লগইন রেজিস্ট্রেশন

ধর্মনিরপেক্ষতা ও জীবনের দূর্বৃত্তায়ন : একটি পোষ্টারের বিবর্তন

লিখেছেন: ' রোকন রাইয়ান' @ শনিবার, জুন ১৮, ২০১১ (৩:০০ অপরাহ্ণ)

মুছা আল হাফিজ : বিগত শতকের ত্রিশের দশকের কথা। সোভিয়েত রাশিয়া থেকে নাস্তিক্যবাদ বানের পানির মতো ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।
জীবন সম্পর্কে উদ্ভট চিন্তা মানুষকে কতোটা উদ্ভ্রন্ত করতে পারে, এর বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপিত হচ্ছিল গোটা রাশিয়া জুড়ে। আল্লহকে অস্বীকার করে প্রবৃত্তিকে প্রভু বানিয়ে নাস্তিকরা কেবল নিজেদের মানসিক দেওলিয়াত্বেরই প্রদর্শনী করছিলো না, বরং এই ভ্রষ্টতাকে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছিলো সবার ওপর। নাগরিক মাত্রই একে গ্রহণে বাধ্য ছিলেন। এর বিরুদ্ধে টু শব্দটি উচ্চারণের সুযোগ ছিলো না কারো। অন্তত তাদের জন্য এটা ছিলো অসম্ভব যারা পৃথিবীতে জীবিত থাকতে পছন্দ করে। কেননা সেখানে রাষ্ট্রীয় নীতির প্রতিবাদ করা মাত্রই ‘সাম্যবাদের’ নীপিড়ন শুরু হতো। ‘মানবতার প্রয়োজনে’ হত্যা করা হতো প্রতিবাদীকে, অথবা তাকে পাঠিয়ে দেয়া হতো নির্বাসনে কিংবা কারাগারে।
বুদ্ধিজীবীরা ‘প্রগতিশীল সত্যের’ জন্য কোরবান হয়ে যাচ্ছিলেন। নাস্তিক্যই ছিলো সেই সত্য। মিডিয়াগুলো ‘মানবতার মুক্তির’ প্রচারণা চালাতে চালাতে বাতাসে ফেনা তুলছিলো। ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিলো সেই মুক্তির সারকথা। নতুন পৃথিবীর স্বপ্নে উজ্জীবিত সাংস্কৃতিক তৎপরতাও চলছিলো জোরে শোরে। নাস্তিক্যের দিকে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করাই ছিলো এর লক্ষ্য। সোভিয়েত ইউনিয়নের চতুর্দিকে প্রবল তরঙ্গ বইতে লাগলো, প্রতিটি তরঙ্গে একই আওয়াজ, একই প্রণোদনা। সব কিছুর মূলে ছিলো রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা। এবং এতে বলিয়ান হয়েই যত্রতত্র গড়ে ওঠেছিলো বেজবোজনিকি (নাস্তিক) এসোসিয়েশন। এই সব এসোসিয়েশনই সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহিত্য-সংস্কৃতি, তথ্য ও প্রচার মাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ করতো, তাদের যুদ্ধ ছিলো ধর্মীয় মূল্যবোধের বিরুদ্ধে, যাকে তারা জীবন সংহারক বিষতূল্য মনে করতো। তাদের প্রচার ছিলো স্বয়ং আল্লাহর বিরুদ্ধে এবং এক্ষেত্রে অগ্রমান্য সাহস ও দক্ষতার স্বাক্ষর তারা রেখেছিলো।
প্রতিটি দর্শনীয় জায়গা, সড়ক কিংবা ভবনের আশপাশে এবং বিশেষ করে ইবাদত খানার চারপাশে যেসব প্রচারণায় তাদের অফুরন্ত উৎসাহ ছিলো, এর মধ্যে একটি হলো মস্ত এক পোস্টার, অতি সুন্দরভাবে চিত্রিত পোস্টারটিতে নীল রঙ্গের ঢিলা জামা পরা এক তরুণ কম্যুনিষ্ট বুট জুতা দিয়ে লাথি মেরে মেঘ-ভরা আকাশ থেকে ফেলছে এক হাস্যকর সাদা দাড়িওয়ালা জোব্বা পড়া ভদ্রলোককে। পোস্টারের নিচে লেখা ছিলো, ‘এভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের শ্রমিকরা খোদাকে লাথি মেরে তাড়িয়েছে আকাশ থেকে।’ বেজবোজনিকরা এমন পোষ্টার দিয়ে সেটে রাখতো বুখারা-সমরকন্দ-তাসখন্দ ইত্যাদির মসজিদের দেয়াল। তাদের প্রিয় খেলা ছিলো যে লোকটাই মসজিদে ঢুকবে, তাকে বিদ্রুপ করা এবং মসজিদের ভেতরে শুকরের মাথা নিক্ষেপ করা। বিশ্বাসকে হত্যা করার এ উগ্রতা দশকের পর দশক ধরে চালানো হয়। এতে রাশিয়া সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলো।
কিন্তু এতো ধানাই-পানাই প্রচেষ্টার পরও দেখা গেলো যে অস্ত্র দ্বারা কম্যুনিজম ধর্মকে হত্যা করতে চেয়েছিলো, সেই অস্ত্র প্রয়োগে নিজেই নিজেকে খুন করে বসলো। ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চ থেকে তার উদ্ভট, অশুভ অস্তিত্বটি নিয়তির পদাঘাতে একেবারে ভাগাড়ে নিক্ষিপ্ত হলো। কারণ সে জন্মই গ্রহণ করেছিলো ভাগাড়ে নিক্ষিপ্ত হবার জন্য। মানবীয় প্রকৃতি ও খোদায়ী ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহাত্তকভাবে এক বিকলাঙ্গ চিন্তার ঔরষ থেকে সে দিন সে জন্ম নিলো, সেদিনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিলো যে জারজ মতবাদটি পৃথিবীতে বহু বিপর্যয়ের বিস্তার ঘটাবে এবং শেষ পর্যন্ত ফেরাউনি বরণ না করে তার জন্য কোনো উপায় থাকবে না। ফলত বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়ন টুটে গেলো এবং ছুটে গেলো। গতকাল যে দৈত্যটি ধরাকে সরা মনে করেছিলো, তার উন্মাদনার শেষ সমাধি রচিত হলো ডুবে যাওয়া টাইটানিকের মতো, সময়ের সমুদ্র বুকে। ঈমানের বসতিকে বিপন্ন করে তোলা সুনামি হয়ে ওঠেছিলো যে কম্যুনিজম, বেলা শেষে দেখা গেলো সে আর নেই। কিন্তু বুখারা-তাসখন্দের মসজিদে আজান হচ্ছে। বুকে বুকে বিশ্বাসের বাতি জ্বালিয়ে লোকেরা আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে। অন্য দশ দিনের মতো একান্তই স্বাভাবিকভাবে।
এইসব সরল মানুষের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের মৃত্যু অস্বাভাবিক না হলেও কম্যুনিজমের লক্ষ লক্ষ সন্তান-সন্ততির জন্য এ মৃত্যু ছিলো বড়ই মর্মজ্বালার। দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বেজবোজনিকিরা কম্যুনিজমের পতনে এতিম হয়ে যায়। তারা ভুগতে থাকে কেন্দ্রহীনতার দারিদ্রে। কম্যুনিজমের এই সব লাওয়ারিশ আওলাদ মাথার ওপর প্রভূর ছায়া না থাকায় নতুন ছায়ার প্রয়োজন খুবই অনুভব করলো। ফলে এতোদিন বিভিন্ন বাম সংগঠনের ব্যানারে পূঁজিবাদ-সাম্যাজ্যবাদের বিরুদ্ধে হম্বি-তম্বি করলেও এবার লুকিয়ে লুকিয়ে পূজিবাদের ক্ষেতের মুলা খাওয়া শুরু করলো। দেশে দেশে তারা সাম্রাজ্যবাদের মতাদর্শিক যুদ্ধে সম্মুখ বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রভুর পক্ষে প্রোপাগান্ডায় দক্ষতার প্রমাণ পেশ করতে লাগালো। ফলে দালালির ব্যাপারটা আর গোপন থাকল না। কেউ কেউ সবকিছু খোলে দিয়ে একেবারে দিগম্বর দালাল আর কেউ কেউ তুখোড় বামপন্থী মুখোশের আড়ালে সাম্রাজ্যবাদের আদর্শিক প্রতিপক্ষ ইসলামের বিরুদ্ধে যারপরনাই আস্ফালন করে প্রভূর দেয়া খুদ-কুজেকে হালাল করছিলেন। সাম্রাজ্যবাদের পুরনো পাইক পেয়াদাদের সাথে এদের আস্ফালন মিলিত হয়ে এক ধরণের ভূমিকম্প সৃষ্টি হলো। এক্ষেত্রে কম্যুনিস্টদের নাস্তিক্য ও ধর্মদ্রোহী ওদ্ধত্য নতুন মাত্রা যোগ করলো।
আগে যেসব বেজবোজনিকি সরাসরি খোদার বিরুদ্ধে বলতো, এবার তারা ধরন পাল্টিয়ে খোদার দীনকে প্রত্যাখান করতে চাইলো। মাথার ওপর ধর্মনিরপেক্ষতার ছাতা ধরে আগের শত্র“ সম্রাজ্যবাদকে প্রভু বানাবার মুনাফেকি করলেও নাস্তিক্য ও খোদাদ্রোহের পুরনো চরিত্রকে তারা ধরে রাখে বিশ্বস্ততার সাথে। তবে সোভিয়েত প্রভুর সময়ে সেই চরিত্রের প্রকাশ ঘটতো উগ্ররূপে আর গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে সাম্রাজ্যবাদী প্রভুর শাসনামলে তা কিছুটা সংহত হয়েছে, খোঁড়া হলেও কিছু যুক্তির আশ্রয় নিয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতার গর্তকে আশ্রয় বানিয়ে দুনিয়ার অধিকাংশ নাস্তিকই ধর্মের বিশ্বাসকে ব্যক্তিগত জীবনের খোয়াড়ে ঢুকিয়ে ফেলার পক্ষে বিরক্তিকর হুক্কাহুয়ায় বাতাস ভারি করে তুলছে। ধর্মহীনতার দৌরাত্ম এখন ধর্মনিরপেক্ষতার নাম করেই পরিচালিত হচ্ছে। নাস্তিকতার কোনো উলঙ্গ পোস্টার যদিও আর চোখে পড়ছে না। কিন্তু পরিবর্তিত রাজনীতি-অর্থনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, সমাজ ও আইন-আদালতের আকাশ থেকে খোদার সত্যকে ফেলে দেয়ার পক্ষে প্রোপাগাণ্ডার এক বিশ্ববিস্তৃত পোস্টারের নামই তো ধর্মনিরপেক্ষতা। আগে সেই পোস্টার সাঁটা হতো নি®প্রাণ দেয়ালে। এখন তা সেঁটে দেয়া হচ্ছে আমাদের চোখে মুখে বুকে পাঁজরে।
আমরা শুধুই দেখছি, দেখার অনুমতি আছে। কিন্তু টু শব্দটি উচ্চারণ করা যাবে না। শুধু দেখতে পারবেন ধর্মনিরপেক্ষতার নামে দূর্বৃত্তায়নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে পবিত্র সম্ভাবনার নিহত মুখ, একগুয়ে রামরাজদের উদ্ধত খায়েশে তছনছ হয়ে যাচ্ছে সংবিধান, ঈমানদারদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে পারলেই পরজীবী দালালরাও হয়ে যাচ্ছে মহানবীর… সীমান্তের ওপার থেকে সুতোয় ধরে টান দিলেই ধেই ধেই করে নাচছে বানরের মিত্রজোট… স্বাধীনতাকে বলাৎকার করা হচ্ছে উদ্ধতভঙ্গিমায়… ধর্মনিরপেক্ষতার নামে দূর্বৃত্তায়নই হয়ে যাচ্ছে শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্য…
এসব ঘটতেই থাকবে এবং আপনার জন্য রয়েছে দেখার অধিকার। দেখে দেখে কাতর হয়ে যান কিংবা পাথর বনে যান- এর বাইরে আর নিরাপদ কোনো বিকল্প কারো জন্য নেই।

লেখক : কবি ও কথাশিল্পী

Processing your request, Please wait....
  • Print this article!
  • Digg
  • Sphinn
  • del.icio.us
  • Facebook
  • Mixx
  • Google Bookmarks
  • LinkaGoGo
  • MSN Reporter
  • Twitter
৫৯ বার পঠিত
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (ভোট, গড়: ৫.০০)

১ টি মন্তব্য