লগইন রেজিস্ট্রেশন

মহানবী (সাঃ) এর কথা ও মর্মকথা – ২

লিখেছেন: ' রাশেদ' @ সোমবার, মে ১৭, ২০১০ (৬:১৭ অপরাহ্ণ)

প্রথম পর্ব

কিন্তু এমনও তো হতে পারতো যে, অবিশ্বাসীরা তাদের আপাত-সুখস্বর্গকে অটুট রেখেও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হতো।
কারণ এমন অনেক বিশ্বাসীও তো ছিল ও আছে, যাদের জাগতিক আচরণ ও চরিত্র ঠিক বিশ্বাসের সঙ্গে অঙ্গীকৃত নয়।
তারা বিশ্বাসে অবিচল কিন্তু স্বভাব ও কর্মে অবিশ্বাসীর মতোই শিথিল ও স্বেচ্ছাচারী। মহানবী (সাঃ) এর বাণী ও জীবনবিধান
অবশ্য এই ধরণের দ্বৈতাচার ও আত্মবিভক্তির কোন মূল্য দেয় না। কারণ ঝড়কে বিশ্বাস করে নিরাপদ বেষ্টনীতে প্রবেশ
না করা এবং ঝড়ের আগমনকে অস্বীকার করা একই কথা। উভয়ের জন্য ফলাফলের কোন প্রভেদ ঘটে না। অতএব
একই নিয়মে আন্তরিক অভ্যর্থনা ও আপ্যায়নের নিমিত্ত জাহান্নাম দুজনকেই স্বাগত জানাবে। তবু বিশ্বাসীরা অন্তত এই
অর্থে একটু অগ্রসর যে, তারা বিষয়টি মেনে নিয়েছিল, যদিও নানা দুর্বলতাহেতু বাহ্যত তারা অবিশ্বাসীদেরই দলভুক্ত।
কিন্তু অবিশ্বাসীরা সত্যের এমনই প্রতিশ্রুত শত্রু যে, তারা বরং ইসলাম নির্ধারিত বহু সৎকর্মে আত্মনিয়োগ করতেও
সম্মত, অথচ এমনকি কোন দুর্বলতম মুহূর্তেও বিশ্বাসকে প্রশ্রয় দেবে না।

দেবে না তার কারণ, তারা নৈতিক অপরাধবোধে আক্রান্ত হতে চায় না; তারা বদ্ধ উন্মাদদের মত নিঃশর্ত ও নিরবচ্ছিন্ন
স্বাধীনতাকামী। বিশ্বাস মানুষের মধ্যে যে নৈতিক চাপ সৃষ্টি করে, তা এমনকি উৎকট স্বেচ্ছাচারীকেও গোপনে গোপনে
দুর্বল করে তোলে। আর অবিশ্বাসীরা এই দুর্বলতারই মূলোৎপাটন করতে চায়। তারা চায় নিরঙ্কুশ অমিতাচার, নিরঙ্কুশ
আনন্দ ও ভোগ ও স্বাধীনতা। তাই তারা অনেক সময় অনেক ভালো কাজ করে, কিন্তু করে মন চায় বলে; অনেক সময়
অনেক দুষ্কর্ম থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখে, কিন্তু সেও কোন শুভত্বের প্রতি আকর্ষনবশত নয়, তা নিতান্তই স্নায়ুর ক্লান্তি
কি আলস্য কি মানসিক অবসাদহেতু। এবং এই জন্যই তারা এক হাতে শোষণ ও প্রতারণায় মানুষকে নিঃস্ব করে তোলে,
গড়ে তোলে সম্পদের পাহাড়; আবার অন্য হাতে জনকল্যাণে ব্যায় করে অঢেল অর্থ। সকালে কখনো উপাসনায়
আত্মসমাহিত কি পরহিতব্রতে তৎপর ও মনোযোগী; বিকালে সেই মানুষই নিষিদ্ধ ড্রাগের চোরাচালান নিয়ে গোপন
বৈঠকের সভাপতি অথবা পরস্ত্রীহরণে পুলকিত রাবণ। এই-যে দ্বৈত প্রতিমান, এই-যে নির্দ্বিধ আত্মবিভক্তি, পাপবোধমুক্ত
সম্পূর্ণ নৈতিকতাশূন্য দৈত্য ও দেবতার এই-যে এমন বিদ্রুপাত্মক যুগল কার্যক্রম রচনা, এ কেবল অবিশ্বাসীর পক্ষেই
সম্ভব। এইজন্যই বিশ্বাসকে তারা ভয় পায়, এবং সর্বশক্তি দিয়ে বিশ্বাসীকে শত্রুজ্ঞানে উৎখাত করাই তাদের ‘মানবধর্ম’
ও প্রগতিবাদ।

প্রকৃতপক্ষে অবিশ্বাসীরা যাই বলুক, ক্ষুদ্রবুদ্ধি মানুষ তার দৃষ্টিক্ষীণতা-হেতু যাই মনে করুক, মোহাম্মদ (সাঃ) প্রদত্ত
সংবাদ অকাট্য। কেউ বলে নি, তিনি উন্মাদ কি বাতিকগ্রস্ত ছিলেন; কিছুতেই প্রমাণ করা যাবে না, তিনি যা বলেছেন
তা বিকৃতমস্তিষ্ক প্রসূত কোন বিকার, এবং এমন কোন সাক্ষ্যও নেই যে, তাঁর কথা কোন ফাঁকি বা প্রতারণা বা
চাতুরিমিশ্রিত শিকার-কৌশল। অনেকে অনেক কথা বলেছেন, নানা সময়ে নানা ধরণের নিন্দা ও কটুবাক্যে বিদ্ধও
হয়েছেন তিনি, কিন্তু অদ্যাবধি কোন গবেষক একটি উদাহরণও তুলে ধরতে পারে নি যে, কোরআন শরীফের একটি
বাক্য কি শব্দও অসত্য; নবী (সাঃ)এর একটি কথা কি কাজও প্রমাদস্পৃষ্ট। এবং এইজন্যই তাঁর কথায় যিনি যত বিশ্বাসী,
তাঁর প্রতি প্রেম ও আনুগত্য যার যত বেশী, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, তিনি তত বেশী সফল ও সম্মানিত। তিনি বলেন,
আল্লাহর ভয়ই সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান; আল্লাহও বলেন, আল্লাহর সন্তুষ্টিই জীবনের শ্রেষ্ঠতম সাফল্য। আলৌকিকত্ব নয়, নয়
কোন জীবনবিচ্ছিন্ন মায়াবাদ – মহানবী (সাঃ) যা বলেছেন তা এক সুস্পষ্ট বাস্তবতা।

দূরদৃষ্টিহীন মানুষ কখনো গুবরে পোকাকেও সূর্যজ্ঞানে পূজা করে, কখনো এই মানুষকেই বলে ‘প্রভু নারায়ণ’, কখনো
চন্দ্রগ্রস্ত শ্মশানবাসী উলঙ্গ উন্মাদকে বলে ‘ত্রিকালদর্শী’ মহাপুরুষ, গঞ্জিকামুগ্ধ পাগলের প্রলাপকে মনে করে ‘বাণী’।
অথচ যে মহাপুরুষ মানুষকে তার সকল ক্ষুদ্রতা ও সংকীর্ণতা ও অলীক আতঙ্ক থেকে মুক্ত করে প্রতিষ্ঠিত করলেন
আল্লাহর শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টিরূপে সর্বাধিক উচ্চতম মহিমায়, সেই নবী মোহাম্মদ (সাঃ) অসংখ্য মনুষ্যরূপী বিশ্ববাসীর কাছে
এখনো অবিশ্বাসের পাত্র। যিনি বললেন, মানুষের সমমর্যাদাসম্পন্ন আর কেউ নেই, সৃষ্টিকর্তার পরেই তার স্থান,
সে-ই সৃষ্টিকর্তার প্রিয়তম ও একমাত্র প্রতিনিধি, সাগরে-সৈকতে জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে যেখানে যা কিছু সবই মানুষের
জন্য, সেই পরম সুসংবাদদাতা মহামানবেরই এক চরম প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ালো আধুনিক পৃথিবী।

অথচ এই আধুনিক বিশ্বের কী এমন গৌরব! বিজ্ঞানের সহায়তায় ভোগের কিছু উপকরণ বাড়ানো ছাড়া পৃথিবী আর
কী কর্মটি করেছে? আর সেই ভোগেরও তো চারপাশে বিরাজ করছে এই মানুষেরই স্বসৃষ্ট সহস্র প্রকার অভিশাপ ও
মারণাতঙ্ক। এইডস কি আণবিক বোমা, কোকেন ম্যানড্রেক্স, পরস্বাপহরণ, বিশ্ববিস্তৃত জুয়া, যুদ্ধ, গুপ্তচরবৃত্তি, নিরপরাধ
শিশু ও নারীব্যবসা – এইসব নিয়ে মত্ত উন্মুক্ত পৃথিবী আজ এক দুর্গন্ধময় নর্দমায় পরিণত। এই কি মানুষের স্বপ্নের
পৃথিবী! চিন্তাশীল ও বিবেকবান মানুষ আজ বলতে বাধ্য হচ্ছে, মনুষ্যকুলে জন্মগ্রহণ করাই এক অভিশাপ। কিন্তু এটাই
স্বাভাবিক ও যথোচিত, কারণ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) প্রতি অবিশ্বাসী পৃথিবীর নসীব এর চেয়ে ভালো হওয়া উচিত
নয়। যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণ কি আদৌ কোন কাজ? মোশাদ কি সিআইএ, ‘র’ বা কেজিবি পালনও কি কোন প্রকৃত কর্ম? এর চেয়ে
সহস্রগুণ উৎকৃষ্ট কাজ মৌমাছিপালন বা কাজী পেয়ারার চাষ, এমনকি গোখাদ্য সংগ্রহ কি শৌচাগার নির্মাণ কি অশ্বের
জন্য তৃণকর্তন। অতএব অকাজ-কুকাজে নিমজ্জিত আধুনিক মানবসম্প্রদায় যে মহানবী (সাঃ) কে কিঞ্চিত্তম অনুধাবনেও
ব্যর্থ হবে, এটাই মনস্তত্ব সম্মত।

অথচ এই মহামানবকে না মানার কোন প্রশ্নই ওঠে না, কারণ তিনি যা বলেছেন তার কিছুই কখনো অসার প্রমাণিত হয় নি।
তিনি বলেছেন, মানুষের জীবন আপাতদৃশ্যমান এই জন্মমৃত্যুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; অনন্ত তাৎপর্যে মণ্ডিত এক সুবিশাল
প্রেক্ষাপটে স্থাপিত মানবজীবন। জীবনের এই ব্যাপ্তির কথা এই অনন্ত প্রসারিত অস্তিত্বের কথা মহানবী (সাঃ) ছাড়া আর কে
এমন পরম বিশ্বস্ততার সঙ্গে অকুণ্ঠ উচ্চারণে তুলে ধরেছেন? যে মানুষ নিজেকে মনে করে ‘খিড়কি পুকুরের গুগলিগ্রাসী’
পৃথুলা পাতিহাঁস, তাকেই তিনি জানিয়ে দিলেন, তার ডানায় রয়েছে অফুরান শক্তি, সে আসলে নক্ষত্রবিহারী অপরাজেয়
বলাকা। অথচ পাতিহাঁসসদৃশ মানুষ এ কথায় কর্ণপাত না করে বরং বক্তার প্রতিই লোষ্ট্র ও কটাক্ষ নিক্ষেপ করেছে। অবিশ্বাস
নামক দুরারোগ্য ব্যাধি যে কী পরিমাণে মানবচেতনাকে আচ্ছন্ন করেছে, এই আচরণ তার প্রমাণ।

অক্সফোর্ড কি হার্ভার্ড কি লেনিনগ্রাদের বিশ্ববিদ্যালয়প্রসূত অনেক পণ্ডিত শুধু বই লিখতে জানে; তাদের আসলে সদ্য-কথা-শেখা
শিশুর মত কথা-বলাতেই আনন্দ। বয়স্ক শ্রোতাদের সকৌতুক ও সস্নেহ উৎসাহে মার্কস কি ম্যাকিয়াভেলী কি ক্যামু-পড়া
এই পণ্ডিতন্মন্য অপরিণত শিশুরাই আজ মানবসভ্যতার পথপ্রদর্শক। মানুষকে তারা মনে করে উন্নতবুদ্ধির একটি জন্তু মাত্র।
তারা মনে করে, বন্য কি গৃহপালিত পশুর সঙ্গে মানুষের যে ব্যবধান, তা আদৌ প্রকৃতিগত নয়, কথঞ্চিত বুদ্ধিবিকাশের
মাত্রাগত। তারা মনে করে, আল্লাহ নেই, থাকলেও তা নিয়ে বিচলিত হবার কিছু নেই। তাদের বিশ্বাস, প্রেরিত কোন রাসূল
নেই এবং কোরআন একটি বানিয়ে লেখা মেধাবী পুস্তক মাত্র; মনে করে, পরকাল কি পরকালের জবাবদিহিতা একটি কল্পিত
উপাখ্যান, এবং কোরআন ও হাদীসে বর্ণিত জান্নাত-জাহান্নাম একটি ছেলেভুলানো রূপকথা। সত্যই তথাকথিত এই আত্মমুগ্ধ
অতিপ্রগতিশীল বীরপুঙ্গবেরা বড় কুশলেই আছে! অথচ এটাও তো যুক্তিরই কথা, অসৎ মানুষকে বিশ্বাস করে লাভবান হওয়ার
চেয়ে, সৎ ও পবিত্র ও মানবপ্রেমে সতত জাগরুক কোন মানুষের প্রতি বিশ্বাস রেখে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াও ভালো। কোন তর্ক নয়,
অবিশ্বাসীরাই বলুক, মহানবী (সাঃ) এর চেয়ে অধিক সৎ অধিক পবিত্র অধিক মানবপ্রেমী কোন মানুষ কি এই গ্রহে কখনো
অবতীর্ণ হয়েছে?

আল্লাহপাক বলেন, তাঁর অনুমতি না হলে মানুষের মতি হয় না। অতএব আল্লাহর করুণারিক্ত মতিভ্রষ্ট অস্বীকারকারীরা যে
সর্বপ্রযত্নে আপনাপন দৃষ্টি ভুল লক্ষ্যেই নিবদ্ধ রাখবে, এটা বিধিনির্বন্ধ। ইবলিস একদা নবী (সাঃ) এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে
বলেছিল – সবাই আমাকে দোষারোপ করে কিন্তু হুজুর ভেবে দেখুন, আল্লাহ যখন জাহান্নাম সৃষ্টি করেছেন, জাহান্নামের
উপযোগী কিছু লোকও সৃষ্টি করেছেন। এই কথায় মহানবী (সাঃ) সত্যই অত্যন্ত বিচলিত হয়েছিলেন এই ভেবে যে, পৃথিবীতে
আসলে অনেক মানুষের জন্মই জাহান্নামের সদাবুভুক্ষু উদরপূর্তির জন্য। আল্লাহপাক ভালো জানেন, তাঁর বিচার অভ্রান্ত,
সবকিছু তাঁরই রহস্যময় ইচ্ছাধীন, সত্য প্রত্যাখ্যানকারী এই কূট ও বক্র ও তার্কিকদের নসীব অপরিবর্তনীয়। সত্যই যে
অপরিবর্তনীয় তার অনেক দৃষ্টান্তও আল্লাহপাক উপস্থাপন করেছেন। নবী (সাঃ) এর পিতৃব্য আবু তালিব তার ভ্রাতুষ্পুত্রের
জন্য, ইসলামের জন্য অনেক শ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন। মহানবী (সাঃ) এর প্রতি ছিল তাঁর অকৃত্রিম প্রেম ও দরদ,
ইসলামের সত্যতাও ভেতরে ভেতরে অনুধাবন করেছিলেন। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য, এই ধর্মের প্রতি আনুষ্ঠানিক আনুগত্য, এমনকি
মৌখিক স্বীকৃতি প্রদানেরও সৌভাগ্য হয়নি তার। অথচ ইসলামের এক প্রবল প্রতিশ্রুত শত্রু, মহানবী (সাঃ) এর প্রাণসংহারে
বদ্ধপরিকর ক্রোধান্বিত ওমর মুহূর্তমধ্যে পরিণত হলেন সম্পূর্ণ বিপরীত এক অন্য মানুষে।

লেখক: আবু জাফর
———————–
চলবে ইনশাআল্লাহ।

Processing your request, Please wait....
  • Print this article!
  • Digg
  • Sphinn
  • del.icio.us
  • Facebook
  • Mixx
  • Google Bookmarks
  • LinkaGoGo
  • MSN Reporter
  • Twitter
৭৫ বার পঠিত
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (ভোট, গড়: ৫.০০)