ক্রান্তিলগ্নে ইসলাম – ১
লিখেছেন: ' মুসলিম৫৫' @ শনিবার, মে ২১, ২০১১ (১০:০৯ পূর্বাহ্ণ)
বিসমিল্লাহির রাহমানি রাহিম
আস সালামু ‘আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু
আমরা ক’জন একটা সামষ্টিক পাঠে বসি – বর্তমানে একটা বই ধরে চলছে আমাদের সাপ্তাহিক সামষ্টিক পাঠ। বইখানা ১৯৩৪ সালে লেখা । আমি ইতিপূর্বে বইখানা ৪/৫ বার পড়েছি। ইসলামের উপর আমার জীবনে পড়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ১০টি বইয়ের একটি হবে এই বইটি। এই বইয়ে বহু প্যারাগ্রাফ আছে, যা থেকে কোন বুদ্ধিদীপ্ত পাঠক চাইলেই একটা গোটা পুস্তক রচনা করতে পারবেন অনায়াসে। কোন “ইসলামী ভাব সম্প্রসারণের” আয়োজনে, চাইলে, এই বইটির শত শত বাক্যকে ব্যবহার করা যেত। আমি নিশ্চিত জানি না, তবু আন্দাজ করতে পারি – এতদিনে বাংলায় এর অনুবাদও নিশ্চয়ই হয়েছে। তবু সামষ্টিক পাঠে আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে গিয়ে, আমার কি অনুভূতি হলো তা আপনাদের সাথে শেয়ার করার অদম্য বাসনা থেকে এই সিরিজ পোস্টে হাত দেয়া। আমি ঐ বই থেকে কেবল কিছু অত্যন্ত সীমিত সংখ্যক নির্বাচিত প্যাসেজ আলোচনা করবো – excerpts বলতে পারেন।
বইখানির নাম: Islam at the Crossroads আর লেখকের নাম: Muhammad Asad। আমি বইখানি কিনেছিলাম London-এর Dar al-Taqwa থেকে। তবে আমাদের দেশেও এখন ভারতীয় “পাইরেটেড” প্রিন্ট পাওয়া যায়। আমার কপিটা ১৯৮৭ সালের revised edition। আর Muhammad Asad ১৯৯২ সালে মারা গিয়েছেন ৯২ বছর বয়সে! অনেকেই হয়তো জেনে থাকবেন – তবু, যারা জানেন না, তাঁদের অবগতির জন্য: Muhammad Asad ছিলেন অস্ট্রীয়-জার্মান জাতীয়তার একজন ইহুদী (যদিও তাঁর জন্মস্থান এখনকার পোল্যান্ডের অংশ)। ১৯০০ সালে জন্মগ্রহণ করা Leopold Weiss-এর বয়স যখন ২২+, তখন তৎকালীন প্যালেস্টাইনে বেড়াতে এসে তিনি আরবদের ইসলামভিত্তিক জীবনযাত্রার ধরন দেখে অভিভূত হন এবং তারই পথ ধরে অল্প ক’বছরের মাঝেই (১৯২৬ সালে) ইসলাম গ্রহণ করেন। তারপর ইসলামের হয়ে তিনি অনেক কাজ করেন। তাঁর লেখা The Road to Mecca, Islam at the Crossroads ইত্যাদি বই-পত্রকে যুগান্তকারী বললেও বুঝি কম বলা হবে – ভাবলে অবাক হতে হয় যে, এক সময় তার অনুভব কি দারুণ শুদ্ধ ও খাঁটি ছিল। অথচ, গত শতাব্দীর ৫০-এর দশকের শুরুতে তিনি যখন তার দ্বিতীয় স্ত্রী – সৌদী নাগরিক মুনিরাকে (যাকে তিনি তার প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পরে বিয়ে করেছিলেন) ত্যাগ করে যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং পোলিশ বংশোদ্ভূত পলাকে বিয়ে করেন, তারপর থেকে তার ধ্যান-ধারণা পরিবর্তিত হতে শুরু করে; যার ফলশ্রুতিতে দুঃখজনকভাবে শেষ জীবনে তিনি modernist ও rationalist এক “নব্য-মুতাযিলা”য় পরিণত হন। Islam at the Crossroads-এর পাতায় পাতায় ছড়িয়ে থাকা ইসলামের স্বাতন্ত্র, সৌন্দর্য, কার্যকারিতা ও শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে তাঁর প্রকাশ্য গর্ব তথা পশ্চিমা অবিশ্বাসী সভত্যার antithesis হিসাবে ইসলামকে তুলে ধরা তাঁর কথাগুলো যেন তাঁর শেষ জীবনের পরিণতির দিকে তাকিয়ে – তাঁর অতীত জীবন ও অনুভূতির কথা তাঁকে মনে করিয়ে দিয়ে – নিষ্ঠুর বিদ্রূপের হাসি হাসতে থাকে। সেজন্যই শেষ জীবনে সম্পন্ন করা, তাঁর স্বপ্নের কাজ: The Message of the Qur’an-এর ব্যাপারে, রক্ষণশীলতা তথা শুদ্ধতাকে গুরুত্ব দেয়া স্কলাররা এত সতর্ক! অদ্ভুত সুন্দর অনুবাদ ও ভাষাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও, যার পাতায় পাতায় রয়েছে modernist, rationalist ও মুতাযিলা ভাবধারার অভিব্যক্তি ও ব্যাখ্যা – আর সেজন্যই সৌদী আরবের মত puritan ‘আলেমদের দেশে The Message of the Qur’an-এর প্রবেশ নিষেধ। যাহোক, মুহাম্মদ আসাদের কাজের সমালোচনা করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা বরং দেখবো যে, এখন থেকে প্রায় ৭৭ বছর আগে লিখিত Islam at the Crossroads বইয়ে আসাদ মুসলিম উম্মাহর স্থবিরতা, অথর্বতা ও দুবর্লতার জন্য দায়ী যে রোগগুলো চিহ্নিত করেছিলেন এবং সেগুলোর জন্য যে প্রেসক্রিপশন দিয়েছিলেন – আমরা আজো সেই রোগগুলোই বুঝে উঠতে পারি নি – প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী চিকিৎসার কথা না হয় বাদই দিলাম! আসুন তাহলে Islam at the Crossroads থেকে কিছু অংশ পড়া যাক এবং তা নিয়ে কিছু ব্যাখ্য বিশ্লেষণ করা যাক।
আমার কাছে যে সংস্করণটা রয়েছে, নতুন করে লেখা তার মুখবন্ধে আসাদ বলেন:
What I had in mind when I wrote this book was a re-awakening of the Muslims’ consciousness of their being socially and culturally different from the all-powerful Western society, and thus a deepening of their pride in, and their desire to preserve, such of their own traditional forms and institutions as would help them to keep that essential “difference” alive and make them once again culturally creative after the centuries of our community’s stagnation and intellectual sterility.(Tangier 1982, page# 7-8, Author’s Note)
তিনি বলছেন: “তিনি যখন বইটি লেখেন, তখন তিনি মুসলিমদের এই ব্যাপারে সচেতন করতে চেয়েছিলেন যে, তারা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে পশ্চিমা সমাজের চেয়ে ভিন্ন। আর তিনি চেয়েছিলেন সেই সুবাদে, তাদের নিজেদের ঐতিহ্য ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে তাদের গর্ববোধ এবং সেগুলোকে সংরক্ষণ করার ব্যাপারে তাদের আকাঙ্খা যেন আরো গভীর হয় – যাতে সেই অত্যাবশ্যক “পার্থক্যটা” জীবন্ত থাকে এবং তারা যেন, শত শত বছরের স্থবিরতা ও বন্ধ্যাত্ব কাটিয়ে আরেকবার সাংস্কৃতিক বিষয়ে সৃজনশীল হয়ে ওঠে!”
এরপর মুহাম্মদ আসাদ ঐ মুখবন্ধে আরো বলেন যে, তার মানে এই নয় যে, তিনি সবাইকে গণহারে অতীতের জীবনযাত্রায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন বা অতীতমুখী করতে চাইছেন। বরং তিনি চাইছেন, তারা যেন “কুর’আন ও সুন্নাহ”য় এবং “কুর’আন ও সুন্নাহ”-র উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে ফিরে যান। আমরা এখানে একটা জলজ্যান্ত উদাহরণ তুলে ধরতে পারি। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে এবং নিজেদের দ্বীন-ধর্মকে সম্ভাব্য বিকৃতি থেকে রক্ষা করতে, আজ থেকে প্রায় দেড় শত বছর আগে, ১৮৬৬ সালে দেওবন্দের “দারুল উলুম” মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। আক্বীদাহ্ ও মানহাজের অনেক ভুল-ভ্রান্তি থাকলেও, ভারতীয় মুসলিমদের জন্য মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতারা একটা প্ল্যাটফর্ম উপহার দিতে পেরেছিলেন – যে কোন ধর্মীয় সংকটে মানুষ তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতো – কি করতে হবে জানতে চেয়ে। কিন্তু আজ আমরা, বর্তমান-সময়ে-জীবন-যাপন-করা ও ইসলামের-পুনর্জাগরণের-চিন্তা-ভাবনা-করা মুসলিমরা যদি অতীতে ফিরে গিয়ে দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠলগ্নের পরিবেশ/প্রতিবেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করি, তবে তা আমাদেরকে আরো স্থবির ও মৃতপ্রায় একটা অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে। তার পরিবর্তে যে কোন পুনর্জাগরণের চিন্তায় আমাদের উচিত মূলে অর্থাৎ “কুর’আন ও সুন্নাহ্”য় ফিরে যাবার চেষ্টা করা। এখানে ইমাম মালিকের (রহ.) একটা বিখ্যাত “আসার” বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য – তিনি বলেছিলেন:
“The affairs of the later part of this ummah can never be corrected except with that which corrected the affairs of the early generations of this Ummah.”
অর্থাৎ,
“এই উম্মাহর পরবর্তী অংশের জীবনযাত্রা কখনোই শুদ্ধ করা যাবেনা কেবল মাত্র ঐসব (নীতি/পদ্ধতি) ছাড়া, যা এই উম্মাহর প্রথম প্রজন্মগুলোর জীবনকে শুদ্ধ করেছিল।”
(ইনশা’আল্লাহ্ চলবে………)
“এই উম্মাহর পরবর্তী অংশের জীবনযাত্রা কখনোই শুদ্ধ করা যাবেনা কেবল মাত্র ঐসব (নীতি/পদ্ধতি) ছাড়া, যা এই উম্মাহর প্রথম প্রজন্মগুলোর জীবনকে শুদ্ধ করেছিল।”১০০% সত্য।
@এম এম নুর হোসেন, ধন্যবাদ ভাই!
ধন্যবাদ আপনাকে চালিয়ে যান।
@মুসাফির, আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ! চলবে ইনশা’আল্লাহ্!!
বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে এবং নিজেদের দ্বীন-ধর্মকে সম্ভাব্য বিকৃতি থেকে রক্ষা করতে, আজ থেকে প্রায় দেড় শত বছর আগে, ১৮৬৬ সালে দেওবন্দের “দারুল উলুম” মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। আক্বীদাহ্ ও মানহাজের অনেক ভুল-ভ্রান্তি থাকলেও, ভারতীয় মুসলিমদের জন্য মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতারা একটা প্ল্যাটফর্ম উপহার দিতে পেরেছিলেন – দারুল উলুম দেওবন্দের আক্বীদায় কি কি ভূল আছে একটু জানাবেন কি?
@রাসেল আহমেদ, এসব নিয়ে বিতর্ক বা বচসায় যেতে চাই না। একবার এসবের পথ ধরে, এই ব্লগের পরিবেশ এতই জঘন্য একটা পর্যায়ে গিয়েছিল যে, আমি এখানে ব্লগিং প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম। বহুদিন পরে আবার এই পোস্টটা দিলাম। যাহোক, যদি সত্যিই জানতে চান তবে নীচের লিংকের বইটি পড়ে দেখুন। আপনাকে ঐ বইয়ের কথা মানতেই হবে এমন কোন কথা নেই। তবে দয়া করে কোন বিতর্কের অবতারণা করবেন না। আমি এই লাইনে আর কোন কথা বলতে চাই না।
http://ahlalhadeeth.files.wordpress.com/2010/09/the-creed-of-deobandi-elders2.pdf
@মুসলিম৫৫, ধন্যবাদ আপনাকে । তবে বিতর্ক সৃষ্টি করে এমন কথা পোষ্টের মাঝে না আনাই ভাল।