যবানের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া
লিখেছেন: ' মাসরুর হাসান' @ শুক্রবার, ডিসেম্বর ৩১, ২০১০ (৫:১৬ অপরাহ্ণ)
মুহিউস সুন্নাহ হযরত মাওলানা আবরারুল হক রহ.
যবানের হাকীকত
যবান মস্ত বড় স্পর্শকাতর অঙ্গ। সে আনুগত্যও করে আবার নাফরমানীও করে। হিত সাধনকারীও আবার ক্ষতিকরও বটে। এ কারণেই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনÑ “যখন সকাল হয় তখন প্রতিটি মানুষের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যবানের সামনে কাকুতি মিনতি করে বলে, আমাদের ব্যাপারে তুমি আল্লাহকে ভয় কর, এই জন্য যে, আমরা তোমার নেতৃত্বে চলি। তুমি ঠিক থাকলে আমরা ঠিক, তুমি বাঁকা হলে আমরা সবাই বাঁকা। (তিরমিজি : ২/৬৩)
প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস মোল্লা আলী ক্বারী রহ. এ সম্পর্কে বলেন, “সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সম্পর্ক যবানের সাথে এই রকম যে, এটি মানুষের কুফর ও ঈমানের মুখপাত্র ও হাতিয়ার। এই জন্য যবানের ভারসাম্য ও দৃঢ়তা হিতসাধনকারী আর বক্রতা ক্ষতিকর হয় অন্যান্য অঙ্গের জন্য।
যবানের দ্বীনি ও পার্থিব ক্ষতি
যবান প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে সাধারণত চিন্তা-বিবেচনা ও সতর্কতা অবলম্বন করা হয় না বলে মুখে যা আসে নির্বিবাদে তাই বলে দেওয়া হয়, অথচ এই অবিবেচনা প্রসূত কথার কারণে কত ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। আমাদের সামনে বাক-বিতণ্ডা ও ঝগড়া-বিবাদ থেকে যত সব হাঙ্গামা হচ্ছে তার ইস্যু খোঁজ করলে দেখা যাবে যে, ঐ অবিবেচনাপ্রসূত কথা। পার্থিব ক্ষতি যেমন হয় তেমনি দ্বীনি ক্ষতিও কোন অংশে কম হয় না। কখনো কখনো হাসি-তামাশা ও ফুর্তির সাথে এমন বাক্য ব্যয় করা হয় যার পরিণতি হয় অত্যন্ত ভয়াবহ। হাদীসে পাকে বর্ণিত হয়েছেÑ মানুষ মুখের দ্বারা বেশি পদস্খলিত হয়, পা পিছলিয়ে পড়ার চেয়ে। (মেশকাত : ২/৪১৩) মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোন জিনিস থেকে থাকলে তা এই যবানই। একবার হুজুর আকদাস সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় যবান মুবারকের প্রতি ইঙ্গিত করে হযরত মায়াজ ইবনে জাবাল রা. কে বলেছিলেন,“স্বীয় যবানকে সংযত ও নিয়ন্ত্রণে রাখো।’ একথার প্রেক্ষিতে হযরত মায়াজ রা. জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমরা যে কথা বলি এ ব্যাপারেও কি জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে? উত্তরে তিনি ইরশাদ করলেন, “হে মায়াজ! তুমি একথা জেনে রেখ, মানুষকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে তাদের মুখের খারাপ কথা।”
জনৈক সাহাবী রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, “আমার সম্পর্কে সব চেয়ে বেশি কোন জিনিসকে আপনি ভয় করেন, তখন তিনি স্বীয় যবান মুবারক ধরে বলেছিলেন, “যবানের খারাবী ও অনিষ্টতাকে।”
গীবতের ক্ষতি ও তার তীব্রতা
আজকাল শয়তান আমাদেরকে যবানের গোনাহে লিপ্ত করে ফেলছে আর আমরা মনে করছি কিছুই হয়নি। বড় বড় যেসব গোনাহতে আজকে সবাই লিপ্ত, তার ভিতর অন্যতম হচ্ছে কু-ধারণা,খারাপ কথা বলা, কুদৃষ্টি এবং পরশ্রীকাতরতা। গীবত এমন এক গোনাহ যাতে ভাল নেককারদেরকেও শয়তান লিপ্ত করে ছাড়ে। এজন্য নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, “গীবত যিনার চেয়েও মারাত্মক।” গীবত যিনার চেয়ে মারাত্মক কিভাবে হতে পারে? এ ব্যাপারে সাহাবাগণ বিস্মিত হলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ গীবত কি করে যিনার চেয়ে মারাত্মক হতে পারে? তদুত্তরে তিনি বললেন, “কোন মানুষ জিনা করার পর তওবা করলে আল্লাহ পাক তার তওবা কবুল করে নেন, কিন্তু গীবতকারীর গোনাহ ততক্ষণ পর্যন্ত মার্জনা হয় না যতক্ষণ পর্যন্ত যার গীবত করা হয়েছে সে ক্ষমা না করে দেয়।” (মেশকাত : ২/৪১৫)
বোঝা গেল যিনার গোনাহের চেয়ে গীবতের গোনাহ এই জন্য বেশি যে, জিনাকারীকে আল্লাহ তায়ালা তওবা ও ইস্তিগফারের দ্বারা মাফ করে দিবেন, কিন্তু গীবতের গোনাহ যার গীবত করা হয়েছে তার থেকে মাফ না নিলে মাফ হবে না। নিন্দিত ব্যক্তি যদি নিন্দুকের থেকে হাজার রাকাত নামায, হজ্ব ও সদকার সোয়াব দাবী করে তাহলে তাকে তাই দিতে হবে। বেশি ইবাদত বন্দেগী করে গীবত করলে বিনিময়ে সমস্ত সোয়াব অন্যের আমল নামায় চলে যাবে। ইমাম আব্দুল ওয়াহাব শারানী রহ. বলতেন, ‘আমাদের মুরব্বীগণ গীবত না করার উপর বাইয়াত করতেন। তারা এ ব্যাপারে খুবই পরহেয করে চলতেন। সেই যুগের একজন বুজুর্গ হযরত আকমাল উদ্দিন রহ এর আমল সম্পর্কে বলা হয়, তিনি তাঁর মজলিসে কাউকে এই শর্তের উপর বসতে অনুমতি দিতেন যে, গীবত করবে না। অন্যথায় মজলিস থেকে উঠিয়ে দিতেন। হযরত হাসান বসরী রহ. এর একটি ঘটনা ইমাম শারানী রহ. বর্ণনা করেছেন যে, একবার তিনি আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে কোথাও গিয়েছিলেন। মজলিসে মেজবান গীবত শুরু করে দিল। তখন তিনি বললেন, লোকেরা প্রথমে মানুষকে রুটি খাইয়ে থাকে আর তুমি আমাকে নড়িভুড়ি খাইয়ে দিলে। একথা বলে তিনি না খেয়ে উঠে গেলেন।
বেহুদা কথার পরিণাম
হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ. বলেন, “বুযুর্গগণ বেশি কথা বলার ভিতর এই ক্ষতি আবিস্কার করেছেন যে, এর কারণে গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা মুশকিল হয়। একথা অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত সত্য যে, যারা বেশি বক বক করে তারা অনিবার্যত মিথ্যা ও পরনিন্দায় জড়িয়ে পড়ে। বেশি কথা বললে চিন্তা-ভাবনা করে ধীর মস্তিষ্কে বলা এবং যবানের গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা মুশকিল হয়ে পড়ে। যদি কেউ ব্যতিক্রমি হয়ে গোনাহ থেকে বেঁচেও থাকে তবুও কথার দরুন এক প্রকার ক্ষতি থেকে বাঁচতে পারে না। সেটি কী? কবি বলেছেনÑ
বেশি কথা বললে অন্তর মরে যায়,
যদিও তা মুক্তাতুল্য সুন্দর হয়।
অর্থাৎ বেশি কথায় অন্তরের মৃত্যু ঘটে, অন্ধকার সৃষ্টি হয়। অন্তর কঠিন হয়ে পড়ে। আমল ও আখলাকের দ্বারা ক্বলবে যে নূর সৃষ্টি হয় তার অধিকাংশই যবানের অযথা কথা বলার দ্বারা দূর হয়ে যায়।
অন্য আরেক স্থানে তিনি বলেন, আরেফীনদের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণে এ সত্য প্রমাণিত হয়েছে যে, দিনভর প্রয়োজনীয় কথোপকথনে অন্তরে অন্ধকার-প্রভাব রেখাপাত করে না। ফলের দোকানদার কিংবা ফেরী ওয়ালা দিনভর তার আসবাবপত্র বিক্রির জন্য হাকডাক দিয়ে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করলে তাতে অন্তরে অন্ধকার আসবে না, কারণ এটা তো জীবিকার প্রয়োজনে। আর নি®প্রয়োজনে একটি বাক্যও যদি যবান থেকে বেরিয়ে পড়ে তাহলে তাতে দিল কাল হয়ে যায়।
সজীব ক্বলবের গুরুত্ব
ক্বলব বা অন্তর অন্ধকার ও শক্ত হওয়ার দ্বারা কি ক্ষতি হয় এ সম্পর্কে হযরত হাকীমুল উম্মত বলেন, এটা এমন এক মুসিবত যার পর যে কোন গোনাহে লিপ্ত হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। সমস্ত ইবাদতের কেন্দ্রবিন্দু কলবের সজীবতা। নেক কর্মের তাওফীক তো ক্বলবের নুরের দ্বারা হয় আবার সমস্ত গোনাহের প্রতিক্রিয়া অন্ধকার, সেটাও অন্তরে প্রতিফলিত হয়। তো যখন গীবত কিংবা বেহুদা কথার কারণে অন্তরে সজীবতা ও নুর থাকল না বরং সেখানে জন্ম হলো অন্ধকার ও কাঠিন্য তখন এমন অন্তরের অধিকারী ব্যক্তি যে কোন গোনাহের উপযুক্ত হয়ে পড়ে।
অল্প কথার উপকারিতা
আমরা অহেতুক কথার অপকারিতা ও ক্ষতিসমূহ জানতে পারলাম। তাহলে এই বেশি কথা বলা থেকে বেঁচে থাকার উপায় কী? উপায় হলো, খুব বেছে কথা বলা এবং নি®প্রয়োজনীয় বাক্য ব্যয় না করা। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- “নির্লিপ্ত ও চুপ থাকাটা বড় বিজ্ঞতা এবং এর উপর আমলকারীদের সংখ্যা অল্প। অন্য আরেক হাদীসে এসেছে, ‘যে চুপ থাকে সে মুক্তি পায়। আরেক হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে, তার উচিত কথা বললে ভাল কথা বলবে নতুবা চুপ থাকবে। এই হাদীসের ব্যাখায় ইমাম নববী রহ. বলেন, ‘এই হাদীস স্পষ্টত একথা বুঝায় যে, মানুষের জন্য কর্তব্য হলো ভাল কথা বলা, আর ভাল ও মূল্যবান কথা সেটাই যেটা উপকারী। আর যে কথা উপকারী হওয়ার ব্যাপারে সংশয় থাকে সে কথা বলা থেকে বিরত থাকা।
কথা বেছে বলা পূর্ণতা
বোঝা গেল, কথা বলার ক্ষেত্রে বেছে বেছে বলার ভিতরই পূর্ণতা ও যোগ্যতা বিদ্যমান। আল্লাহওয়ালা ও বুযুর্গগণ বেশি কথা বলা থেকে বেঁচে থাকতেন এবং এড়িয়ে যেতেন, যাতে যবানের কোন গোনাহ না হয়। এজন্য তারা উপায় উদ্ভাবন করতেন। হযরত রবী রহ.-এর আমল ছিল যে, সকাল হলেই তার নিকট একটি কলম ও সাদা কাগজ রাখা হতো। যখন কথা বলতেন তখন তা লিখে নিতেন, অতঃপর সন্ধ্যার সময় এ ব্যাপারে নফসের সাথে পর্যালোচনা করতেন।
হযরত হাকীমুল উম্মত একটি ঘটনা বলেছেন যে, এক বুযুর্গ কারো বাড়িতে গমন করে দরজায় দাঁড়িয়ে ভিতরের কাউকে ডাকলেন। অন্দর মহল থেকে উত্তর এল বাসায় নেই। জিজ্ঞাসা করলেন কোথায়? উত্তর এল, জানি না। এই কথাটুকু বলার কারণে ঐ বুযুর্গ ৩০ বছর পর্যন্ত এই বলে ক্রন্দন করেছেন যে, “সে কোথায়” এই অযথা কথাটুকু আমি কেন বলেছি, আমার আমলনামায় তো অযথা কথা লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে। অথচ সে মুমিনই কামিয়াব, যে বেহুদা জিনিস পরিহার করে চলে।
কথার প্রকারভেদ ও তার হুকুম
এজন্য যখন কথা বলা হয়,তখন চিন্তা করে নেয়া উচিত যে, আমি যে কথা বলবো তা সঙ্গত কী না। যদি সঙ্গত ও ভাল হয় তাহলে বলবে নতুবা চুপ থাকা উত্তম। ইমাম গাজালী রহ. কথা চার প্রকার বলে উল্লেখ করেছেন
(১) যে কথার দ্বারা শুধু ক্ষতি আর ক্ষতি।
(২) যাতে ক্ষতিও আছে আবার লাভও আছে।
(৩) যাতে কোন উপকারও নেই এবং ক্ষতিও নেই। এটাই বেহুদা কথা।
(৪) যে কথা উপকারী হয়।
ইমাম গাজালী রহ. বলেন, প্রথম প্রকার কথা থেকে পরহেয করে চলা অপরিহার্য। দ্বিতীয় প্রকার কথার ক্ষেত্রেও এই হুকুম। এখন রইল তৃতীয় প্রকারের কথা, এতে লিপ্ত হওয়া প্রকারান্তরে ক্ষতি ও সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কোন ফলাফল নেই। চতুর্থ নম্বরের যে কথা লাভ ও উপকার সাধনকারী, তার ভিতর কখনো এমনও কিছু কথার সংমিশ্রণ থাকে যা কার্যত ক্ষতিকর ও গোনাহের কারণ। মোটকথা যবানের হিফাজত খুবই প্রয়োজন, যার উপর পরিত্রান ও মুক্তি নির্ভরশীল।