মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এর শরয়ী বিধান (৩য় পর্ব)
লিখেছেন: ' sayedalihasan' @ শুক্রবার, জুন ১৭, ২০১১ (৬:৩৯ পূর্বাহ্ণ)
আমরা আমাদের এ প্রবন্ধে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এর বৈধতা-অবৈধতার বিষয়টি দু’টি দিক থেকে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ্।
প্রথমত : ভিত্তিগত (substantive and theoretical)
দ্বিতীয়ত : পদ্ধতিগত (procedural)
ভিত্তিগত দিক : মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এর পদ্ধতি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকমের হলেও তত্ত্বগত ভিত্তিটি (theoretical basis) সবসময় একই। তা হলো, নিম্ন লেভেলের ডিস্ট্রিবিউটর কর্তৃক বিক্রিত পণ্যের একটি কমিশন সর্বোচ্চ লেভেল পর্যন্ত পায়। যেটাকে এক কথায় ‘শ্রমের বহুস্তর সুবিধা’ বলা যায়। কোনো কোনো লেখক এর নাম দিয়েছেন ‘‘Chain reaction of labour’’, কেউবা আবার ব্যক্ত করেছেন ‘‘Chain pyramidal commission’’ কিংবা ‘‘Compound brokerage’’ ইত্যাদি নামে। তাদের এ নীতিটির সাথে ইসলামের শ্রমনীতির রয়েছে সরাসরি সংঘর্ষ। কারণ ইসলামের শ্রমনীতি হলো,
﴿أَلَّا تَزِرُ وَازِرَةٞ وِزۡرَ أُخۡرَىٰ ٣٨ وَأَن لَّيۡسَ لِلۡإِنسَٰنِ إِلَّا مَا سَعَىٰ ٣٩﴾[النجم: 38-39]
‘‘কোনো মানুষই অপরের বোঝা উঠাবে না। মানুষ ততটুকুই পাবে যতটুকু সে চেষ্টা করে’’ [সূরা আন-নাজম, আয়াত : ৩৮-৩৯]। এ আয়াত থেকে সুস্পষ্ট যে, মানুষ কেবল তার নিজের শ্রমের প্রত্যক্ষ ফল লাভের অধিকারী। কারও নিযুক্ত কর্মী না হলে একজন আরেকজনের শ্রমের ফলে অংশীদার হতে পারে না। একইভাবে মানুষ তার শ্রমের ফল কেবল নিকটবর্তী লেভেল থেকে আশা করতে পারে। কোনো ক্রমেই তা বহুস্তর (multi level) পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে না। এটি যেমন ইসলামি শ্রমনীতির সাথে অসংগতিপূর্ণ তেমনি মানবীয় বুদ্ধি বিবেচনায় অস্বীকৃত। কারণ, এ ব্যবসায় এক পর্যায়ে দেখা যায় নিম্নলেভেলের ডিস্ট্রিবিউটর ফরিদপুরের মাসুদ উচ্চলেভেলের ডিস্ট্রিবিউটর বরিশালের নোমানকে চিনে না, তাদের সাথে কোনো যোগাযোগ ও কথা-বার্তা নেই অথচ নিম্নলেভেলের মাসুদ থেকে উচ্চলেভেলের নোমান কমিশন পাচ্ছে। মানবীয় সুস্থ বিবেক বলছে, কোনো পণ্যের পেছনে যে প্রত্যক্ষ শ্রম দিয়েছে কেবলমাত্র সেই পারিশ্রমিক পেতে বাধ্য। কিন্তু যে পরোক্ষ শ্রম দিয়েছে সে পারিশ্রমিক পেতে বাধ্য নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একজন শিক্ষক সে তার প্রত্যক্ষ শ্রমের ফল হিসেবে বেতন দাবি করতে পারে। কিন্তু সে যদি দাবি করে, তার ছাত্ররা যত জনকে শিক্ষিত করে কর্মক্ষম করে তুলবে এবং ভবিষ্যতে তারা আরও যাদেরকে শিক্ষিত করে তুলবে তাদের প্রত্যেকের আয়ের একটি ক্ষুদ্র অংশ উর্ধবতন শিক্ষককে কমিশন হিসেবে দিতে হবে তাহলে বিষয়টি মেনে নেয়ার মত নয়। কারণ এখানে শিক্ষকের শ্রম শুধু তার সরাসরি ছাত্রদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তার ছাত্রদের ছাত্র বা তাদের ছাত্রের প্রতি তাঁর কোনো শ্রম নেই। তার শ্রমের ভিত্তিতে সরাসরি তার ছাত্রদের কাছ থেকে সে বেতন বা সম্মান পাওয়ার অধিকার রাখে কিন্তু ডাউনলাইনের ছাত্রদের কাছ থেকে সে কিসের ভিত্তিতে কমিশন বা বেতন ভোগ করবে?
সুতরাং ইসলামি শ্রমনীতি ও মানবীয় বুদ্ধি বিবেচনায় শ্রমের বহুস্তর সুবিধা (multi level benefit of labour) নীতিটি শরী‘আত সম্মত হতে পারে না। অথচ এ নীতিটিই মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এর সবচেয়ে বড় তাত্ত্বিক ভিত্তি। এ ভিত্তি সরিয়ে ফেললে এ প্রকার ব্যবসার অস্তিত্বই থাকবে না। কোনো সাধারণ কোম্পানি থেকে পণ্য কিনে অপরজনের কাছে বিক্রির মাধ্যমে লাভবান হওয়ার বৈধ অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে। অনুরূপ কোনো ক্রেতা সংগ্রহ করে দেয়ার মাধ্যমে কোম্পানির কাছ থেকে দালালীর কমিশন (brokerage fee) নেয়ার অধিকারও প্রত্যেকের রয়েছে। কারণ এ উভয় ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ শ্রম জড়িয়ে আছে। এ প্রত্যক্ষ শ্রমের প্রত্যক্ষ সুবিধা নিকটতম স্তর থেকে একবারই পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এ একটি নির্দিষ্ট পয়েন্ট ভ্যালুর পণ্য কিনে দালালীর অধিকার অর্জন করা যা বাস্তবায়ন করতে প্রত্যক্ষ শ্রম দিয়ে নতুন ক্রেতা সংগ্রহ করতে হয়। যে যত বেশি ক্রেতা সংগ্রহ করতে পারে সে ততজনের কমিশন লাভ করার অধিকার রাখে। কিন্তু কোনো ক্রমেই আপলেভেলের প্রত্যক্ষ শ্রম স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে সুদূর-বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে না। অথচ মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এ তা-ই ঘটে।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট যে, প্রত্যেক ব্যক্তির আয় ও দায় (income and liability) সবসময় ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ। তবে এ স্বাভাবিক নীতির ব্যতিক্রম যে সকল বৈধতা শরী‘আতে পাওয়া যায় তা শরী‘আতের বিধান হিসেবে সমালোচনার উর্ধ্বে। যেমন ধনীর সম্পদে অভাবী মানুষের অধিকার, সদকায়ে জারিয়ার সাওয়াব, গোনাহে জারিয়া ইত্যাদি। এগুলো শরী‘আত প্রণেতা কর্তৃক গৃহীত। কাজেই তা স্বাভাবিক নিয়ম বহির্ভূত।
পদ্ধতিগত দিক : মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এর তাত্ত্বিক ভিত্তি (Theoretical Basis)-এর সাথে ইসলামের প্রতিষ্ঠিত শ্রমনীতি ও মানবীয় বুদ্ধি বিবেচনার সাংঘর্ষিক দিকটি আলোচনা করার পর এবার আমরা এর কিছু পদ্ধতিগত সংঘাত নিয়ে আলোচনা করব ইনশা আল্লাহ্।
(চলবে)