ফতওয়া ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
লিখেছেন: ' মাসরুর হাসান' @ রবিবার, অক্টোবর ১০, ২০১০ (২:৩৭ অপরাহ্ণ)
মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমূদুল হাসান
(১) ফাতওয়া এবং ইসলাম
মানুষ মাত্রই চাই সে কোন ধর্মে বিশ্বাসী হোক অথবা না হোক অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জন এবং উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে জ্ঞান অর্জনে প্রয়াসী হয়। জ্ঞান অর্জন এবং সঠিক দিক নির্দেশনা লাভের একটি সর্বজন স্বীকৃত ও স্বভাবগত মাধ্যমকে বাংলা পরিভাষায় “প্রশ্নোত্তর” বলা হয়। “প্রশ্নোত্তরের” মাধ্যমে শরীয়তের করণীয় ও বর্জনীয় মাসআলা-মাসায়েল এবং বিধিবিধান সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করাকে শরীয়তের পরিভাষায় “ফাতওয়া” বলে। পবিত্র কুরআন ও হাদীস থেকেই এই পরিভাষাটি সংগৃহিত। ফাতওয়ার কার্যক্রম মৌখিক এবং লিখিতভাবে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগ থেকেই প্রচলিত রয়েছে এবং থাকবে। এ বিষয়ে মুসলিম অমুসলিমদের মধ্যে কোন বিতর্ক নেই এবং থাকতে পারে না। কারণ ধর্ম বিশ্বাসী অথবা অবিশ্বাসী সকলেই নিজ নিজ পরিভাষায় জ্ঞান অর্জনে এই মাধ্যমকে গ্রহণ করে থাকে। করণীয়-বর্জণীয় ব্যক্তি জীবন, সামাজিক জীবন এবং রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমও একই নিয়মে পরিচালিত হয়। একই নিয়মে আদালতে দণ্ডবিধি চূড়ান্ত করে রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর করা হয়। এ ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়তের স্বাতন্ত্র্য হলো দণ্ড-বিধি- যথা, চুরি সাব্যস্ত হলে কবজী পর্যন্ত হস্ত কর্তন, ব্যভিচার প্রমাণিত হলে বেত্রাঘাত এবং মধ্যপান সাব্যস্ত হলে হদ শাস্তি কার্যকর করা কেবল সরকারী ব্যবস্থাপনার অন্তর্ভুক্ত। ব্যক্তি গোষ্ঠি এবং পাঞ্চায়েতী ব্যবস্থাপনায় দণ্ডবিধি কার্যকর করণ ইসলামী শরীয়তে মোটেই সমর্থিত নয়, বরং কঠোরভাবে নিষেধ।
(২) ফাতওয়ার প্রভাব
একথা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত যে, মুহাম্মাদ বিন কাসেমের নেতৃত্বে ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম ইসলামী রাষ্ট্র এবং শাসনব্যবস্থা কায়েম হয় এবং দীর্ঘ কয়েক বছর স্থায়ী হয়। পরবর্তী সময়ে ইংরেজ তার মিত্র বাহিনীর সহায়তায় ভারতবর্ষ দখল করে এবং ইসলামী রাষ্ট্র খতম করে অমুসলিম রাষ্ট্র কায়েম করে এবং ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। মুসলমানদের উপর চরম নির্যাতন চালায়। বালাকোটের ময়দানে দশহাজার উলামা-মাশায়েখ এবং লক্ষ লক্ষ মুসলিম নর-নারীকে শহীদ করে। হাজার হাজার মসজিদ, মাদরাসা ও খানকাহ ধ্বংস করে দেয়। ইসলামী লাইব্রেরী, পবিত্র কুরআন ও হাদীসের লক্ষ কিতাবাদি পুড়িয়ে ছাইি করে ফেলে। ঠিক এই মুহূর্তে ইংরেজদের অনাধিকার চর্চা এবং দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে নিজ দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে ইংরেজ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে অসহেযোগিতার ডাক দিয়ে ফাতওয়া জারি করেন, সাহসী ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় বীর পুরুষ, হযরত শাহ ওলীউল্লাহ রহ.-এর পুত্র দূরদর্শী আলেমে দ্বীন হযরত মাওলানা আব্দুল আজীজ মুহাদ্দেসে দেহলভী রহ.। হযরত শাহ সাহেবের অসহযোগ আন্দোলনের ফাতওয়ায় সর্বস্তরের জনগণের সাড়া দেয়ার পরিণামে ইংরেজ বেনিয়ারা মারাত্মক প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। ইংরেজ বেনিয়ারা কোন উপায় না উক্ত বয়কট ফাতওয়ার বিরুদ্ধে ফাতওয়া তৈরীর প্রয়োজনে মীর জাফর বাহিনী সৃষ্টি করে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়। ইংরেজ বেনিয়াদের এদেশ থেকে চিরবিদায়ের মূল শক্তি হিসেবে শাহ সাহেবের ফাতওয়া ভূমিকা পালন করে। তখন থেকে ফাতওয়া শব্দটি সর্বমহলে এবং বিশেষ করে ইসলাম বিরোধী রাজনৈতিক মহলে পরিচিতি লাভ করে, সমালোচিত হতে শুরু করে। ইংরেজেরা ফাতওয়ার এই প্রভাবকে খর্ব করার জন্য কঠোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং অদ্যাবধি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে।
সাম্প্রদায়িকতা
বর্তমান বিশ্বে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, জুলুম, নির্যাতন, এবং নির্মূল করার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস অত্যন্ত ভয়াবহ। আফগানিস্তান-ইরাকসহ সমস্ত মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ এবং মুসলিম উম্মাহ সাম্রাজ্যবাদি শক্তির করতলে নিগৃহিত ও নির্যাতিত। ফাতওয়া সংক্রান্ত প্রোপাগাণ্ডা ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসেরই নামান্তর। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ নব্বই ভাগ মুসলিম জনগোষ্ঠির দেশ। অসম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে সারা বিশ্বে এদেশের যথেষ্ট সুখ্যাতি রয়েছে। এ দেশে রয়েছে ইসলামের অবর্ণনীয় অনুশীলন এবং দূর্গশক্তি। শান্তির ধর্ম ইসলামে বিশ্বাসী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে অমুসলিম সংখ্যালঘু সমাজ অত্যন্ত নিরাপদে রাজার হালে জীবন যাপন করে থাকে। তাদের প্রতি মুসলমানদের অসম্প্রদায়িক আচার-ব্যবহার মূলত ইসলামী শিক্ষা-চরিত্রেরই সুফল। কিন্তু মনে হচ্ছে মুসলমানদের সরলতা এবং সদাচরনকে তাদের দুর্বলতা মনে করা হচ্ছে, অথবা তাদেরকে উস্কানী দিয়ে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির পথ সুগমের ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। অন্যথায় বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এত অধিক অবহেলা প্রদর্শন করা হচ্ছে কেন? ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ইসলাম এবং মুসলমানদের উপর একের পর এক অসহনীয় কঠোর আঘাত হানা হচ্ছে কেন? ফাতওয়ার মত অত্যাবশ্যকীয় কার্যক্রমকে ছলে-বলে-কলে কৌশলে বন্ধ করার ভিত্তিহীন প্রোপাগাণ্ডা করা হচ্ছে কেন?
মুসলমানদের অধিকার
বাংলাদেশ সংখ্যাগষ্ঠি মুসলিম দেশ। এদেশের স্বাধীনতার জনক শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব লাহোর সম্মেলনে অতী গর্বের সাথে বাংলাদেশকে বিশ্বের ২য় সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশ হিসেবে দ্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে শতকরা নব্বই ভাগ মুসলিম মুক্তিযোদ্ধার রক্ত ঝরেছে। ৩০ লক্ষ্যের মধ্যে নব্বই ভাগ মুসলিম স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন। মুসলমান সমাজ সর্বশক্তিমান আল¬াহর একত্ববাদে বিশ্বাসী। তারা আল্লহপাক কর্তৃক শরীয়তের অনুশীলনের মাধ্যমেই কেবল অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে বিশ্বাসী। তাদের আরো বিশ্বাস, হযরত রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বশেষ রাসূল। তিনি নিষ্পাপ, তাঁর সমালোচনা করা মহাপাপ ও অমার্জনীয় অপরাধ। মুসলমানদের নিকট রাসূলে পাক সাল্লাল্রাহু আলাইহি ওয়াসাল্লম তাদের জান-মাল ও ইযযত-সম্মানের চেয়ে অধিক মূল্যবান। মুসলমান জনগোষ্ঠি সাহাবায়ে কেরামদেরকে সমালোচনার ঊর্ধ্বে মনে করে তাদেরকে শরীয়তের মাপকাঠি বিশ্বাস করে এবং তাদের অনুসরণকে রাসূলে পাকের অনুসরণ বলে বিশ্বাস করে। মুসলমানগণ আইম্মায়ে মুজতাহিদীন ও ওলামা মাশায়েখদেরকে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঠিক উত্তরসুরী এবং উম্মতের দিকনির্দেশনাকারী সর্বজন শ্রদ্ধেয় বলে বিশ্বাস করে। মুসলমানগণ পবিত্র কুরআন হাদীসকে আল্লাহপাকের অহি মনে করে এবং কর্মজীবন ও আখেরাতের জন্য একমাত্র মুক্তির সনদ এবং অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের পাথেয় বিশ্বাস করে। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম নাগরিকদের নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার কোন সুযোগ আছে কী? আছে কী ভবিষ্যত কোন পরিকল্পনা?
বাংলাদেশের যমীনে মহান স্রষ্টা আল্লাহপাকের ক্ষমতাকে খর্ব করে জনগণকে ক্ষমতার উৎস বলা হয়। আল্লাহ পাকের নির্দেশনা এবং বিধি-নিষেধকে কেবল অবমাননাই নয় রীতিমত প্রত্যাখান করার পথ সুগম করা হয়। বিশ্ব নবীর সমালোচনা করা হয়। তাঁকে অনিষ্পাপ আখ্যায়িত করে ইসলামের ভিত্তি নস্যাৎ করার ন্যক্কারজনক প্রয়াস চালানো হয়। নবীর নামে মিথ্যাচার ও অপপ্রচার চালানোর সেমিনার করা হয়। তাঁর বিকৃত কার্টুন প্রকাশ ও প্রচারের ধৃষ্টতা দেখানো হয়।
সাহাবায়ে কেরাম সমস্ত মুসলিম জাতি শ্রদ্ধাভাজন, তাঁরা আখেরী নবী সা.-এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে লালিতপালিত, তাঁদেরকে স্বয়ং নবী সা.-ই বিশ্ব মানবতার জন্য প্রতীক বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু আজ তাদের কেবল মৌখিক সমালোচনাই করা হচ্ছে না বরং বই-পুস্তক লিখে ও প্রচার করে তাদেরকে হেয়প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। উলামা-মাশায়েখদেরকে তিরস্কার করা হচ্ছে। পবিত্র কুরআন ও হাদীসের বিজ্ঞ শিক্ষিতদেরকে মূর্খ, সমাজের জন্য বোঝা এবং তাদের কর্মস্থল মসজিদ, মাদরাসা ও খানকাহসমূহকে জঙ্গীবাদির উৎস সাব্যস্ত করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। পবিত্র কুরআনের অবমাননা হচ্ছে অহরহ। পায়খানায় নিক্ষেপ করা, পায়ের নীচে রেখে দলিত করা, তদরূপ কুকুরের মাথায় টুপি ধারণ করার মত জঘন্য অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে। এভাবে মুসলমানদেরকে বারবার আঘাত করা হচ্ছে, অথচ এর কোন সুনির্দিষ্ট প্রতিকার নেই, নেই কোন প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় দণ্ডবিধি।
বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুতি
আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক সংসদ রয়েছে। ৯০% মুসলমানদের ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্য, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ প্রশাসনের ৯০% ব্যক্তি ইসলামে বিশ্বাসী। আল¬াহপাককে সর্বশক্তিমান এবং বিশ্ব রাসূলকে মুক্তির দিশারী সর্বশেষ রাসূল বলে বিশ্বাস করে। কিন্তু অতীতের কোন সরকার মুসলমানদের অধিকার বিশেষ করে ধর্মীয় অধিকার প্রতিষ্ঠায় কোন কর্মসূচী আইনগত করে নি। আইনগত দণ্ডবিধিও নির্ধারণ এবং পাশ করা হয় নি। বর্তমান সরকার নির্বাচনী এশতেহারে ইসলাম ক্ষং মুসলমানদের সার্বিক অধিকার রক্ষায় প্রতিশ্র“তিবদ্ধ। তাদের গণতান্ত্রিক এবং ধর্মীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা দিয়েছে। জনগণ প্রতিশ্র“তি বাস্তাবয়নের অপেক্ষায় অধীরচিত্ত হয়ে আছে।
ইতিমধ্যে একমুখী জাতীয় শিক্ষার চূড়ান্ত শিক্ষানীতি আমাদের হস্তগত হয়েছে। এতে দেশবাসী হতাশার মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে। সরকারের প্রতিশ্র“তি আদৌ বাস্তব ছিল কি না জনমনে এ নিয়ে বিরাট সংশয় দেখা দিয়েছে। কেননা এই শিক্ষা নীতিতে বলা হয়েছে
(১) এই শিক্ষানীতি সংবিধানের নির্দেশানুযায়ী দেশে সেক্যুলার গণমুখীসূলভ সুষম সার্বজনীন সুপরিকল্পিত এবং মানসম্পন্ন শিক্ষা দানের সক্ষম শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার ভিত্তি ও রনকৌশল হিসেবে কাজ করবে। আমাদের জানা মতে সংবিধানে “আল্লাহ সর্বশক্তিমান এবং বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম বিদ্যমান রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানকে ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক সংবিধান বলা হয়ে থাকে। এমতাবস্থায় সাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে যে, এই শিক্ষানীতির লক্ষ্য যদি সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থা কায়েম করার রণকৌশল হয়, তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জাতির শিক্ষা-দীক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হবে কী রূপে, অথবা ইসলাম একটি ধর্ম হিসেবেই এদেশে অস্তিত্ব বজায় রাখবে কীভাবে? কারণ সেক্যুলারের অভিধানিক অর্থ হচ্ছে- আত্মিক অথবা ধর্মীয় বিষয়ের সাথে সম্পর্কহীন শিক্ষা ব্যবস্থা। এই শিক্ষাব্যবস্থা চালু হলে ধর্মীয় অবস্থান শূন্যের কাতারে দাঁড়াবে, আর গণতন্ত্র হবে পদদলিত। পক্ষান্তরে সেক্যুলার একটি মত ও পথ এর রয়েছে বিশ্বাসসম্পর্কীয় বিষয়াদি। যেমন, আল¬াহর অস্তিত্বের অস্বীকার মৃত্যুর পর পুনর্জীবন, আখেরাত ইত্যাদি বিষয়াদির অবিশ্বাস। অতএব সেক্যুলার মূলত এক ধরনের মত ও পথ অর্থাৎ একটি ধর্মেরই নামান্তর। এমতাবস্তায় ধর্মরিপেক্ষতার অবকাশ সেক্যুলারেও নেই। বোঝাগেল, এ ধরনের জাতীয় শিক্ষানীতি বাংলাদেশ সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতন্ত্র উভয়ের মাঝে সাংঘর্ষিক।
(৩) জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে বলা যায় যে, এই শিক্ষানীতির মাধ্যমে সুকৌশলে ধর্মীয় শিক্ষা তথা ইসলামী শিক্ষাকে দুর্বল করা বরং খতম করার প্রয়াস প্রতীয়মান হয়। কেননা জাতীয় শিক্ষানীতির ৮ বৎসর প্রাইমারী শিক্ষার ১ম ও ২য় শ্রেণী পর্যন্ত ধর্মশিক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ফলে ৭/৮ বৎসর বয়সপর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের ধর্মসম্পর্কে কোন প্রকার ধর্মীয় জ্ঞান লাভের উপায় থাকবে না। অথচ ইসলামে ৭ বৎসর বয়সে নামায পড়ার তাকীদ রয়েছে। সুতরাং অযু, নামায ইত্যাদি মাসআলা-মাসায়েলের শিক্ষা দেয়া অত্যবশ্যকীয়।
(৪) ১ম ও ২য় শ্রেণীর পরের শ্রেণীসমূহে জীবনী ও গল্পভিত্তিক ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা দানের অস্পষ্ট শিক্ষাক্রমের কথা বলা হয়েছে। ৩য় শ্রেণী থেকে মাত্র একঘণ্টা ধর্মীয় শিক্ষার জন্য বরাদ্দ করা মূলত ধর্মশিক্ষা থেকে বঞ্চিত রাখারই প্রয়াস। তাছাড়া তাজবীদের সাথে পবিত্র কুরআন শিক্ষা করার কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি মোটেই।
(৫) পবিত্র কুরআন মুখস্থ করা মুসলিম জাতীর গৌরবময় ঐতিহ্য ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার কারণে পবিত্র কুরআন মুখস্থ করার পথ বন্ধ করা হয়েছে। কারণ, হাফেয হওয়ার সাধারণ বয়স হচ্ছে ৬-১২ পর্যন্ত। ৮ বৎসর প্রাইমারী পড়াশুনা শেষ করে ১৪/১৫ বৎসর বয়সে তাদের জন্য হেফয করার মন মানসিকাত থাকে না। তাছাড়া ৮ বৎসরের বাধ্যতামূলক বিশাল সিলেবাস পাঠের সাথে হিফয করা মোটেই সম্ভব নয়। কেননা হিফয করার সময় অন্য কোন বিষয়ে মনযোগী হলে হিফয করা সম্ভব হয় না।
(৬) ৮ বৎসরের প্রাইমারী শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক না করে ঐচ্ছিক করে নিলে পবিত্র কুরআন মুখস্থ করার অবকাশ থাকতো,। তেমনিভাবে বাধ্যতামূলক পাঠ্যসূচীর বাইরে পড়শুনার জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের শর্ত আরোপ না করে ধর্মীয় শিক্ষার অবকাশ দেয়া যেতো। কিন্তু কেন এই অবকাশ না দিয়ে ধর্মীয় ও গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে, জনগণ এই রহস্য জানতে।
(৭) একশ্রেণীর শিক্ষাবিদ ও গবেষক কথায় কথায় আমাদেরকে পাশ্চাত্বকে অনুসরণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আমাদের জাতীয় নীতিতেও এরূপ দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। কিন্তু ভারত, আমেরিকা, ইউরোপ, বৃটেন, আফ্রীকাসহ সারা বিশ্বে এ লেবেল-ও লেবেল, পরীক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে এবং অনেক দেশে কাওমী শিক্ষা ব্যবস্থার স্বতন্ত্র স্বীকৃতি বিধিত রয়েছে। অথচ শতকরা নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশে কওমী শিক্ষা সিলেবাসকে স্বীকৃতির অধিকার থেকে কেবল বঞ্চিতই করা হচ্ছে না বরং খতম করে দেয়ার নীলনকশা বাস্তবায়নে একটি দল অতী গোপনে সক্রীয় হয়েছে।
(৮) জাতীয় শিক্ষানীতির এ সমস্ত দিক সংশোধনের ব্যাপারে যথেষ্ট পরামর্শ দেয়া হয়েছে এবং লেখালেখিও কম হয়নি। দেশের শীর্ষস্থানীয় ওলামা-মাশায়েখদের সাথে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার মতবিনিময় করে তাদেরকে আশ্বস্থ করেছেন। এসব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে এদেশের মুসলিম জনগণ। অতীতের সরকারগুলোও আলেম-উলমাাদেরকে আশ্বাস দিয়েও নিরাশ করেছে। বর্তমান সরকারের নিকট আমরা এরূপ আচারণের আশা করি না। বিষয়টি গভীরভাবে বিচেনায় আনা প্রয়োজন।
ফাতওয়া ইস্যু
জাতীয় শিক্ষানীতির বিষয়টি নিয়ে যখন মুসলিম সম্প্রদায় তাদের শিক্ষাগত অধিকার থেকে বঞ্চিতের বেদনায় ভুগছে ঠিক সেই মুহূর্তে ফাতওয়া ইস্যু মুসলিম জাতিকে আতংকিত করে তুলেছে, বিগত সরকার সমূহের আমলে দেশের জনগণ এবং আলেম-উলামাদের হাজারো আবেদন-নিবেদন মোটেই কর্ণপাত করা হয় নি, তবে ফাতওয়া প্রদান নিষেধ আইন চূড়ান্ত পাশ করাও সম্ভব হয়নি। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে বিষয়টিকে গোপনে রেখে চূড়ান্ত করেছে বলে মিডিয়ায় প্রকাশ পেয়েছে। মুসলিম জাতির ধর্মীয় অধিকার খর্বের এমন একটি আইন বিশ্বের ইতিহাসে এটাই প্রথম। মুসলমানদের জন্য এটা অত্যন্ত কলংকজনক। বিশ্বে এর কোন নজীর নেই। এরূপ আইনকে চূড়ান্ত করা গণতন্ত্র বিরোধী কী না এবং মুসলমানদের শিক্ষাগত অধিকার খর্ব হয় কী না, সরকারের গভীরভাবে ভেবে-চিন্তে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
(৯) ফাতওয়ার ব্যাপারে পর্যালোচনা
ফাতওয়ার ব্যাপারে চূড়ান্ত রায়ে যা বলা হয়েছে, তার ব্যাখ্যা দুভাবে করা যেতে পারে। (ক) যেহেতু অতীতে গলদ ফাতওয়া এবং বে আইনীভাবে কার্যকর করার কারণে সমাজের শান্তি শৃংখলা বিনষ্ট হয়েছে, তাই অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে ফাতওয়া দেয়ার কাজকে চূড়ান্তভাবে নিষেধ করা হলো।
(খ) ফাতওয়া সঠিকভাবে দেয়া নিষেধ নয়, বরং গলদ ফাতওয়া দেয়া ও তা কার্যকর করা নিষেধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ‘ক’ তে উলে¬খিত কারণে ফাতওয়া নিষিদ্ধ হওয়ার আইন পাশ হয়ে থাকলে সাধারণভাবে কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। তবে এমতাবস্থায়ও চুড়ান্তভাবে ফাতওয়া নিষেধ করণ কেবল গণতন্ত্র বিরোধীই নয়, বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জাতির ধর্মীয় অধিকার খর্ব করার শামিল। কারণ, অনেক ডাক্তারদের গলদ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করণ এবং কার্যকর করণের ফলে পূর্বে বহু রোগীর মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে, ইঞ্জিনিয়ারের ভুলের কারণে বহু বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়েছে, গলদ প্রশ্নমালার কারণে পরীক্ষায় বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়েছে। বিগত কয়েক বৎসরে স্কুল, কলেজ ও ভার্সিটিতে বহু যুবক-যুবতী, মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী শত্রুতা, ব্যভিচার, প্রেম ভালোবাসা ইত্যাদি কারণে খুন হয়েছে। আত্মহত্যা করেছে ও এসিডের শিকার হয়েছে। তদরূপ গলদ ড্রাইভিং-এর কারণে প্রতি বৎসর হাজার হাজার নর-নারী এবং নিষ্পাপ শিশুরা প্রাণ হারায়। তাহলে ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কাজ বন্ধ করা হয় না কেন? বন্ধ করে দেয়া হয় না কেন? যে কারণে এসব বন্ধ করা হয় না ঐ কারণ তো ফাতওয়ার ক্ষেত্রে বিদ্যমান।
গলদ ফাতওয়া দানকারী এবং তা কার্যকরকারীদের জন্য শাস্তির বিধান করা যেতে পারে। কিন্ত সঠিক ফাতওয়া দান করাও বন্ধ করে দেয়া কীভাবে যুক্তিযুক্ত হতে পারে না? এটা মুসলিম জাতির প্রতি বৈষম্য আচরণ এবং তাদের ধর্মীয় অধিকার খর্বের মধ্যে গণ্য হবে। অন্যান্য জাতির ক্ষেত্রেও কী প্রশ্নোত্তরের ভুলের কারণে এর ধারা বাহ্যিকভাবে বন্ধ করার কোন প্রয়াস গ্রহণ করা হয়েছে কী এই প্রশ্নও জটিল হয়ে উঠবে।
আর ‘খ’তে উল্লেখিত কারণে ফাতওয়া নিষেধ করা হয়ে থাকলে কারো কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। কেননা ফাতওয়ার মাধ্যমে মাসআলা মাসায়েলের জ্ঞান অর্জন করা শরীয়তের এবং অনুশীলনের জন্য একটি জরুরী বিষয়, অযোগ্য ব্যক্তিদের গলদ ফাতওয়া প্রদান ও তা কার্যকর করণ মোটেই শরীয়তসম্মত নয়। এ হিসেবে গলদ ফাতওয়া বন্ধের প্রয়াস অত্যন্ত সঠিক ও গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত। বিষয়টিকে পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করা যাক।
(১০) ফাতওয়া বোর্ড
অন্যান্য মুসলিম দেশের ন্যায় আমাদের দেশেও নগণ্য সংখ্যক বিভিন্ন মাযহাবের অনুসারী বিদ্যমান রয়েছে। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো গায়রে মুকাল্লিদ ওরফে আহলে হাদীসের অনুসারী। তাদের মধ্যেও রয়েছে মত ও পথের বিভিন্নতা। মূলত এ দেশের মুসলিম সমাজ চাই সুন্নী বা ওয়াহাবী অথবা বিদআতী হোক, সকলেই হানাফী মাযহাবের অনুসারী। সুতরাং সর্বশ্রেণীর নির্ভরযোগ্য ওলামা-মাশায়েখ এবং নির্ভরযোগ্য মুফতী সাহেবদের সাথে মতবিনিময়ের মাধ্যমে অভিজ্ঞ মুফতীগণের সমন্বয়ে একটি ইফতা বোর্ড কায়েম করে স্ব স্ব মাযহাব অনুসারে ফাতওয়া প্রদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এই বোর্ডের অধীনে সারা দেশে আঞ্চলিক বোর্ডের সহায়তায় ফাতওয়া দানের ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। সমস্যা সমাধানের অবিকল্প পথ এটাই। এটাই হবে যে কোন সরকারের জন্য যুগান্তকারী পদক্ষেপ এবং সংশ্লিষ্ট মুসলিমদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং আস্থা অর্জনের উপায়।
www.dawatul-haq.com