ফিকাহ শাস্ত্রবিদদের ব্যবহারে ‘সুন্নাহর’ সংজ্ঞা
লিখেছেন: ' মেরিনার' @ শুক্রবার, ডিসেম্বর ১৮, ২০০৯ (১২:২৪ অপরাহ্ণ)
[আমরা দেখবো কিভাবে স্কলারভেদে সুন্নাহর সংজ্ঞা পরিবর্তিত হয়। ফিকাহ শাস্ত্রবিদ, হাদীসের স্কলার, ইসলামী আইনতত্ত্ববিদ বা উসূলি এবং আক্বীদাহ্ বিশেষজ্ঞ - এই চার শ্রেণীর স্কলাররা যে ভাবে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় সুন্নাহর সংজ্ঞা দিয়ে থাকেন, তার সবক'টির সাথে পরিচিত না হয়ে, সুন্নাহ সম্বন্ধে কথা বলতে গিয়ে আমরা অনেক সময়েই বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়াই! ]
ফিকাহ শাস্ত্রবিদদের ব্যবহারে ‘সুন্নাহর’ সংজ্ঞা
এখানে আমরা দ্বীনী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় প্রাপ্ত সুন্নাহর যত সংজ্ঞার কথা আলোচনা করবো তার মাঝে, ফিকাহ শাস্ত্রবিদরা যে অর্থে ‘সুন্নাহ’ শব্দটিকে ব্যবহার করে থাকেন, সেটাই আভিধানিক অর্থে ‘সুন্নাহ’ শব্দটির সবচেয়ে নিকটবর্তী। তবে ‘সুন্নাহ’ শব্দটির এই ব্যবহার অর্থাৎ ‘প্রশংসনীয় এক কর্মপদ্ধতি’ এই অর্থে এর ব্যবহার, আসলে বিভ্রান্তির এক উৎসে পরিণত হয়েছে।
[ইসলামিক আইনের একটা উৎস হিসাবেও ফিকাহ শাস্ত্রবিদরা ‘সুন্নাহ’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন। এরকমটা যখন করা হয়, তখন আসলে উসুলিরা (অর্থাৎ ইসলামী আইনতত্ত্ববিদরা) যে অর্থে শব্দটি ব্যবহার করেন, তাদের কাছ থেকে সে অর্থটা তখন ধার নেয়া হয়। আমরা এই পর্যায়ে কেবল ফিকাহ শাস্ত্রবিদদের বা ফক্বীহদের নিজস্ব জগতে সুন্নাহ শব্দটির যে সংজ্ঞা রয়েছে, সেটা নিয়ে আলাপ করবো ।]
বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ফিকাহ শাস্ত্রবিদরা কোন একটা সুনির্দিষ্ট কাজের ফতোয়া নিয়ে গবেষণা করে থাকেন। সাধারণ ভাবে যে কোন কাজকে নিম্নলিখিত পাঁচটি শ্রেণীর একটিতে ফেলা হয়: অবশ্যকরণীয় , পছন্দনীয়, অনুমোদিত , অপছন্দনীয় ও নিষিদ্ধ। এছাড়াও যে কোন কাজ শুদ্ধ ও সিদ্ধ অথবা পরিত্যাজ্য ও অকার্যকর হতে পারে ।
পছন্দনীয় কাজ বোঝাতে স্কলাররা অগনিত শব্দ ব্যবহার করে থাকেন। সে সব শব্দের মাঝে “মানদুব” ও “মুসতাহাব” এর মত শব্দগুলো রয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে প্রতিটি শব্দের সামান্য ভিন্ন অর্থ রয়েছে। তবে নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় শ্রেনীর কর্মকান্ড বোঝাতে সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত অভিব্যক্তির একটি হচ্ছে ‘সুন্নাহ’। সুতরাং ,উদাহরণস্বরূপ ফকীহরা বলবেন যে, ফজরের ফরজ সালাতের আগে দুই রাকাত সালাত হচ্ছে ‘সুন্নাহ’! এর অর্থ হচ্ছে এই যে, “ঐ দুই রাকাত সালাত ফরজ বা অবশ্য করণীয় নয়। তথাপি তাদের মর্যাদা বা পুরস্কার এমন এক পর্যায়ের যে তা তাদেরকে নিছক অনুমোদিত কাজের চেয়ে অধিকতর মর্যাদা সম্পন্ন অবস্থান দেয়।”
সাধারণ ভাবে ফিকহশাস্ত্রবিদরা এ সমন্ত কর্মকান্ড যেগুলোকে তারা ‘পছন্দনীয় ’ বা ‘সুন্নাহ’ বলে অভিহিত করে থাকেন , সেগুলোকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করে থাকেন , যেমন:
১)’সুন্নাহ’, হচ্ছে এমন একটি কাজ, যা সম্পাদন করাটা আইন দ্বারা উৎসাহিত করা হয়; তবুও আইন সেগুলোকে অবশ্যকরণীয় বা প্রয়োজনীয় বলে ঘোষণা করে না।
২)একটা ‘সুন্নাহ’কাজ হচ্ছে এমন একটা কাজ, যা সম্পাদন করলে কোন ব্যক্তি পুরস্কৃত হবে, কিন্তু যা করতে ব্যর্থ হলে সে শাস্তি পাবে না অথবা অন্য কথায় বলতে গেলে, সে যদি কাজটা না করে সেজন্য তাকে দোষারোপ বা নিন্দা করা যাবে না। উত্তর আফ্রিকার মালিকী ও হাম্বালীদের মাঝে এটা হচ্ছে, সুন্নাহর একটা বহুল প্রচলিত সংজ্ঞা ।
৩)‘সুন্নাহ’ কাজ হচেছ এমন একটা কাজ, যা সম্পাদন করতে কউকে অনুরোধ করা হয়, কিন্তু জোর দিয়ে বলা হয় না – পূর্বঞ্চলীয় (উত্তর আফ্রিকা ছাড়া বাকী অঞ্চলের) মালিকী এবং শাফিঈদের মাঝে সুন্নাহার এই সংজ্ঞা প্রচলিত।
৪)একটা সুন্নাহ কাজ হচ্ছে এমন একটা কাজ যা রাসূল (সা.) লাগাতার ভাবে সম্পাদন করেছেন – যদিও কখনো কখনো তিনি দৃশ্যত কোন কারণ ছাড়াই সে গুলো করা থেকে বিরত থেকেছেন। হানাফীরা এই সংজ্ঞাটি দিয়ে থাকেন। [হানাফীরা অবশ্য এই শ্রেণীর সুন্নাহকে সুন্নাতে গায়ের মুয়াক্কাদা বলে থাকেন ।]
এই ধরণের সংজ্ঞাগুলোকে মনে হয় ফিকাহ শাস্ত্রবিদরা সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত আইনী সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন । তবে একটা সাধারণ ধারণা দিতে কাউকে হয়তো আইনী সংজ্ঞার কড়াকড়ির গন্ডি ছাড়িয়ে যেতে হতে পারে । সম্ভবত “পছন্দনীয়” কর্মকান্ডগুলিকে এমন সব কর্মকান্ড বলে বর্ণণা করা উচিত, যেগুলো সমাধা করলে কেউ একজন পরিপূর্ণ মুসলিম হবে এবং যে কেউ যদি তার ইসলামকে ও ঈমানকে সম্পূর্ণ করতে চায় তবে ঐ কাজগুলোকে বেশী বেশী সমাধা করবে – সেগুলোকে ফরজ কাজের মর্যাদা দান না করেই। উপরন্ত এটা কখনোই ভুললে চলবে না যে, ‘সুন্নাহ’ কাজগুলো নিশ্চিতই আল্লাহর কাছে প্রিয় এবং সেগুলো আল্লাহর নিকটবর্তী হবার একটা উপায়।
ঐ সমস্ত কাজ যে গুলোকে কেবল পছন্দনীয় বা ‘সুন্নাহ’ বলে মনে করা হয় সেগুলোর ব্যাপারে আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখা উচিত। যুমাইরিয়া বলেন :
“ফিকাহ শাস্ত্রবিদদের ব্যবহারে ‘সুন্নাহ’ বলে যা কিছুকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে কেউ কেউ ঢিলে ঢালা মনোভাব পোষণ করেন । তাদের ঢিলে ঢালা মনোভাব এই দাবীর উপর প্রতিষ্ঠিত যে, ‘সুন্নাহ’ কাজ হচ্ছে সে সব কাজগুলো যেগুলোকরার জন্য যে কেউ পুরস্কৃত হবে অথচ না করার জন্য কেউ শাস্তি লাভ করবে না । একই সময়ে স্কলাররা এমন বহু হাদীস, যেগুলো যে কাউকে সুন্নাহর অনুসরণ করতে ও সেগুলোর সাথে লেগে থাকতে উৎসাহিত করে, সেগুলোর উপর ভিত্তি করে বলেছেন যে, যে কেউ যদি প্রথাগত ভাবে সুন্নাহর কর্মকান্ডগুলি পরিত্যাগ করে , তবে সে সেজন্য শান্তি প্রাপ্ত হবে। সে ভুল করছে এবং একটা পাপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে। সাহাবীগণ আগ্রহভরে ঐ সমস্ত কাজ সমাধা করতেন , যেমন ভাবে তারা অবশ্যকরণীয় কাজ গুলো করতেন – আল-লাখনোয়ী তার “তুহফা আল আখইয়ার” বইতে এ ব্যাপারে বেশ কিছু উদ্ধৃতি দিয়েছেন। ফিকাহশাস্ত্রবিদরা যে অবশ্যকরণীয় ও সুন্নাহ ভিতর পাথর্ক্য করে থাকেন, সেটা সুনিদিষ্ট ঘটনার বেলায় প্রযোজ্য – কিন্তু সুন্নাহর কর্মকান্ডকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করার বেলায় প্রযোজ্য নয়।”
ফিকাহশাস্ত্রবিদদের মাঝে সুন্নাহর আরেকটি প্রচলিত ব্যবহার হচ্ছে, নব্য-প্রথা বা বিদ’আতের বিপরিতে সুন্নাহকে উল্লেখ করা। এই অর্থে সুন্নাহ বলতে এমন যে কোন কিছু বোঝানো যেতে পারে যা শরীয়াহ দ্বারা অনুমোদিত, সেক্ষেত্রে যা কিছু কুর’আন, রাসূল (সা.)-এঁর কর্মকান্ড অথবা এমনকি সাহাবীদের সামষ্টিক কর্মকান্ড থেকে গৃহীত – এ সব কিছুই সুন্নাহর ভিতর অর্ন্তভুক্ত হবে । উদাহরণস্বরূপ ফিকাহ শাস্ত্রবিদরা একটা বিবাহ বিচ্ছেদকে তালাক আস-সুন্নাহ বলে অভিহিত করতে পারেন, যার অর্থ দাঁড়াবে সুন্নাহ মোতাবেক বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটেছে । যার বিপরীতে যেটা সম্পূর্ণরূপে সুন্নাহ মোতাবেক হয়নি, সেটাকে তারা তালাক আল-বিদ’আহ বলে অভিহিত করবেন। কখনো কখনো একটা কাজ সম্পূর্ণরূপে সুন্নাহ মোতাবেক করা না হয়ে থাকলেও সেটা আইনত সিদ্ধ বলে বিবেচিত হয়, কিন্তু সেই কাজ করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সঠিক পন্থা অবলন্বন না করে একটা ভুল করেছে বলেই বিবেচিত হবে। আর সেজন্য তারা দুই ধরণের কাজের ভিতর পাথর্ক্য করে থাকেন।
[Page10~14, The Authority and Importance of Sunnah - Jamaal al-Din M. Zarabozo থেকে অনুদিত।]
জাজাকাল্লাহ
ধন্যবাদ। অনেক কিছু শিখতে পারলাম।
ধন্যবাদ। অনেক কিছু শিখতে পারলাম।Go ahead.
সুন্নাহ্ সম্পর্কে অনেক কিছু জানা গেল।
লেখককে ধন্যবাদ।