ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান
লিখেছেন: ' মাসরুর হাসান' @ শুক্রবার, ডিসেম্বর ৩১, ২০১০ (৫:৫৭ অপরাহ্ণ)
মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমূদুল হাসান
স্থান : গুলশান সেন্ট্রাল জামে মসজিদ তারিখ : ২৬/১১/১০ ইং
আল্লাহর বাণী পৌঁছানোর মাধ্যম
উম্মতের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছানোর মাধ্যম হলেন নবী-রাসূলগণ। সেই ধারাবাহিকতায় আখেরী উম্মতের কাছে আল্লাহর সকল দিকনির্দেশনা ও বিধি-নিষেধ পৌঁছেছে আখেরী নবীর মাধ্যমে। এই মাধ্যম ব্যবহার না করে সরাসরি উম্মতের কাছে বাণী অবতীর্ণ করলে তাদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না যে, সেগুলো শুনবে, বুঝবে ও ধারণ করবে। হযরত মুসা আ. মানসিক ও শারীরিকভাবে এত শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহর তাজাল্লিতে তুর পাহাড়ে বেহুশ হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। তবে হ্যাঁ ময়দানে হাশরে আল্লাহপাক মানুষকে এমন শক্তি দান করবেন যে, মানুষ সেদিন আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এবং কথাবার্তা বলতে সক্ষম হবে।
প্রকৃত শান্তি ও সফলতার পথ
আখেরী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সময় থেকে কেয়ামত পর্যন্ত আগত সকল মানুষের ইহকালিন ও পরকালীন সুখ-শান্তি ও সফলতার পথ দেখানোর জন্য আল্লাহপাক সায়্যেদুল আম্বিয়া হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নির্বাচন করেছেন। অতএব নির্দ্বিধায় একথা বলা যায় যে, মুসলিম, ইহুদী, খৃষ্টান, হিন্দু ও বৌদ্ধসহ সকল জাতির শান্তি ও সফলতার জন্য একমাত্র পথ হলো রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পূর্ণ অনুসরণ অনুকরণ। যারা নবীর আদর্শ ও পথকে অনুসরণ করবে না তারা কোনদিনও প্রকৃত শান্তি সফলতার পথ খুঁজে পাবে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
অর্থ:“যদি মূসা আ. জীবিত থাকতেন তাহলে আমার অনুসরণ করতে বাধ্য থাকতেন।” অর্থাৎ ইহুদী-খৃষ্টান তো দূরের কথা যদি তাদের নবীগণও জীবিত থাকতো তাহলে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ-অনুকরণ করা ছাড়া তাদের নাজাতের উপায় থাকতো না।
মুসলমানদের আকীদা হলো হযরত ঈসা আ.-কে জীবিত অবস্থায় আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। কেয়ামতের পূর্বে পুনরায় দুনিয়াতে আসবেন। ইহুদীদের আকীদা হলো হযরত ঈসা আ. কে হত্যা করা হয়েছে। খৃষ্টানদের অনেকের ধারণাও তাই। যারা বলে হযরত ঈসা আ. কে শুলে চড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে তাদের ধারণা একদম ভিত্তিহীন। মুসলমানরা যদি এমন আকীদা রাখে তাহলে তাদের ঈমান নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। আল্লাহপাক পবিত্র কুরআনে বলেছেন
অর্থ: তারা তাঁকে (ঈসা আ.) হত্যা করতে পারেনি, ক্রুশবিদ্ধও করতে পারেনি বরং তাদের ধাঁধাঁয় ফেলা হয়েছিল। এ বিষয়ে যারা মতানৈক্য করে তারা তো নিঃসন্দেহে সন্দেহের মাঝে পড়ে আছে। এই সম্পর্কে অনুমানের অনুসরণ করা ব্যতীত তাদের কোন জ্ঞানই নেই। একথা নিশ্চিত যে, তারা তাকে হত্যা করতে পারেনি বরং আল্লাহ তাঁকে নিজের কাছে উঠিয়ে নিয়েছেন।
ইহুদীদের ভ্রান্ত ধারণা এবং তার কারণ
ইহুদীরা যখন হযরত ঈসা আ. কে হত্যা করতে ঘরে প্রবেশ করলো তখন আল্লাহপাক তার নিজ কুদরতে তাঁকে আকাশে উঠিয়ে নিলেন। আর যে ব্যক্তি হত্যা করার ইচ্ছায় প্রথমে ঘরে প্রবেশ করেছিল আল্লাহপাক তার চেহারাকে হযরত ঈসা আ.-এর চেহারায় রুপান্তরিত করে দিয়েছিলেন। তখন অন্যরা তাকেই হযরত ঈসা মনে করে হত্যা করেছিল। হত্যাকারীদেরকে তখন এটা বুঝানো অসম্ভব ছিলো যে, সে আসল ঈসা নয়, নকল ঈসা। আল্লাহপাকের দয়া যে, তিনি কুরআনের মাধ্যমে এর সত্যতা আমাদেরকে জানিয়েছেন। চোখের দৃষ্টির চেয়ে আমাদের কুরআনের উপর বিশ্বাস বেশি। ইহুদী খৃষ্টানদের বিশ্বাস কুরআনের উপর নেই বলে এখনো তারা অন্ধ বিশ্বাসে নিমজ্জিত হয়ে আছে। ইহুদীদের দাবী হলো, তারা হযরত ঈসা আ. কে হত্যা করেছে, শুলিবিদ্ধ করেছে। তাদের ধারণায় হত্যার কারণ হলো, তিনি জারজ ছিলেন, (নাউযুবিল্লাহ)। কারণ তিনি পিতা ছাড়া দুনিয়াতে এসেছিলেন। ইহুদীদের কথাকে খৃষ্টানরাও মেনে নিয়েছে।
ইহুদী-খৃষ্টানদের ইতিহাস এবং কুরআন
ইহুদী-খৃষ্টানদের রচিত ইতিহাস মানুষের উপর বেশি প্রভাব ফেলেছে। একদল মুসলমান ইহুদী-খৃষ্টানদের ইতিহাস পড়ে তাদের একান্ত অনুগামী হয়েছে, তাদের আকীদা বিশ্বাসের প্রতিককে নিজেদের গলায় টাই হিসেবে ঝুলাচ্ছে। কালেমায় বিশ্বাসীদের জন্য এই প্রতীক গ্রহণ করা কিছুতেই সমীচীন নয়। হাদীসে বলা হয়েছে যে, যে যাকে ভালবাসবে তার সঙ্গে তার হাশর হবে। আমাদের এখনো সতর্ক হওয়া উচিত। আমরা যে তাদের আদর্শ, তাহযীব-তামাদ্দুন তথা সভ্যতা-সংস্কৃতি গ্রহণ করছি তারা কি আমাদের কোনো সংস্কৃতি গ্রহণ করেছে? এরকম ভাবনা আমাদের মাঝে কেন আসে না?
যে সমস্ত ইতিহাস আমাদের কুরআনের বিপরীত সে সমস্ত ইতিহাসকে আমরা ভ্রান্ত মনে করি। আমাদের দৃষ্টি ভুল করতে পারে, কিন্তু কুরআন ভুল করতে পারে না। মোটকথা কুরআন-হাদীসের মানদণ্ডে যে সমস্ত ইতিহাস গলদ প্রমাণ হয় সেগুলোকে আমরা বিশ্বাস করি না, মানি না। হযরত ঈসা আ. কিয়ামতের পূর্বে আবার দুনিয়াতে আসবেন সাবেক ও প্রাক্তন নবী হিসেবে। আমাদের দেশে বর্তমান সরকারের সময় যেমন সাবেক সরকার ও মন্ত্রীদের কোন কথা চলে না, তেমনি হযরত ঈসা আ. এরও কথা তখন চলবে না। বরং তিনি শেষ নবীর শরীয়ত ও আদর্শ অনুসরণ করে চলবেন। অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতিনিধি হিসেবে এসে মুসলমানদের দেখভাল করবেন।
ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবনের জন্য
অনেকে বোঝে না, তাদেরকে বোঝানো উচিত যে, আল্লাহ নবীর অনুসরণ শুধু ব্যক্তি জীবনের জন্য নয়। ব্যক্তি জীবনে মানুষ যে চরিত্রের অধিকারী হয় সমাজ সে চরিত্রে গড়ে ওঠে। যে সমাজের অধিকাংশ ব্যক্তি নাস্তিক হয় সেই সমাজটাও নাস্তিক সমাজ হয়ে যায়। ব্যক্তিগণ পৌত্তলিক হলে সমাজও পৌত্তলিক সমাজ হয়। ব্যক্তি নিয়েই তো সমাজ, আলাদা তো কিছু নয়।
ভারতবর্ষের ইতিহাস, হিন্দু মুশরিকদের ইতিহাস অধ্যয়ন করে দেখলে বোঝা যাবে যে, মানুষদের ব্যক্তি জীবনের প্রভাব সমাজ জীবনে কীভাবে পড়েছে। ব্যক্তি জীবন এক ধরনের হবে আর সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন অন্য ধরনের হবে এমন ধারণা করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। যে ব্যক্তি মনে করে যে, ব্যক্তি ও ঘরের জীবন এক ধরনের আইন অনুযায়ী চলবে আর সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন তথা ব্যবসা-বাণিজ্য, লেন-দেন, রাজনীতি, বিচার-আচার ইত্যাদি অন্য ধরনের সংবিধান অনুযায়ী চলবে, সে ব্যক্তিকে অজ্ঞ বলা ছাড়া উপায় নেই।
কথিত বুদ্ধিজীবী
আমাদের দেশের পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত কথিত বুদ্ধিজীবীরা বলেন যে, “ধর্মের অনুশীলন ব্যক্তি জীবনের জন্যে, ঘরের জীবনের জন্যে, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মকে টেনে আনা ঠিক নয়।” আমার বুঝে আসে না যে, এরা কোন ধরনের বুদ্ধিজীবী। সমাজ কি ব্যক্তি ছাড়া? রাষ্ট্র কি ব্যক্তি ছাড়া? ব্যক্তি জীবন যেমন হবে সমাজ জীবন তেমন হবে, সমাজ জীবন যেমন হবে ব্যক্তিজীবন তেমন হবে, এটাই বাস্তবতা। যে জাতির বুদ্ধিজীবীরা এমন বাস্তবতা বহির্ভূত উক্তি করে, তাদের কিসের উন্নয়ন আর কিসের সফলতা! জেনে রাখুন, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইসলামের যুক্তিযুক্ত আইন-কানুন ও দিকনির্দেশনা রয়েছে। যদি মানুষেরা আখেরী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনকে নিজেদের জীবনের জন্য মডেল বানায় তাহলে শান্তির জন্য এত হাহুতাশ করার প্রয়োজন হবে না। পবিত্র কুরআনে এসেছে,
অর্থ: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাঝেই রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ।
একে অপরের সংশোধন
জনগণ ভুল করলে সরকার আর সরকার ভুল করলে জনগণ সে ভুল ধরিয়ে দিয়ে শোধরানোর জন্য সহযোগিতা করবে। নিজের ভুল তো নিজে ধরা যায় না। তাই একে অপরকে কৌশলে বুঝিয়ে সঠিকপথে পরিচালিত করতে হবে। সরকার দেশবাসী তথা অধীনস্তদের ব্যাপারে হাশরের ময়দানে জিজ্ঞাসিত হবে যে, কেন মানুষ নামায পড়েনি, নারী কেন ধর্ষিত হতো, মানুষের অধিকার কেন প্রতিষ্ঠিত হতো না, মানব জীবনের নিরাপত্তা কেন বাস্তবায়ন হতো না ইত্যাদি। তেমনি জনগণকে জিজ্ঞাসা করা হবে যে, তোমরা কেন সরকারের ভুল ধরিয়ে দাওনি। সরকার ভ্রান্ত পথে চললে জনগণ দায়ী নয়। তবে জনগণ ভ্রান্ত পথে চললে তার জন্য সরকার দায়ী কেন হবে, এমন ধারণা করা একদম বোকামী।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক বলেছেন, হে নবী! আপনি আপনার উম্মতদেরকে বলে দিন
অর্থ: যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাসতে চাও; তার প্রতি ঈমান এনে মুমিন হতে চাও তাহলে আমাকে ভাল বাসো।
এখানে উপস্থিত সবাই যে মুসলমান তা বলাই বাহুল্য। মুমিন না হলে তো মসজিদে আসতেন না। তবে ইদানিং অমুসলিমরাও মসজিদে আসছে, ইফতার পার্টিতে যোগ দিচ্ছে। মুসলমনরা খুশি হয়ে তাদেরকে দাওয়াত দিচেছ। এই সুযোগে কাফেররা মসজিদের জন্য টাকা বাজেট করছে। অবস্থা দেখে মনে হয় যে,মুসলমানরা ফকির হয়ে গেছে।
আল্লাহপাক কুরআনে পাকে আমাদেরকে এভাবে ডাক দিয়েছেনÑ ¤ ¤ ¦ ž ¤ Ÿ ¢ র্ “হে ঈমানদারগণ!” আল্লাহ পাক যখন মুসলমানকে ঈমানদার বলে, মুমিন বলে আহবান করেন তখন বান্দার কেমন লাগার কথা! জনৈক বুযুর্গ এ আয়াতের আওয়াজ কোনো তেলাওয়াতকারীর কণ্ঠে শ্রবণ করলে বেহুশ হয়ে যেতেন।
কালেমার তাৎপর্য
সচিব, মন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি ও অন্যান্য পদবীধারীদের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকে, কাজের দায়িত্ব থাকে। তেমনি যিনি মুমিন, ঈমানদার হওয়ার দাবী করবেন তারও কিছু দায়িত্ব ও বৈশিষ্ট্য আছে। মুমিন বলে দাবী করার সর্বপ্রথম সিড়ি হলোلااله الاالله সে কারোর আনুগত্য করবে না, একমাত্র আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য করবে। সৃষ্টিকারী, রিযিকদাতা, হায়াত মউত দেয়ার অধিকারী একমাত্র আল্লাহকেই মানবে, অন্য কারোর গোলামী করবে না। চাই সে সমাজের, রাষ্ট্রের, যতবড় ক্ষমতাবান ও গুণী হোক। সর্বক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহরই দাসত্ব করবে। এই দাসত্বের পদ্ধতি কী, সে ব্যাপারে কালেমার দ্বিতীয় বাক্যে বলা হচ্ছে محمد الرسول الله ¦ অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহর রাসূল মেনে নিয়ে তাঁর বাতলানো তরীকায় সার্বিক জীবন পরিচালনা করা। আর এটাকেই বলে সুন্নতী জিন্দেগী। একবার এক হাদীস নিয়ে আমি খুবই পেরেশানীতে পড়েছিলাম। হাদীসটি হলো
من احب سنتي فقد احبني ومن احبني كان معي في الجنة
যারা আমার সুন্নতকে ভালবাসবে তথা পালন করবে তারা যেন আমাকেই ভালবাসলো, আর যারা আমাকে ভালবাসলো তারা আমার সঙ্গে জান্নাতে থাকবে।
এই হাদীসে বলা হয়েছে সুন্নত পালন করলে জান্নাতে যাওয়া সম্ভব, আর অপর একটি হাদীসে বলা হয়েছে “যে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়বে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” অথচ উপরের হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, শুধু লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়লে জান্নাতে যাওয়া যবে না, নবীর সুন্নত পালন করতে হবে। চিন্তায় পড়ে গেলাম যে, দুই হাদীসে দু’রকম কথা, তাহলে কোনটা ধরবো? পরে বুঝলাম যে, কালেমার শুধু প্রথম বাক্য ধরেছি তাই এই পেরেশানি। পরের বাক্যেই তো উপরে উল্লেখিত প্রথম হাদীসের কথা বলা হচ্ছে যে, সার্বিক জীবনে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাসূল হিসেবে মানতে হবে। আত্মা ছাড়া শরীর যেমন ক্রিয়াশীল হয় না তেমনি শরীর ছাড়াও আত্মার ক্রিয়া প্রকাশ পায় না। কালেমার প্রথম বাক্যের সাথে দ্বিতীয় বাক্যের সম্পর্ক এমনই। যে ব্যক্তি ‘লাইলাহা ইল্লাহ” মানে কিন্তু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ মানে না, সে ঐ আত্মার ন্যায় যার সাথে শরীর নেই। আবার যে ব্যক্তি শুধু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে পড়ে থাকে কিন্তু আল্লাহ কে মানে না, সে ঐ শরীরের ন্যায় যার মাঝে আত্মা নেই। মোটকথা আত্মাবিহীন শরীরের যেমন দাম নেই শরীর বিহীন আত্মারও তেমন দাম নেই। ঠিক তদরূপ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া আল্লাহকে যেমন পাওয়া সম্ভব নয় তেমনি আল্লাহকে ছাড়া মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পাওয়া সম্ভব নয়। দুনিয়া-আখেরাতের সফলতা ও কামিয়াবীর জন্য এই নীতিকে মানতে হবে। অন্যথায় শান্তির দেখা কখনো মিলবে না।
সাহাবীদের জীবনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগের কিছু সংখ্যক নবী-প্রেমিক যাদেরকে সাহাবী বলা হয়, এখনকার যুগেও তাঁর কিছু পাগল আছেÑ তাদের জীবন ছিল খুবই নিখুঁত। তাঁরা ঐতিহাসিক জীবন যাঁপন করে গেছেন। তাঁদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন এখনো মানুষের জন্য মডেল হয়ে আছে। তাঁদের সেই সোনালী যুগের কথা মানুষ এখনো বলে এজন্য যে, তাঁরা প্রথমে বকরী-উট চরানো দল ছিল। নিজেদের মেয়ে সন্তানদেরকে জীবন্ত কবর দিত। তাদের ইতিহাস সবারই জানা। মধ্যযুগীয় বলে তাদের ঘৃণা করা হয়। কিন্তু সেই তাঁরাই যখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শকে মুখে স্বীকার করে ব্যক্তিগত ও সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করতে শুরু করলেন তখন দুনিয়ার সামনে তারা সর্বোত্তম মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন এবং সারা পৃথিবী তাঁদের কাছে মাথানত করতে বাধ্য হলো।
দ্বীনের করুণ অবস্থা এবং আমাদের নিষ্ক্রীয়তা
আমাদের দেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মৃসলিম দেশ। কিন্তু বড় ব্যথা ও কষ্ট লাগে এদেশের মুসলমান, ধর্মীয় শিক্ষা, তাহযিব-তামাদ্দুন ও কৃষ্টি-কালচারের প্রতি তাকালে। হাশরের ময়দানে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সামনে আমাদের জবাব দেয়ার মতো কী আছে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো মদীনার মাটিতে শুয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলছেন, তোমাদের দেশ তো মুসলিম প্রধান দেশ, হাফেয-মাওলানা, আলেম-উলামা, মুফতি, পীর-মাশায়েখদের দেশ, মাদরাসা-মসজিদের দেশ, তাহলে তোমাদের দেশে আল্লাহর দ্বীন ও আমার সুন্নতের এই দূরবস্থা কেন? নবীর শাফাআত ছাড়া হাশরের ময়দানে এক কদম চলাও কি সম্ভব হবে? তাহলে আমরা কী বিশ্বাস নিয়ে দুনিয়াতে চলাফেরা করছি? নিজেদের স্বার্থের উপর যখন কোন আঘাত আসে তখন আমরা হৈ চৈ শুরু করি, প্রতিহত করতে উদ্যত হই, অথচ দ্বীনের ও সুন্নতের এই করুণ অবস্থা দেখেও আমরা স্থির ও নিস্ক্রীয় থাকি কীভাবে? মনে হয় নবীর সুন্নত এই দেশে ইয়াতিম হয়ে গেছে। শুধুমাত্র শুক্রবারের নামায পড়লেই কি ঈমানদার ও মুমিন হওয়ার দাবি করা যায়? প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়তে হবে এবং সুন্নত তরিকায় অন্যান্য ইবাদত করতে হবে। শুধু আনুষ্ঠানিক ইবাদতের আল্লাহর কাছে কোনো মুল্য নেই। আমাদেরকে কাফের বেদ্বীনদের চরিত্র ও সংস্কৃতি ছেড়ে নবীর আদর্শে আদর্শবান হতে হবে। আজ ইহুদী-খৃষ্টানরা মুসলমানদের সংস্কৃতি বিলুপ্ত করে নিজেদের সভ্যতা সংস্কৃতি চালু করছে। আর আমরা নাকে তেল দিয়ে গভীর নিদ্রায় মগ্ন আছি। আমরা শুধু অর্থের পেছনে, ক্ষমতার পেছনে পাগলপারা হয়ে ঘুরছি। পরকালীন জীবনের কথা ভাবার সময় পাই না।
ভায়েরা আমার! আমাদের শেষ হাতিয়ার হলো, খাঁটি মনে তাওবা করে আল্লাহর কাছে অতীতের গোনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। মানুষ মাত্রই ভুল হয়, এই ভুলের জন্য খাঁটি মনে এস্তেগফার করলে আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর রহমত থেকে দূরে সরাবেন না। হাদীস শরীফে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনই বলেছেন।
আল্লাহর হক
মাতা-পিতার হক আদায় না করলে সমাজের কাছে সন্তানের জবাবদিহি করতে হয়, তেমনি সন্তানের হক আদায় না করলে মাতা-পিতাকে, স্ত্রীর হক আদায় না করলে স্বামীকে সমাজের কাছে জবাব দিতে হয়, এমনিভাবে আল্লাহ ও তার নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হক আদায় না করলে কাল হাশরের ময়দানে জবাব দিতে হবে। আল্লাহ তায়ালার হক আমাদের উপর কী কী আছে তা জানতে হবে। প্রতি মুহূর্তে, প্রতিদিনে ও রাতে, মাসে ও বছরে আমাদের উপর আল্লাহর হক কী কী তা জেনে আমল করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেকে সৃষ্টি করে দেখার জন্য চোখ, শোনার জন্য কান, বলার জন্য যবান, চলার জন্য পা দিয়েছেন।
যদি এটা বুঝে আসে তাহলে তাঁর হকসমূহ সঠিকভাবে আদায় করতে আমাদের একান্ত সচেষ্ট থাকতে হবে।
মৃত্যুর চিন্তা
মৃত্যু সম্পর্কে সতর্ক হওয়া চাই। আজ আছি কাল নাও থাকতে পারি। প্রত্যেকটি মানুষ চাই বিত্তশালী, ফকির, বাদশা, আলেম, জাহেল, ইমাম, মুসল্লী যাই হোক এই অস্থায়ী জীবন ছেড়ে তাকে একদিন পরপারে চলে যেতেই হবে। অস্থায়ী জীবনের পেছনে যদি রাত দিন এত খাটতে হয় তাহলে স্থায়ী জীবনের জন্য কতটুকু মেহেনত করতে হবে তা বোঝা উচিত।
যিকিরের সরদার
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ঈমানী শক্তি ও আমলী শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য, মনোবল বাড়ানোর জন্য, আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করণ এবং তাঁর ভয় অন্তরে প্রবেশ করানোর জন্য সর্বদা বেশি বেশি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর যিকির করা চাই। সকল যিকিরের মধ্যে এটা সর্বশ্রেষ্ঠ যিকির তথা যিকিরের সরদার। এই যিকিরের দ্বারা অন্তরে সজীবতা আসবে। হিংসা-বিদ্বেষ, খোদাদ্রোহিতা দূর হবে। অন্তর ফ্রেশ হবে। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা, হাঁটতে চলতে এই যিকির করা উচিত। সূর্যের আলোতে অন্ধকার দূর হয়ে পৃথিবী যেমন আলোকিত হয়ে যায় তেমনি যিকিরের মাধ্যমে অন্তরের ময়লা দূর হয়ে নূরে নূরান্বিত হয়ে যায়। পারলে প্রত্যেক নামাযের পর কমপক্ষে ২৫ বার লাইলা ইল্লাল্লাহ এর যিকির করা। ওযু ছাড়াও এই যিকির করা যায়। এই যিকির প্রত্যেক পরিবারের অধীনস্ত ছেলে-মেয়ে, চাকর-চাকরানী সবাইকে শেখানো উচিত। চাকর-চাকরানীদের দ্বারা মানুষ খানা-দানা পাকানোর কাজ করায়, অথচ তারা কি পবিত্র না অপবিত্র; ঢিলা-কুলূখ ব্যবহার শিখেছে কী না এবং তা ব্যবহার করে কী না সে ব্যাপারে কোন খোঁজ খবর নেয়া হয় না। “খাও দাও ফূর্তি করো” এর নাম মানব যিন্দেগী নয়। মৃত্যুর পর যে অনন্ত কালের জীবন শুরু হবে সেটাই আসল যিন্দেগী। সেই যিন্দেগীর জন্য এখান থেকে পাথেয় সংগ্রহ করে যেতে হবে।
দোয়া ও ইস্তিগফারের সরদার
যিকিরের যেমন সরদার আছে তেমনি দোয়ারও সরদার আছে। দোয়ার দ্বারা দিল আলোকিত হয়। দোয়ার ক্রিয়া হলো তা মানুষের গোনাহকে ছাফ করে দেয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সর্বোত্তম যিকির ও সর্বশ্রেষ্ঠ দোয়াটি যে ব্যক্তি সকালে পড়লো আর সন্ধ্যায় মারা গেল, সে ব্যক্তি জান্নাতী হবে, তদরূপ সন্ধ্যায় পড়ে সকালে মৃত্যুবরণ করলে জান্নাতী হবে। হাদীসে বর্ণিত দোয়া ও ইস্তিগফারের সরদার হলো
اللهم أنت ربي لا إله إلا أنت خلقتني و أنا عبدك وأنا على عهدك ووعدك ما استطعت ، أعوذ بك من شر ما صنعت ، أبوء لك بنعمتك على و أبوء لك بذنبي فاغفر لي فإنه لا يغفر الذنوب إلا أنت
দোয়াটির ভাবার্থ হলো হে আল্লাহ! আপনি আমার প্রতিপালক। আপনি আমাকে শরীর, আত্মা, হাত, পা দান করেছেন। আমি স্বীকার করছি যে, আপনি ছাড়া আমার দ্বিতীয় মা’বূদ নেই। আপনি আমাকে খুব মুহাব্বত করে সৃষ্টি করেছেন। আরো স্বীকার করি যে, আমি আপনার গোলাম। আমি আমার শক্তি অনুপাতে আপনার সঙ্গে কৃত ওয়াদা পালনে চেষ্টা করছি। আপনার দেয়া সমস্ত নেয়ামত স্বীকার করছি। ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে আমি অনেক গোনাহ করেছি, তা স্বীকার করে আপনার দরবারে তার ক্ষমার ভিক্ষা চাচ্ছি। আপনি আমার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিন! আমি অকাট্যভাবে বিশ্বাস করি যে, একমাত্র আপনিই গোনাহ মাফের ক্ষমতা রাখেন। পৃথিবীর অন্য কেউ আমার গোনাহ ক্ষমা করতে পারবে না। আমাকে জান্নাত দিতে পারবে না, শান্তি দিতে পারবে না।
এই দোয়া ও যিকির যে প্রতিদিন করবে আশা করা যায় আল্লাহ পাক তাকে সর্ব প্রকারের গোনাহ থেকে বাঁচিয়ে রাখবেন, দুনিয়া-আখেরাতের বিপদ ও ক্ষতি থেকে কুদরতীভাবে হেফাযত করবেন। আল্লাহ পাক আমাদেরকে নবীর বাতানো তরীকায় সহীহভাবে দ্বীনকে মেনে চলার তাওফীক দান করুন! আমীন!
www.dawatul-haq.com
ভাই মাসরূর হাসান আপনাকে ধন্যবাদ, আল্লাহ তায়ালা হযরত মাহমুদুল হাসান দাঃ বাঃ এর হায়াতের মাঝে খুব বরকত দান করূন (আমীন)।
@মুসাফির, আমীন,আল্লাহ তায়ালা আপনাকে তাঁর দ্বিনের খিদমতের জন্য কবুল করুন।
আল্লাহ তায়ালা বক্তা শ্রোতা সকলকে প্রকৃত মুসলিম হওয়ার জন্য তৌফীক দান করুন। আমীন।