লগইন রেজিস্ট্রেশন

মজলিসে দাওয়াতুল হক বাংলাদেশ : শুভ্র জীবনের শুদ্ধ অনুশীলন কেন্দ্র

লিখেছেন: ' মাসরুর হাসান' @ শনিবার, মার্চ ১৯, ২০১১ (১০:১৫ অপরাহ্ণ)

যানজটের নগরী ঢাকায় সবচেয়ে বেশি জ্যাম কোথায়-এ প্রশ্নের উত্তর হুট করে দেয়া যাবে না। কিছুটা সময় নিয়ে ভেবে উত্তর দিতে হবে। ভাবতে ভাবতে মনের মনিটরে ভেসে উঠবে মগবাজার মোড়, বনানী সিগন্যাল, মৌচাক মোড়, ফার্মগেটসহ ঐতিহ্যবাহী জ্যামের কেন্দ্রগুলো। তবে সাম্প্রতিক সময়ে যে জায়গায় এসে ভাবনা আটকে যাবে, সেটা হলো যাত্রাবাড়ির জ্যাম। নির্মাণাধীন উড়াল সেতুর জন্য সাময়িকভাবে যে ভুগান্তি হচ্ছে এ রাস্তায় নিয়মিত চলা মানুষের, তা ভাষায় প্রকাশ করে তাদের অনুভূত ভুগান্তিকে ছোট করা ঠিক হবে না। চার রাস্তার মোড় হওয়ার ফলে এমনিতেই এখানে সবসময় জ্যাম লেগে থাকতো, আর এখন ওভারব্রিজ না থাকায় একি রাস্তায় যান ও জন হওয়ার ফলে অবস্থা আরো চরমে। নিত্যদিনের যাত্রায় সীমাহীন ত্যক্ত বিরক্ত এ পথের কোন কোন যাত্রীর মুখে এ চৌরাস্তার বর্তমান নাম জাহান্নামের চৌরাস্তা। গত ২-৩ মার্চ এখানে দেখা গেল একটি ভিন্ন চিত্র, দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসা হাজারো মানুষ কথিত এ জাহান্নামের চৌরাস্তা পেরিয়ে ছুটছে প্রকৃত জান্নাতের প্রত্যাশায়। জান্নাত লাভের সুদীপ্ত কামনায়। তাদের গন্তব্য যাত্রাবাড়ী মহাসড়কের পাশে অবস্থিত জামিয়া মাদানিয়া মাদরাসায়, মজলিসে দাওয়াতুল হকের ১৭তম ইজতেমায়।
নানা ব্যস্ততার কারণে ইজতেমার প্রথম দিন যেতে পারিনি, ২য়দিন পূর্ব সিদ্ধান্ত মতো এডিটোরিয়াল বোর্ড অব ইসলামিক ম্যাগাজিনস এর প্রতিনিধি হিসেবে আমরা [আমি, সমকাল সহ-সম্পাদক মুফতি এনায়েতুল্লাহ, মাসিক আর রাশাদের নির্বাহী সম্পাদক জহির উদ্দিন বাবর] উপস্থিত হলাম বাদ জুমা। তখনও যাত্রাবাড়ি মহা সড়ক থেকে মাদরাসা পর্যন্ত নামাজের বিছানা পাতা রয়েছে, বোঝা গেল নামাজের সারি মসজিদ, মাদরাসার ময়দান ও আশপাশের রাস্তা ভেদ করে একেবারে মহাসড়ক পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছিল। রাস্তা ছেড়ে ভিতরে গিয়েই প্রচন্ড ভিড়ে পড়লাম, মাইকে শোনা যাচ্ছে মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমুদুল হাসান সাহেব বয়ান করছেন। আমরা ভিড় ঠেলে এগুতে লাগলাম ধীরে ধীরে। মূল প্যান্ডেলে ঢুকে পড়লাম আরেক বিড়ম্বনায়। চারপাশে সব বড় বড় আলেমের জটলা, ডানে তাকাই তো কোন মাদরাসার শায়খুল হাদিস, বামে তাকাই তো মুহতামিম, আরেকটু সামনে গেলে পরিচিত কোন পীর সাহেব। আর চারদিকে তো মুখচেনা নাম না জানা নানা মাদরাসার শিক্ষক, তরুণ আলেমের হাজারও মুখ। লেখালেখির সাথে জড়িত হওয়ার ফলে অনেককে আমরা ভালোভাবে চিনি, আর তারাও আমাদের অনেকটা চেনেন। প্রথমে ভাবলাম সালাম দিয়ে দেখা করা শুরু করি, পরে চিন্তা করলাম অন্তত সিনিয়র আলেমদের সাথে দেখা করতে গেলেও এ কাজেই এশার নামাজ হয়ে যাবে। পরক্ষণে কোন দিকে না তাকিয়ে কাক্সিক্ষত রুমের দিকে এগুলাম আমরা।
আমাদের সাহেবে দাওয়াত হলেন মুহিউসসুন্নাহ দা.বা.-এর সুযোগ্য সাহেবজাদা, যাত্রাবাড়ি মাদরাসার স্বনামধন্য উস্তাদ মাওলানা মাসরুর হাসান । উপস্থিতি যেমন হাজার হাজার তেমনি হযরতের সাথে এক পলকের দেখা করার লাইনেও শতশত লোক। মাসরুর ভাইয়ের আন্তরিক সহযোগিতা না পেলে এ অবস্থায় হযরতের দোয়া নেয়া অসাধ্য বিষয ছিল। যাক, আল্লাহর শোকর, সে সুযোগ আমাদের হলো। সেদিন দৈনিক সমকালে দাওয়াতুল হকের ইজতেমার ওপর জহির উদ্দিন বাবরের লেখা একটি চমৎকার ফিচার ছাপা হয়েছিল, বিনয়ের সাথে সেটি হুজুরের হাতে দিলাম। হুজুর আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন।
খাবারের পর আমাদের জায়গা হলো যে রুমে তার নাম সম্প্রচার রুম। নাম শুনে ভ্রু সামান্য কুঞ্চিত হলেও যখন দেখলাম আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে ইজতেমার সকল বয়ান সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে তখন ভ্রু আগের জায়গা নামিয়ে আনলাম। তবে দ্বীনের প্রচার ও প্রসারে প্রযুক্তির এ চমৎকার ব্যাবহার দেখে বিস্ময়ে সবার চোখগুলো খানিকটা বড় হয়ে উঠলো।
ইজতেমা শুরু হয়েছিল আগের দিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার বাদ ফজর থেকে। শেষ হবে আজকের আখেরী মুনাজাতের মাধ্যমে। জুমার নামাজের পর বয়ান করছিলেন হযরত মুহিউসসুন্নাহ দা.বা.। এতক্ষণে তাঁর বয়ান শেষ, এখন মাইকে শুনছি প্রফেসর হামিদুর রহমান সাহেবের মায়াভরা কন্ঠ। আমার নিজ ভাবনা মতে প্রফেসর সাহেব একটি আর্কাইভ টাইপের মানুষ। বিগত হওয়া অসংখ্য মনীষা ও আকাবিরদের এক জীবন্ত আর্কাইভ তিনি। তাঁর মনের বৃহৎ কোঠায় জমা আছে সে সব বুযুর্গ ও কামেল মানুষদের মুল্যবান কথা ও জীবন চিত্র। তিনি এখন আলোচনার সময় শুধু মনে জমা রাখা সে বিষয়গুলো একে একে ডিসপ্লে করেন। যখন তাঁর বয়ান শুনি তখন যদিও আমাদের চোখ থাকে তার দিকে কিন্তু সে চোখের দৃষ্টি চলে যায় দূরে, অনেক দূরে। কখনো সুদূর হেরেম শরিফের একপ্রান্তে, যেখানে পর্দা দিয়ে কামরা বানিয়ে হাফেজ্জি হুজুর রহ. ও শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক সাহেব সস্ত্রীক অবস্থান করছেন, সেখানের নানা গল্প, কখনো বা হযরত হারদুঈ রহ.এর খানকায়, যখন হারদুঈ হযরত সুন্নত তরিকায় কাউকে আজান শেখাচ্ছেন..। এসব ঘটনার বিবরণ তিনি এত সুন্দর ও প্রাঞ্জল ভাষায় দেন মনে হয় যেন এ সব কিছুই আমরা এখানে বসে নিজ চোখে দেখছি। এখানেই একজন আলোচকের প্রকৃত সফলতা। আল্লাহ পাক তাঁকে দীর্ঘ হায়াত দান করুন।
ইতিমধ্যে আমরা ব্যস্ত হয়ে গেলাম পত্রিকায় পাঠানোর জন্য মাহফিলের নিউজ প্রস্তুত করতে। দৈনিক সমকালের সহ-সম্পাদক বন্ধুবর মুফতি এনায়েতুল্লাহ এরি মাঝে নিউজের একটি খসড়া দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন। জহির উদ্দিন বাবরের ল্যাপটপে চটপট কম্পোজও হয়ে গেল। খবর পেলাম সাবেক রাষ্ট্রপতি হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ চলে এসেছেন আখেরী মুনাজাতে অংশ নিতে। এসেই চলে গেছেন মসজিদে, এক কোণায় বসে গেছেন বয়ান শুনতে। শত হলেও সাবেক রাষ্টপতি, নানা সময়ের নানা ঘটনায় যিনি ফেবারিট, সাধারণ মানুষই নয় আমরা মিডিয়াকর্মীরাও যাকে দেখলে একটু নড়ে চড়ে দাঁড়াই, সে লোকটি পাজামা পাঞ্জাবী পড়ে মাথায় টুপি এটে হেঁটে যাচ্ছেন, স্বাভাবিকভাবেই একটু নড়াচড়া হলো, দু একজন হয়ত সামান্য সরে গিয়ে তাকে জায়গা করে দিচ্ছিলেন এগিয়ে যেতে। এতেই প্রচন্ড চটে গেলেন মুহিউস সুন্নাহ দা.বা.। এসব কি হচ্ছে? সবাই বয়ানের দিকে মুতাওয়াজ্জুহ হন, চুপ করে বসেন। মাইকে মুহিউস সুন্নাহর গর্জন শোনা গেল। সাথে সাথেই চারদিক নিস্তব্ধ।
অন্য মাহফিলের সাথে এখানের মুল পার্থক্যটা হলো, অন্যখানের যারা আলোচক তারা এখানের শ্রোতা, শুধু শ্রোতাই নয় বরং অনুগত শ্রোতা। কারণ কার কখন কোনটা ভুল ধরা পড়ে এ ব্যাপারে সবাই তটস্থ। এসব হাজারো মানুষ এখানে আসার একটাই কারণ, সেটা হলো ইসলাহ, আত্মিক শুদ্ধতা বা অন্তরের পবিত্রতা অর্জন। কথাটা প্রথমে কিছুটা বেমানান মনে হয়। যারা আলেম তারা তো এমনি শুদ্ধ তার আবার শুদ্ধতার প্রয়োজন কি? সাধারণ মানুষের কাছে হয়তো বিষয়টা এমনি। কিন্তু যারা প্রকৃত আলেম তারা জানেন কেবল শুদ্ধতাই সবকিছু নয়, শুদ্ধতার পাশাপাশি চাই শুভ্রতাও, যে শুভ্রতা হবে আকাশের স্বচ্ছ শুভ্রতার মতো, যে শুভ্রতা মাটির মানুষকে নিয়ে যাবে আকাশের কাছাকাছি, আসমানওয়ালার আরো কাছে..। এ বিষয়ে এরচেয়ে বেশি বলার সাধ্য আমার নেই, এটা অন্য জগত। এবার নিজ জগতে আসা যাক।
আসরের নামাজের আগের কথা। মুনাজাত শুরু হবে হবে ভাব, এমন সময় মাইকে মহিউস্স সুন্নাহ ঘোষণা করলেন, মদিনা থেকে এক শাইখ এসেছেন, তিনি এক প্রোগ্রামে গিয়েছিলেন, এখন ফেরার পথে, তিনিও দোয়ায় শামিল হতে চাচ্ছেন, আমরা তার জন্য কিছুটা অপেক্ষা করবো। তখনি মনে হলো, এ আরব শায়েখের কথা গতকাল মাহফিলে অংশ নেয়া একবন্ধু বলেছিল, সে আরব শায়েখ তার আলোচনার শেষ পর্যায়ে মহিউস সুন্ন্াহ সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন এভাবে, আনা ওজাদতু শাইখুল আরব ওয়াল আজম। এরি মাঝে খবর পাওয়া গেল আরব শায়েখ এখনও অনেক দূরে। সুতরাং আর অপেক্ষা নয়, মোনাজাত শুরু হলো।
একেবারে টানা চল্লিশ মিনিট মুনাজাত, আমার জানা মতে বিশ্ব ইজতেমার পর এখানের মুনাজাতটিই সবচেয়ে দীর্ঘ। আরেকটি জিনিস বুঝলাম, প্রস্তুতি নিয়ে, ভাষা স্টাডি করে কোন মুনাজাত হয় না। আমাদের দেশের মাহফিল গুলোতে সচরাচর যে মুনাজাত হয় সেখানে ভাষা থাকে, ভাব থাকে না, কথার বেগ থাকে কিন্তু কোন আবেগ থাকে না। এখানে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখলাম। মুহিউসস সুন্ন্াহ যেন সবগুলো মানুষের মনের আকুতি নিয়ে দাঁড়িয়েছেন সে মহান সত্তার সকাশে, যিনি উপস্থি সকলের আন্তরের মালিক। কত সাদামাটা ভাবেই না তিনি মোনাজাতের বাক্যগুলি বলছিলেন। একটি বাক্য বলেন আর হাজারও লোক এক সাথে হু হু করে কেঁদে উঠে। আরেকটি বাক্য বলেন চারদিকে কান্নার ঢেউ উঠে। মানুষ কত কাঁদতে পারে, সেটার একটি বিরল দৃশ্য দেখলাম সেদিন। মুনাজাতের পুরোটা সময় এক অজানা ভাব বিরাজ করছিলো গোটা মাহফিলে। অনেককে দেখা গেল মোবাইলের মাধ্যমে মুনাজাতে দূরের লোকদেরকেও শরিক করছেন। বিশেষ আগ্রহের কারণে আরবের সে শায়েখর জন্যও মোবাইলে মোনাজাত প্রচার করা হলো। মোনাজাতে অংশ নেয়া মানুষের ভিড় মসজিদ, চারপাশের মাদরাসার বহুতল ভবন মাঝখানের ময়দান ছাড়িয়ে আশপাশের রাস্তাসহ একেবারে পাশ্ববর্তি মহাসড়কে গিয়ে ঠেকেছিলো, ফলে কিছু সময়ের জন্য থমকে গিয়ে ছল ব্যস্ততম এ সড়ক ।
মুনাজাত শেষ হলে আমি রুমের দরজা দিয়ে ভিড় আচ করতে চাচ্ছিলাম। দেখলাম হাউজের পাড়ে যেন একটু বেশি ভিড় ও জটলা। একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে যা দেখলাম, তা একেবারে নতুন দৃশ্য আমার কাছে। একজনের পর একজনকে আনা হচ্ছে আর মাথায় পানি ঢেলে স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে। শুনলাম মুনাজাতের সময় এরা হার্টফিল করেছেন। কাউকে কাউকে দেখলাম অচেতন অবস্থায় এখনো আল্লাহ আল্লাহ করে কাঁদছেন, আবার কারো হাত এখনো মুনাজাতের মত করে উপরের দিকেই উঠানো। বয়সে প্রায় সবাই যুবক। কত অবাক করা বিষয়, আজকের এই ফেসবুক প্রজন্মের সময়ে যুব বয়সের এ ছেলেগুলিও রক্তে মাংসে গড়া মানুষ, ২০১১ সালের টগবগে যুবক। সমাজের ভিন্নপথের যাত্রী অন্য পথের যুবকদের আজ কি খবর? মাগরিবের নামাজের পর এদের একজনের সাথে পরম আবেগ নিয়ে মুসাহাফ করলাম, নিজের জন্য দোয়া চাইলাম। বেশ কিছুক্ষণ নিজের হাত ২টিকে আগলে রাখলাম।
সবশেষে যখন মাহফিল থেকে বাসায় ফিরছি তখন কেবল মনের মাঝে একটি ভাবনাই বার বার উঁকি দিচ্ছিল, কী ঐশী মন্ত্রের বলে মানুষের মাঝে আল্লাহভীতির এতো প্রভাব পড়তে পারে! কোন পরশ পাথরের সংস্পর্শে মানুষের অন্তরে নবীপ্রেমের এত দোলা লাগতে পারে!!

গাজী মোহাম্মাদ সানাউল্লাহ
মিডিয়া কর্মী ও উন্নয়ন গবেষক
gazisanaullah@gmail.com

Processing your request, Please wait....
  • Print this article!
  • Digg
  • Sphinn
  • del.icio.us
  • Facebook
  • Mixx
  • Google Bookmarks
  • LinkaGoGo
  • MSN Reporter
  • Twitter
১৩৪ বার পঠিত
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (ভোট, গড়: ৫.০০)

২ টি মন্তব্য

  1. কী ঐশী মন্ত্রের বলে মানুষের মাঝে আল্লাহভীতির এতো প্রভাব পড়তে পারে! কোন পরশ পাথরের সংস্পর্শে মানুষের অন্তরে নবীপ্রেমের এত দোলা লাগতে পারে!! (Y) মহান আল্লাহ হযরতের হায়াতের মধ্যে খুব বরকত দান করুন। (আমীন)

  2. আমাদের দেশের মাহফিল গুলোতে সচরাচর যে মুনাজাত হয় সেখানে ভাষা থাকে, ভাব থাকে না, কথার বেগ থাকে কিন্তু কোন আবেগ থাকে না। এই যদি হয় দোয়ার অবস্থা তাহলে এই দোয়া দিয়ে কিভাবে কাজ হবে?