মহান মালিকের কাছে চাইতে হয় কীভাবে
লিখেছেন: ' মাসরুর হাসান' @ শুক্রবার, নভেম্বর ১১, ২০১১ (২:১৪ অপরাহ্ণ)
মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমুদুল হাসান দা.বা.এর বয়ান
ربناظلمناانفسنا وان لم تغفرلناوترحمنالنكونن من الخاسرين এই দোয়া করে আদম আ. ক্ষমা পেয়েছেন। আদম আ. ربنا বলেছেনاللهم বা ربيবলেননি। ربنا শব্দে বহু বচন এনে পুরো মানবজাতিকে তিনি শামিল করেছেন। অন্যের জন্য দোয়া করলে দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি তাই তিনি এভাবে দোয়া করেছেন।
অন্যের জন্য দোয়া করার অতি উত্তম বিষয়টিতে বর্তমানে মন্দেও ছোয়া লেগেছে। যেমন, কাউকে খুশি করার জন্য তার নাম নিয়ে দোয়া করা, হাদিয়া পাওয়ার আশায় পেয়ে বড় করে দোয়া করা। ব্যংক, বীমা অন্যান্য সুদভিত্তিক কোম্পানী-সংস্থাসহ যে কোনো হারাম কারবারের দোকান, কারখানা ফ্যাক্টরির আয়-উন্নতির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা কেবল হারামই নয়। বরং মহান প্রতি পালকের সাথে এক প্রকার তামাশা করা হয় (নাউযুবিল্লাহ)। জেনেশুনে হারাম লাভ ও উন্নতির জন্য দোয়ার ভয়ংকর পরিণতির কথা আমরা বালআম বাউরার ঘটনা থেকে জানতে পারি। কুরআনে কারীমেই বর্ণিত আছে যে, বা’লাম বাউর হারাম কাজের জন্য দোয়া করেছিল,আল্লাহ তায়ালা তার করুণ পরিনতি দুনিয়াতে দেখিয়েছেন। যবান বন্ধ করে দিয়েছেন, জিভ বের করে ঝুলিয়ে রেখেছেন। আর আখেরাতে তো রয়েছে তার জন্য লাঞ্ছনাকর শাস্তি রয়েছেই।
একটু ভেবে দেখুন! দুনিয়ার এই জীবন ক’দিনর! অন্যের হারাম কারবারে লাভবান হওয়ার বিনিময়ে আমার আখেরাত কেন বরবাদ করবো!
জনৈক কবি বলেছেন,
سكنتك يادارالفناءمصدقا* بانني الي دارالبقاءاسير
অর্থঃ হে নস্বর জগত ! আমি তোমার কোলে থেকেও বিশ্বাস করছি, আমি স্থায়ী জগতের পথিক। মৃত্যু সবার জন্য অনিবার্য। একে ঠেকাবার ক্ষমতা নেই কারো। রাষ্ট্রক্ষমতায় ফেরাউন,অর্থক্ষমতায় কারুন, জ্ঞানের বলে আবু জাহেল,শক্তির বড়াইয়ে রোকানা; কেউ কি রেহাই পেয়েছে মৃত্যুর নির্দয় ছোবল থেকে? কুরআনে পাকে আল্লাহ বলছেন,
ياايهاالذين امنوااتقواالله حق تقاته
অর্থঃ হে মুমিনরা!তোমরা আল্লাহ তায়ালাকে যথাযথভাবে ভয় করো। আর রাসূল সা. বলছেন,
كن في الدنياكانك غريب اوعابرسبيل
অর্থঃ দুনিয়াতে এমনভাবে বসবাস করো যেন তুমি ভীনদেশী মুসাফির কিংবা রাস্তার একজন পথিক।
কবি বলেন,
فمااعظم في الامرصاير*الي عادل ليس في الحكم يجور
কী জবাব আছে তোমার! পরম ন্যায়পরায়ণ বিচারকের সামনে যখন দাঁড়াবে, যিনি এতটুকু জুলুমও করেন না!
ট্রেনে চলার পথে প্রতিটি স্টেশনে যেভাবে টিটির সম্মুখীন হতে হয়, তেমনি আমাদের গন্তব্য পথে অনেক স্টেশন আছে। মৃত্যু, কবর, হাশর ও পুলসিরাতের পারাপারেও টিটির সম্মুখীন হতে হবে। ছাড়পত্র কি সংগ্রহ করতে পেরেছি?
হযরত আবু সাইদ মুসিলি রহ.একবার হজের সফরে যাচ্ছিলেন। সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তার সাওয়ারি যখন একটা জনশূন্য এলাকা দিয়ে যাচ্ছিল, যেখানে প্রতিনিয়ত হিংশ্র জানোয়ারের ভয়; না আছে খাবার-দাবারের ব্যবস্থা না পানীয়। এমন ভয়ানক স্থানে তিনি দেখতে পেলেন একটা ছোট্ট ছেলে। মৌনভাব নিয়ে কোথা যেন যাচেছ, আবার বিলবিল করে কি যেন পড়ছে। কাছে গিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন- বাছা কোথায় যাচছ? সে উত্তর দিলো,
রবের (প্রতিপালকের) কাছে। ছোট্ট ছেলের অকপট উত্তর শুনে বিস্মিত হলেন আল্লামা মুসিুল রহ.। মুখের দিকে তাকিয়ে কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার ঠোট নাড়ছো কেন?: সে বললো আল্লাহর কিতাব পড়ছি।
আল্লাহর কিতাব পড়তে ঠোট নাড়তে হয়। নামাজের মধ্যে অনেকে মনে মনে তিলাওয়াত করে । এ রকম তিলাওয়াত দ্বারা নামাজ আদায় হবে না। ফোকাহায়ে কেরামের মতে এতটুকু জোড়ে পড়তে হবে যেন নিজের কানে শুনতে পায়। নিজকে শুনাতে গিয়ে অনেকে আবার ফিসফিস আওয়াজে পড়ে, যার দরুন অন্যদের নামাজের ক্ষতি হয়। আমি বলে থাকি, এমনভাবে স্পষ্ট উচ্চারণ করে পড়বে যেন নিজের কানে পঠিত বিষয়ে উপলব্ধি হয়। শুনতে পারা আবশ্যক নয়।
যা হোক মুসিলি রহ. বুঝলেন যে, ছেলেটি হজ্বের সফরে বের হয়েছে। প্রশ্ন করলেন তোমার সাওয়ারি কোথায়?
: দুই পা-ই যথেষ্ট।
: তোমার সফর সঙ্গী কে?
: আল্লাহ তায়ালাই উত্তম সঙ্গী।
: সঙ্গে খাবার তো কিছুই দেখছি না,খাও কোথায়?
: আমি তো আল্লাহর মেহমান;মেহমান হয়ে অন্যের খাবার গ্রহণ করা অভদ্রতা নয় কি?
: তুমি তো ছোট্ট,জীবনের এখনো অনেক সময় বাকি, হজ্বের জন্য এতটা উতলা হয়েছ কেন?
সেদিন দেখেছি আমার চেয়েও ছোট্ট এক ছেলে মারা গেছে। অতএব হায়াতের কী আর নিশ্চয়তা?
কবি বলেন,
ياصاحبي لاتغتربتنعم* فان العمرينفدوالنعيم يزول.
اذاحملت الي القبورجنازة* فاعلم بانك بعدهامحمول.
অর্থঃ দুনিয়ার স্বাচ্ছন্দ্যে তুমি প্রতারিত হয়ো না। একদিন বেলা ডুবে যাবে,হারিয়ে যাবে সুখের ছায়া। কবরে যখন জানাযা বহন করো মনে রেখো তোমাকেও এভাবে বহন করা হবে।
ياليتني كيف اقوم عندها* زادي قليل وذنوبي كثير.
فان اك مجزياعنده برحمة* فانني بشرالعقاب جدير.
অর্থঃ হায়! সেদিন কীভাবে দাঁড়াব আমি? আমার তো পাথেয় কম অপরাধ বেশি। কোন বিনিময় যদি পেয়ে যাই তাহলে এটা হবে তার পক্ষ হতে একান্ত করুণা। নতুবা আমি তো কঠোর শাস্থির উপযুক্ত।
اترجوان تكون رفيق قوم * لهم زادوانت غير زاد.
অর্থঃ তুমি তো এমন লোকদের সাথি হতে চাচ্ছ;যাদের পাথেয় আছে আর তুমি নিঃসম্বল।
আল্লাহ তায়ালা বলেন
فادخلي في عبادي وادخلي جنتي.
অর্থঃ আমার নেক বান্দাদের শামিল হও। আর জান্নাতি হয়ে যাও।
ইমাম শাফি রহ.এ আয়াতের মর্ম বুঝার পর মৃত্যু কামনা করতে শুরু করলেন । কারণ মারা গেলেই তো উত্তম সাথি পাওয়া যাবে, জান্নাতে যাওয়া যাবে।
মুুসিলি রহ.ছেলেটির বর্ণনায় ভীষণ হতবাক হলেন। বিস্ময় কেটে উঠতে আবছা চোখে যে-ই নিচের দিকে তাকালেন অমনি ছেলেটি উধাও। আর দেখা গেল না। এদিক-সেদিক দৌড়ে গেলেন কোথাও পাওয়া গেল না। দীর্ঘ একমাস সফর শেষে মুসিলি রহ. যখন বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করছেন হঠাৎ দেখতে পেলেন সেই ছোট্ট ছেলেটি। মুসতালযিমে দাঁড়িয়ে করুণ আর্তনাদ করে কাঁদছে। উপস্থিত লোকেরা ছেলেটার কাঁন্না দেখে ভেংগে পড়ছে। গায়েব থেকে তিনি শুনতে পেলেন, ছেলেটার দোয়ায় যারা আমিন বলবে তাদের দোয়াও কবুল করা হবে। বিলম্ব না করে তিনিও দোয়াতে শরিক হয়ে গেলেন। দোয়া শেষে জিজ্ঞেস করলেন, হে ছোট্ট! এত দুরের পথ পায়ে হেঁটে কবে এসেছ তুমি?
: যখন আপনার সাথে কথা বলেছি তখনই আল্লাহ তায়ালা আমাকে বাইতুল্লাহ শরীফে পৌঁছে দিয়েছেন। এটাকে সুফিদের ভাষায়“তাইয়ুল আরদ”বলা হয়। যার অর্থÑআল্লাহর পক্ষ হতে পৌঁছতে যমিনকে ছোট করে দেওয়া। কথিত আহলে হাদীসের লোকেরা তাইয়ুল আরদকে অস্বীকার করে। এটা তাদের না জানা, না পাওয়া ও নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। যে কখনো দুধ দেখেনি,মধু পান করেনি দুধ ও মধুর স^াদ সে কী করে বুঝবে? আল্লামা সুয়ূতী রহ:এর অতি ভক্ত একজন খুব দরিদ্র খাদেম ছিলো। সুয়ূতী রহ:হজ্বে যাচ্ছিলেন। সাময়িকভাবে শায়েখের অনুপস্থিতি ভক্তের জন্য অসম্ভব কষ্ট হচ্ছিল। হজ্বে যাওয়ার আগে সূয়ুতী রহ.ভক্তকে বললেন, চোখ বন্ধ করো। যখন খুলতে বলবো তখনই খুলবে। শায়খের নির্দেশ মতো চোখ বন্ধ করে যখন খুললো, দেখতে পেলো মক্কায় চলে এসেছে। হজ্ব শেষে চোখ বন্ধ করে আবার দেশে ফিরে এল। ভক্তকে বলে দিলেন কারো কাছে এ ঘটনা বলবেনা। একে বলে ‘তাইয়ুল আরদ’।
আলোচনা করছিলাম দোয়া সম্পর্কে। দোয়াতে অনুপস্থিত ব্যক্তিকে শামিল করে ব্যাপকভাবে দোয়া করা উত্তম। এর অর্থ এই নয় যে নিজের জন্য বা কারো নাম ধরে সীমাবদ্ধ দোয়া করা জায়েয নেই। একদা এক সাহাবী এভাবে দোয়া করলেন :
اللهم ارحمني ومحمداولاترحم معنااحدا
অর্থ: হে আল্লাহ!রহমতস্নাত কর আমাকে এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। অন্য কাউকে আমাদের সাথে শরিক করোনা। এই দোয়া শুনে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : لم تهجرت واسعا؟ ব্যাপকতা থেকে কেন বিরত থাকছো? বাস! এটুকুই বলেলন। সেই সাহাবীকে কোনরুপ বাধা নিষেধ করেননি। বুঝা গেল এধরনের সীমাবদ্ধ দোয়া জায়েয তবে অনুত্তম। ব্যাপকভাবে দোয়া করলে দু’টি লাভ ১/ অন্যের উপকার করে এই আয়াতের হুকুম বাস্তবায়ন :وتعاونواعلي البروالتقوي “নেক ও খোদাভীতির কাজে তোমরা একে অপরকে সহযোগীতা কর।” ২/খাছ করে দোয়া করলে গোনাহের কারণে ফিরিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে, পক্ষান্তরে আম দোয়া যে ধরনের দোয়াতে মুখলিস আল্লাহওয়ালাও থাকেন, তাদের সংশ্রব বৃথা যায় না, তাদের উসিলায় গোনাগারদের দোয়াও আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন। দোয়াতে এমন ব্যাপকতা আনা উচিত যেন পূর্ব পুরুষ আদম আ.পর্যন্ত শামিল হোন আবার কেয়ামত অবধি পরবর্তী প্রজন্ম যেন শামিল হয়ে যায়। যেমন ইবরাহিম আ. ছেলে ইসমাইলের জন্য দোয়া করেছেন এবং তার বংশের জন্য দোয়া করে বলেছেন :
অর্থ : পরওয়ারদেগার! আমাদের উভয়কে তোমার আজ্ঞাবহ কর এবং আমাদের বংশধর থেকেও একটি অনুগত দল সৃষ্টি কর, আমাদের হজ্বেও রীতিনীতি বলে দাও এবং আমাদের ক্ষমা কর। নিশ্চয় তুমি তওবা কবুলকারী, দয়ালু।
পরওয়ারদেগার! তাদের মধ্য থেকেই তাদের নিকট একজন পয়গম্বর প্রেরণ করুন। যিনি তাদের কাছে তোমার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করবেন, তাদেরকে কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দিবেন, এবং তাদের পবিত্র করবেন। নিশ্চয় তুমিই পরাক্রমশালী হেকমতওয়ালা। (সূরা বাকারা : ১২৮-১২৯)
সেই দোয়ার প্রতিফলই শ্রেষ্ঠনবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
অনুরূপ আদম আ.ও দোয়াতে ربنا (বহু বচন) ব্যবহার করে তাঁর পরবর্তী সব সন্তানদের জন্য দোয়া করে গেছেন। বোঝাগেল, ব্যাপকভাবে দোয়া করার প্রথম আদর্শ রেখেছেন হযরত আদম আ.। আল্লাহপাক আমাদেরকে নবীগণের আদর্শ অনুসরণ করে জীবনকে কামিয়াব করার তাওফীক দান করুন!
www.dawatul-haq.com