাইকেলের চাকার মত]
[এখানে সূর্য, চাঁদ ,নক্ষত্রকে গোল বলা হয়েছে; গোলক বলা হয় নি। তার মানে এই না যে তারা সূর্য, চাঁদ ,নক্ষত্রকে দ্বিমাত্রিক ভাবত।]
ইবনে তাইমিয়া বলেনঃ ফালাক মানে গোল। [মাজমু আল-ফাতওয়া, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃঃ ৫৬৬-৫৬৭]
তিনি [মাজমু আল-ফাতওয়া, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃঃ ৫৬৫-৫৬৬]-তে বলেন যে,
যেহেতু পৃথিবীর অপর পার্শ্ব পানি দ্বারা বেষ্টিত [তখনও আমেরিকা আবিষ্কৃত হয় নি, কাজেই আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে কোন ভূখন্ড নেই বলেই তখনকার লোকেরা মনে করত] আর সেখানে কোন মানুষ বা এরকম কিছুই নেই। এমনকি যদিও আমরা ধরে নিই যে অপর পার্শ্বে মানুষ আছে, এরকম ক্ষেত্রেও তারা পৃথিবীর পৃষ্ঠেই আছে। অপর পার্শ্বের লোকেরা এই অংশের মানুষদের নিচে নয়, আবার এই অংশের লোকেরা অপর পাশের মানুষেরও নিচে নয়। কারন প্রত্যেক গোলকীয় বস্তু একটি বিন্দুকে [মারকাজ] ঘিরে থাকে [বুঝা গেল, তিনি গোলক কি সেটা সাধারণ মানুষকে বুঝানোর চেষ্টা করছেন] গোলকীয় বস্তুর কোন পাশ অপর পাশের নিচে হতে পারে না, এভাবে উত্তর মেরুও দক্ষিণ মেরুর নিচে হতে পারে না। [মুসলিমরা যখন প্রথম পৃথিবীর মানচিত্র এঁকেছিল; তখন উত্তর মেরু নিচে ও দক্ষিণ মেরু উপরে এঁকেছিল, তিনি সেটাই বুঝাচ্ছেন।] (সংক্ষিপ্ত)
উপরের আলোচনা থেকে বুঝাই যাচ্ছে যে, তিনি বলতে চাচ্ছেন পৃথিবী গোলক। আর গোলক পৃথিবী থেকে দৃশ্যমাণ নক্ষত্র, চাঁদ, সূর্যকে দ্বিমাত্রিক হবে এমন ভাবাও অযৌক্তিক। বিশেষ করে, যখন এরা সকলে গতিশীল আর প্রচন্ড তাপ প্রদানকারী বস্তু সূর্যকে দ্বিমাত্রিক বলা বোকামি। আদিম মানুষেরাও এরকম ভাবত কিনা সন্দেহ। অর্থাৎ আকাশের বস্তুগুলো গোলকের ন্যায়। এবং পৃথিবী নিজেও গোলক, যার মানে হল- উলামা পৃথিবীকে আকাশে [মহাশূণ্যে] অবস্থিত বলেই মনে করতেন।
وكذلك أجمعوا على أن الأرض بجميع حركاتها من البر والبحر مثل الكرة . قال : ويدل عليه أن الشمس والقمر والكواكب لا يوجد طلوعها وغروبها على جميع من في نواحي الأرض في وقت واحد ، بل على المشرق قبل المغرب ” انتهى من “مجموع الفتاوى” (25/195) باختصار .
আবুল হুসাইন ইবনে আল-মুনাদি [রাহঃ] থেকে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া [রাহঃ] [১৩২৮ খ্রিস্টাব্দ] বর্ণনা করেন, যখন সে বললঃ আবুল হুসাইন আহমাদ ইবনে জাফর ইবনে আল-মুনাদি [রাহঃ] দ্বীনি বিষয়ে গবেষণা ও কর্মের জন্য সুপরিচিত বিশিষ্ট উলামা থেকে এবং ইমাম আহমাদের দ্বিতীয় স্তরের সাথীদের থেকে বর্ণনা করেন, যে উলামার মাঝে এ ব্যাপারে মতপার্থক্য ছিল না যে আকাশ হচ্ছে বলের মত।[এটা অনেকগুলো মতের একটি-অনুবাদক।]
সে বললঃ একইভাবে, সর্বসম্মতিক্রমে জলভাগ ও স্থলভাগসহ সকল কিছু ধারণকারী এই পৃথিবী একটি বল [গোলক]-এর ন্যায়। সে বলল, এটা এই ঘটনা দ্বারা বুঝা যায় যে, পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে একই সময়ে সূর্য,চাঁদ, নক্ষত্র অস্ত যায় না; বরং প্রাচ্যে পাশ্চাত্যের আগেই সূর্য অস্ত যায়।
[ মাজমু’ আল-ফাতাওয়া ২৫\১৯৫]
আল্লাহ অধিক জানেন।
মুসলিম বিজ্ঞানী আল বিরুনী তৎকালীন খলীফা-র নির্দেশে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ মাপেন। সমতল পৃথিবীর ব্যাসার্ধ কি মাপা সম্ভব? বিশেষ করে, আল বিরুনী নিচের পদ্ধতি অবলম্বন করলে, নিশ্চয়ই সমতল পৃথিবীর ব্যাসার্ধ মাপা যেতো না।
সম্ভাব্য অপযুক্তি
# ইবনে তাইমিয়া গ্রীকদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।
জবাবঃ সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী [রাহঃ] তার ‘ইসলামী জীবন ব্যবস্থা’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে, ইবনে তাইমিয়া তার সমকালীন যুগে তাফসীরকে গ্রীকদের প্রভাব থেকে রক্ষা করেছিলেন। আমার কথা হল, যেহেতু ইবনে তাইমিয়াকে মুসলিমরা একারনে স্মরণ করে যে, তিনি গ্রীকদের প্রভাব থেকে ইসলামকে বাচিয়েছেন, সেহেতু রক্ষাকারী নিজেই শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয় কি করে? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? সারা পৃথিবী ইসলামের বিপক্ষে চলে যাবে, কিন্তু ইবনে তাইমিয়া একা ইসলামের পতাকা উড্ডীন রাখবেন। এটা হল ইবনে তাইমিয়া। কখনও মিথ্যার ধার ধারেন না, আর কোথাকার গ্রীকদের কোন মূল্য তার কাছে নেই। আর ইবনে হাযম ও আবু ইয়ালা সম্পর্কে কি বলবেন? তারাও গ্রীক প্রভাবিত? অপযুক্তি আর কাকে বলে! আল্লামা জালাল উদ্দীন সূয়ুতি [রাহঃ] এর পূর্বে, মানে ৯১১ হিজরীর আগে কেউ পৃথিবী সমতল বলেছেন কিনা সন্দেহ।
তিনি (ইমাম ইবনে তাইমিয়া) গ্রীকদের বিরোধিতা করতেন এর প্রমাণ হল, ইবনে তাইমিয়া [রাহঃ] তার অসাধারণ রচনা ‘আল রিসালা আল আরশিয়াহ‘ গ্রন্থে নব্য-প্লেটোবাদী দার্শনিকদের যারা আল্লাহর আরশ নবম আকাশের গোলকে রয়েছে দাবি করে, তাদের প্রত্যাখ্যান করেছেন। [মাজমু আল-ফাতওয়া, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃঃ ৫৪৬] ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাহ:) রচিত কিতাবের ইংরেজি অনুবাদ Against Greek Logicians শিরোনামে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছে। মোটকথা, উল্লিখিত সালাফদের ব্যাপারে গ্রীক প্রভাবিত তকমা দেয়া, নির্জলা অপবাদ ব্যতীত কিছুই নয়।
আরও পড়ুনঃ পৃথিবী গোলাকার হওয়ার ব্যাপারে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের প্রমাণ