ইলমে ফেকাহর সুচনাকালঃ প্রসঙ্গ ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-৬
লিখেছেন: ' দ্য মুসলিম' @ শনিবার, জানুয়ারি ৩০, ২০১০ (১১:৩৯ অপরাহ্ণ)
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়াবারকাতুহু।
সুত্রঃ মাসিক মদিনা, জানুয়ারী ২০১০।
ইলমে ফেকাহর সুচনাকালঃ প্রসঙ্গ ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-১
ইলমে ফেকাহর সুচনাকালঃ প্রসঙ্গ ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-২
ইলমে ফেকাহর সুচনাকালঃ প্রসঙ্গ ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-৩
ইলমে ফেকাহর সুচনাকালঃ প্রসঙ্গ ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-৪
ইলমে ফেকাহর সুচনাকালঃ প্রসঙ্গ ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-৫
অন্যান্য উস্তাদগণঃ
আবু হানীফা রঃ ছিলেন সর্বকালেন সেরা মজতাহেদ ফিকাহবিদ ইমাম। বিশেষজ্ঞ শ্রেণীর কোন আলেমকে মুজতাদেদের স্তরে পৌছাতে হলে হাদীসের হাফেজ, তফসীর শাস্ত্রের সর্বোচ্চ বিশেষজ্ঞ এবং সাহাবীগণের জীবন ধারা সম্পর্কিত সকল বিষয়ের উপর সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম জ্ঞান থাকা অপরিহর্য হয়ে যায়। হযরত আবু হানীফাকে মজতাহেদ ইমামের স্তরে পৌছার জন্য উপরোক্ত বিষয়গুলিতে সর্বাধিক জ্ঞান অর্জন করতে হয়েছিলো। ফেকাহশাস্ত্র তথা কুরআন-মহাসাগর মন্হন করে মাসআলা-মাসায়েল নির্ধারণ করার প্রশিক্ষণ তিনি ইমাম হাম্মাদের নিকট থেকেই আয়ত্ব করেছিলেন। এছাড়াও তাঁর এলমে-ফেকাহর আর একজন বিশিষ্ট উস্তাদ ছিলেন আহলে বাইতের উজ্জলতম নক্ষত্র যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দেস ও ফকীহ ইমাম জাফর সাদেক রঃ।
ইমাম আবু হানীফার মন্তব্য হচ্ছে, যুগের সর্বাপেক্ষা বড় ফকীহ ছিলেন ইমাম জাফর সাদেক রঃ। তার চাইতে অধিক ধীসম্পন্ন কোন ফকীহর সাক্ষাত অন্য কোথাও পাইনি। (আল-মওয়াফেক)
হাদিস এবং তফসীর শাস্ত্র আয়ত্ব করার উদ্দেশ্যে ইমাম আবু হানীফা সে যুগের যে সব সেরা মুহাদ্দেসগণের শরনাপন্ন হয়েছিলেন, তাদের সংখ্যা হাফেজ জাহাবীর মতে ২৯০ জন। এঁদের মধ্যে এমন পন্ঞাশ ব্যক্তির নাম পাওয়া যায় যাদের বর্ণনা বুখারী-মুসলিম সহ সেহাহ-সেত্তার সকল কিতাবেই বিশেষ যত্নের সাথে গ্রহণ করা হয়েছে। (ইমামে আজম, আবু হানীফাহ রহঃ)
একই কারণে যেমন মোয়াত্তা ইমাম মালেক গ্রন্হটি প্রথম দিকে সংকলিত সর্বাধিক শুদ্ধ কিতাব রূপে গন্য করা হয, তেমনি হাদিস শাস্ত্রের প্রথম সংকলন গ্রন্হ “মুসনাদে ইমাম আবু হানীফা” নামক হাদিস সংকলনটি বিশুদ্ধতার দিক থেকে যে সর্বাগ্রগন্য তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই।
ইমাম সাহেবের হলকায়ে দরছ ও ফতওয়াঃ
দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর রাঃ কর্তৃক কূফা নগরীর গোড়াপত্তন করার পর পরই কূফা তথা সমগ্র ইরাকবাসীগণের জন্য এলমে-নববী শিক্ষা দান এবং ফতোয়া প্রদানের নিয়োজিত হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর একান্ত সহচর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ দীর্ঘকাল কূফায় অবস্হান ও দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে দ্বিনী এলেম চর্চার একটা বিশেষ ধারা গড়ে উঠেছিলো। প্রকৃত প্রস্তাবে এলমে-ফেকাহর গোড়াপত্তনকারীও ছিলেনহযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ। ইবরাহীম নখয়ীর রঃ মাধ্যমে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ এর প্রবর্তিত এলেমের সেই বিশেষ ধারার উত্তরাধিকার লাভ করেছিলেন ইমাম হাম্মাদ রঃ। তার হাতেই ইবনে মাসউদের রাঃ দ্বারা বপনকৃত ফেকাহ নামের চারাগাছটি একটি পরিপূর্ণ বৃক্ষের আকার ধারণ করে। ইমাম হাম্মাদের রঃ প্রতিষ্ঠিত দরসগাহের পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করার পর ইমাম আবু হানীফা রঃ তার অচিন্ত্যনীয় মেধা ও অধ্যবসায়ের দ্বারা সে বৃক্ষটি ফলে ফুলে সমৃদ্দ করে তুলেন। ইমাম আবু হানীফা রঃ এর মাধ্যমেই হযরত মসউদের রাঃ এলম ও প্রজ্ঞার মীরাছ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। ইমাম হাম্মাদের তিরোধানের পর কূফঅর জ্ঞানী সামাজ যে শুন্যতা অনুভব করছিলেন, অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ইমাম আবু হানীফা রঃ তা পূরণ করে দিতে সমর্থ হয়েছিলে। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম যুফার, আসাদ ইবনে ওমর, কাসেম ইবনে মাআল প্রমুখ সেরা আলেমগণও এ হালকার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়ার পর ইমাম আবু হানীফা রঃ পরিচালিত শিক্ষায়তনটিই কূফা তথা সমগ্র ইরাকের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষা কেন্দ্রে পরিণত হয়ে যায়।
একটি অদ্ভুদ স্বপ্ন এবং সেরা স্বপ্নতত্ববিদের ব্যাখ্যাঃ
এ সময়ে ইমাম আবু হানীফা রঃ একটি অদ্ভুদ স্বপ্ন দেখে কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। দেখলেন, যেন তিনি প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবর শরীফ খনন করে কিছু হাড়-কংকাল সংগ্রহ করছেন। স্বপ্নটি দেখার পর কিছু দিন তিনি ছিলেন মানসিক ভাবে খুবই উদ্বিগ্ন। শেষ পর্যন্ত স্বপ্নদ্রষ্টার পরিচয় গোপন রেখে তিনি স্বপ্নের বিবরণ তাবীর শাস্ত্রের ইমাম মুহম্মদ ইবনে সিরীনের রঃ খেদমতে পেশ করেন। ইবনে সিরীন রঃ এই স্বপ্নটিকে একটি মোবারক স্বপ্ন রূপে আখ্যায়িত করে বলেন, স্বপ্নদ্রষ্টা যুগের ইমাম এবং প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এলমের উত্তরাধিকার পুনজ্জীবিত করবেন। (আল-মোয়াফেক)
ইমাম মুহম্মদ ইবনে সিরীন রঃ কর্তৃক প্রদত্ত স্বপ্নের ব্যাখ্যা ইমাম আবু হানীফার জীবন-সাধনার মধ্য দিয়ে কেমন অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হয়েছিলো তা বিস্তারিত ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। কুরআন-হাদিসের পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা বিশ্লেষনের মাধ্যমে ইমাম আবু হানীফা রঃ ইসলামী বিধানশাস্ত্র তথা শরীয়তের আদেশ-নিষেধ এমন চমৎকার ভাবে বিশ্লেষন করে দিয়েছেন, যা পরবর্তীতে মুসলিম উম্মাহর জন্য সর্বাপেক্ষা নিরাপদ এবং সর্বাধিক সংখ্যক লোকের অনুসৃত বিধান শাস্ত্রের স্হান দখল করতে সমর্থ হয়েছে। ইমাম আবু হানীফা রঃ সময়কাল থেকে শুরু করে হিজরী একাদশ শতাব্দীর সমাপ্তিকাল অর্থাৎ হাজার বছরেরও আধিককাল পর্যন্ত সমড়্র আলমে-ইমলামের কোর্ট-কাচারী, লেন-দেন, বিবাহ-তালাক এবং সকল আনুষ্ঠানিক এবাদত-বন্দেগীতে আবু হানীফার ফেকাহই ব্যাপকভাবে অনুসৃত হয়েছে। কারণ একমাত্র ইমাম আবু হানীফা রঃ ছাড়া অন্যকোন ইমাম বা মনীষীই জীবনের সকল চাহিদা পূরণ উপযোগী বিস্তারিত বিধান উম্মতের সামনে পেশ করতে সক্ষম হননি। একারনেই যারা ইমাম আবু হানীফার মাযহাব মেনে নিতে অস্বীকার করেন, তারাও বিচার-পদ্ধতি পরিচালনায় বা অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্মের বহু ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফার রঃ মাযহাব মেনে নিতে বাধ্য হন।
(চলবে।)
[...] [...]
[...] [...]