হাজ্ব বিষয়ক একটি প্রশ্ন
লিখেছেন: ' আবু আনাস' @ সোমবার, মার্চ ৮, ২০১০ (৫:৫৮ অপরাহ্ণ)
কিছুদিন আগে এক ছোট ভাই নিচের প্রশ্নটি পাঠায় –
-
“অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, আমরা যা দেখি যে চারপাশের মানুষজন (এখনো পর্যন্ত আমিও) দুনিয়াবি কাজেই ব্যস্ত হয়ে আছে। মোটামুটি বেশিরভাগ মানুষের মধ্যবয়েসের পরে একটা ধর্মের প্রতি টান আসে। তারা হজ্ব পালন করেন আর তার পরে মোটামুটি পরিপূর্ণ ইসলামী জীবনযাপন করেন। আমি যেটুকু জানি তা হলো হজ্ব পালনের পরে মানুষ শিশুর ন্যায় পবিত্র হয়ে যায়। কাজেই হজ্ব পালনের পরে পরিপূর্ণ ইসলামী জীবন কাটালে তাদের নিষ্পাপ অবস্থায় মৃত্যু হচ্ছে। এখন সেই অবস্থায়, তারা কি কবরের আযাব এবং দোযখের শাস্তি পাবেন? যেখানে প্রকৃত অবস্থায় তারা জীবনের বেশিরভাগ সময় দুনিয়াবি কাজে কাটিয়েছেন?”
এরই পরিপ্রেক্ষিতে নিচের লেখাটির জন্ম। উল্লেখ্য এখানে কোন ফিক্হের বিষয় আলোচিত হয়নি, শুধুমাত্র ইসলামের সাধারণ মূলনীতিগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। শ্রদ্ধেয় ড. মানযুরে ইলাহিকে কিছু সংশয়পূর্ণ বিষয় পরিষ্কার করে দেয়ায় ধন্যবাদ দিচ্ছি।
প্রথমত, হাজ্বে গেলেই নিষ্পাপ হওয়া যায় ধারণাটি পুরোপুরি ঠিকনা। কেউ যদি শিরক্ এবং কুফরি না ছাড়ে তবে তার হাজ্বে কোন লাভ হবেনা। আমাদের দেশে ভোটে দাঁড়ায় অথচ নামে আলহাজ নাই এমন মানুষ বিরল। বেশিভাগ নেতার ক্ষেত্রেই এই হাজ্ব করার উদ্দেশ্য মানুষের ভোটব্যাঙ্ক। এক্ষেত্রে হাজ্বের উদ্দেশ্য “আল্লাহর সন্তুষ্টি” থেকে সরে মানুষের সন্তুষ্টি হবার কারণে হাজ্বটি বাতিল বলে গণ্য হবে এবং তা কোন ধরণের পূণ্যের বদলে শিরকের পাপ বহন করবে। তখন এই শিরক্যুক্ত হাজ্ব থেকে মুক্তি পেতে তওবা করতে হবে। এছাড়াও হাজ্ব করে নিষ্পাপ হবার শর্ত হল হাজ্বের সময় নিচের জিনিসগুলো থেকে বেঁচে থাকতে হবে (১) –
১. অশ্লীল কথা।
২. অশ্লীল কাজ।
৩. যে কোন ধরণের পাপ।
দ্বিতীয়ত, পরিপুর্ণ ইসলামী জীবন যাপন কিন্ত অনেক কষ্টসাধ্য একটা ব্যাপার। এর জন্য অনেক সাধনা দরকার হয়। এমনকি যাদের অভ্যাস নেই তাদের জন্য হাজ্বের পুর্বোল্লেখিত শর্তগুলো মানা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। যেমন কথায় কথায় একটি বাজে কথা বলা যার মুদ্রাদোষ সেই লোক কিন্তু হাজ্ব করতে গিয়েও হঠাৎ পা হড়কে পড়তে গিয়ে ঐ শব্দটি উচ্চারণ করবে। হিন্দি চ্যানেলের উর্বশী-মেনকাদের নাচ দেখে যার সময় কাটত, সেই লোক হাজ্ব করে এসে আর কখনোই ঐ রস আস্বাদন করবেনা এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই অনৈসলামিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত কেউ হাজ্ব করে এসে পরিপুর্ণ ইসলাম (আমাদের পরিপুর্ণ ইসলাম না রসুলুল্লাহ (সাঃ) এর পরিপুর্ণ ইসলাম) পালন করবে এটা প্র্যাক্টিকালি অসম্ভব।
আমরা যদি ধরেও নেই হাজ্বের পর একটা মানুষ হঠাৎ করে পরিপুর্ণ ইসলাম পালন করতে শুরু করল তবে তার সেই আমূল পরিবর্তনের জন্য যা দায়ী তা আসলে “সত্যিকার অনুশোচনা”। একজন মানুষ যখন তার কৃতকর্মের জন্য খুব অনুতপ্ত হবে এবং সে আগে যা করতো তার জন্য লজ্জিত হবে কেবলমাত্র তখনই তার পক্ষে সম্ভব তার আগের জীবনযাত্রাকে ত্যাগ করা। এখানে কিন্তু মূল চালিকাশক্তি তার অনুতাপবোধ, হাজ্ব নয়। হাজ্ব অবশ্য অনুতাপবোধ জন্ম দিতে পারে, কিন্তু এছাড়াও অন্য অনেক কারণে অনুতাপবোধের জন্ম হতে পারে। বহু মানুষ তার কাছের কেউ মারা যাবার পর বদলে যায়, কেউ কোন একটা ঘটনায় আল্লাহর ক্ষমতা দেখে বদলে যায়, কেউ হয়তো একটা বই পড়ে বদলে যায়, কেউ অন্য কারো একটা কথা শুনেও বদলে যেতে পারে। এবং এই অনুতপ্ত মানুষগুলোর পাপমুক্তির অনেক ব্যবস্থা ইসলামে আছে – রমজানে এক মাস রোজা, আরাফার দিন রোজা, মুহাররমের নয়-দশ তারিখের রোজা, জুম’আর সালাত, উদু করার পর দু’রাকাত সালাত, এমনকি জামাতের সালাতে জোরে আমিন বলার মাধ্যমে (২) পুর্ব জীবনের সমস্ত পাপ মোচন করা হয় বলে রসুলুল্লাহ (সাঃ) আমাদের জানিয়ে গেছেন।
এখানে বলে নেয়া ভালো হবে যে এই সমস্ত পাপ বলতে কিন্তু “হাক্কুল্লাহ” বা আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত পাপের কথা বোঝাচ্ছে। কেউ যদি অন্য কোন মানুষের সাথে অসদাচরণ করে বা তার ক্ষতি করে তবে সেই পাপ আল্লাহ ক্ষমা করেননা, এর ক্ষমা সেই মানুষের কাছ থেকে নিতে হবে।
তৃতীয়ত, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআ’তের বিশ্বাস মতে কোন মানুষের কবরের আজাব বা জাহান্নামের শাস্তি আসলে ক্ষমা করা হয়েছে কিনা তা আসলে মানুষের জানা নেই। রসুলুল্লাহ (সাঃ) বেচে থাকার সময় কারো কারো ব্যাপারে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল যে তারা মুক্তিপ্রাপ্ত। এছাড়া আর কারো ব্যাপারে কিছু বলবার এখতিয়ার আমাদের নেই – এ ক্ষমতা এবং জ্ঞান শুধু আল্লাহর। এর কারণ মানুষ মানুষের মনের খবর রাখেনা, আল্লাহ রাখেন। এজন্য একজন প্রকৃত বিশ্বাসী সবসময় ইবাদাত করার সময় আশা এবং ভয় সাথে রাখে। তার মনে আশা থাকে যে আল্লাহ তাকে মাফ করে দিবেন, আর ভয় থাকে যে যদি সে সুন্দরভাবে ক্ষমা না চাইতে পারে তবে হয়ত আল্লাহ তাকে শাস্তি দিবেন। তবে আল্লাহর ঔদার্য এবং ক্ষমাপরায়ণতার কথা মাথায় রেখে আমরা একথা বলতে পারি যে যদি কেউ সত্যি সত্যি অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় তবে আল্লাহ তাকে মাফ করে দেন। আমরা একটি বিখ্যাত হাদিসে কুদসি থেকে জানতে পারি যে যদি কেউ আসমান থেকে যমিন পর্যন্ত পাপ নিয়ে আল্লাহর সামনে এসে দাঁড়ায় এবং যদি তাতে শিরক্-এর পাপ না থাকে তবে আল্লাহ আসমান থেকে জমিন পর্যন্ত ক্ষমা নিয়ে তার সাথে সাক্ষাত করবেন।(৩) আলহামদুলিল্লাহ – এ ক্ষমা নেয়ার জন্য আমাদের কাউকে টাকা দিতেও হবেনা, কোন পীর-মাজারে ধর্ণা দিতেও হবেনা, খালি আল্লাহর কাছে মন থেকে মাফ চাইলেই হবে!
চতুর্থত, আমরা আমাদের সাধারণ বিবেচনাবোধ ব্যবহার করে যা দেখি তা হল যে যেমন কাজ করবে সে তেমন ফল পাবে। পরীক্ষাতে যে বেশি পরিশ্রম করে সে ভাল ফল করে। যে অনেক বই পড়ে তার জ্ঞান বাড়ে, চিন্তার পরিধি বাড়ে। যে প্রতিষ্ঠানের বিক্রি বেশি তাদের আয়ও বেশি। ঠিক তেমন যে ইসলাম যত সুন্দরভাবে মানবে সে সেই অনুযায়ী পরকালে সম্মানিত হবে, পুরষ্কৃত হবে। একনিষ্ঠতায় সমান দু’ব্যাক্তিকে বিবেচনা করি – যে তার পুরোটা জীবন ইসলামের পথে চললো আর যে জীবনের দশটি বছর ইসলাম মানলো তাদের পুরষ্কার তো সমান হতে পারেনা। এজন্য পূণ্যের পরিমাণের তারতম্য অনুযায়ী পুরষ্কারও পরিবর্তিত হবে। রসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন –
“জান্নাতিরা অন্য জান্নাতিদের বিভিন্ন উচ্চস্থানের কক্ষে দেখতে পাবে যেমন তোমরা পূর্ব ও পশ্চিম দিগন্তে উজ্বল তারকারাজি দেখতে পাও। এর কারণ তাদের মর্যাদার ব্যবধান।” জনসাধারণ জিজ্ঞাসা করলো “হে আল্লাহর রসুল, এটা কি রসুলদের মর্যাদা যার কাছাকাছি অন্য কেউ পৌছাতে পারবেনা?” রসুলুল্লাহ (সাঃ) উত্তরে বললেন “না, যার হাতে আমার প্রাণ সেই সত্বার কসম তারা সে সকল মানুষ যারা আল্লাহ ও তার রসুলে বিশ্বাস করতো।” (৪)
ইসলাম ইবাদাতের ক্ষেত্রে গুণগত মানকে প্রাধান্য দেয় পরিমানকে নয়। তবে যদি গুণগত মান সমান হয়ে যায় তবে যার ইবাদাতের পরিমান বেশি সে প্রাধান্য পাবে। সুতরাং কোন মানুষ যদি সারাজীবন প্রকৃত ইসলামের পথে থাকে সে যে পরিমাণ পুরষ্কার পাবে, আর যে হাজ্বের পর থেকে প্রকৃত ইসলামের পথে আসলো সে পুর্বোক্ত জনের সমান পুরষ্কার পাবেনা।
পরিশেষে, ইসলামের দৃষ্টিতে পুরোপুরি দুনিয়াবি কাজ বলে কোন কথা নেই। কেউ যখন সত্যিকার মুসলিম হিসেবে জীবনযাপন করবে তখন তার সব কাজই হবে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য। কেউ বুয়েটে পড়ছে – তার পরিকল্পনা থাকবে এমন কিছু করা যেখানে তাকে ঘুষ খেতে হবেনা। সেজন্য যদি বেশি পড়তে হয় তবে সেই পড়াটাও শুধুমাত্র আল্লাহকে খুশি করার জন্য, এবং এটা ইবাদাত হিসেবে গণ্য হবে। একজন ব্যবসায়ী কিছু ফল বিক্রি করছে, সে যেমন জনসাধারণের সুবিধা করে দিচ্ছে তেমন লাভের টাকা দিয়ে সে তার পরিবারের ভরণ-পোষন করছে। তাই সে যতক্ষণ সত্যি কথা দিয়ে ব্যবসা করছে ততক্ষণ সে আল্লাহর আনুগত্য করছে যার জন্য সে বিচার দিবসে পুরষ্কার হিসেবে আরশের ছায়াতলে স্থান পাবে। এমনকি একজন মুসলিম যখন ঘুমাতে যাবে তখন তার উচিত রসুলুল্লাহ (সাঃ) এর শিক্ষা অনুযায়ী ঘুমানোর আগে যেই প্রার্থনাগুলো উনি আমাদের শিখিয়ে গেছেন সেগুলো করা। এর ফলে এই ঘুম যা নিতান্তই একটি জৈবিক বিষয়, তার দ্বারাও সে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারবে। আল্লাহ আমাদের ইসলামের প্রকৃত মর্ম বোঝার ক্ষমতা দিন। আমিন।
—————————————————————————————————————————–
১ – সহিহ বুখারিঃ ১৫২১, সহিহ মুসলিমঃ ১৫৩০
২ – সহিহ বুখারিঃ ৪৪৭৫
৩ – আনাস (রাঃ) থেকে উদ্ধৃত, ইমাম তিরমিযি ও ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল থেকে বর্ণিত
৪ – সহিহ বুখারিঃ ২০৮২, সহিহ মুসলিমঃ ২৮৩১
ইসলামের দৃষ্টিতে পুরোপুরি দুনিয়াবি কাজ বলে কোন কথা নেই। কেউ যখন সত্যিকার মুসলিম হিসেবে জীবনযাপন করবে তখন তার সব কাজই হবে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য।
এমনকি একজন মুসলিম যখন ঘুমাতে যাবে তখন তার উচিত রসুলুল্লাহ (সাঃ) এর শিক্ষা অনুযায়ী ঘুমানোর আগে যেই প্রার্থনাগুলো উনি আমাদের শিখিয়ে গেছেন সেগুলো করা। এর ফলে এই ঘুম যা নিতান্তই একটি জৈবিক বিষয়, তার দ্বারাও সে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারবে। আল্লাহ আমাদের ইসলামের প্রকৃত মর্ম বোঝার ক্ষমতা দিন।
সহমত ।
ভালো পোস্ট।
পোস্টদাতার আছে আবেদন: বিশদ বিবরণের পাশাপাশি একটা সারসংক্ষেপ দিলে ভালো হত! কারণ সব পাঠকের হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকে না।
>>> এখানে বলে নেয়া ভালো হবে যে এই সমস্ত পাপ বলতে কিন্তু “হাক্কুল্লাহ” বা আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত পাপের কথা বোঝাচ্ছে। কেউ যদি অন্য কোন মানুষের সাথে অসদাচরণ করে বা তার ক্ষতি করে তবে সেই পাপ আল্লাহ ক্ষমা করেননা, এর ক্ষমা সেই মানুষের কাছ থেকে নিতে হবে।<<<
এই কথাটা যদি কেউ আমাদের "মাল্টিপল হাজী" নেতৃবৃন্দকে বোঝাতে পারতো!!!
@মুসলিম,