আক্বীদাহ্ বিশেষজ্ঞদের মতে “সুন্নাহ্” শব্দটির সংজ্ঞা
লিখেছেন: ' মেরিনার' @ রবিবার, জানুয়ারি ৩, ২০১০ (১২:৪৯ পূর্বাহ্ণ)
[আমরা দেখবো কিভাবে স্কলারভেদে সুন্নাহর সংজ্ঞা পরিবর্তিত হয়। ফিকাহ শাস্ত্রবিদ, হাদীসের স্কলার, ইসলামী আইনতত্ত্ববিদ বা উসূলি এবং আক্বীদাহ্ বিশেষজ্ঞ - এই চার শ্রেণীর স্কলাররা যে ভাবে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় সুন্নাহর সংজ্ঞা দিয়ে থাকেন, তার সবক'টির সাথে পরিচিত না হয়ে, সুন্নাহ সম্বন্ধে কথা বলতে গিয়ে আমরা অনেক সময়েই বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়াই।
এই লেখাটি সঠিকভাবে বুঝতে হলে এই সিরিজের আগের লেখাগুলো পড়া আবশ্যক!!
আক্বীদাহ্ বিশেষজ্ঞদের মতে "সুন্নাহ্” শব্দটির সংজ্ঞা
হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর প্রাক্কালে আক্বীদার (বিশ্বাস ও ঈমান বিষয়ক) বিশেষজ্ঞরা "সুন্নাহ” শব্দটিকে ঈমানের ভিত্তি বা বিষয়াবলী, সুপ্রতিষ্ঠিত বা অবশ্যকরণীয় কাজ, যে সমস্ত বিষয়ে বিশ্বাস আনতে হবে সেসব এবং ইসলামের সুনিদিষ্ট বিধান ইত্যাদি বোঝাতে ব্যবহার করতে শুরু করেন ৷ এই অভিব্যক্তি, অর্থাৎ "সুন্নাহর” এই ব্যবহার, ইসলামের ভিতর উপদলের সংখ্যা যত বৃদ্ধি পেতে শুরু করলো, ততই জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকলো ৷ কোন কোন স্কলার নতুন নতুন উৎপথগামী উপদল গুলোর ভ্রান্ত বিশ্বাস থেকে ঈমানের বিষয়গুলোকে পৃথক করে দেখাতে এবং সেগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করতে "সুন্নাহ” শব্দটিকে ব্যবহার করতেন ৷ ইবনে রজব বলেন: "পরবর্তী সময়ের অনেক স্কলারই (প্রথম দুই তিন প্রজস্মের পরবর্তী সময়ের), নিদিষ্টভাবে, যা কিছু (সঠিক) বিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ত তা বোঝাতে, ‘সুন্নাহ’ শব্দটি ব্যবহার করতেন ৷ কেননা, সেটাই হচ্ছে দ্বীনের ভিত্তি এবং যে কেউ যখন সেটার বিরোধিতা করে, তখন সে একটা বিপজ্জনক অবস্থানে রয়েছে৷”
কেউ কেউ "সুন্নাহ" শব্দটিকে খুব সমন্বিত অর্থবহ একটা উপায়ে ব্যবহার করেছেন, যেন, ঈমানের সকল আবশ্যক উপাদানগুলো এর মাঝে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় - এই ব্যবহারটা গ্রহণযোগ্য, কেননা যা কিছু ঈমানের উপাদান বা যা কিছু দিয়ে ঈমান গঠিত, তার সবকিছুই রাসূল (সা.) নিজে বিশ্বাস করেছেন, অনুশীলন করেছেন অথবা প্রচার করেছেন ৷ উদাহরণ স্বরূপ কেউ কেউ এভাবে সুন্নাহর সংজ্ঞা দিয়ে থাকেন: "রাসূল (সা.) এবং তাঁর সাহাবীগণ যে হেদায়েতের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন ( তার সবকিছুই জ্ঞান, বিশ্বাস, উক্তি বা বক্তব্য এবং কার্যকলাপ ) ৷"
এই সংজ্ঞা অনুযায়ী সাহাবীদের আমল ও বিশ্বাসকে সুন্নাহর অংশ বলে গণ্য করা হয়, কেননা নবী (সা.) তাঁদেরকে যে পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁরা সেটাই অনুসরণ করতেন - এই ব্যাপারটা পরবর্তী প্রজন্মগুলোর কিছু মানুষদের বৈশিষ্ট্যের চেয়ে আলাদা, যারা রাসূলের(সা.) পদ্ধতির বিরম্নদ্ধে গিয়ে তাদের নিজস্ব পদ্ধতিসমূহ উদ্ভাবন করেছিলেন ৷
আক্বীদাহ বিশেজ্ঞদের জন্য কখনো কখনো "সুন্নাহ” শব্দটি উৎপথগামীতা বা বিদ’আতের বিপরীত হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে ৷ এরকম ক্ষেত্রে কেউ বলে যে, "অমুক মানুষটি সুন্নাহর উপর রয়েছে (অথবা সুন্নাহ অনুসরণ করছে)৷” - তখন এর অর্থ দাঁড়ায় এরকম যে বিশ্বাস , সাধারণ ভাবে পদ্ধতি ও আচরণের নিরিখে সংশিৱষ্ট ব্যক্তিটি রাসূল (সা.) যে পন্থা প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন এবং তাঁর সাহাবী ও তাঁদের অনুসারীদের জন্য রেখে গেছেন, সেটিই অনুসরণ করে চলেছেন ৷ আবার একথাটা মনে রাখা গুরম্নত্বপূর্ণ যে, এভাবে যখন "সুন্নাহ” শব্দটি ব্যবহৃত হয়, তখন সাহাবীরা রাসূল (সা.)-এঁর কাছ থেকে যা সরাসরি শিখেছিলেন, তার ধারাবাহিকতা হিসাবে যে জীবনযাত্রা ও বিশ্বাস তাঁরা জীবনে ধারণ করেছিলেন, তার সবকিছুকেই বোঝায় [তার সবকিছুকেই অন্তর্ভুক্ত করে] ৷ কোন ব্যক্তি যদি দ্বীনের উপলদ্ধি ও অনুসরণের বেলায় সাহাবীদের পথ অনুসরণ করতে অস্বীকার করে, তবে সে কার্যত সুন্নাহ থেকেই মুখ ফিরিয়ে নিলো৷
অপরপক্ষে যখন কেউ বলে যে “অমুক বিদআতের উপর রয়েছে” তখন বুঝতে হবে যে, তার এমন কিছু বিশ্বাস বা পদ্ধতি রয়েছে, যা ইসলামের শুদ্ধ শিক্ষার পরিপস্থী ৷ যাঁরা রাসূল (সা.)-এঁর পথ অনুসরণ করেন তাঁরা আহলুস সুন্নাহ বা সুন্নাহর জনগোষ্ঠী বলে পরিচিত ৷ ঐসব মানুষ যারা অগণিত ভিন্ন পথ অনুসরণ করে থাকেন, তাদের “আহলুল বিদ’আহ” বা উৎপথগামী জনগোষ্ঠী বলে অভিহিত করা হয় ৷ সুতরাং “সুন্নাহ” অর্থ হচেছ দ্বীনের সঠিক বিশ্বাস ও উপলদ্ধি ৷ আবু আল কাসিম আল আসবাহানী বলেন, “কেউ সুন্নাহর উপর রয়েছেন অথবা কেউ আহলুস সুন্নাহ বলতে বোঝায় যে, তিনি ওহীর মাধ্যমে যা এসেছে এবং (সাহাবীও অন্যান্যদের কাছ থেকে) আমাদের কাছে যা হস্তান্তরিত হয়েছে, সেই সব কর্মকান্ড এবং বিশ্বাসের সাথে সঙ্গতির্পূণ অবস্থায় রয়েছেন ৷ এটা এজন্য যে, কেউ যখন আল্লাহর সাথে অসঙ্গতির্পূণ এবং তাঁর রাসূলের সাথে অসঙ্গতির্পূণ অবস্থায় থাকেন, তখন সম্ভবত সুন্নাহ তিরোহিত হয়৷”*
শাওয়াত উল্লেখ করেন যে, নিম্নলিখিত হাদীসটিতে “সুন্নাহ” কথাটি এই অর্থে ব্যবহৃত হয় ৷ এখানে রাসূল (সা.) বলেন, “যে সুন্নাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় ,সে আমার কেউ নয়৷”(বুখারী ও মুসলিম)
রাসূল (সা.) আরো বলেন: “নিশ্চিতই তোমাদের ভিতর যারা বেঁচে থাকবে, তারা অনেক বিভেদ দেখবে, সুতরাং আমার সুন্নাহ এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহর সাথে লেগে থেকো, তোমরা সেটাকে দাঁত দিয়ে কামড়ে থেকো ৷ এবং নতুন ভাবে উদ্ভাবিত বিষয়সমূহ এড়িয়ে চলবে ৷ নিশ্চিতই প্রতিটি উদ্ভাবনই হচেছ পথভ্রষ্টতা ৷” ( আহমাদ ,দাউদ, তিরমজী ,হিব্বান, আবি আমিন,আল-বায়হাকী, আল-হাকিম ইত্যাদিতে শব্দের সামান্য তারতম্য সহকারে লিপিবদ্ধ রয়েছে ৷ এ হাদীসটি সহীহ বলে গণ্যকরা হয় ৷)
ইসলামের প্রথম যুগের স্কলারদের অনেকের বক্তব্যেই সুন্নাহর এই অর্থটা ফুটে ওঠে ৷ উদাহরণ সরূপ আবদুলৱাহ ইবনে মাসউদ(রা.) বলেন, “সুন্নাহর অনুশীলনে কারো মধ্যপন্থী হওয়াটা বিদআতের উপর চরম বিশ্বস্ত হওয়ার চেয়ে শ্রেয়৷” মুহাম্মদ ইবনে শিহাব আল যুহরী বলেন, “আমাদের যেসব স্কলার গত হয়েছেন তাঁরা বলতেন ,‘সুন্নাহর সাথে লেগে থাকা হচেছ নাজাত লাভ৷‘ ”
প্রথম যুগের স্কলারদের কেউ কেউ সুন্নাহর এই সংজ্ঞাকে আরো এক ধাপ সামনে নিয়ে যান এবং রাসূল (সা.) যেসব দিক নির্দেশনা নিয়ে আসেন এবং সাহাবীদের কাছে হস্তান্তর করেন এবং সাহাবীরা যা পযায়ক্রমে তাঁদের অনুসারীদের কাছে হস্তান্তর করেন – তা দ্বীনের মৌলিক ব্যাপারই হোক বা নিদিষ্ট কোন বিষয়-সংশ্লিষ্ট ব্যপারেই হোক, তার সবকিছুর ব্যাপারেই তাঁরা ‘সুন্নাহ’ শব্দটি প্রয়োগ করতেন ৷ ‘সুন্নাহ’ হচ্ছে সিরাতুল মুস্তাকিম বা সরল পথ – এর সাধারণ ব্যাপারগুলো এবং বিস্তারিত সকল খুঁটিনাটি সমেত ৷ বাস্তবে এভাবে যখন “সুন্নাহ” শব্দটি ব্যবহার করা হয় তখন তা ইসলামের সমার্থক হয়ে যায় ৷ আল-আক্ল-এঁর মতে ইসলামের প্রথম যুগের স্কলারদের অনেকের উদ্ধৃতিতেই “সুন্নাহর” এই অর্থটা ফুটে উঠে যেমন, আবু বকর (রা.) থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়, “সুন্নাহ হচেছ আল্লাহর সুদৃঢ় হাতল ৷”
[Page22~26, The Authority and Importance of Sunnah - Jamaal al-Din M. Zarabozo থেকে অনুদিত।]
এই বিষয়ে আরো একটি খুবই সুন্দর বই পড়েছিলাম “ইসলামি শরীয়াহ ও সুন্নাহ” লেখক : মুস্তফা হোসেন সুবায়ী ।