তা’লীমে দ্বীন : সর্বাপেক্ষা মর্যাদার জিম্মাদারি
লিখেছেন: ' মাসরুর হাসান' @ রবিবার, অক্টোবর ১০, ২০১০ (২:২৫ অপরাহ্ণ)
মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমূদুল হাসান
[২০১০-২০১১ সনের নতুন শিক্ষাবর্ষের সূচনার পূর্বদিন যাত্রাবাড়ী জামিয়ার দফতরে শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত নসীহতের সারাংশ]
আমাদের দেশের আলেমদের জন্য তিনটি ভাষার উপর পাণ্ডিত্য অর্জন করা অতি জরুরী। সেগুলো হলো- [১] আরবী। কারণ, কুরআন-হাদীসের মূল হলো আরবী। [২] উর্দু। কারণ, আরবী কিতাবসমূহের বিগত একশত বছরের তাহকীকাত ও ব্যাখ্যা বের হয়েছে উর্দু ভাষায়। [৩] বাংলা। কারণ, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। কুরআন-হাদীসের ইল্ম স্বজাতির সামনে পেশ করতে হলে তাদের ভাষার উপর যথেষ্ট দখল থাকা জরুরী। তবে সর্বপ্রথম জরুরী হলো, সব উস্তাদ ও ছাত্রের আরবী কিতাব বোঝার উপর পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করা। আরবী কিতাব না বোঝার দরুন আমরা অনেকেই প্রকৃত ইলম হাসিল করতে সক্ষম হচ্ছি না। বর্তমানে উস্তাদ-ছাত্ররা আরবীর প্রতি খুব অমনোযোগী। এর প্রধান কারণ হলো, প্রতিটি কিতাবের মূর ইবারতের বাংলা অনুবাদ হয়ে আরবী ইবারতসহ ছাপা হয়ে সে গুলো বাজারে আসছে। তাই উস্তাদ-ছাত্ররা মূল আরবী কিতাব না কিনে ঐ অনুবাদ কেনার জন্য পাগলের মতো ছুটে যাচ্ছে। তবে কিছু উস্তাদ ছাত্র তো ব্যতিক্রম আছেই। আমাদের মুরব্বীগণ ছাত্রদের এই স্বভাবের ব্যাপারে খুবই সজাগ ছিলেন। আপনারাও খুব সজাগ থাকার চেষ্টা করবেন। নুতন বছরের শুরুতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছাত্ররা এসেছে আপনাদের কাছ থেকে ইল্ম্ হাসিল করার উদ্দেশ্যে। তাদের ইল্ম্, আমল ও আদব-আখলাকের ব্যাপারে আপনাদের অতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে, সাথে সাথে নিজেদের ইলম-আমলের ব্যাপারেও খুবই সজাগ থাকতে হবে; যাতে আপনাদের ইল্ম্-আমলের প্রভাব ছাত্রদের উপর পড়ে।
যে সব উস্তাদ পাঠ্য-কিতাব এবং তার ব্যাখ্যাগ্রন্থসমূহ আরবী কিংবা উর্দু এমনকি বাংলার মাধ্যমেও বুঝতে সক্ষম নয় তাদের জন্য শিক্ষকতা করা উচিত নয়। কারণ এতে ছাত্রদের ফায়দার বিপরীতে ক্ষতিই হবে।
বর্তমানে উস্তাদরা শুধু হাদীসের কিতাব পড়ানোর জন্য পাগল হয়ে যায়। নিচের দিকের উর্দু কিতাবসমূহ পড়াতে চায় না। অথচ আমাদের আকাবিরদের বিগত একশত বছরের নব্বইভাগ তাহকীকাতই উর্দূতে হয়েছে। আমাদের মাদরাসার ক্লাসরুটিনের কাগজে দেখলাম বড় বড় হুযুররা নিচের দিকের উর্দু কিতাব পড়াতে চায় না। আমার এখনো মনে চায় যে, মুখতাসারুল মাআনী, কুদুরী এবং উর্দু কিতাবসমূহ পড়াই। উর্দু দোছরী, তেছরী ইত্যাদি কিতাব পড়ানো খুবই কঠিন। কারণ এ সমস্ত কিতাবের ভাষার উচ্চারণ শুদ্ধভাবে ছাত্রদেরকে পড়াতে হয়, লোগাত দেখতে হয়। শুদ্ধভাবে নিচের উর্দু কিতাবগুলো যদি ছাত্ররা পড়তে না পারে তাহলে বড় বড় শরাহ-শুরুহাত বুঝতে তাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। মক্তবের ছাত্রদের মতো কিতাব বিভাগের ছাত্রদেরকেও ইবারতের শুদ্ধ উচ্চারণের মশক করতে হবে। অনেকেই উর্দু উচ্চারণ পড়াতে পারে না। যে স্থানের উচ্চারণ ‘এমালা’ হবে সে স্থানের উচ্চারণকে দীর্ঘ ‘ঈ’-কার দিয়ে পড়ে।
হিফয বিভাগের ছাত্ররা হিফয সমাপ্ত করে পুনরায় আবার এক বছর ধরে শোনায়। অথচ শুরু থেকেই যদি হাফেয সাহেবরা সহীহ-শুদ্ধ ও ভালভাবে পড়ায় তাহলে হিফয শেষ করার পর আবার এক বছর সময় নষ্ট করতে হতো না। তবে একাজটা ছাত্র বেশি হওয়ার দরুন অনেক সময় সম্ভব হয় না।
বছরের শুরু থেকেই নুরানী ও কিতাব বিভাগের ছাত্রদের নিকট থেকে নিয়মিত পড়া শোনা এবং হাতের লেখা দেখা একান্ত প্রয়োজন। ছাত্রদেরকে ওয়াজ ও লেখনীর মাধ্যমে জাতির সামনে সুন্দর করে শরীয়তের দিকনির্দেশনা বিধানসমূহ প্রচার করতে পারার জন্য বাংলা ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে হবে। আমি বাংলা ভাষার পেছনে যে মেহনত করেছি তা যদি আরবী ও উর্দুর পেছনে করতাম তাহলে সারা দুনিয়ার মানুষ উপকৃত হতো এবং আমার নাম-দাম হতো। কিন্তু বড় একটি প্রশ্ন থেকে যেত যে, আমার স্বগোত্র ও স্বদেশের এসব ভেবেই অন্য ভাষার তুলনায় বাংলা ভাষায় অধিক হারে কিাতব লিখতে শুরু করি। এ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় যে সমস্ত প্রবন্ধ-নিবন্ধ আমি লিখেছি তা বহুদিন ধরে ছাপানো যাবে।
আগের ছাত্রদের মাঝে অনেক আদব ছিল। তারা উস্তাদদের নাম না নিয়ে রুমের নম্বর অনুযায়ী ১/২/৩ নম্বর হুযুর কিংবা উস্তাদের গ্রাম বা থানার সাথে যুক্ত করে ডাকতো। কিন্তু এখনকার ছাত্ররা উস্তাদদের নাম নিয়ে ডাকে। জমানার এই পরিবর্তন সম্পর্কে উস্তাদদের ভালোভাবে অবগত থাকা এবং সে অনুপাতে ছাত্রদের সাথে আচরণ করা উচিত। দরসে গিয়ে হাশি-খুশিভাবে ছাত্রদেরকে সবক পড়ানো উচিত। তাদেরকে এমন কোন কথা না বলা, যাতে সে বেয়াদবী করে বসে। গালি বা কোনো অশোভন ভাষায় তাকে শাসালে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে যে, সে উল্টো উস্তাদকে শাসালো। হাদীসে এসেছে, মুসলমানকে গালি দেয়া বড় গোনাহ।
আলেমদেরকে আল্লাহ তাআলা ইলম দিয়েছেন মানুষের নিকট দ্বীনের বাণী পৌঁছানোর জন্য। এটা তাদের জন্য অবশ্য পালনীয়।
যাত্রাবাড়ী মাদরাসার ছাত্রদের আমল-আখলাকের সুনাম দেশ-বিদেশে প্রসিদ্ধ। দেওবন্দ মাদরাসার পরিত্রকায়ও এই মাদরাসার ছাত্রদের আমল-আখলাক নিয়ে লেখা ছাপা হয়েছিল। তবে সুনাম অর্জনের জন্য নয়, ছাত্রদের ইলমী ও আমলী জিন্দেগী যাতে আরো সুন্দর হয় সে জন্য আপনারা তাদের পেছনে এখলাসের সাথে মেহনত করবেন। মনে রাখবেন, ভাল ও মন্দ এই দুটি বিষয় কোন দিনও গোপন থাকে না। এর তাছির একদিন না একদিন প্রকাশ পাবেই। তাই নিজের ও ছাত্রদের ভালো-মন্দের ব্যাপারে খুবই সজাগ থাকতে হবে যাতে আপনার উদাসীনতার কারণে নিজের জীবন ও ছাত্রদের জীবনে কোন বিপদ নেমে না আসে। ছাত্ররা আপনাদের জীবনের জন্য ‘মাআাশ’ ও ‘মাআদ’ অর্থাৎ পার্থিব জীবনে জীবিকার এবং পরকালীন জীবনের সফলতার মাধ্যমে।
নিজের অযোগ্যতার কারণে হাদীসের ভুল তাকরীল, কুরআনের ভুল মশক ও কিতাবে ইবারতের গলদ অর্থ বর্ণনা করা সাংঘাতিক ক্ষতিকর কাজ। ভালভাবে কিতাব পড়াতে না পারলে কর্তৃপক্ষকে জানানো একান্ত প্রয়োজন। হযরত থানবী রহ. বলেছেন, আমার উস্তাদের নিকট একছাত্র পড়তে আসলে উস্তাদের মুহতারাম তখন ছাত্রকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি আমার নিকট কী হিসেবে পড়তে চাও? যদি তুমি আমাকে পরিপূর্ণ আলেম মনে করে পড়তে চাও তাহলে আমার দ্বারা তোমাকে পড়ানো সম্ভব নয়। কারণ দুনিয়ার সমস্ত ইলম আমার হাসিল করা হয়নি আর যদি এই ভেবে পড় যে, আমি কিছু জানি আর কিছু জানি না তাহলে পড়তে পারো। কারণ, পড়াতে গিয়ে আমি যা বলতে বা বোঝাতে পারবো না সে ক্ষেত্রে বলবো, তুমি অন্যের নিকট থেকে বুঝে আসো।
আল্লাহর ফযলে আমরা নতুন বছরের ইবতিদা তথা সূচনা করতে পারলাম। এটা আমাদের প্রতি আমাদের মালিকের মেহেরবানী। ইলম ও আমলের যিম্মাদারী হলো দুনিয়ার মাঝে সবচেয়ে বড় যিম্মাদারী। যারা এই যিম্মাদারী সঠিকভাবে আদায় করবে তারা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় দামী ও মর্যাদাবান। দুনিয়াদাররা যেভাবে তারা তাদের কর্মকে দুনিয়ার সফলতার জন্য একমাত্র মাধ্যম মনে করে তেমনি আমাদেরকেও দ্বীনের এই কাজকে দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতার সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম মনে করতে হবে।
আল্লাহপাকের শুকরিয়া যে, তিনি আমাদেরকে তার দ্বীনের তালীম ও তাবলীগের জন্য কবুল করেছেন। চোখ বন্ধ করলে বোঝে আসে যে, দুনিয়ার কী করুণ অবস্থা! আল্লাহ আমাদেরকে জান্নাতী পরিবেশে রেখে দ্বীনের খেদমত করার যে তাওফীক দিচ্ছেন সে জন্য আল্লহর কাছে সর্বদা শোকরগোযার থেকে নিজেকে সর্ববিষয়ে পবিত্র রেখে ছাত্রদের পিছনে মেহনত করে যাওয়া জরুরী। আল্লাহপাক আমাদেরকে তাওফীক দান করুন!
www.dawatul-haq.com