ইলমে ফেকাহর সুচনাকালঃ প্রসঙ্গ ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-১
লিখেছেন: ' দ্য মুসলিম' @ শুক্রবার, ডিসেম্বর ২৫, ২০০৯ (২:১২ অপরাহ্ণ)
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়াবারকাতুহু।
সুত্রঃ মাসিক মদিনা, ডিসেম্বর ২০০৯।
জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ
ইমাম আবু হানীফা হিজরী ৮০ সনে কুফার এক সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী পরিবারে জন্মড়্রহণ কবেন। তাঁর জৌত্র ইসমাঈলের জবানী- আমার পিতামহ ছিলেন নোমান ইবনে ছাবেত ইবনে নোমান ইবনে মুরযেবান। মুরযেবান ছিলেন পারস্য অঞ্চলের একজন বিশিষ্ট ভূম্যাতিপতি। তাঁর পুত্র যুতী যুদ্ধবন্দিরূপে কুফায় আসেন। ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার হওয়ার পর তাঁর নামকরণ করা হয় নোমান। তিনি কূফার একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করার পর হযরত আলীর (রাঃ) খেদমতে হাজির হয়ে তাঁর দোয়া লাভ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। যূতী বা নোমাদের পৌত্র আবু হানীফা রহঃ বিদ্যা ও মনীয়ার অকল্পনীয় গভীরতার ক্ষেত্রে শেরে-খোদা হযরত আলীর দোয়ার বরকত আমরা গর্বের সাথে স্মরণ করি। (খতীব বাগদাদী রচিত তারীখে বাগদাদ।)
অন্য এক বর্ণনায় দেখা যায়, ইমাম ইবু হানীফার পিতামহ নোমান (যুতী) ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার কারনে পরিবার-পরিজনের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। তিনি তখন জন্মভূমি ত্যাগ করে ইসলামী খেলাফতের তদানিন্তন বাজধানী কুফায় চলে আসেন। এখানেই তিনি ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করে স্হায়ী বসতি স্হাপন করেন। (ইমামে-আজমর, শিবলি নোমানী)।
নোমান (যুতী) হযরত আলীর রা. খেদমতে হাজিরা দিতেন। হযরত আলীর রা. সান্নিধ্যেই তাঁর দীনি শিক্ষা এবং আমলের প্রশিক্ষন লাভ করার সুযোগ ঘটেছিলো।
জন্মস্হান কুফাঃ
ইমাম আবু হানীফার জন্মভূমি কুফার তখন গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। বাগত শতাব্দির প্রখ্যাত হাদিস তত্ববিদ আল্লাম কাউসারী ‘ নসবুর-রায়া ‘ নামক গ্রন্হে লিখেছেন- দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর রা. কর্তৃক হিজরী ১৭ সনে কূফা নগরের ভিত্তি স্হাপন করা হয়। প্রধানতঃ মুজাহেদীনের একটি ছাউনী শহর রূপে প্রতিষ্ঠিত কূফায় বিপুল সংখ্যক সাহাবী এবঅং বহু সম্ভ্রান্ত আরব পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়। এই শহরে বসতি স্হাপনকারী মুসলমানদের মধ্যে দীনি এলেম প্রচার এবং ফতোয়া প্রদান করার গুরু দায়িত্বে বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদকে রা. সরকারিভাবে নিয়োগ দান করা হয়। হযরত ওমর রা. কূফবাসীগণের প্রতি প্রেরীত এক ফরমানে উল্লেখ করেছিলেন যে আবদুল্লাহ ইবনে মসউদের ন্যায় প্রাজ্ঞ ব্যক্তির এখানেই (রাজধানীর মদিনায়) বিশেয় প্রয়োজন ছিল। তা সত্বেও তোমাদে প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য করে তাঁকে কূফায় পাঠানো হলো। বলাবাহুল্য যে, খলীফার এই ফরমানের দ্বারাই বোঝা যায় যে, আবদুল।লাহ ইবনে মসউদ রা. কত প্রাজ্ঞ ও উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন একজন সাহাবী ছিলেন। ইবনে মাসউদ রা. তৃতীয় খলীফা হযরত ওসমানের রা. খেলাফত আমলের শেষ সময় পর্যন্ত জনগণের মধ্যে কুরআন, হাদিস এবং ফেকাহর তালীম দিতে থাকেন। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতেই কূফায় অন্যুন চার হাজার বিশিষ্ট মুহাদ্দেসম মুফাছছেরও ফকীহর সৃষ্টি হয়েছিল। হযরত আলী রা. যখন রাজধানী যখন রাজধানী স্হানান্তর করে কূফায় আসেন, তখন এখানকার জ্ঞান চর্চার পরিবেশ তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। কাঁর মন্তব্য ছিল- আল্লাহ পাক ইবনে মাসউদের রা. কল্যাণ করুন। তিনি এই শহরকে এলেমের নগরীতে পরিণত করে দিয়েছেন।
এমন আরো প্রাজ্ঞ সাহাবী কূফায় বসতি স্হাপন করেছিলেন যাঁদের অবদানে এ উম্মতের জ্ঞান ভান্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে। এদের মধ্যে বিশেষ উল্লেযোগ্য ছিলেন হযরত সয়ীদ ইবনে জুবায়ের রা.। কুফার কোন লোক যদি তফসীর শাস্ত্রের সর্বাপেক্ষা প্রাজ্ঞ সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের নিকট কোন মাসআলা জিজ্ঞেস করতে যেত, তখন তিনি বলতেন, তোমাদের শহরে সাঈদ আবনে জুবায়ের রা. এর ন্যায় প্রাজ্ঞ ব্যক্তি থাকার পরও এখানে তুমি মাসআলা জিজ্ঞেস করতে এলে কেন?
এই কুফা শহরেই সর্বাপেক্ষা প্রজ্ঞাবান তাবেয়ী ইমাম শা’বী বসবাস করতেন। মা’বী সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমরের রা. মন্তব্য ছিল, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রায় সবকটি যুদ্ধেই আমি শরীক ছিলাম। কিন্তু ইমাম শা’বী যুদ্ধগুলোর পুংখানুপুংকরূপে বর্ণনার ক্ষেত্রে যে নিপুনতার পরিচয় দেন, আমার ন্যায় প্রত্যক্ষদর্শীদের পক্ষেও সম্ভবতঃ সেরূপ নিখুঁত বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়।
কূফায় বসবাসকারী আর একজন বিশিষ্ট তাবেয়ী ছিলেন ইবরাহীম নখয়ী রহ.। ইনি সাহাবী হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. এবং উম্মত-জননী হযরত আয়েশার রা. নিকট থেকেও হাদিস বর্ণনা করেছেন। আল্লাম ইবনে আবদুল বার এর মন্তব্য হচ্ছে- ইবরাহীম নখয়ী তাঁর যুগের সকল আলেমের চাইতে উত্তম ছিলেন । হিপরী ৯৫ সনে ইবরাহীম নখয়ীর ইন্তেকালের পর আবু ইমরান তাঁর শষ্যদের সামনে এই বলে আক্ষেপ করেছিলেন যে, তোমারা আজ এই যুগের সর্বাপেক্ষা বড় ফেকাহবিদকে সমাহিত করলে।
তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল- ইনি কি হাসান বসরী রহ. এর চাইতেও বড় আলেম ছিলেন? জবাব দিলেন নিঃসন্দেহে তিনি বসরা ‘কূফা’ শাম ও হেজাযের সকল আলেমের মধ্যে সেরা ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
কূফায় যে পনেরো শ সাহাবী বসতি স্হাপন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে সত্তরজন ছিলেন বদরযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবী।
হযরত আলকামা রহ. ন্যায় জ্ঞানসাধক তাবেয়ীও কূফাতেই বসবাস করতেন। আল্লামা রমহরমুযী রহ. ক্বাবুসের এ মর্মের একটি বর্ণনা উদ্ধুত করেছেন যে – আমি আমর পিতাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, আপনি আলক্বামার নিকট মাসআলা- মাসায়েল জিজ্ঞেস করতে যান। তিনি তো হযরত ইবনে মাসউদের সাগরেদ। জবাবে তিনি বললেন- বৎস! আমি তাঁর নিকট হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনেক সাহাবীগণকেও বিভিন্ন মাসাআলা-মাসায়েল জানার উদ্দেশ্যে যাতায়াত করতে দেথেছি।
প্রখ্যাত বিচারক কাজী শুরাইহ- এর কর্মস্হলও ছিলো কুফানগরী। হযরত আলী রা. বলতেন, শুরাইহ আরবের সর্বাপেক্ষা বিচক্ষন বিচারক। এ ছাড়াও এমন আরও ৩৩জন তাবেয়ী আলেমের কর্মস্হল ছিল এইকূফায় যাঁরা সাহাবয়ে কেরামের জমানাতেই ফতওয়া দানের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। এসব প্রাজ্ঞ সাহবী এবং তবেয়ীগণের নিকট যারা এলেম শিক্ষা করেছিলেন, তাঁদের সংখ্যা ছিল অগনিত। অত্যাচারী শাসনকর্তা হজ্জায আবনে ইউসুফের বিরুদ্ধে কূফার উপকন্ঠ ‘দাইরে- জামাজেম’ এ আবদুর রহমান ইবনে আশআস যখন যুদ্ধ ঘোষনা করেন, তখন তার সাথে কুরআন-হাদিস বিশেষজ্ঞ আলেমের সংখ্যাই ছিল চার হাজার। রামহরমুযীন ইমাম ইবনে সিরীনের পুত্র আনাসের বানী বর্ণনা করেন যে, আমি যখন কুফায় উপনীত হই তখন এই শহরে চার হাজার হাদীস বিশেষজ্ঞ এবং চারশতও বেশি ফেকাহবিদ আলেম বাস করতেন।
ইমাম বুখারী রহ. এবং ইমাম আহমদ রহ. ইবনে হাম্বলের উস্তাদ আফফান ইবনে মুসলিম বলেন- আমি কুফায় চার মাস অবস্হান করেছি। তখন সেখানে হাদিসের এমন ব্যাপক চর্চা ছিল যে, ইচ্ছা করলে আমি অন্যুন এক লক্ষ হাদিস লিপিবদ্ধ করতে পারতাম। কিন্তু পঞ্চাশ হাজার হাদিস লিপিবদ্ধ করার পর আর আমি অগ্রসর হইনি। এই পঞ্চাশ হাজার হাদিস এই শহরের সকল শ্রেণীর লোকজনের মধ্যে আলোচিত হতো। ইমাম বুখারী রহ. বলেন, হাদিস সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে আমি বারবার কুফা গিয়েছি। (ফতহুল বারী)
ইমাম তিরমিযী রহ. বহু স্হলে কূফাবাসীদের অভিমতের উল্লেখ করেছেন। এই কুফা নগরীতেই ইমাম আবু হানীফার রহ. জন্ম এবং এই শহরেই তিনি জ্ঞানার্জন করার সুযোগ লাভ করেছিলেন। ইমাম সাহেবের যুগে যেসব সাহাবী ওবং প্রজ্ঞ তবেয়ী জীবিত ছিলেন তিনিও তাদের সকলের নিকট থেকেই হাদিস সংগ্রহ ও আয়ত্ব করেছিলেন। অপরদিকে তাবেয়ীগণেরও অনেকেই আবু হানীফার নিকট থেকে হাদিস শিক্ষা লাভ করেছিলেন।
( চলবে )
চলুক ভাই, আমিও আছি আপনার সাথে।
ধন্যবাদ, সময়োযোগী ।ইদানিং অনেকেই হানাফি মাযহাবের বিষয়ে মিথ্যা প্রচারনা চালাছেছ।
মশাআল্লহ, ভালো হয়েছে, চালিয়ে যান…
সকলকে ধন্যবাদ। দোয়া করবেন।
[...] [...]
Peace In Islam » Blog Archive » ইলমে ফেকাহর সুচনাকালঃ প্রসঙ্গ ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-২
[...] [...]
[...] [...]
[...] [...]
[...] [...]
[...] [...]
[...] [...]
আস সালামু আলাইকুম
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ আমার একটা প্রশ্ন আমি শুনেছি ইমাম আবু হানিফা (র:) নাকি শিয়াদের ইমাম জাফর সাদিক এর নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। এটা কি ঠিক? যদি ঠিক হয় তাহলে তো…
@shanty,
কখনো শুনিনি। উনি মুলত ইমাম হাম্মাদ রঃ থেকেই শিক্ষা লাভ করেছিলেন। পোষ্ট গুলো পড়লে বুঝতে পারবেন।
আপনার কথার কোন দলিল দিতে পারবেন?
@দ্য মুসলিম, ইমাম জাফর সাদেক (রহ:) থেকে ইলম অর্জন করলে সমস্যা কি ? শিয়ারা দাবী করে ইমাম জাফর সাদেক (রহ:) তাদের ইমাম যেটা সম্পূর্ন মিথ্যা । উনি আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের একজন মহান স্কলার যার সাথে শিয়াদের এই মিথ্যা দাবীর কোনো সত্যতা নেই।
ধন্যবাদ হাফিজ, সুন্দর মন্তব্যের জন্য।