জননীর পদতলে সন্তানের বেহেশত
লিখেছেন: ' sayedalihasan' @ বৃহস্পতিবার, অগাষ্ট ১৮, ২০১১ (১০:৩৭ পূর্বাহ্ণ)
সন্তান- সন্ততির পৃথিবীতে আসার মাধ্যম হচ্ছে তার পিতা ও মাতা। শিশুর জন্মদিন থেকে তার প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত তার লালন-পালনের বাহক হচ্ছে তার পিতা-মাতা। সমস্ত সৃষ্টিজগতের লালন ও পালনকর্তা একমাত্র আল্লাহ। তাই তিনি রব্বুল আ’লামীন তথা বিশ্বজগতের প্রতিপালক। আল্লাহতাআলা তাঁর ইবাদাত ও বন্দেগী করার হুকুম দেয়ার পর প্রত্যেক সন্তানকে তার পিতা-মাতার সাথে সুব্যবহারের নির্দেশও দিয়েছেন। যার বহু প্রমাণ আল-কুরআনে এবং হাদীসে আছে।
মহান আল্লাহপাক বলেনঃ “ আর তোমার পালনকর্তা (কতিপয়) সিদ্ধান্ত দিয়েছেন (তা এই) যে, তোমরা কেবলমাত্র তারই ইবাদাত করবে এবং পিতা-মাতার সাথে সুব্যবহার করবে। যদি তাদের মধ্যে একজন কিংবা দু’জনই তোমার নিকটে বৃদ্ধ বয়সে অবশ্যই পৌঁছে যায় তাহলে (তাদের খিটখিটে ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে) তাদেরকে তুমি উফ্ শব্দও বলবে না এবং তাদেরকে ধমকও দেবে না। আর তাদের জন্য তুমি সম্মানবাচক কথা বল এবং তাদের জন্য দয়ার মধ্য থেকে নম্রতার বাহু ঝুঁকিয়ে দাও। আর তাদের জন্য দুআস্বরূপ একথা বলবে, হে আমার পালনকর্তা, তাদের দু’জনের ওপর ঐরূপ দয়া কর যেরূপ তারা আমাকে ছোট বেলায় লালন-পালন করেছিলেন” (সূরা বানী ইসরাইল, ২৩-২৪ আয়াত)
উক্ত আয়াত দু’টিতে আল্লাহতাআলা মানুষকে ৫টি নির্দেশ দিয়েছেনঃ
১) তার ইবাদাতের পরেই পিতা-মাতার সাথে সুব্যবহার করা।
২) পিতা-মাতাকে বৃদ্ধ বয়সে পেলে তাদের খিটখিটে মেজাজের কারণে বিরক্ত হয়ে তাদেরকে ‘উহ’ শব্দও না বলা।
৩) তাদের ধমক না দেয়া।
৪) তাদের মানসম্মান রেখে কথা বলা এবং শক্তির গরম না দেখানো।
৫) তাদের প্রতি দয়া করার জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করা।
মহান আল্লাহ পাক বলেন:- “ আর আমি মানুষকে বিশেষ তাগিদ দিয়েছি তার পিতা-মাতার সাথে সদয় ব্যবহার করার। তার মা তাকে (পেটে) রেখেছে এবং তাকে দুধপান ছাড়ানো সময় দিয়েছে ত্রিশ মাস। পরিশেষে যখন সে পূর্ণশক্তিতে পৌঁছে যায় এবং চল্লিশ বছর বয়সে উপনীত হয় তখন সে (যেন) বলে, হে আমার পালনকর্তা (আল্লাহ) তুমি আমাকে শক্তি দান কর যাতে আমি তোমার সেই সম্পদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি যা তুমি আমাকে এবং আমার পিতা-মাতাকে পুরস্কার দিয়েছো। আর আমি যেন এমন ভাল ভাল কাজ করতে পারি যা তুমি পছন্দ কর। আর আমার সম্মানে আমার সন্তান-সন্ততিদের মধ্যেও তুমি ঐ যোগ্যতা দান কর। আমি তোমার কাছেই ফিরে এসেছি এবং আমি তোমার কাছে আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যেও রয়েছি (সূরা আহক্কা-ফ, ১৫ আয়াত)।
হযরত ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, একবার আমি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে জিজ্ঞেস করলাম, কোন কাজটা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়? তিনি বললেন, সঠিক সময়ে নামাজ পড়া। আমি বললাম, তাঁরপর? তিনি বললেন, মা-বাপের সাথে সদ্ব্যবহার। আমি বললাম, তারপর? তিনি বললেন, আল্লাহর পথে সংগ্রাম (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত)।
সাহাবী হযরত আবু উমামাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, একজন লোক বললো, হে আল্লাহর রসুল! সন্তানের ওপর পিতা-মাতার অধিকার কি?হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তারা দু’জন তোমার জান্নাত অথবা তোমার জাহান্নাম (ইবনে মা-জাহ, , মিশকাত)।
সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আওফা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর যুগে আলক্কামাহ্ নামে এক যুবক ছিল। সে আল্লাহর আনুগত্যে নামায ও রোযা এবং দান খয়রাতে খুবই সাধ্যসাধনাকারী ছিল। সে একবার অসুখে পড়ে এবং তার অসুখটা খুবই বেড়ে যায়, ফলে তার স্ত্রী হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে লোক পাঠায় এই খবর দিয়ে যে, আমার স্বামী মরণের পথে। তাই আমি আপনাকে তার অবস্থাটা জানাবার ইচ্ছা পোষণ করছি। অত:পর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আম্মার ও সুহাইব এবং বেলাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এই তিনজন সাহাবীকে পাঠালেন এবং তাদেরকে তিনি বললেন, তোমরা তার কাছে যাও এবং কালিমা দ্বারা তাকে তালক্বীন (মনে) করাও। তাই তারা তার কাছে গেলেন এবং তাকে মরণাপন্ন অবস্থার মধ্যে পেলেন। অত:পর তারা তাকে “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু” মনে করিয়ে দিতে লাগলেন। কিন্তু তার জিহবা তা বলতে পারছিল না। তাই তাঁরা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর কাছে এই খবর পাঠালেন যে, তার জিহবা কালিমা পড়তে পারছে না। তখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন তার মা-বাপের মধ্যে কেউ বেঁচে আছে কি? বলা হলো, হে আল্লাহর রসুল! তার বৃদ্ধ মা আছে। অত:পর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কাছে দূত পাঠিয়ে বললেন, তাকে বল, আপনি যদি চলার শক্তি রাখেন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে আসার তাহলে আসুন, অন্যথায় আপনি ঘরে থাকুন। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনার কাছে আসবেন, তারপর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দূত তার কাছে এসে তাকে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কথাটা জানালেন।
তখন বৃদ্ধা বললেন, আমার প্রাণ তার জন্য উত্সর্গিত হোক, আমিই তাঁর কাছে আসার হকদার বেশী। তাই তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর কাছে এলেন এবং তাঁকে সালাম দিলেন। তিনিও তার সালামের জবাব দিলেন এবং তাকে বিজ্ঞাসা করলেন, হে আলক্বামার মা! আপনি আমাকে সত্য কথা বলুন। আর আপনি যদি আমাকে মিথ্যা বলেন, তাহলে আল্লাহর তরফ থেকে অহী আসবে। আপনার ছেলে আলক্বামার ব্যাপারটা কি? তিনি বললেন, সে তো খুবই নামাযী ও খুবই রোয়াদার এবং অতি দানখয়রাতকারী। অত:পর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আপনার অবস্থাটা কি? তিনি বললেন, হে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমি তার প্রতি অসন্তুষ্ট। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তা কেন? তিনি বললেন, হে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সে তার স্ত্রীকে আমার ওপরে প্রধান্য দেয়। তখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন. আলক্বামার মায়ের অসন্তুষ্টি আলক্বামার জিহবাকে কালিমা পড়া থেকে আটকে রেখেছে। তারপর তিনি বললেন, হে বেলাল! তুমি যাও এবং আমার খাতিরে বহু কাঠ যোগাড় কর। তখন বৃদ্ধা বলল, হে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা দিয়ে আপনি কি করবেন? হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন আপনার সামনে আমি ওকে পোড়াবো। বৃদ্ধা বললো, হে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার ছেলেকে আমারই সামনে আপনি পুড়াবেন, তা আমার অন্তর সহ্য করতে পারবে না। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, হে আলক্বামার মা! আল্লাহর শাস্তি অতি কঠিন এবং অতিস্থায়ী। তাই আপনি যদি এ ব্যাপারে খুশী হন যে, আল্লাহ আপনার ছেলেকে ক্ষমা করে দিন তাহলে আপনি ওর প্রতি সন্তষ্টু হয়ে যান। তাঁর কছম! যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে। আলক্বামার নামাজ ও রোজা এবং দান ও খয়রাত কোনই ফাইদা দেবে না যতক্ষণ আপনি ওর প্রতি নারাজ থাকবেন। অত:পর বৃদ্ধা বললো, হে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমি সাক্ষ্য রাখছি আল্লাহতায়ালাকে ও তাঁর ফেরেশতাদেরকে এবং আমার কাছে যেসব মুসলমান হাজির আছে তাদেরকে যে, আমি অবশ্যই আমার ছেলের প্রতি সন্তুষ্ট। তারপর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, হে বেলাল! তুমি আলক্বামার কাছে যাও এবং দেখো যে, সে- “লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ” বলতে পারেন কি না? হতে পরে আলক্বমার মা আমাকে লজ্জা ক’রে এমন কথা বলছেন যা তার অন্তরে নেই। তাই হযরতবেলাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু গেলেন। অত:পর তিনি ঘরের ভেতর থেকে আলক্বমাহকে বলতে শুনলেন, “লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ”। অত:পর হযরত বেলাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ঐ ঘরে ঢুকলেন এবং বললেন, হে লোক সকল! আলক্বমার মায়ের সন্তুষ্টি আল্ক্বমার জিহ্বাটাকে খুলে দিয়েছে।
তারপর ঐদিনেই আলক্বমাহ মারা যান। অত:পর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কাছে হাজির হলেন এবং তাকে গোসল দেবার ও কাফন পরাবার নির্দেশ দিলেন। তারপর তিনি তাঁর জানাযা পড়ালেন এবং তাকে কবর দিতে হাজির হলেন। তারপর তিনি তাঁর কবরের কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, হে মুহাজির ও আনসারদের দল। যে ব্যক্তি তার মায়ের ওপরে স্ত্রীকে প্রাধান্য দেবে তার ওপর আল্লাহ এবং তাঁর ফেরেশতা ও সমস্ত মানুষের অভিশাপ হবে। আল্লাহ তার তরফ থেকে কোন ফরয ও নফল কবুল করবেন না। (ত্ববারানী, হুকুকুল ওয়ালিদাইন, ১২৩-১২৫ পৃষ্ঠা)। মুসনাদে আহমাদে এই হাদীসটি অনেকটা বর্ণিত হয়েছে (মাজমাউয যাওয়া-য়িদ, ৮ম খন্ড, ১৪৮ পৃষ্ঠা)।
আফযালুন নাস বা’দাল আম্বিয়া, ছিদ্দীক্বে আকবর হযরত আবু বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু খলিফা থাকা অবস্থায় ১২ হিজরীতে ওমরাহ করার উদ্দেশ্য মক্কায় তাশরীফ আনলে নিজের পুরাতন বাড়িতেও যান। তখন তাঁর পিতা হযরত আবু কুহা-ফা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু নিজের ঘরের সামনে কতিপয় যুবককে নিয়ে বসেছিলেন তখন লোকেরা বলল আপনার পুত্র বর্তমান খলীফা হযরত আবু বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আসছেন। ছিদ্দীক্বে আকবর হযরত আবু বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে দেখে তিনি খুশীতে ডগমগ হয়ে উঠে দাঁড়ান। এদিকে তাঁর পিতার সাথে তাড়াতাড়ি সাক্ষাতের জন্য আগে বাড়তে থাকেন। অতঃপর তিনি যখন তাঁর পিতাকে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পেলেন তখন তিনি বললেন, হে আমার পিতা! আপনি দাঁড়াবেন না একথা বলে তিনি উটটাকে না বসিয়ে উটের পিঠ থেকেই লাফ দিয়ে পড়লেন যাতে উনার বৃদ্ধ পিতাকে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে না থাকতে হয়। (মুনতাখাব কাঞ্জুল উম্মা-ল, ২য় খন্ড, ১৬৯ পৃষ্ঠা, স্বিফাতুস স্বফ্অহ্ ১ম খন্ড, ৯৮ পৃষ্ঠা)।
আল্লাহ পাক আমাদের কে মাতা পিতার খেদমত করার তাওফিক দান করুন।
জাযাকাল্লাহ।