আল জাহিজ বনাম ডারউইন
লিখেছেন: ' Mahir' @ বুধবার, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২০ (৩:৪০ অপরাহ্ণ)
সদালাপ ব্লগের আলী মোর্শেদ ভাই লিখেছিলেন, “যুক্তিবাদ এবং বিজ্ঞান-মনষ্কতার দাবিদার তথাকথিত মুক্তমনাদের ভণ্ডামির আরেকটি অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে তাদের বিজ্ঞান-আলোচনার দৌড় বিবর্তনবাদ তথা ডারউইনবাদ পর্যন্ত, যেমন অনেকে উপহাস করে বলে থাকে মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। এই ভণ্ডামি প্রকাশের নমুনা হচ্ছে যে, তারা প্রতিবছর ঘটা করে ডারউইন দিবস, ডারউইনের জন্মদিন, ইত্যাদি পালন করে থাকে অথচ তাদেরকে নিউটন দিবস, আইনস্টাইন দিবস, গ্যালিলিও দিবস ইত্যাদি বা তাদের জন্মদিন পালন করতে দেখা যায় না। এর কারণ হিসেবে মনে হয়, এই ভণ্ড বিজ্ঞান-মনাদের কাছে বিজ্ঞান মানেই বিবর্তনবাদ বা ডারউইনিজম আর ডারউইনিজম মানেই বিজ্ঞান। তাদের এহেন কাজ-কারবার দেখে মনে হয় যেন ডারউইনবাদকে তারা ধর্মের পর্যায়ে উন্নীত করে ফেলেছে এবং ডারউইনকে এই ধর্মের দেবতা বা নবীর আসনে বসিয়েছে”।
সম্প্রতি তারা তাদের নবীর সমর্থনে মুসলিম মনীষীদের ব্যবহার করা শুরু করেছে। তারা দাবি করছে যে, মুসলিম মনীষীরা বিবর্তনবাদের পক্ষে ছিল। ইংরেজিতে এসকল দাবি আমরা প্রায়ই দেখে থাকি। কিন্তু বাংলাদেশে এই নব্য ফিতনার অনুবাদ সম্ভবত বিবিসি প্রথম করেছে। [i] মূল ইংরেজি বিবিসি সাইটে আমি তাদের নিবন্ধের ইংরেজি ব্লগ পাই নি।
যাই হোক, একথা অনস্বীকার্য যে, ইসলামের স্বর্ণযুগে বিশ্বের সকল উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার মুসলিম বিজ্ঞানীরা করেছেন। তারা বিজ্ঞানের মূল ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন। আর আজকে আমাদের তৈরি করা ভিত্তির উপর অবিশ্বাসীরা নিজেদের জন্য দালান আর আমাদের জন্য কবর নির্মাণ করে চলেছে। আর কোন রূপ কারন অনুসন্ধান ব্যতীত, আমাদের কপালে পশ্চাৎপদ সিল মেরে দিচ্ছে। বিজ্ঞান গবেষণা করা অশেষ নেকীর কাজ। ইমাম নববী [রাহ.] তার ‘রিয়াযুস সালিহীন’ কিতাবের প্রথম অধ্যায়ের নবম অনুচ্ছেদ একটি অনুচ্ছেদের শিরোনাম দিয়েছেন, “আল্লাহ তা‘আলার বিশাল সৃষ্টিজগৎ… এবং ইহ-পরকালের বিষয়াদি নিয়ে… চিন্তা-ভাবনা করার গুরুত্ব”। মুসলিম বিজ্ঞানীরাও সওয়াবের নিয়তে বিজ্ঞান গবেষণা করতেন।
মুসলিমদের বুদ্ধিমত্তা অতীতে যেমন ছিল, এখনও তেমন-ই আছে। আমার থিসিস সুপারভাইজার আমাদের বলেন যে, ‘আমরা বাইরের দেশে পড়েছি; ওদের সাথে উঠা-বসা করেছি; এমনকি ওদের পড়িয়েছি। কখনও মনে করবে না যে, তুমি ওদের চেয়ে কম জানো। বরং ওরা তোমাদের চেয়ে কম জানে। ওদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম পরীক্ষাতেও ত্রিকোণমিতির সূত্র আলাদা কাগজে লিখে দিতে হয়। নইলে অংক করতে পারে না”। আমাদের আরেক প্রফেসর একদিন বলেছিলেন, “আমাদের ছেলেরা বেশি দূর পড়াশোনা করতে পারে না, কারন আমরা গরীব। আমাদের কোন মতে পাস করে পরিবার সামলাতে চাকরি খুঁজতে হয়”। একজন আলিম উপমা দিয়েছিলেন যে, মুসলিমরা হল দৌড় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ঐ দৌড়বিদ যার হাত পেছন থেকে বাধা।
তো আল জাহিজ রচিত ‘কিতাব আল হায়াওয়ান’ বইটি বিবর্তনের পক্ষে যায় বলে দাবি করা হয়েছে। আমি মনে করি, এই দাবি সম্পূর্ণ ভুল। কারন “বিবর্তন” শব্দটি সঠিকভাবে এবং ধারাবাহিকভাবে ব্যবহার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিবর্তনবাদীরা ‘বিবর্তন’ দ্বারা বুঝাতে চান যে, কোন বুদ্ধিমান সত্ত্বার হস্তক্ষেপ ছাড়া-ই অনু-পরমাণু নিজে থেকে একত্র হয়েছে এবং সময়ের সাথে সাথে মানুষে পরিণত হয়েছে। বিবর্তনবাদী কের্কুট এই “সাধারণ বিবর্তন তত্ত্ব” (জিটিই)-এর সংজ্ঞা নিয়ে বলেন, “general theory of evolution” (GTE) as “the theory that all the living forms in the world have arisen from a single source which itself came from an inorganic form… The evidence which supports this is not sufficiently strong to allow us to consider it as anything more than a working hypothesis”. অর্থাৎ, “বিশ্বব্যাপী সমস্ত জীবিত জীবগুলি এমন একক উত্স থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যা নিজেই একটি অজৈব উপাদান থেকে এসেছে… এই তত্ত্বকে সমর্থনকারী প্রমাণ এতটা শক্তিশালী নয় যে তত্ত্বটিকে নির্মাণাধীন [অপূর্ণাঙ্গ] অনুমান ছাড়া অন্য কিছু বিবেচনা করা যায় না”।
কিন্তু আল জাহিজ তার বইয়ের কোথাও অজৈব পদার্থের প্রাণ লাভের কথা উল্লেখ করেন নি। সর্বপ্রথম প্রজাতির উদ্ভব নিয়ে তিনি কোন আলোচনা করেন নি। তবে ডারউইনের আগেই তিনি প্রজাতির বেঁচে থাকার সংগ্রাম [প্রাকৃতিক নির্বাচন] এবং প্রজাতির পরিবর্তন বা বিবর্তন [মাইক্রো নাকি ম্যাক্রো জানা যায় নি] নিয়ে আলোচনা করেছিলেন।
প্রাকৃতিক নির্বাচনে আল্লাহর হস্তক্ষেপ আছে বলে আল-জাহিজ মন্তব্য করেছেন। [ii]
তাছাড়া আল জাহিজ এই কথাও বলেন নি যে, বুদ্ধিমান সত্ত্বার হস্তক্ষেপ ছাড়া-ই প্রজাতির পরির্তন হয়েছে। বরং তিনি আল্লাহ-র অস্তিত্বের কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন, “All small animals eat smaller ones; and all big animals cannot eat bigger ones… God makes cause of some bodies life from some bodies’ death and vice versa”, মানে, ছোট প্রাণী আরো ক্ষুদ্র প্রাণী খায়; এবং সকল বড় প্রাণী আরেকটি বৃহত্তর প্রাণীকে খেতে পারে না… আল্লাহ কিছু প্রাণীর মৃত্যুর দ্বারা কিছু প্রাণীর জীবন বাঁচান ও তার বিপরীত করেন”। [iii] তিনি লিখেছেন যে, বিভিন্ন কারনে প্রজাতি বিবর্তিত হয়, যার একটি কারন হল ‘আল্লাহ’। [iv]
মোট কথা, তিনি উদ্দেশ্যহীন পরিবর্তন [মিউটেশন] ও অজীবজনি নিয়ে কিছু বলেন নি। যেহেতু তিনি অজীবজনি নিয়ে কিছু বলেন নি, আর তিনি মুমিন। সেহেতু আমার মন্তব্য হচ্ছে, তিনি এক প্রকারের Theistic Design তত্ত্বের প্রবক্তা ছিলেন। আমি তাকে Theistic Evolutionist বলতাম, যদি তার পূর্বে কেউ অজীবজনির ধারনা দিত, আর তিনি তা মৌনভাবে হলেও সমর্থন করতেন।
theistic design বলার কারন হল, তিনি মনে করতেন, চতুষ্পদ (তার দেয়া উদাহরণ হল: কুকুর,নেকড়ে শিয়াল) প্রাণীর আগমন হয়েছে একই প্রাণী আল-মিস্ক থেকে। কিন্তু আল-মিস্ক কোথা থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে সেটা তিনি বলেন নি। একথা বলেন নি যে, মিস্ক এসেছে অন্য আরেক প্রাচীন প্রাণী থেকে, সেটি আবার আগের আরেকটি প্রাণী থেকে এসেছে। সহজে-ই অনুমান করা যায় যে, তিনি আল-মিস্ককে প্রথম সৃষ্ট জীবের প্রকৃত রূপ মনে করতেন। তিনি লিখেছেন, “People said different things about the existenee of al-miskh (= original form of quadrupeds). Some acceptcd its evolution and said that it gave existence to dog, wolf, fox and their similars. The members of this family came from this form (al-miskh).” [v]
তার ধারনা ভূমিকম্প ও বন্যার কারনে প্রথম প্রকৃত রূপ আল-মিসক বিলুপ্ত হয়ে গেছে। [vi]
তিনি বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের শারীরিক গঠনের পার্থক্যের জন্য ভূপ্রকৃতিকে দায়ী করেছেন। তিনি দাবি করেছেন যে, পরিবেশের প্রভাবে মানুষ কিছুটা আল-মাস্কে পরিণত হচ্ছে। আল-মাস্ক শব্দের প্রকৃত অর্থ ‘ব্যক্তির বাহ্যিক গড়নে পরিবর্তন ‘। মানুষের বানর ও শূকরে পরিণত হওয়া নিয়ে কুরআন-হাদিসে এই শব্দ বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে। [vii] [ বিস্তারিত] আল-মাস্খ শব্দটি নেতিবাচক অর্থ প্রকাশ করে। যেমনঃ distort, disfigure। অর্থাৎ এমন পরিবর্তন বুঝায়, যা খারাপ। আমার মতে, আল-মাস্খ শব্দটি devolution অর্থে মিউটেশন শব্দের সমার্থক।
আল জাহিজ মনে করতেন যে,পরিবেশের প্রভাবে মানুষের মুখ কিছুটা বানরের মত হয়ে যেতে পারে, অথবা নাক শূকরের মত হয়ে যেতে পারে। কিন্তু বানর এক সময়ে মানুষ হয়ে যেতে পারে, এটা তিনি বলেন নি।কারন হিসাবে সহজে অনুমান করা যায়, তিনি মানুষকে প্রথম প্রকৃত জীব মনে করতেন। আর তিনি একথাও বলেন নি যে, মানুষ বানর জাতীয় প্রাণী থেকে এসেছে।
Without doubt, we have seen that some nabatheen navigators resembled the ape in some geographical environment, likely we have also seen some’ people from Morocco and have found, them as like as aI-maskh, except for a little difference.. . And it is possible that the polluted air and water, and dust made this change in the character of these Moroccans. .. if this effect goes on more and more in them, those changes in their bristles, ears, colours, and form (similar to the ape) increase more … “ [viii]
সুতরাং, আল জাহিজ মূলত আধুনিক ‘নিপুণ নকশা’ তত্ত্বের প্রবর্তক।
পড়ুনঃ নেকড়ে কিভাবে কুকুর হল?
[i] BBC News বাংলা. (2019). ডারউইনের বহু আগে মুসলিম বিজ্ঞানীর মুখে বিবর্তনবাদ. [online] Available at: https://www.bbc.com/bengali/news-47426938 [Accessed 10 Mar. 2019].
[ii] Conrad LI. Ṭā‘ūnand Wabā’: conceptions of plague and pestilence in early Islam. Journal of the Economic and Social History of the Orient. 1982;25:268–307. http://doi.org/c9bgv8. Bayrakdar M. Al-Jahiz and the rise of biological evolutionism. Islamic Quarterly. 1983;27:149–55
[iii] al jahiz, kitab hayawan, Cairo, 1909,, Vol. VI, pp. 133-134
[iv] al jahiz, kitab hayawan, Cairo, 1909, Vol. VI, pp. 24-25
[v] খন্ড ৪;পৃ:২৩
[vi] al:Jahiz, op. cit., vol. IV, p. 24; cf. vol. VII, p. 77
[vii] মা‘রেফুল কুরআন, ১ম খন্ড;২৩৩ পৃ.
[viii] Vol. IV, p. 2’1; und cf. vol. IV, pp. 25-27.