ইসলাম প্রচারে তাবলীগ ও বিশ্ব ইজতেমা
লিখেছেন: ' mukallidussunnah' @ শনিবার, জানুয়ারি ২৮, ২০১২ (১০:৫৩ পূর্বাহ্ণ)
‘তাবলীগ’ আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো প্রচার করা, প্রসার করা, ইসলামের দাওয়াত দেয়া, বয়ান করা, প্রচেষ্টা করা বা পৌঁছানো প্রভৃতি। পরিভাষায় একজনের অর্জিত জ্ঞান বা শিক্ষা নিজ ইচ্ছা ও চেষ্টার মাধ্যমে অন্যের কাছে পৌছানো বা অন্যকে শিক্ষা দেয়াকে তাবলীগ বলা হয়। তাবলীগ এক নিরলস সংগ্রাম ও সাধনারম নাম। তাবলীগের মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর পরিচয় ও সম্পর্ক হওয়া, যাতে তার কাছ থেকে মানুষ সব সমস্যার সমাধান লাভ করে দুনিয়া ও আখিরাতে শান্তি সফলতা পায়। ধর্মপ্রাণ মানুষ আত্মশুদ্ধি ও তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে সমাজজীবনে নানারকম দুর্ণীতি, সুদ, ঘুষ, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, সন্ত্রাস, বোমাবাজি, হত্যাকাণ্ড নির্যাতন, অন্যায়-অত্যাচার, পাপাচার, ব্যভিচার, বিশৃংখলা, মিথ্যা বলা, অন্যের ক্ষতি করা প্রভৃতি সামাজিক অনাচার থেকে বিরত থাকতে পারেন। মূলত ইসলাম ধর্মের মৌলিক নীতি, আদর্শ ও শিক্ষাবলী অন্যের কাছে সহজভাবে পৌছে দেয়াই হলো তাবলীগ। আর ‘ইজতেমা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে সমবেত করা, সভা সমাবেশ বা সম্মেলন। ধর্মীয় কোন কাজের জন্য বহুসংখ্যক মানুষকে একত্র করা, কাজের গুরুত্ব বোঝানো, কাজটি যথাযথভাবে সম্পন্ন করার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া এবং ব্যাপকভাবে এর প্রচার প্রসারের জন্য বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করা ইত্যাদি বিষয়কে পরিভাষায় ধর্মীয় ইজতেমা বলা হয়। তোমার কাছে যদি কোন বাণী থাকে তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও’ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুখনিঃসৃত এ শাশ্বত বাণীকে আহবান করে ঢাকার অদূরে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় তাবলীগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমা। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামÑশহর-বন্দর থেকে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান এ মহাসম্মেলনে সমবেত হন। একই সঙ্গে মিলিত হন বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশ থেকে আগত হাজার হাজার তাবলীগ অনুসারী ঈমানদার মুসল্লী। তারা কোনরকম বৈষয়িক লাভের আশা না করে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দ্বীনের মেহনত করে ইজতেমা ময়দানকে মুসলিম মহামিলনের জন্য প্রস্তুত করে তোলেন।
মানবজাতির আদি পিতা হযরত আদম আ. এর মাধ্যমে দুনিয়ার ইতিহাসে তাবলীগ শুরু হয়। ধর্ম প্রচারক নবীদের মধ্যে তিনিই প্রথম, আর সর্বশেষ হলেন বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাবলীগ বা ধর্মের প্রচার নবী-রসূলদের কাজ। এজন্যই আল্লাহতায়ালা পৃথিবী সৃষ্টির প্রারম্ভ থেকেই দুনিয়ায় নবী-রাসূল পাঠানোর ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছেন। এ ধরণীতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আগমনের প্রধান উদ্দেশ্যই হলো আল্লাহর দ্বীন ততা শান্তির ধর্ম ইসলামের মর্মবাণী সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়া আর তিনিও আজীবন কঠোর চেষ্টা সাধনার মাধ্যমে তা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন এবং ইসলামের প্রাথমিক যুগে আরবের বর্বর-অসভ্য জাতিকে সুসভ্য জাতিতে পরিণত করে একটি অন্ধকার সমাজকে আলোকময় সমাজ হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, (তরজমা) “হে নবী তুমি বলো, এটাই আমার পথ আল্লাহর প্রতি মানুষকে আহবান করি সজ্ঞানেÑ আমি এবং আমার অনুসারীরাও’ (সূরা ইউসুফ : ১০৮) আল্লাহর একত্ববাদ প্রচারের জন্য অসংখ্য নবী ও রাসূলকে মনোনীত করে দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে। যেহেতু আখেরী নবীর পর কেয়ামত পর্যন্ত আর কোন নবী রাসূল দুনিয়ায় আসবেন না, তাই তাবলীগের আমলের দায়িত্ব ইসলামের সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মতদের। সব নবী রাসূল ও সাহাবী সারা জীবনই ইসলামের দাওয়াতের কাজে ব্যয় করেছেন। আরাফাতের ময়দানে বিদায় হজ্বের ভাষণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, (তরজমা) “আমিই সর্বশেষ নবী বিধায় নবুওয়াত ও রিাসালাতের অব্যাহত ধারার এখানেই পরিসমাপ্তি অনাগতকালের মানুষের জন্য দ্বীনের পরিচয় বিধৃত আল কোরান ও সুন্নাহ রেখে গেলাম। এগুলো মানুষের কাছে পৌছে দেয়ার দায়িত্ব তোমাদের। এ দায়িত্বের কারণে শ্রেষ্ঠ উম্মত হিসাবে তোমাদের বেছে নেয়া হয়েছে। এর উপর তোমাদের শুধু শ্রেষ্ঠত্বই নয়Ñ অস্তিত্বও নির্ভরশীল।
ইসলামের অতুলনীয় সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার প্রধান মাধ্যম হলো মানব সমাজে তাবলীগ করে ধর্মকে সহজ-সাবলীলভাবে বেশি করে প্রচার ও প্রসার করে। মুসলমানের ধর্ম, ঈমান, আমল, ঐতিহ্য রক্ষা করে চলার জন্য প্রয়োজন হলো ইসলামের অনুসারীদের জাতীয় ঐক্য এবং বিশ্বমুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ সুর্দঢ় করা। বিধিবদ্ধ ইবাদত ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো পালনের মাধ্যমে বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্ব এবং ঐক্যর বন্ধন সুদৃঢ় ও মজবুত হয়। বর্তমান যুগে ইসলাম ও মুসলমানদের বিশ্বভ্রাতৃত্ব এবং ঐক্য বজায় রাখার জন্য তাবলীগের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনস্বীকার্য। বিশ্ব ইজতেমার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশ-বিদেশের ঈমানদার ত্যাগী আলেম-ওলামাদের কাছ থেকে পবিত্র কুরান ও হাদীসের আলোকে বয়ান শুনে ঈমান-আমলের দাওয়াত সারাবিশ্বে পৌছে দেয়া। শুদু বয়ান শোনা বা বিশ্ববাসীর শান্তি ও হেদায়অতের জন্য আখেরি মোনাজাতে প্রচুর লোকের অংশগ্রহণ বিশ্ব ইজতেমার উদ্দেশ্য নয় বরং যাতে বেশি জামাত বের হয়, ইজতেমায় এর দিকনির্দেশনা দেয়া হয়- যেন প্রতিটি জামাত নির্ধারিত এলাকার প্রতি মসজিদে দু-তিনদিন করে থেকে তাওহীদ রিসালাত, আখিরাত, ঈমান ও আমলের দাওয়াত দেয়। তাবলীগের চিল্লায় বের হয় অনেক খারাপ লোকও ভালো হচ্ছে। তাই দেশের প্রতিটি মসজিদ থেকে অন্তত একটি করে জাামত বের করার লক্ষ নিয়ে বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের মহামলিনে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। পৃথিবী সৃষ্টির আদি থেকে আজ পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যাপক ও গতিশীল ইসলামী আন্দোলনের একটি প্রধান ধারা ইসলামের দাওয়াত ও তাবলীগ, যা ধর্মপ্রচারের আলোকে গড়া মানবতার আত্মশুদ্ধির আন্তর্জাতিক দাওয়াতী সংস্থা। যার কর্মীরা কাফেলা বেধে আল্লাহর প্রেমে মসজিদ থেকে মসজিদে সফর করেন, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যান, মানুষের বাড়িতে গিয়ে সবিনয়ে আল্লাহর পথে আহবান করেন, জামাতে নামায আদায়ের কতা বলেন, পবিত্র কোরান তিলাওয়াত ও ধর্মীয় আদর্শ শিক্ষার কথা বলেন, সেই সঙ্গে নিজেরাও আত্মোন্নয়ন ও উৎকর্ষ সাধনের জন্য কঠোর অনুশীলন করেন। এমন অনেক মুসলমান আছেন যারা তাবলীগ জামাতের মাধ্যমে সত্যিকারের পরহেজগারী অর্জন করেছেন এবং ধর্মীয় বিষয়াদি সম্পর্কে শিক্ষিত ও সচেতন হয়েছেন। বিশ্ব মুসলিম জাতিকে ইসলামের দিকে আহবানকারী নিবেদিতপ্রাণের অধিকারী একটি বিরাট ধর্মীয় কাফেলার দাওয়াত ও তাবলীগ হলো ইসলাম এবং মুসলমানদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় মৌলিক কার্যক্রম। পৃথিবীতে মানবতার কল্যাণে ইসলামের অনুসারীদের পাঠানো হয়েছে। বিশ্ব ইজতেমার মাধ্যমে- এ চিরন্তন সত্যের মহড়া ও দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়।