ইলমে ফেকাহর সুচনাকালঃ প্রসঙ্গ ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-২
লিখেছেন: ' দ্য মুসলিম' @ শনিবার, জানুয়ারি ২, ২০১০ (২:৫২ পূর্বাহ্ণ)
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়াবারকাতুহু।
সুত্রঃ মাসিক মদিনা, ডিসেম্বর ২০০৯।
ইলমে ফেকাহর সুচনাকালঃ প্রসঙ্গ ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-১
ইমাম আবু হানীফা (রহ.) তাবেয়ী ছিলেন।
এই উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম ছিলেন সাহাবায়ে-কেরাম। সাহাবীদের পরবর্তী মর্তবা হচ্ছে তাবেয়ীগণের। সর্বসম্মতভাবে সাহাবীর সংজ্ঞা হলোঃ যাঁরা ঈমানের সাথে হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন এবং ঈমান নিয়েই মৃত্যুবরণ করেছেন। আর তাবেয়ী হচ্ছেন, যাঁরা ঈমানের সাথে সাহবীগণের সাক্ষাত লাভ করেছেন এবং ঈমানের সাথে মৃত্যুবরণ করেছেন। (নাখবাতুল-ফেকার)
সাহাবী এবং তবেয়ীগণের মর্যাদা নির্দেশ করে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- ঈমান আনার ব্যাপারে অগ্রবর্তিগণ, মুহাজের ও আনসারবৃন্দ এবং তাদের সৎকর্মের যারা অনুসরণ করেছেন তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করেছেন এবং তাঁরাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন।
হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, অত্যন্ত সৌভাগ্রবান সেই সমস্ত লোক যারা আমার সাক্ষাত লাভ করেছে এবং আমার সাক্ষাত যারা পেয়েছে, তাদেরকে পেয়েছে।
অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে- সর্বাপেক্ষা বরকতময় হচ্ছে আমার সময়কাল এবং তার পরবর্তী যুগ আর তার পরবর্তী যুগ।
ইমাম আবু হানীফার রহ. জন্ম ৮০ হিজরী সনে। সর্বাপেক্ষা বয়স্ক সাহাবী হযরত আবু তোফায়েল রা. ইন্তেকাল করেছেন ১১০ হিজরীতে। আবু হানীফার জন্মকাল থেকে নিয়ে একশত দশ হিজরী এই দীর্ঘ ত্রিশ বছর সময়কালের মধ্যে শতাধিক সাহাবী জীবিত ছিলেন। হাফেযুল হাদিস ইমাম মুযনীর রহ. বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম আবু হানীফা রহ. অন্যুন ৭২জন সাহাবীর সাক্ষাত লাভ করেছিলেন। (মুজামুল মুসান্নেফীন)
হাফেজ ইবনে হাজার আসক্বালানী রহ. বলেন, তাবেয়ী হওয়ার জন্য সাহাবীগণের সাক্ষাত লাভই যথেষ্ট। কেননা, হাদীস শরীফে শুধুমাত্র দেখা’র কথা বলা হয়েছে। সে মতে যারা তাবেয়ী হওয়ার জন্য দীর্ঘ সাহচর্য এবং সাহাবীগণের নিকট থেকে হাদিস বর্ণনা করাকেও শর্ত নির্ধারণ করেন তাদের বক্তব্য সঠিক নয়। (নুযহাতুননযর)
শায়খ আবুল হাসান হাফেজ ইবনে হাজারের উপরোক্ত বক্তব্যের ব্যাখ্যা করে বলেন- আল্লামা এরাক্বীর অভিমত অনুযায়ী এটাই অধিকসংখ্যক আলেমের অভিমত এবং এটাই সর্বাধীক গ্রহণযোগ্য তথ্য। কেননা, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বক্তব্য থেকে তাই প্রমাণিত হয়। সুতরাং হাদীসের বক্তব্য অনুযায়ী ইমাম আবু হানীফা রহ. সন্দেহাতীত ভাবে তাবেয়ীগণের অন্তর্ভুক্ত বলে প্রমাণিত হল। কেননা, তিনি আনাস ইবনে মালেক রা. এবং অন্য আরো কয়েকজন সাহাবীকে দেখেছেন। যেসব লোক ইমাম আবু হানীফকে রহ. তাবেয়ীদের মর্যাদা দিতে চান না, এরা নির্বোধ এবং বিদ্বষপরায়ন। (প্রাগুক্ত)
হাফেজ ইবনে হাজার আসক্বালানী রহ. আরো লিখেছেন- ইমাম আবু হানীফা রহ. বহুসংখ্যক সাহাবীর সাক্ষাত লাভ করেছেন। কেননা, তিনি ৮০ হিজরী সনে কুফায় জন্মগ্রহণ করেছেন এবং সেসময় সেই শহরে সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আবী আওফা রা. জীবিত ছিলেন। তাঁর ইন্তেকাল ৮০ হিজরীর অনেক পরে হয়েছে। তেমনি বসরাতে আনাস ইবনে মালেক রা. ছিলেন। তাঁর ইন্তেকাল হিজরী নব্বই সনে পরে হয়েছে। সে মতে ইমাম আবু হানীফা রহ. নিঃসন্দেহে তাবেয়ীগণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। (তানসীকুন-নেজাম)
বুখারী শরীফের ব্যাখাগ্রন্হে ইবনে হাজার আসক্বালানী রহ. উপরোক্ত সিদ্ধান্তটি আলেমগণের সর্বসম্মত অভিমত বলে উল্লেখ করেছেন। হাফেজ যাহাবী রহ. বলেন, ইমাম আবু হানীফা রহ. সাহাবী হযরত আনাস ইবনে মালেককে রা. অনেকবার দেখেছেন। (খাইরাতুল-হেসান)
আল্লামা ইবনে হাজার মক্কী রহ. মেশকাত শরীফের ব্যাখ্যা গন্হে উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম আবু হানীফা রহ. অন্যুন আটজন সাহাবীর সাক্ষাত লাভ করেছেন।
এঁরা হচ্ছেন-
১) হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. (ওফাত ৯৩ হিজরী)
২) আব্দুল্লাহ ইবনে আবী আওফা রা. (ওফাত ৮৭ হিজরী)
৩) সহল ইবনে সাআদ রা. (ওফাত ৮৮ হিজরী)
৪) আবু তোফায়ল রা. (ওফাত ১১০ হিজরী)
৫) আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়দী রা. (ওফাত ৯৯ হিজরী)
৬) জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. (ওফাত ৯৪ হিজরী)
৭) ওয়াসেনা ইবনুল আসকা রা. (ওফাত ৮৫ হিজরী)
ইবনে সাআদ লিখেছেন- সার্বিক বিচারেই ইমাম আবু হানীফা রহ. একজন তাবেয়ী ছিলেন। তাঁর সতীর্থ ফেকাহর ইমামগণের মধ্যে আর কারো এই মর্যাদা লাভের সৌভাগ্য হয় নাই। (তানসীক্ব)
আল্লামা খাওয়ারেজমী রহ. বলেন- ওলামাগণের এ বিষয়ে ঐক্যমত রয়েছে যে, ইমাম আবু হানীফা রহ. নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণের পবিত্র মুখ থেকে হাদিস শ্রবণ করে তা বর্ণনা করেছেন। তবে এরূপ হাদিসের সংখ্যা কত ছিল, এ সম্পর্কে বিভিন্ন মত রয়েছে। (তানসীক্ব)
ইমাম আবু হানীফা রহ. কর্তৃক সাহাবীগণ থেকে বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা কারো মতে ছয়, কারো মতে সাত এবং কারো মতে আটখানা। যেসব সাহাবী থেকে ইমাম সাহেব হাদিস বর্ণনা করেছিলেন, তাঁদের নাম যথাক্রমে – আনাস ইবনে মালেক রা., আবদুল্লাহ ইবনে আবী আওফা রা., সহল আবনে সাআদ রা., আবু তোফয়ল রা., আমের ইবনে ওয়াছেলা রা., ওয়াছেলা ইবনে আশক্বা রা., মা’কাল ইবনে ইয়াসার রা., এবং জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. প্রমুখগণ।
হাদিস শাস্ত্রের ‘ আমিরুল মুমেনীন’ রূপে খ্যাত আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক স্বরচিত কবিতার এক পংক্তিতে উল্লেখ করেছেন যে, নোমান ( আবু হানীফা ) এর পক্ষে গর্ব করার মতো এতটুকুই যথেষ্ট যা তিনি সরাসরি সাহাবীগণের নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন।
ইমাম আবু হানীফা রহ. স্বয়ং একটি বর্ণনায় বলেন, আমার জন্ম হিজরী ৮০ সনে এবং ৯৬ সনে প্রথম হজে যাই। তখন আমার বয়স ষোল বছর। মসজিদুল-হারামে প্রবেশ করে দেখলাম, একটি বড় হালকায় বহু লোক সমবেত হয়ে রয়েছেন। আমি আমার পিতাকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কিসের জমায়েত? তিনি বললেন, এটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনুল হারেছের রা. পাঠদানের হালকা। এ কথা শুনে আমি সেদিকে অগ্রসর হলাম। তাঁকে বলতে শুনলাম, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর দীন সম্পর্কিত গভীর জ্ঞান অর্জনে আত্মনিয়োগ করে, তার সকল প্রয়োজনের জিম্মাদার স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা হয়ে যান এবঙ তাকে এমন সব উৎস থেকে রিজিক পৌছাতে থাকেন, যা সে কখনো কল্পনাও করেনি। (মুসনাদে ইমাম আযম)
উল্লেখ্য যে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে হারেছের রা. ইন্তেকাল হয়েছে ৯৯ হিজরীতে। তখন ইমাম সাহেবের বয়স হয়েছিলো ১৯ বছর।
‘এলামুল-আখবার’ নামক গ্রন্হে বর্ণিত অন্য একখানা হাদিস ইমাম আবু হানীফা রহ. সরাসরি সাহাবী হযরত আনাস ইবনে মালেকের রা. নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন। উক্ত হাদিসে বলা হয়েছে যে, এলেম শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উপর ফরজ।
একই সুত্রে হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে ইমাম আবু হানীফা রহ. কর্তৃক বর্ণিত অন্য আর একখানা হাদিস হচ্ছে- পাখীরা আল্লাহর উপর যতটুকু ভরসা করে জীবন ধারন করে কোন বান্দা যদি ততটুকু ভরসা করতে শেখে তবে আল্লাহ পাক তাকেও অনুরূপ রিজিক দান করবেন। পাখীরা সকাল বেলায় খালি পেটে বের হয়ে যায়, সন্ধায় পেট ভরে বাসায় ফিরে আসে।
ইমাম সাহেব আর একখানা হাদিস সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবী আওফা রা. থেকে বর্ণনা করেছেন। হাদিস খানা হচ্ছে- যে ব্যক্তি মসজিদ নির্মাণ করবে আল্লাহ পাক তার জন্য বেহেশতে গৃহ নির্মাণ করবেন।
শেষোক্ত হাদিসখানাকে ইমাম জালালুদ্দিন সিয়ুতী রহ. মোতাওয়াতের হাদিস রূপে অভিহিত করেছেন।
মোল্লা আলী কারী রহ. বরেন, এই হাদিসটির অন্যুন পঞ্চাশটি সনদ আমি সংগ্রহ করেছি। তম্মধ্যে ইমাম আবু হানীফার রহ. মাধ্যমে বর্ণিত সনদিই সর্বোত্তম।
(চলবে)
[...] [...]
[...] [...]
[...] [...]
[...] [...]
[...] [...]
[...] [...]
[...] [...]