অস্থায়ী ক্ষমতার দম্ভ স্থায়ী জীবনের সর্বনাশ ডেকে আনে
লিখেছেন: ' মাসরুর হাসান' @ শনিবার, জুন ১৬, ২০১২ (২:৫১ অপরাহ্ণ)
মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমূদুল হাসান দা.বা.-এর বয়ান
স্থান : বারিধারা জামে মসজিদ, ঢাকা, তাং- ২০০৮ইং
اللهم صل علي محمد وعلي اله وسلم تسليما-استغفرالله ربي من كل ذنب واتوب اليه-لاحول ولا قوة الا بالله العلي الغظيم
জোর যার মু্ল্লুক তার
‘জোর যার মুল্লুক তার’ এই প্রবাদের সাথে আমরা খুবই পরিচিত। এই প্রবাদ যতটা না শুনি তার চেয়ে অনেক বেশি আমরা আমাদের দেশে ও বিশ্বে প্রত্যক্ষ করি। সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষমতাধর ও ক্ষমতাসীনরা অন্যদের সাথে যে আচরণ করে তা কয়েক হাজার বছর আগের মিশরের মহা ক্ষমতাধর ফেরাউনের আচরণের সাথে মিলে যায়। আসলে কাল-যুগ ভিন্ন হোক ক্ষমতার স্বাদে কোনো ভিন্নতা নেই। কুরআনে পাকের সূরা মুমিনের এক আয়াতে উল্লেখিত আছে,
وقال فرعون ذروني اقتل موسي وليدع ربه-الخ
আয়াতের প্রেক্ষপট হলো- বনী ইসরাঈলদের মধ্যে যখন হযরত মুসা আ. এর দাওয়াতের প্রভাব অন্তর অন্তর বৃদ্ধি পেতে লাগল এবং ফেরাউন তার রাজত্ব হারানোর আশংকায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল তখন সে মন্ত্রীসভার অধিবেশন আহবান করল। মুসা আ.-এর দাওয়াতী মিশনকে বন্ধ করার জন্য মন্ত্রীদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রস্তাব উত্থাপিত হল। সর্বশেষে ফেরাউন বক্তব্য পেশ করল। সে দম্ভ ভরে বললো, “সব দায়িত্ব আপনাদের হাতে থাকবে, শুধু একটি দায়িত্ব আমি গ্রহণ করলাম। তা হলো, মুসাকে হত্যা করা। একাজটি আমি নিজের হাতে সম্পন্ন করতে চাই।” তার প্রতিটি শব্দের সাথে যেন ক্রোধের আগুন ঝরে পড়ছে। বলছে, আমার উপর ছেড়ে দাও মুসার ব্যাপার। আমি নিজ হাতে তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় করবো। দেখি তাকে কে ঠেকায়। পারলে ডাকুক তার রবকে।
ক্ষমতার দম্ভ
কথার জোর কত দেখেছেন! নেতা পর্যায়ে কেউ উন্নীত হলেই কিংবা সরকারী কোন বড় পদের অধিকারী হলেই তার কথার মধ্যে এমন দম্ভ ও আমিত্বভাব প্রকাশ পায়। হোক না সে পদ মাত্র কয়েকমাস কিংবা কয়েক বছরের জন্য। আমাদের দেশেই দেখুন, মাত্র পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় আসীন হয়ে নিজেদেরকে সুপার পাওয়ার মনে করতে থাকে। তাহলে চারশো বছর মিশরের শাসন ক্ষমতা যার হাতে ছিল সেই ফেরাউনের দম্ভ ও অহংকার কেমন থাকতে পারে আন্দাজ করুন। সে শুধু নিজেকে সুপার পাওয়ার মনে করেনি, সে ঘোষণা করেছে আমি তোমাদের সবচেয়ে বড় প্রভু ও পালনকর্তা। আমার উপরে আর কেউ নেই। মুসার রব আবার কে? সবার চেয়ে বড় আমি।
এমন ধারণা যে নিজে করে এবং এ ধারণা জাতির সামনে অব্যাহতভাবে প্রচারও করে তাকে কি আর অন্য এক রবের অধীনতা স্বীকার করার জন্য দাওয়াত দেয়া যায়! একারণেই মুসা আ. এর প্রতি তার এত ক্রোধ। যার দরুন মুসা আ. কে খতম করার দায়িত্ব সে নিজেই গ্রহণ করেছে।
রাষ্ট্রপতি হত্যার দায়িত্ব নিজে নেয়ার কারণ
এরূপ সিদ্ধান্তের পেছনে মূলত দুটি কারণ হতে পারে। প্রথমটি হলো, মিশরের জাতিকে সে দেখিয়ে দিতে চায় যে, যে মুসার এত গ্রহণযোগ্যতা, এত প্রভাব, যে মুসা আমার রাজত্ব ধ্বংস করার দুঃসাহস দেখায় তাকে আমি নিজের হাতে খতম করেছি। অতএব আমার শক্তি ও সামর্থ্য এবং বিরত্ব ও বাহাদুরি তোমরা আন্দাজ করো। আমাকে যে তোমরা সবচেয়ে বড় রব বলে স্বীকার করো তার প্রতি কোনো প্রশ্ন উত্থাপনের অবকাশ নেই। মুসা যা বলে তা মিথ্যা। দ্বিতীয় কারণটি হলো, তার ধারণা সে মুসা আ. কে অন্যদের অপেক্ষা সহজে হত্যা করতে পারবে। কারণ, হাজার শত্র“তা থাকলেও মুসা আ. তো শৈশবে ও কৈশোরে আমার ঘরেই এবং আমার অর্থেই লালিত পালিত হয়েছে, তাই সে যত বড়ই হোক আমার সামনে আসলে আমার দয়া ও অনুগ্রহের কথা স্মরণ করে সে তার মাথা নিচু রাখবে। আমার দিকে চোখ তুলে কথা বলবে না। যেমন ধরুন, আপনি আমার অর্থে লেখাপড়া শিখে বিশ-পঁচিশ বছর আমার ইণ্ডাষ্ট্রিতে চাকুরি করে শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ে অনেক বড় ব্যক্তিত্বে পরিণত হলেন। এরপর ক্ষমতাসীন কোনো রাজনৈতিক দলের টিকেটে একদিন শিল্পমন্ত্রী হয়ে গেলেন। এখন অনেক সম্মান ও পাওয়ারের অধিকারী আপনি। কিন্তু আমার সামনে আপনি দেখানোর জন্য হলেও ঠিকই নত স্বরে কথা বলবেন। মন্ত্রীত্বের পাওয়ার আমার উপর প্রয়োগ করবেন না। কারণ, আপনার প্রতি আমার বিরাট অনুগ্রহ রয়েছে, যার বদৌলতেই আজ আপনি মন্ত্রী। ফেরাউনও এমন ধারণা করেছে।
সৃষ্টির আনুগত্যে স্রষ্টার নাফরমানী
আসলেই সুস্থ বিবেকের দাবি হলো, এহসানকারীকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা এবং এহসানের বদলা এহসান দ্বারা দেওয়া। তবে সেখানেও লক্ষ্য রাখতে হবে যে, সৃষ্টিকর্তার কোনো নাফরমানী হচ্ছে কি না। কারণ শরীয়তের নীতি হলো সৃষ্টির আনুগত্য করতে গিয়ে স্রষ্টার অবাধ্যতা বৈধ নয়। তাই যত বড়ই এহসানকারী হোক, আল্লাহর নাফরমানীর ক্ষেত্রে তার কথা মানা যাবে না কিংবা তার মর্যাদাকে প্রাধান্য দেয়া যাবে না। মাতাপিতার চেয়ে বড় এহসানকারী দুনিয়াতে কেউ নেই। তাদের ক্ষেত্রেও যখন পূর্বোক্ত নীতি প্রযোজ্য সেখানে অন্যান্য এহসানকারীর ক্ষেত্রে তো কথাই নেই। একজন অতি সাধারণ মানুষের জন্য যেখানে এই নীতি লংঘন করা দণ্ডনীয় অপরাধ সেখানে হযরত মুসা আ. একজন নবী হয়ে কি এই নীতি লংঘন করতে পারেন? কক্ষণো না। কিন্তু ফেরাউনের তো আর এ বুঝ ছিল না। তাই সে মানুষের স্বাভাবিক বিবেকের দাবি যেটা অর্থাৎ এহসানকারীর প্রতি এহসান করা- এটাই ধারণা করেছে।
মানুষের প্রতি আল্লাহর এহসান
মানুষের প্রতি আল্লাহর যে এহসান সে পরিমাণ এহসান কোনো মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়। আল্লাহ পাকের এক বিন্দু এহসানের সমপরিমাণ এহসান দুনিয়ার সব মানুষ মিলে করতে সক্ষম নয়। আল্লাহ রূহ দান করেছেন। দুনিয়ার সবাই মিলে কি পারবে একজন মৃত মানুষকে রূহ দান করতে? কক্ষণো পারবে না। অতএব সর্বাপেক্ষা মহান এহসানকারী তথা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এহসানকে মানুষের এহসানের উপর প্রাধান্য দিতে হবে। মুসা আলাইহিস সালাম তো তাই দেবেন। কিন্তু ফেরাউন ভুল ধারণা করে বসে আছে। তার কথা হলো, মুসা আমার সামনে মাথা নিচু করে আসবে, আমি তাকে আমার প্রভুত্ব স্বীকার করতে বলবো। সে অস্বীকার করলে তৎক্ষণাৎ নিজ হাতে তাকে হত্যা করবো। আমার ঘরে খেয়ে, আমার টাকায় লালিত পালিত হয়ে এখন আমাকে না মেনে অন্য রবকে মানবে? দেখি তার রব এসে তাকে রক্ষা করে কি না।
দম্ভ-অহংকার জন্ম হওয়ার রহস্য
আসলে ফেরাউনের এই বড়াই ও দম্ভ কিন্তু একদিনে পয়দা হয়নি। কয়েক শো বছর রাজত্বের পর তার মধ্যে এই সীমাহীন অহংকারের জন্ম হয়েছে। এই জন্য একই পদে বেশি দিন থাকতে হয় না। কিংবা থাকতে দিতে হয় না। তাহলে সীমালংঘন থেকে বাঁচা যাবে নতুবা ক্ষমতার অপব্যবহার হবেই। সে নিজেকে সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী মনে করবে, আইন-কানুন ও দ্বীন ধর্ম সবকিছুর ঊর্ধ্বে মনে করবে। এরপর এক সময় নিজেও ধ্বংস হবে এবং আরো অনেককে ধ্বংস করবে। কারণ অহংকার যে পতনের মূল একথাটি খুবই সত্য কথা। এর বাস্তব উদাহরণ ফেরাউন, হামান, কারুন ও নমরূদ। যারা জানে না তারা ইতিহাস থেকে জেনে নিক কিংবা পৃথিবী ঘুরে তাদের ধ্বংস হওয়ার জায়গা পরিদর্শন করে আসুক। একথা আল্লাহ পাকই কুরআন শরীফে বলেছেন,
قل سيروا في الارض فانظرو كيف كان عاقبة المجرمين
“হে নবী! আপনি (অবিশ্বাসীদেরকে) বলুন, তারা যেন পৃথিবীময় বিচরণ করে অপরাধীদের শেষ পরিণতি প্রত্যক্ষ করে”।
পাপের কালিমা
ফেরাউনের যে দম্ভ তা শুরুতে ছিল না। আস্তে আস্তে পয়দা হয়েছে। যে গুনাহ করে তার দিলেও গুনাহের আছর তথা পাপের কালিমা আস্তে আস্তে পড়তে থাকে। একসময় সে বেপরোয়াভাবে গুনাহ করতে থাকে, অহংকারের সাথে আল্লাহর নাফরমানীতে লিপ্ত হতে থাকে। সবশেষে ঈমান হারা হয়ে মৃত্যুবরণ করে।
ইচ্ছাকৃত নামায তরক
যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত নামায তরক করে তার এমন পরিণতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অনিচছাকৃত কাযা হলে কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে হঠাৎ একবার কাযা করে ফেলেছে পরে তওবা করে নিয়েছে, তাহলে তো ক্ষমা পাওয়া যাবে। কিন্তু যদি ইচ্ছাকৃত দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এমন কি বছরের পর বছর নামায না পড়ে তাহলে তার কাফের হয়ে মৃত্যু বরণ করার সম্ভাবনা রয়েছে। হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একটি হাদীসের মর্ম এরকমই। হাদীসটি হলো, من ترك الصلوة متعمدا فقد كفر নামায পড়া যে মহান আল্লাহর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ সে বিষয়ে কোন ভ্রুক্ষেপ করে না, এই নির্দেশ অমান্যকারীকে দুনিয়া ও আখেরাতে ভয়াবহ শাস্তির সম্মুখীন হওয়ার যে হুশিয়ারি রয়েছে সে হুশিয়ারিকে পরোয়া করে না, আর এরূপ অবস্থা মাসের পর মাস বহাল থাকে, এরূপ ব্যক্তির কাফের হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অনেক সময় এমন ব্যক্তিকে কেউ নামাযের দাওয়াত দিলে সে এরূপ বলে ফেলে যে, “আরে কিসের আবার নামায? নামায না পড়লে কী হবে? কিছুই হবে না। খামাখা।” একথার দ্বারা ঐ ব্যক্তি তখনি কাফের হয়ে যাবে। কারণ একথার মাধ্যমে নামায যে আল্লাহর হুকুম তা সরাসরি অস্বীকার করা হয়েছে।
আমানতের খেয়ানতের সম্ভাব্য পরিণতি
আরেকটি হাদীসে রয়েছে, لاايمان لمن لا أمانة له
যার আমানতদারী নেই তার ঈমান নেই। হাদীসের মর্ম হলো, যে ব্যক্তি বেপরোয়াভাবে বারবার আমানতের খেয়ানত করে, হতে পারে মৃত্যুর আগে সে ঈমান হারা হয়ে যাবে। অনেকের কাছে টাকা আমানত রাখা হয় যাতে টাকাগুলো হেফাযতে থাকে এবং যে কোনো সময় তলব করলে একসাথে টাকাগুলো পাওয়া যায়। কিন্তু উক্ত ব্যক্তি খরচ করে ফেলে। পরে চাইলে বিভিন্ন কথা বলে। কেউ বলে, হারিয়ে গেছে কিংবা পরে দেবে। কেউতো এমনও বলে যে, সে টাকা তো তোমাকে দিয়ে দিয়েছি। এমন খেয়ানত যে বারবার করতে থাকে বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে, সে বেঈমান হয়ে যেতে পারে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে হেফাযত করুন! সালাত এবং আমানতের খেয়ানত থেকে বাঁচার তাওফীক দান করুন!
ওয়াদা খেলাফীর ভয়াবহ পরিণতি
আরেকটি হাদীসের কথা মনে পড়লো। এটাও আপনাদেরকে শুনিয়ে দেই। হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, (মর্মার্থ)
“বারবার যে ওয়াদা খেলাফী করে তার ঈমান হারাবার আশংকা রয়েছে।” ওয়াদা খেলাপী মানে কথা দিয়ে কথা না রাখা। নির্ধারিত সময়ে কোনো কাজ করার কথা বলে ঐ সময়ে না করা। কোনো কিছুর অঙ্গীকার বা প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা ভঙ্গ করা। ওয়াদা মানুষের সাথেও হতে পারে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথেও হতে পারে। সব ধরনের ওয়াদার কথাই উপরোক্ত হাদীসে বলা হয়েছে। কালিমার প্রথমাংশ لااله الا الله¦ বলে আল্লাহ পাকের সাথে ওয়াদা করা হয়েছে যে, হে আল্লাহ আমরা আপনাকে ছাড়া আর কাউকে ইলাহ বলে স্বীকার করবো না। এরপর محمد الرسول الله বলে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে ওয়াদা করা হয়েছে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। তিনি যে হুকুমই করেন আমি তা মান্য করবো। তিনি যা বলবেন তা বিশ্বাস করবো এবং মানবো। তার কথা মত জীবন পরিচালনা করবো; যারা এই ওয়াদা রক্ষা করবে না তাদের জন্যই উপরোক্ত হাদীসের হুশিয়ারী।
কিছু মানুষের মজ্জাগত অভ্যাস
কিছু মানুষ আছে যাদের ওয়াদা খেলাফ করা মজ্জাগত অভ্যাস। শুধু ছলচাতুরী করে। তার কাছে আপনার পাওনা টাকা চেয়েছেন তো বলবে, এখন তো নাই, দশ তারিখে আসুন প্লীজ! এদিকে তার আগেই আট তারিখে বিদেশে যাওয়ার প্লান রয়েছে। আবার হয়তো তখন কাছে টাকা ছিল কিন্তু মিথ্যে বলে আরেকটি কবীরা গোনাহ টেনে আনলো। এরপর যখন পাওনাদার তাকে বলে, কী ব্যাপার, আপনি দশ তারিখে টাকা দেয়ার কথা বলে আট তারিখেই চলে গেলেন যে? তখন একেবারে অভিনয় করে বলে যে, আরে ভাই! আইএ্যাম সরি ভাই, আমি একদম ভুলে গেছি। দেখুন, এক গুনাহ অপর গুনাহকে কীভাবে টেনে আনে। তখন পাওনাদার বলে, আচ্ছা এবার কবে দিবেন? তখন বলে, ভাই! আমি ওমুককে টেলিফোন করে দিচ্ছি সে আপনাকে টাকা পৌঁছে দেবে। কিছুদিন পর পাওনাদার টাকা না পেয়ে আবার এসে বলে, কই আপনার লোক? গেল না তো কেউ। তখন বলে, তার ফোনটার কী যে হলো এতবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ফোন ঢুকলোই না। আসলে সে ফোনই করেনি। তার কাজই শুধু ছলচাতুরী করা আর বিভিন্ন গুনাহ টেনে এনে পাপের বোঝা ভারী করা।
ঋণ না নিতে হাদীসে উৎসাহ
এসব কারণে হাদীসে ঋণ নিতে নিষেধ করা হয়েছে। একেবারে অনন্যোপায় হলে তখন ভিন্ন কথা। নচেৎ সবসময়ই ঋণী হওয়া থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা ভালো। কারণ ঋণ মানুষের স্বভাবকে নষ্ট করে দেয়। সময় মতো দিতে পারে না, তখন মিথ্যা ও ছলচাতুরীর আশ্রয় নেয়। ঋণ গ্রহণ মানুষের সমস্যা দূর করতে পারে না। বরং গ্রহীতা পূর্বের সমস্যার সাথে আরো একটি সমস্যা ডেকে আনে। দু’একটা ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ ঋণ গ্রহীতাকেই দেখা যায় যে, নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ করতে পারে না। ব্যক্তিগত ও সংসারের খরচের জন্য যারা ঋণ নেয় তারা ঋণ না নিয়ে খাওয়া-পরা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যয়ের পরিমাণ কমিয়ে দিলেই হয়ে যায়। প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই আজ বেশি খরচের প্রবণতা দেখা যায়। যে সব খরচের কোনই প্রয়োজন নেই। নির্ঘাত অপচয় ছাড়া কিছু নয়। ধনী লোকেরা তো কেবল বিলাসিতার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা অপচয় করে। ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিতেই থাকে। একবার ঋণ নিয়ে লক্ষ কোটি টাকা লাভ করেছে তাতেও মনে ভরে না। আরো টাকা অর্জন করতে চায়, আবার ঋণ নেয়। এভাবে লাভ করে আর ঋণ নেয়। কোনো সময় ব্যবসায় বড় ধরনের লস হয়। তখন সব শেষ হয়ে যায়, ব্যাংকের টাকা আর পরিশোধ করতে পারে না। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক পার্টি ও ব্যক্তিকে চাঁদা দিতে দিতেও লাভ শেষ হয়ে যায় অনেকের। নির্বাচন এসে গেল, সম্ভাব্য বিজয়ী দল চাইলো এক কোটি। ব্যবসায়ী মনে করে, এরা বিজয়ী হলে এক কোটির বিনিময়ে দশ কোটির ফায়দা ওঠাতে পারবো; তাই দিয়ে দেয় এক কোটি। পরে ঐ পার্টি বিজয়ী না হলে তার সব শেষ। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে কিংকর্তবিমূঢ় হয়ে পড়ে। যাহোক বলছিলাম যে, যে করে হোক ঋণী হওয়া থেকে বেঁচে থাকতে হবে। তাহলে সামান্য কষ্ট পোহাতে হলেও মানসিক শান্তির সাথে জীবনযাপন করা যাবে।
‘রব’ শব্দের বিশ্লেষণ
আমরা পূর্বে আলোচনা করছিলাম যে, ফেরাউনের এই সীমাহীন দম্ভ প্রথমে ছিল না। প্রথমে সে নিজেকে ‘সবচেয়ে বড় রব’ বলতো না। বলতো, আমি মিশরের রব। আভিধানিক দিক দিয়ে কথাটি সঠিক হলেও এভাবে ‘রব’ শব্দের ব্যবহার সৃষ্টির ক্ষেত্রে অনুচিত। কারণ অভিধানে ‘রব’ এর অর্থ হলো কোনো কিছুর অভিভাবক, প্রতিপালক, তত্ত¡াবধায়ক, দেখাশোনা কারী ইত্যাদি। কিন্তু শরীয়তের পরিভাষায় একমাত্র সারা বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা এবং প্রতিপালক আল্লাহ তাআলাকেই ‘রব’ বলা যাবে। ‘রাসূল’ শব্দের ক্ষেত্রেও একই কথা। আমার কাছে আপনি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে কোনো বার্তা নিয়ে এলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম আপনি কে? উত্তরে বললেন আমি ‘রাসূল।’ তাহলে আভিধানিক অর্থের দিক দিয়ে এরূপ বলা যায় বটে, কিন্তু এরকম ব্যবহার বর্জনীয়। কারণ যে কোনো বার্তাবাহককে অভিধানে ‘রাসূল’ বললেও এটি শরীয়তের একটি বিশেষ পরিভাষা হিসেবে খ্যাত। অর্থাৎ যার কাছে আল্লাহর ওহী আসে তাকেই রাসূল বলা হয়। যিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে কিতাব প্রাপ্ত হন, নিষ্পাপ হন, যার কথা কোনো দ্বিধা ছাড়াই মানতে হবে, না মানলে নিশ্চিত জাহান্নামে যেতে হবে, এমন ব্যক্তি রাসূল। অতঃএব এ ধরনের শব্দকে আভিধানিক অর্থে ব্যবহার করা ঠিক না। নতুবা নিজেরও ক্ষতি হয় এবং অন্য হাজারো মানুষের ক্ষতি হওয়ার আশংকা থাকে।
অহংকারের ক্রমোন্নতি
যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, ফেরাউন আভিধানিক অর্থ উদ্দেশ্য করে বলেছে যে, আমি ‘রব্বে মিসর’ তথা মিশরের তত্তাবধায়ক বা প্রতিপালক, তবুও একথাটাই তার মধ্যে অহংকারের জন্ম দিয়েছে। আস্তে আস্তে সেই অহংকারই গোনাহের স্রোত টেনে এনেছে। একপর্যায়ে সেই স্রোত ভয়ংকর জলোচ্ছাসের রূপ লাভ করে গর্জে উঠে বলেছে-
اناربكم الاعلي“আমিই তোমাদের সবচেয়ে বড় প্রভু ও প্রতিপালক”। অন্য আরো প্রভু আছে কিন্তু আমি সবার লিডার। আমার কথামতো সবাই চলে।
জনৈক মুফাসসিরের কাণ্ড
দেখুন, সে নিজের কত বড় ক্ষতি করলো। আরো হাজার হাজার মানুষ তার সাথে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সে যে প্রথমে رب مصر (মিসরের রব) বলেছে তার কারণে এখন পর্যন্ত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একজন তো তাফসীরেই লিখেছে যে, ফেরাউন খোদা হওয়ার দাবি করেনি। যদি আপনি প্রশ্ন করেন যে, কুরআনে তো স্পষ্ট বলা হয়েছে সে বলেছে আমি তোমাদের রব (প্রভু)? এর উত্তরে সেই স্বঘোষিত মুফাস্সির বলেন, اناربكم الاعليএর ব্যাখ্যা হল:انا رب اعلي لاهل مصر
অর্থাৎ তোমরা যারা মিশরবাসী আমি তাদের সবচেয়ে বড় ও প্রধান তত্তাধায়ক বা প্রতিপালক।
মুফাসসির সাহেব এখানেই ক্ষান্ত হননি, আরো আগে বেড়ে বলেছেন যে, ফেরাউন মুমিন হয়ে মৃত্যুর বরণ করেছে; শুধু তাই নয়, সে একজন শহীদও বটে। (নাউযুবিল্লাহ)
এই দাবির পক্ষে দলীল কী? দলীল হলো- হাদীসে বলা হয়েছে, (তরজমা) “যে ব্যক্তি পানিতে ডুবে মারা যায় সে শহীদদের অন্তর্ভুক্ত।” আর কুরআন ও সমস্ত ইতিহাস সাক্ষী যে, ফেরাউন পানিতে ডুবে মারা গেছে। অতএব ফেরাউন একজন শহীদ। আর সে যে মুসলমান তার দলীল হলো, মৃত্যুর পূর্বে সে বলেছে, (আয়াতের তরজমা)
“এবার বিশ্বাস করে নিচ্ছি যে, তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, যার উপর ঈমান এনেছে বনী-ইসরাঈলরা। বস্তুত আমিও তাঁরই আনুগত্যকারীদের একজন।” (সূরা ইউনুস)
এরপর আল্লাহ তার প্রতি খুশি হয়ে তাকে মহাসম্মানিত করেছেন। তার দেহকে পঁচে-গলে যাওয়া থেকে হেফাযত করেছেন।
এসব কথা আমি বানিয়ে বলছি না। আমাদের দেশে ‘পৃথিবী’ নামে একটি পত্রিকা আছে, তার এক সংখ্যায় এসব কথা লেখা আছে। তাফহীমুল কুরআন এবং এ জাতীয় অন্যান্য বই পুস্তকে লেখা আছে। যেখানে পুরো উম্মতে মুহাম্মদী তথা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের সমস্ত উলামায়ে কেরাম ফেরাউন কাফের হওয়ার ব্যাপারে একমত, সেখানে এরা বলে যে, সে শহীদ।
শরীয়তের সঠিক বিধান
শরীয়তের বিধান হলো, সাকরাতুল মাউতের সময় অর্থাৎ রূহ বের হওয়ার পূবর্ক্ষণে ঈমান আনলে সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। এজন্যই তো ফেরাউন ঈমান আনার কথা বলার উত্তরে আল্লাহ পাক তাকে ধমক ও তিরস্কারের সাথে বলেছেন,
آلآن وقد عصيت قبل وكنت من المفسدين
(মর্মার্থ) এখন ঈমান আনার কথা বলছ? পূর্বে শত শত বছরেও তোমার ঈমান আনার সুযোগ হয়নি? তখন শুধু নাফরমানী করেছ আর ফাসাদ সৃষ্টি করেছ। এখন তো সময় শেষ, এখন ঈমান আনলে কোনো লাভ হবে না। এই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ঠিক মৃত্যুকালে ঈমান আনলে তা শরীয়ত অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য হবে না।
হাদীসের দলীল
বিষয়টির আরো বিস্তারিত বিশ্লেষণ সেই হাদীসের দ্বারাও হয় যাতে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা বান্দার তওবা ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল করতে থাকেন যতক্ষণ না ঊর্ধ্বশ্বাস শুরু হয়ে যায়। কারণ ঊর্ধ্বশ্বাস বলতে সে সময়কে বোঝানো হয়েছে, যখন জান কবয করার জন্য ফেরেশতা সামনে এসে উপস্থিত হন। তখন সে সময়টি পার্থিব জীবনে গণ্য হয় না বরং এই কর্মজগত তথা পার্থিব জীবন শেষ হয়ে তখন আখেরাতের হুকুম আহকাম আরম্ভ হয়ে যায়। কাজেই সে সময়কার কোনো আমল গ্রহণযোগ্য নয়। ঈমানও নয় এবং কুফরও নয়। এমন সময় যে লোক ঈমান গ্রহণ করে তাকে মুমিনদের মতো কাফন-দাফন দেয়া যাবে না। তাফসীরে রূহুল মা’আনীতে বলা হয়েছে যে, সমগ্র মুসলিম উম্মাহ এ ব্যাপারে একমত যে, ফেরাউনের মৃত্যু কুফরী অবস্থায় হয়েছে। যারা এই এজমা তথা সর্বসম্মত মতের বিপরীত মত কুরআন দ্বারা প্রমাণিত করার চেষ্টা করে তারা কুরআনের অপব্যাখ্যাকারী এবং দ্বীনের বিকৃতি সাধনে সচেষ্ট।
রহস্যাবৃত উদ্দেশ্য
ফেরাউনকে মুমিন বানানোর জন্য তাদের যে কসরত এর মূলে কী উদ্দেশ্য রয়েছে তা আমাদের কাছে রহস্যাবৃত। পুরো কুরআন শরীফে আল্লাহ পাক বারবার বলেছেন যে, আমি মুসাকে নবী হিসেবে ফেরাউনের কাছে পাঠালাম কিন্তু সে আমার অবাধ্য হলো, নবীর সাথে শত্র“তা করলো ইত্যাদি।
সাথে সাথে আল্লাহ পাক আমাদেরকে ফেরাউনের কর্ম ও আচরণ থেকে দূরে থাকতে বলেছেন এবং তার দুনিয়ার পরিণতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে বলেছেন। যদি সে কাফেরই না হবে তাহলে আল্লাহ এগুলো বলবেন কেন? শত চিন্তুা করেও বোধগম্য হয় না যে, ফেরাউনকে মুমিন প্রমাণ করার মধ্যে কী ফায়দা। তবে এটা বোধগম্য যে, এতে অকল্পনীয় ক্ষতি রয়েছে।
পলিটিক্যাল পলিসি
যাহোক আমরা আমাদের পূর্বের আলোচনায় ফিরে আসি। ফেরাউন যে প্রচণ্ড রোষের সাথে বললো আমি নিজেই মুসাকে খতম করবো; তার কোন রব থাকলে তাকে ডাকুক। তার ‘রব’ সহ তাকে শেষ করবো। এর কারণ বলতে গিয়ে সে এক পলিটিক্যাল পলিসি গ্রহণ করেছে। সে জাতিকে বলেছে
اني اخاف ان يبدل دينكم او ان يظهر في الارض الفساد
(মর্মার্থ) আমি যে তাকে হত্যা করতে চাই, এটা তোমাদের স্বার্থে, আমার তেমন কোনো স্বার্থ জড়িত নেই। সে তোমাদের ধর্ম পরিবর্তন করে দিতে চায়। শত শত বছর তোমাদের বাপ-দাদা, তোমাদের মুরব্বী, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন এবং তোমরা যে ধর্মপালন করে আসছো তা বাতিল করে দিয়ে অন্য এক ধর্ম তোমাদের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। যে মহান রবের অর্থাৎ আমার আনুগত্য করে আসছ, সেই রব ভিন্ন এক দুর্বল ও ছোট রবের আনুগত্য করতে বলে। এর ফলে পুরো দেশময় বিরাট নৈরাজ্য সৃষ্টি হওয়ার প্রবল আশংকা রয়েছে। সুতরাং এখনি তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে আমি দেশ ও জাতিকে রক্ষা করবো। যেহেতু আমি তোমাদের রব তাই আমার দায়িত্ব হলো তোমাদেরকে সম্ভাব্য সকল সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য থেকে হেফাযত করা।
নববী হিম্মত
মুসা আ.-ও ছিলেন অত্যন্ত সাহস ও হিম্মত ওয়ালা নবী। তিনি ফেরাউনকে পালটা চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করেন। তিনি ফেরাউনকে লক্ষ্য করে বললেন,
اني عذت بربي وربكم من كل متكبر لايؤمن بيوم الحساب
(মর্মার্থ) আমি তো মুরব্বী বানিয়েছি ঐ মহান সৃষ্টিকর্তাকে যিনি আমাকে এবং তোমাকেও প্রতিপালন করেন। যিনি তোমার হাত, পা, চোখ, নাক, রক্ত-মাংস, নাড়ি-ভুড়ি, হৃৎপিণ্ড এক কথায় সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সৃষ্টি করেছেন। যিনি তোমাকে কথা বলার শক্তি, চিন্তা করার শক্তি, হাটা-চলার শক্তিসহ সকল শক্তি দান করে সেগুলোকে এখন পর্যন্ত সুস্থ রেখেছেন, তিনিই আমার নিরাপত্তা দাতা। তোমার মতো সব অহংকারী ও অবিশ্বাসী থেকে তিনিই আমাকে রক্ষা করবেন। তিনি মহা ক্ষমতাধর। সারাবিশ্বের সকল ক্ষমতা তার ক্ষমতার এক বিন্দু পরিমাণও নয়। সকল বাদশার বাদশা যিনি আমি তার লোক। সুতরাং তুমি আমাকে ভয় দেখিও না।
আমাদের জন্য শিক্ষা
এখানে আমাদের জন্য যে বিষয়টি শিক্ষণীয় তা হলো , আসল মালিকের সাথে সম্পর্ক করতে চেষ্টা করা, তাহলে দুনিয়ার কোনো সমস্যার সমাধানের জন্য দুনিয়ার দুর্বল ও ছোট মালিকের পেছনে হন্যে হয়ে ঘোরার প্রয়োজন হবে না। বিপদ-মুসিবত যিনি পাঠান তার কাছেই তা উঠিয়ে নেয়ার নিবেদন করাই যুক্তিযুক্ত। আমরা কোনো বিপদে বা সমস্যায় পড়লে এর কাছে দৌড়াই, ওর কাছে দৌড়াই, বুক চাপড়াই, হা হুতাশ করি। এসব না করে ঐ সময় কর্তব্য হলো ওযু করে মসজিদে গিয়ে নামায পড়া, তারপর আল্লাহর কাছে হাত তুলে রোনাজারি করা।
সে পথই ধরতে হবে
আমাদের দেশসহ সারা বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের যে দুর্গতি ও দুর্দশা এর থেকে মুক্ত হতে হলে সে পথই ধরতে হবে যে পথ ধরেছেন সাহাবীগণ, তাবেয়ীগণ এবং বিশ্ব বিজয়ী মুসলিম বাহাদুরগণ। যিনি শান্তি দান করার একমাত্র মালিক তার সাথে সম্পর্ক করা ছাড়া যদি আমরা আমেরিকার মতো দুনিয়াবী আসবাবের অধিকারী হয়ে যাই, তবুও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারবো না, ইহুদী-খৃষ্টান জগতকে পদানত করতে পারবো না। সাহাবীদের ঈমান-গ্রহণের পূর্বের অবস্থার কথা স্মরণ করুন। দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সন্ত্রাস নৈরাজ্য ও চরম অশান্তিপূর্ণ এক সমাজে তারা বসবাস করতো। বিশ্বের দরবারে তাদের কোনো সম্মান ছিল না। বিশ্বের অন্যান্য জাতি আরবের লোকদেরকে অশিক্ষিত, মূর্খ ও ইতর জাতি মনে করতো। ঈমান গ্রহণ করার পর আল্লাহর সাথে যখন তাদের সম্পর্ক মজবুত হলো, তখন সেই ঘৃণিত জাতিই হলো বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানিত জাতি। সারা বিশ্ব তাদের পদানত হলো, তাদের অধীনতা স্বীকার করলো। এর মূল কারণ হলো, তারা ছিল আল্লাহর শক্তিতে বলিয়ান। দুনিয়ার আসবাব তথা বস্তুশক্তি বিধর্মীদের তুলনায় তাদের অনেক কম ছিল।
হযরত উমর রা. এর সুপ্রসিদ্ধ উক্তি
এ ব্যাপারে হযরত উমর রা. এর সুপ্রসিদ্ধ উক্তি স্মরণযোগ্য। হযরত আবু উবাইদা রা. বাইতুল মাকদাস অবরোধ করার পর শহরবাসী সন্ধির প্রস্তাব দেয়। তারা বলে, খলীফা হযরত উমর নিজে এসে সন্ধি চুক্তিতে স্বাক্ষর করলে আমরা মুসলমানদের হাতে শহর অর্পণ করবো। হযরত আবু উবাইদা রা. খলীফাকে চিঠি লিখেন। চিঠি পেয়ে হযরত উমার রা. রওনা হলেন। তার সাথে তার গোলামও ছিল। যেহেতু উট ছিল একটি তাই খলীফা ও গোলাম পালাক্রমে সওয়ার হতেন। একজন আরোহী হলে অন্যজন পায়ে হেঁটে চলতেন। যখন আবু উবাইদা রা. এর ছাউনীর কাছে পৌঁছলেন তখন ছিল গোলামের সওয়ারের পালা। তিনি নেমে গোলামকে উঠালেন। হযরত আবু উবাইদা এ অবস্থা দেখে আশংকা করতে লাগলেন যে, না জানি এ অবস্থা দেখে বাইতুল মাকদাস শহরবাসীর উপর বিরূপ কোনো প্রভাব পড়ে আর তারা পুনরায় যুদ্ধ শুরু করে দেয়। তাই তিনি আগে বেড়ে খলীফাকে বললেন, সবার দৃষ্টি আপনার দিকে নিবদ্ধ। এই অবস্থায় গোলামকে সওয়ার করিয়ে আপনি এভাবে গোলামের ন্যায় হেঁটে যাওয়া বোধহয় সঙ্গত হবে না। হযরত উমর রা. তার কথা শুনে রেগে উঠলেন। বললেন, “তোমার পূর্বে কেউই আমাকে এরূপ বলেনি। শোনো, আমরা সবার চেয়ে অপমানিত ও অপদস্থ ছিলাম, আল্লাহ পাক ঈমানের বদৌলতে আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন। যদি আমরা এ পথ পরিত্যাগ করি তাহলে আল্লাহ পাক আমাদেরকে অপমানিত করে ছাড়বেন”। অর্থাৎ আমরা আল্লাহকে আমাদের মালিক বানিয়েছি, তাঁর সাথে আমাদের সম্পর্ক মযবুত করেছি, তাঁর জন্য আমাদের জান-প্রাণ কুরবান করেছি, একারণেই আমাদের এ প্রতাপ, এজন্যই শত্র“রা আমাদেরকে ভয় পায়, যুদ্ধ না করে সন্ধি করতে চায়। অতএব আমরা যদি আল্লাহর শক্তি ও সাহায্যকে প্রধান অবলম্বন না বানিয়ে অন্য কিছুকে বানাই তাহলে আমাদের এই প্রতাপ ও সম্মান বাকি থাকবে না, আমরা হব লাঞ্ছিত ও অপমানিত। আল্লাহ পাক আমাদেরকে সহী বুঝ দান করুন।
www.dawatul-haq.com
সুন্দর হয়েছে লেখা। জাজাকাল্লাহ