কিছু প্রচলিত ও বিভ্রান্তিকর প্রশ্নের উত্তর-৪
লিখেছেন: ' দ্য মুসলিম' @ শুক্রবার, এপ্রিল ২, ২০১০ (৯:৪১ অপরাহ্ণ)
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহু।
সুত্রঃ আশরাফুল জাওয়াব।
মুলঃ আশরাফ আলী থানভী (রঃ)
ইসলামে দাস প্রথা আপত্তিকর।
উত্তরঃ
সামাজিক ক্ষেত্রে ইসলামের হুকুম হলো “তোমার গোলামের সত্তরটি অপরাধ থাকলেও তাকে ক্ষমা করে দাও; আরো অধিক হলে লঘুদন্ড প্রদান কর।” কোন অমুসলমান গোলাম তো দূরের কথা আপন সন্তানের সাথেও এ ধরনের বিনম্র আচরণ প্রদর্শন করতে কখনো দেখা যায় না। কিন্তু অন্তন্ত পরিতাপের বিষয় যে, এত সব সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও বিরোধীদের পক্ষ থেকে ইসলামের দাসপ্রথা সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে আমি অত্যন্ত জোর দিয়ে বলতে চাই যে, গোলামদের সাথে ইসলাম যে আচরণ দেখিয়েছে, কোন পিতা আপন সন্তানদের সাথেও তা করতে সক্ষম নয়।
বস্তুত একমাত্র ইসলামই এমন বিধান দিয়েছে যার ফলে সমাজের একাংশ দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির সন্ধান পেয়েছে। মনে করুন শত্রুদল কর্তৃক যদি মুসলমানগণ আক্রান্ত হয়, অথচ একই শত্রু পক্ষীয় হাজার হাজার লোক তাদের হাতে বন্দী, এখন বলুন এদের সম্পর্কে সঙ্গত আচরণ কি হওয়া উচিত?
প্রথমত এদেরকে যদি মুক্তি দেয়া হয়- তাহলে এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, যুদ্ধাবস্হায় নিজেদের মুকাবিলায় লক্ষ-হাজার সৈন্য দ্বারা শত্রু বাহিনীকে নববলে বলীয়ান করে দেয়া, যা নিছক বোকামিরই নামান্তর।
দ্বিতীয়ত, সাথে সাথে তাদেরকে হত্যা করে ফেলা। এমতবস্হায় দাসত্বের ব্যাপারেই যেখানে বিপক্ষীয়দের এত আপত্তি, সেক্ষেত্রে তাদের মধ্যে তুমুল হৈ-চৈ শুরু হয়ে যেত যে, দেখ ইসলামের বিধান কত নির্মম ও বর্বরোচিত যে, মুহূর্ত বন্দীদের প্রাণ সংহার করে ফেলা হয়েছে।
তৃতীয়ত, তাদেরকে কারাগারে নিক্ষেপ করে সেখানেই বন্দী হিসাবে তাদের অন্ন-বস্ত্রের সংস্হান করা। এ ব্যবস্হা যদিও বর্তমানের কোন কোন উন্নত ও ধনী দেশের পছন্দনীয়, কিন্তু বিভিন্ন কারণে এ ব্যবস্হাও ত্রুটিপূর্ণ। একে তো এর ফলে রাষ্ট্রের উপর বিরাট অর্থনৈতিক চার সৃস্টি হয়। দ্বিতীয়ত, এসব বন্দীকে উৎপাদনমূলক কাজে লাগিয়ে এদের শ্রমলব্ধ অর্থের মাধ্যমে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক চাপ অপেক্ষাকৃত কমিয়ে আনাটা একটা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যবস্হা। অপরদিকে কয়েদীদের নিরাপত্তা ও সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে বিপুল সংখ্যক আমলা নিয়োগ করতে হয়, যাদের শুধু একই কাজে সর্বক্ষণ নিয়োজিত রাখতে হবে, অন্য কোন কাজে লাগানো সম্ভব নয়। তৃতীয়ত অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা গেছে কারাবন্দীদের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দেয়া সত্ত্বেও এসব তাদের নিকট মূল্যহীন হয়ে দাঁড়ায়। কেননা তাদের ব্যক্তি-স্বাধীনতা হারানোর অনুভূতি এবং ক্রোধ এত তীব্য হয় যে, রাষ্ট্রের সকল সুযোগ-সুবিধার যথার্থ মুল্যায়নে তারা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বসে। সুতরাং এতে রাষ্ট্রের টাকাও গেল, অথচ শত্রুর শত্রুতাও হ্রাস পেল না। অধিকন্তু কারাগারে আটক হাজার হাজার আদম সন্তান শিক্ষা ও সভ্যতা থেকে সর্বোতভাবে বঞ্চিত হয়ে যায়, যা মানবতাবিরোধী অপরাধ।
কাজেই ইসলাম ন্যায়ানুগ পন্হায় এদের সম্পর্কে বিধান জারি করেছে যে, যুদ্ধবন্দীদেরকে সৈন্যদের মধ্যে বন্টন করে দিতে হবে। ফলে একটি পরিবারে একটি গোলামের ব্যয়ভার বহন করা কোন সমস্যাই নয়। অপরদিকে রাষ্ট্রও বিরাট আর্থিক চাপ থেকে বেঁচে গেল। অতঃপর মনিব কর্তৃক স্বীয় গোলাম দ্বারা অর্থোপার্জন করানোর অধিকার স্বীকৃত ও আইনসিদ্ধ হওয়ার ফলে তার ভরণ-পোষণ মালিকের উপর আর্থিক বোঝা হয়ে দাঁড়াবে না। এতমবস্হায় মালিকের অনুভূতি এটাই হবে যে, চাকরের পেছনে আমাকে একটা অংক ব্যয় করতে হতো, এখন না হয় সে পয়সাটা এর পেছনেই ব্যয় হলো; আর বিনিময়ে তাকে কাজে খাটিয়ে নেব। এক্ষেত্রে মানসিক একটা প্রশান্তিও রয়েছে। গোলাম যেহেতু বন্দীর তুলনায় চলাফেরা, ভ্রমণ ইত্যাদিতে অপেক্ষাকৃত স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে, তাই মনিবের বিরুদ্ধে তার অন্তরে বিদ্বেষ ও ক্রোধের সঞ্চার হয় না। তদুপরি মনিব যদি তার প্রতি সদয় থাকে, বিনয় ব্যবহার করে তবে সে কৃতজ্ঞ হয়ে মনিবের বাড়িকে আপন বাড়ি এবং তার পরিবারকে আপন পরিবার মনে করতে থাকে। এটা কোন রূপকথা নয়। বাস্তব ঘটনা এর সাক্ষী।
অধিকন্তু এহেন পরিবেশ শিক্ষা-সভ্যতায় উন্নতি করার পথ গোলামের জন্য সুগম হয়ে যায়। কারণ উভয়ের হৃদ্যতার ফলে মনিবের একান্ত ইচ্ছা থাকে আমার গোলাম শিক্ষ-দীক্ষায় উন্নতি করুক, সভ্য মানুষ হিসেবে গড়ে উঠুক। সে তাকে শিক্ষা ও কারিগরি জ্ঞানে দক্ষ এবং পারদর্শী করে তুলতেও যত্নবান হয়। সুতরাং ইসলামের ইতিহাসে লক্ষ করা যায় শত শত আলেম, ফাযেল, জ্ঞানী-গুনী, সুফী, আবেদ এমন রয়েছেন যাঁরা মূলত গোলাম ছিলেন। তাই গোলামশ্রেণীর লোকের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখায় উন্নতি করতে এমনকি রাষ্ট্রপ্রধানের পদে বরিত হতে পর্যন্ত দেখা যায়। ইসলাম বিদ্বেষীরা তরাবারির জোরে ইসলাম প্রচার করেছেন বলে সুলতান মাহমুদের চরিত্রে কলংক লেপনের ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে থাক। কিন্তু ভুরি ভুরি প্রমাণের মধ্য থেকে একটি মাত্র ঘটনা এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে যা তাঁর দয়া ও উদারতার সাক্ষর বহন করে আর গোলামদের সাথে তাঁর আচরণের চিত্র ফুটে ওঠে।
সুলতান মাহমুদ একবার ভারত আক্রমণ করেন এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভারতীয় হিন্দুকে বন্দী করে নিজের সাথে গজনী নিয়ে যান। এদের মধ্যে একজন চালাক-চতুর গোলাম ছিল। তাকে আযাদ করে দিয়ে তিনি বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী করে তোলেন। শিক্ষা সমাপনান্তে তাকে রাষ্ট্রীয় উচ্চপদে নিয়োগ করেন। এক পর্যায়ে তাকে ‘ ঘোর ‘ প্রদেশের শাসনকর্তার পদে নিয়োগ করা হয়। তদানীন্তন কালে ‘ ঘোর ‘ ছিলো আজকালের স্বায়ত্তশিসিত দেশীয় রাজ্যের সমপর্যায়ের। আড়ম্বরপূর্ণ অভিষেক অনুষ্ঠানে তার শিরে রাজমুকুট পরিয়ে দিলে সে রোদন করতে থাকে। সুলতান তাকে প্রশ্ন করলেনঃ একি, এটা কি ক্রন্দনের সময় নাকি আনন্দের? সে আরজ করল- জাঁহাপানা! আজকের এই গৌরবময় আনন্দলগ্নে বাল্য জীবনের ঘটনা স্মরণ করে অশ্রু সংবরণ করতে পারছি না। হুযুর, বাল্য বয়সে হিন্দুস্তান থাকাকালে আপনার অভিযানের খবর শুনে হিন্দুরা ভয়ে কম্পমান থাকত। হিন্দু মায়েরা দৈত্যের ন্যায় আপনার ভয় দেখিয়ে সন্তানদেরকে থামাবার চেষ্টা করত। আমার মা-ও আপনার নাম করে তেমনি জুজুবুড়ির মত ভয় দেখাতেন। আমি মনে করতাম মাহমুদ না জানি কত বড় জালিম, অত্যাচারী। এক পর্যায়ে আমার দেশের উপর আপনি আক্রমণ পরিচালনা করেন। আপনার বিপক্ষে হিন্দু প্রতিরক্ষাকারী দলে এ গোলামও যুদ্ধরত ছিল। তখন পর্যন্ত আমি নিজেও আপনার নামে ভীত-সন্ত্রস্ত থাকতাম। অতঃপর আপনার হাতে বন্দী হলে আমার ভয়ের অবধী ছিল না- “আর বুঝি রক্ষা নেই।” কিন্তু শত্রুপক্ষের ঐতিহ্যের বিপরীত আমার প্রতি আপনার উদার আচরণের ফলে আমার শির আজ রাজমুকুটে সুশোভিত। অতীতের সে স্মৃতি স্মরণ করে করে আজকে আমার চোখে অশ্রু গড়িয়ে যাচ্ছে। হায়… … আজ যদি আমার মা উপস্হিত থাকতেন! তাকে বলতাম- দেখ; এই সেই মাহমুদ যাকে তুমি দৈত্যজ্ঞান করতে।
বন্ধুগণ, এজাতীয় ঘটনায় ইসলামের ইতিহাস পরিপূর্ণ। আর এগুলি ইসলামের উদারনীতিরই সুফল বলা যায়। পক্ষান্তরে এদেরকে যদি করাগারে নিক্ষেপ করা হতো তাহলে মুসলিম সমাজের সাথে হৃদ্যতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠার কোন অবকাশই থাকত না। কিন্তু গোলামির সুবাদের এরা মুসলিম সমাজের সাথে একাত্ম হওয়ার সুযোগ পায়, শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নতি করে নিজ নিজ মেধানুযায়ী প্রত্যেকেই মর্যাদার উচ্চ শিখরে আসীন হওয়ার সুযোগ লাভ করে। তাই তাদের মধ্য থেকে কেউ মুহাদ্দিস, কেউ ফকীহ, মুফাসসির, ক্বারী, বিচারক, হাকীম, পন্ডিত, আবার কেউবা সাহিত্যিকরূপে খ্যাতির অত্যুচ্চ আসনে সমাসীন হয়ে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। গোলামদের সম্পর্কে মহানবী সাঃ এর বাণী হচ্ছে- নিজেরা যা খাবে, পরবে গোলামদেরকেও তাই খেতে-পরতে দেবে। খাদ্য তৈরী করে দিলে তাদেরকে নিজের সাথে বসিয়ে খাওয়াবে। এ সম্পর্কে মহানবী সাঃ এর অন্তিমকালীন বানী প্রণিধানযোগ্য-
নামাজ ও অধীনস্হ গোলামদের সম্পর্কের তোমরা যত্নবান থেকো।
এর চেয়ে অধিক সুযোগ-সুবিধা ও রায়াত আর কি হতে পারে?
আল হামদুলিল্লাহ, সাহাবায়ে কিরাম, তাবেঈন এবং অধিকাংশ মুসলিম সম্রাট গোলামদের সাথে অনুরূপ আচরণ ও নীতি অবলম্বন করেছেন। অবশ্য দু’-একজন এর ব্যতিক্রম করে থাকলে সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার, এর জন্য ইসলাম দায়ী নয়।
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহু।