ইলমে ফেকাহর সুচনাকালঃ প্রসঙ্গ ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-৯
লিখেছেন: ' দ্য মুসলিম' @ রবিবার, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১০ (৯:৩৭ অপরাহ্ণ)
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়াবারকাতুহু।
সুত্রঃ মাসিক মদিনা, জানুয়ারী ২০১০।
ইলমে ফেকাহর সুচনাকালঃ প্রসঙ্গ ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-১
ইলমে ফেকাহর সুচনাকালঃ প্রসঙ্গ ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-২
ইলমে ফেকাহর সুচনাকালঃ প্রসঙ্গ ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-৩
ইলমে ফেকাহর সুচনাকালঃ প্রসঙ্গ ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-৪
ইলমে ফেকাহর সুচনাকালঃ প্রসঙ্গ ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-৫
ইলমে ফেকাহর সুচনাকালঃ প্রসঙ্গ ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-৬
ইলমে ফেকাহর সুচনাকালঃ প্রসঙ্গ ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-৭
ইলমে ফেকাহর সুচনাকালঃ প্রসঙ্গ ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-৮
শিক্ষাদান পদ্ধতিঃ
দরসের মজলিসে তিনি এমনই নিবিষ্টচিত্ত হয়ে পড়তেন যে, অনেক সময় পারিপর্শ্বিকতার জ্ঞান লোপ পেত। একবার তকরীর করার সময় ঘরের ছাদ থেকে একটা সাপ তার কোলের উপর পতিত হ। তিনি শুধু কাপড় ঝাড়া দিয়ে সাপটি দুরে ফেলে দিলেন। একটা বাক্যও উচ্চারণ করলেন না বা এ ঘটনা তাঁর নিবিষ্টতায় মাসান্যতম ব্যাঘাতও সৃষ্টি করতে পারল না।
প্রতিটি তকরীরের শেষে তিনি বলতেন, এটি আমার অভিমত। যতটুকু সম্ভব হয়েছে, তা আমি বললাম। কেউ যদি আমার চাইতেও মজবুত দলীল ও যুক্তির অবতারনা করতে পারেন, তবে তাই অধিকতর গ্রহণযোগ্য হবে। (আবু যোহরা)
কোন একটি বিষয় আলোচনার সময় একবার একজন ছাত্র বলেছিলেন, আপনার এই অভিমতটি খুবই চমৎকার। জবাবে তিনি বলেছিলেন, এমনও তো হতে পারে যে, এক পর্যায়ে এটি ভুল প্রমাণিত হবে। (আবু যোহরা)
ইমাম আবু ইউসুফ রঃ তাঁর সব আলোচনারই লিপিবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করতেন। ইমাম সাহেব বলতেন, আমার তকরীর শুনে তা অনুধাবন করতে বেশি যত্নবান হও। এমনও হতে পারে যে, আজকের এই কথাগুলি পরবর্তীতে ভুল প্রমাণিত হবে। (আবু যোহরা)
যারা বিরূপ মন্তব্য করতো, তাদের সম্পর্কে ইমাম সাহেবের মন্তব্য ছিল- যদি কেউ আমার সম্পর্কে এমন কথা বলে, যা আমার মধ্যে নাই, তবে সে ভুল বলছে। আর আলেমদের কিছু না কিছু দোষ চর্চা তো তাদের মৃত্যুর পরও অব্যাহত থাকে।
ইমাম সাহেব প্রথম যখন শিক্ষা দান শুরু করেন, তখন শুধুমাত্র ইমাম হাম্মাদের সাগরেদগণই তাতে শরীক হতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তাতে কূফার সর্বস্তরের মানুষ, বিশিষ্ট জ্ঞানীগুনী, এমনকি ইমাম সাহেবের উস্তাদগণেরও কেউ কেউ এসে শরীক হতেন। বিখ্যাত তাবেয়ী মাসআব ইবনে কোদাম, ইমাম আমাশ প্রমুখ নিজে আসতেন এবং অন্যদেরকেও দরসে যোগ দিতে উৎসাহিত করতেন। একমাত্র স্পেন ব্যতীত তখনকার মুসলিম-বিশ্বের এমন কোন অঞ্চল ছিল না, যেখানকার শিক্ষার্থীগণ ইমাম আবু হানীফ রঃ এর দরসে সমবেত হননি। মক্কা-মদীনা, দামেস্ক, ওয়াসেত, মুসেল, জায়িরা, নসীবাইন, রামলা, মিসর, ফিলিস্তিন, ইয়ামান, ইয়ানামা, আহওয়ায, উস্তুর আবাদ, জুরজান, নিশাপুর, সমরকন্দ, বুখারা, কাবুল-হেমস প্রভৃতিসহ বিখ্যাত এমন কোন জনপদ ছিল না যেখান থেকে শিক্ষার্থীগণ এসে ইমাম আবু হানীফা রঃ এর নিকট শিক্ষা লাভ করেননি।
মুসলিম-বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জ্ঞানতৃষ্ঞা মিটানোর লক্ষ্যে সমবেত শিক্ষার্থীগণের বিচারেও ইমাম আবু হানীফা রঃ ছিলেন তাবেয়ীগণের মধ্যে কুরআন-হাদীস এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ে সর্বাধিক জ্ঞানী এবং তাকওয়া পরহেজগারীতে অনন্য ব্যক্তিত্ব। ইমাম সাহেবের অনুপম শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের বদৌলতে সে যুগে এমন কিছু সংখ্যক উজ্জল ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি হয়েছিল, যাঁরা মুসলিম উম্মাহর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আকাশে এক একজন জ্যোতিষ্ক হয়ে রয়েছেন। ইমাম সাহেবের সরাসরি সাগরেদগণের মধ্যে ২৮ ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে কাজী (বিচারক) এবং শতাধীক ব্যক্তি মুফতীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ইসালামের ইতিহাসে এক ব্যক্তির প্রচেষ্টায় এত বিপুল সংখ্যক প্রাজ্ঞ ব্যক্তির আবির্ভাব আর কোথাও দেখা যায় না।
ইসলামের প্রাথমিক কয়েকটি শতাব্দি ব্যাপী জ্ঞান অর্জন এবং বিতরণের সর্বাপেক্ষা বড় কেন্দ্র ছিল মক্কা ও মদীনার হারামাইন শরীফাইন। পবিত্র দুই মসজীদে নিয়মিত হাদিস, তফসীর, কেরাআত ও ফেকাহ-ফাতাওয়ার দরছ হতো। দুনিয়ার সমস্ত অঞ্চল থেকেই জ্ঞান পিপাসুগণ মক্কা-মদীনায় সমবেত হতেন। হজের মওসুমে এলেম চর্চার হালকাগুলি সর্বাপেক্ষা বেশি সক্রিয় হযে উঠতো। সাধারণতঃ রমযানের আগেই দুনিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে হজের কাফেলা মক্কা-মদীনায় পৌছে যেত। দুর-দুরান্তের পথ অতিক্রম করে আলেমগণ আসতেন তাদের জ্ঞান ভান্ডার সমৃদ্ধ করার মানসে। হারামাইন শরীফে জগৎ বিখ্যাত আলেমগণের দরসের হালকা বসত। প্রতিটি হালকায় আলেমগণ সমবেত হয়ে তাঁদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে নিতেন। ইমাম আবু হানীফা রঃ জীবনের প্রথম সফরে (৯৬ হিজরী) মক্কার হরম শরীফে সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনুল হারেছ রাঃ এর সাথে সাক্ষাত করার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন এবং তাঁর পবিত্র যবান থেকে হাদিস শ্রবণ করার মাধ্যমেই এলমে-হাদিসের প্রতি তাঁর আগ্রহের সুত্রপাত হয়। তাঁর শুত প্রথম হাদিসখানা ছিল- যে ব্যক্তি আল্লাহর দীনের বিশেষ জ্ঞান এলমে ফেকাহ আয়ত্ব করতে সমর্থ হয়, তার সকল চিন্তা ভাবনার দায়িত্ব আল্লাহ পাক স্বয়ং গ্রহণ করেন এবং তাকে এমন স্হান থেকে রিজিক পৌছান, যা তার ধারণায়ও আসে না। (জামে রযানুল এলেম)
এরপর ইমাম সাহেব আরও ৫৪ হজ করেন। তাঁর জীবনের সর্বমোট ৫৫ট হজের লক্ষ্য ছিল প্রধানত পবিত্র এই মহা সমাবেশ দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের আলেম-সাধক এবং বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞগণের সাথে মতবিনিময় এবং এর মাধ্যমে নিজের অভিজ্ঞতার ভান্ডার সমৃদ্ধ করা।
হজের সফরে ইমাম সাহেব শুধু যে, জ্ঞান আহরণ করতেন তাই নয়, জ্ঞান বিতরণও করতেন। তাঁর অসাধারণ জ্ঞানগরিমার খ্যাতি পূর্ব-পশ্চিমের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিলো্ ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের জ্ঞানী-গুনিগণ তাঁর সাক্ষাত লাভের জন্য আগ্রহী হয়ে থাকতেন।
(চলবে।)
সুন্দর বলেছেন ।