লগইন রেজিস্ট্রেশন

পুনরূত্থান বা পরকাল পরিচিতি

লিখেছেন: ' sayedalihasan' @ মঙ্গলবার, নভেম্বর ৮, ২০১১ (২:০৫ অপরাহ্ণ)

মানুষ দেহ ও আত্মার সমষ্টিইসলাম সম্পর্কে মোটামুটি যাদের জানা আছে, তারা নিশ্চয়ই জানেন যে, পবিত্র কুরআন বা হাদীসে প্রায়ই মানুষের দেহ ও আত্মা প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। সবাই জানেন যে, পঞ্চেন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভবযোগ্য এই দেহ সম্পর্কে ধারণা করা আত্মার তুলনায় অনেক সহজ। আর আত্মা সম্পর্কে ধারণা অর্জন যথেষ্ট জটিল ও দুর্বোধ্য। শীয়া ও সুন্নি, উভয় সমপ্র দায়ের কালাম (মৌলিক বিশ্বাস শাস্ত্র) শাস্ত্রবিদ এবং দার্শনিকদের মধ্যে আত্মা সম্পর্কিত মতামতের ক্ষেত্রে যথেষ্ট মতভেদ বিরাজমান। তবে এটা একটা সর্বজন স্বীকৃত বিষয় যে, ইসলামের দৃষ্টিতে দেহ ও আত্মা দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির অস্থিত্ব। মৃত্যুর মাধ্যমে মানবদেহ তার জীবনীশক্তি হারায় এবং ধীরে ধীরে তা ধ্বংসপ্রাপ্ত ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কিন্তু আত্মার বিষয়টি মোটেও এমন নয়। বরং জীবনীশক্তি মূলতঃ আত্মা থেকেই উৎসরিত। যতক্ষণ পর্যন্ত আত্মা দেহের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকবে, দেহও ততক্ষণ ঐ আত্মা থেকে সঞ্জীবনীশক্তি লাভ করবে। যখনই আত্মা ঐ দেহ থেকে পৃথক হবে এবং (মৃত্যুর মাধ্যমে) দেহের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করবে, তখনই দেহ নিজীব হয়ে পড়বে। তবে আত্মা তার জীবনীশক্তি নিয়ে আপন জীবনকাল অব্যাহত রাখে। পবিত্র কুরআন এবং ইমামগণের (আ.) হাদীস সমূহের মাধ্যমে যা আমরা বুঝতে পারি, তা হল, আত্মা মহান আল্লাহ্‌র এক অসাধারণ ও অভিনব সৃষ্টি। তবে আত্মা ও দেহের অস্থিত্বের মধ্যে এক ধরণের সংগতি ও ঐক্য বিদ্যমান। মহান আল্লাহ্‌ পবিত্র কুরআনে বলেছেন ঃ “আমরা মানুষকে মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি করেছি অতঃপর আমরা তাকে শুক্র বিন্দুরূপে এক সংরক্ষিত আধারে স্থাপন করেছি। এরপর আমরা শুক্রবিন্দুকে জমাটবাধাঁ রক্তে পরিনত করেছি। অতঃপর জমাট বাধাঁ রক্তকে মাংসপিন্ডে পরিণত করেছি। এরপর সেই মাংসপিন্ড থেকে অস্তিত্ব সৃষ্টি করেছি, অতঃপর অস্তিত্বকে মাংস দ্বারা আবৃত করেছি, অবশেষে তাকে এক নতুন রূপে দাঁড় করিয়েছি।” (সুরা আল্‌মু’মিনীন, ১২-১৪ নং আয়াত।)উপরোলি−খিত আয়াত থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয় যে, উক্ত আয়াতের প্রথম অংশে সৃষ্টির জড়গত ক্রমবির্বতন সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে। আর উক্ত আয়াতের শেষাংশে আত্মা, অনুভূতি এবং ইচ্ছাশক্তির সৃষ্টির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এভাবে উক্ত আয়াতের শেষাংশে দ্বিতীয় প্রকৃতির সৃষ্টির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যা প্রথম প্রকৃতির সৃষ্টির চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। পবিত্র কুরআনের অন্যত্র মানুষের পুনরূত্থানের বিষয় অস্বীকারকারীদের প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়েছে। তাদের প্রশ্ন ছিল, মৃত্যুর পর মানুষের দেহ যখন ধ্বংস প্রাপ্ত হয় এবং পুনরায় তাকে প্রথম অবস্থার ন্যায় সৃষ্টি করা সম্ভব? এর উত্তরে মহান আল্লাহ্‌‌ বলেছেন ঃ “তারা বলে, আমরা মৃত্তিকায় মিশ্রিত হয়ে গেলেও পুনরায় নতুন করে সৃজিত হব কি? বরং তারা তাদের পালনকর্তার সাক্ষাতকে অস্বীকার করে। বলুন, তোমাদের প্রাণহরণের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেস্তা তোমাদের প্রাণহরণ করবে। অতঃপর তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কাছে প্রত্যার্বতিত হবে।” (-সুরা আস্‌ সিজদাহ্‌, ১০-১১ নং আয়াত।)এ ছাড়া পবিত্র কুরআনে আরও বিস্তারিতভাবে আত্মা সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে আত্মাকে এক অজড় অস্থিত্ব হিসেবে পরিচয় করানো হয়েছে। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ্‌‌ বলেছেন ঃ “(হে রাসুল সঃ) তোমাকে তারা আত্মার (রূহ্‌) রহস্য সম্পর্কে প্রশ্ন করে থাকে। বলে দাও; আত্মা সে আমার প্রতিপালকের আদেশঘটিত।” (-সুরা আল্‌ ইস্‌রা, ৮৫ নং আয়াত।)এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছেঃ “তিনি যখন কোন কিছু করতে ইচ্ছে করেন, তখন তাকে কেবল বলে দেন, হও তখনই তা হয়ে যায়।” (-সুরা আল্‌ ইয়াসিন, ৮৩ নং আয়াত।)উপরোক্ত আয়াত থেকে এটাই প্রতীয়মাণ হয় যে, কোন কিছু সৃষ্টির ব্যাপারে মহান আল্লাহ্‌র আদেশের বাস্তবায়ন কোন ক্রমধারা বা পর্যায়ক্রমের নীতি অনুসরণ করে না। তাঁর আদেশ বাস্তবায়ন কোন স্থান বা কালের করতলগত নয়। সুতরাং আত্মা যেহেতু মহান আল্লাহ্‌র আদেশ বৈ অন্য কিছু নয়, তাই তা অবশ্যই কোন জড়বস্তু নয়। অতএব যার অস্থিত্বের মাঝে ক্রমধারা, স্থান ও কালের ন্যায় জড় বস্তুবাচক কোন গুণাবলীরই উপস্থিতি নেই। আত্মার রহস্য সম্পর্কে অন্য একটি আলোচনা আত্মার রহস্য সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গী বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধানের মাধ্যমেও সমর্থিত হয়। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই তার নিজের মধ্যে এক সত্তার অস্থিত্ব উপলব্ধি করে, যাকে সে ‘আমি’ বলে আখ্যায়িত করে। মানুষের এ উপলব্ধি চিরদিনের। এমনকি মানুষ মাঝে মাঝে তার নিজের হাত, পা, মাথাসহ দেহের সকল অঙ্গকে ভুলে গেলেও যতক্ষণ সে বেঁচে আছে, তার ঐ আত্মোপলব্ধি (আমি) সে কখনই ভুলে যায় না। যেমনটি সর্বত্র পরিদৃষ্ট হয়, এই সত্তার (আমি) অস্থিত্ব কখনই বিভাজ্য নয়। মানুষের দেহ প্রতিনিয়তই পরিবর্তনশীল। মানবদেহ সর্বদাই একটি সুনির্দিষ্ট স্থান অধিকার করে এবং সময়ের অগণিত মূহুর্তের স্রোত সর্বদাই তার উপর দিয়ে প্রবাহমাণ। কিন্তু ঐ মূল সত্তার অস্থিত্ব সর্বদাই স্থির। কোন পরির্বতনশীলতাই তার অস্থিত্বকে কখনোই স্পর্শ করে না। এতে এটাই প্রতীয়মণ হয় যে, ঐ সত্তার অস্থিত্ব (আমি বা আত্মা) অবশ্যই জড় অস্থিত্ব নয়। তা না হলে অবশ্যই তা স্থান, কাল, বিভাজন ও পরিবর্তনশীলতার মত জড়বস্তুর গুণবাচক বৈশিষ্ট্য সমূহও তাতে পাওয়া যেত। হ্যাঁ, আমাদের সবার দেহই জড়বস্তুর গুণবাচক ঐসব বৈশিষ্ট্যে পরিপূর্ণ। আর আত্মার সাথে দেহের ওতপ্রোত সম্পর্কের কারণে, ঐসব দৈহিক বৈশিষ্ট্য সমূহকে আত্মার প্রতিও আরোপ করা হয়। কিন্তু সামান্য একটু মনোযোগের সাথে লক্ষ্য করলেই এ ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, এখন ও তখন (সময়), এখানে ও সেখানে (স্থান), এরকম ও সেরকম (আকৃতি ও আয়তন) এবং এদিক ও সেদিক (দিক) এসবই আমাদের এ জড় দেহেরই বৈশিষ্ট্য। কিন্তু আত্মা ঐ সকল জড়বাচক বৈশিষ্ট্য থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। দেহের মাধ্যমেই ঐসব বৈশিষ্ট্য তাকে স্পর্শ করে। ঠিক একই কথা আত্মার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যেমন ঃ অনুভূতি ও উপলব্ধি (জ্ঞান) একমাত্র আত্মারই বৈশিষ্ট্য। সুতরাং এটা চিরসত্য যে, জ্ঞান যদি জড়বস্তু হত, তাহলে স্থান ও কাল বিভাজনের ন্যায় জড়বাচক গুণাবলীও তার ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রযোজ্য হত। অবশ্য উক্ত বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়টি একটি ব্যাপক আলোচনা ও অসংখ্য প্রশ্ন ও উত্তরের সূত্রপাত ঘটাতে বাধ্য। তাই এই বইয়ের এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে তার অবতারণা না করাই যুক্তিযুক্ত বলে মনে করছি। এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জ্ঞান আহরণে আগ্রহীদেরকে ইসলামী দর্শনের বইগুলো পড়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।ইসলামের দৃষ্টিতে মৃত্যু বাহ্যিক এবং সংর্কীণ দৃষ্টিতে মৃত্যু মানুষের ধ্বংসেরই নামান্তর। কারণ, জন্ম ও মৃত্যুর মাঝেই মানুষের জীবনকে সীমাবদ্ধ বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু ইসলাম মৃত্যুকে মানবজীবনের একটি পর্যায় থেকে অন্য একটি পর্যায়ে স্থানান্তর বলে আখ্যায়িত করে। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ এক অনন্ত জীবনের অধিকারী, যার কোন শেষ নেই। মৃত্যু মানুষের আত্মাকে তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে জীবনের অন্য একটি স্তরে স্থানান্তরিত করে। মৃত্যু পরবর্তী এ জীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতা মানুষের মৃত্যুপূর্ব জীবনের সৎকাজ ও অসৎকাজের উপরই নির্ভরশীল। মহানবী (সা.) এ ব্যাপার বলেছেনঃ “কখনেই মনে কর না যে, মৃত্যুর মাধ্যমে ধ্বংস হয়ে যাবে। বরং, মৃত্যুর মাধ্যমে তোমরা এক বাড়ী থেকে অন্য বাড়ীতে স্থানান্তরিত হবে মাত্র।” [বিহারূল আনোয়ার, ৩য় খন্ড, ১৬১ নং পৃষ্ঠা।] বারযাখ্‌ (কবরের জীবন) পবিত্র কুরআন ও সুন্নাতের বর্ণনা অনুযায়ী মৃত্যু থেকে নিয়ে কেয়ামত বা পুনরূত্থান দিবসের পূর্ব পর্যন্ত মানুষের একটি সীমিত ও অস্থায়ী জীবন রয়েছে। কেয়ামত বা পরকাল ও পার্থিব জীবনের মাঝামাঝি মানুষের মৃত্যু পরবর্তী এই জীবনের নামই ‘বারযাখ’ বা কবরের জীবন। [বিহারূল আনোয়ার, ২য় খন্ড, বারযাখ অধ্যায়।] পৃথিবীর জীবনে মানুষ তার বিশ্বাস অনুযায়ী যে সব ভাল বা খারাপ কাজ করেছে, মৃত্যু পরবর্তী ঐ ‘বারযাখ’ জীবনে ঐ সব ভাল বা খারাপ কাজের জন্যে প্রতিটি মানুষকেই ব্যক্তিগত ভাবে জবাবদিহি করতে হবে। অতঃপর ঐ জবাবদিহির ভিত্তিতে মোটামুটি একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। আর ঐ সিদ্ধানে-র ভিত্তিতেই মানুষ পরকালে এক সুখময় ও মধুর জীবন অথবা এক অশানি-পূর্ণ ও তিক্ত জীবন যাপনের অধিকারী হবে। আর ঐ ধরণের জীবনযাপন শুরুর মাধ্যমেই মানুষ কেয়ামত বা পুনরূত্থানের জন্যে প্রতীক্ষমান থাকবে। [বিহারূল আনোয়ার, ২য় খন্ড, বারযাখ অধ্যায়।] মানুষের এই বারযাখের (কবরের) জীবন অনেকটা বিচারকার্য শুরু হওয়ার পূর্বে আদালত কক্ষে অপেক্ষামান আসামী বা ফরিয়াদীর মত। বিচারকার্য শুরুর পূর্বে তার প্রস্তুতি পর্ব সম্পনেড়ব র জন্যে আসামী বা ফরিয়াদী সাধারণতঃ প্রয়োজনীয় নথিপত্র পূর্ণ করা ও তল্লাসী সম্পন্ন করা সহ প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। এরপর সে আদালত কক্ষে গ্রেপ্তার অবস্থায় বিচারকার্য শুরু হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। মানুষ এ পৃথিবীতে বসবাসকালীন সময়ে যেভাবে জীবনযাপন করেছে, মৃত্যুর পর বারযাখ বা কবরের জীবনে তার আত্মাও ঠিক সেভাবেই জীবনযাপন করবে। যদি সে পার্থিব জীবনে সৎলোক হয়ে থাকে, তাহলে বারযাখের জীবনেও সে সৌভাগ্য, ও প্রাচুর্য্যের অধিকারী হবে এবং আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভকারী সৎলোকদের নৈকট্য লাভ করবে। আর যদি সে অসৎ ব্যক্তি হয়ে থাকে তাহলে, বারযাখের জীবনেও সে কষ্ট ও শাস্থির অধিকারী হবে এবং দুষ্টও পথভ্রষ্ট অসৎ লোকদের সংসর্গ লাভ করবে। মহান আল্লাহ্‌‌ মৃত্যু পরবর্তী সৌভাগ্যবান লোকদের অবস্থার ব্যাপারে বলেছেন ঃ “আর যারা আল্লাহ্‌র পথে নিহত হয়, তাদেরকে তুমি কখনো মৃত মনে করো না। বরং তারা তাদের নিজদের পালনকর্তার নিকট জীবিত ও জীবিকা প্রাপ্ত। আল্লাহ্‌‌ নিজের অনুগ্রহ থেকে যা দান করেছেন তার প্রেক্ষিতে তারা আনন্দ উদ্‌যাপন করছে। আর যারা এখনো তাদের কাছে এসে পৌঁছেনি তাদের পেছনে তাদের জন্যে আনন্দ প্রকাশ করে। কারণ, তাদের কোন ভয়-ভীতিও নেই এবং কোন চিন্তা ভাবনাও নেই। আল্লাহ্‌র নেয়ামত ও অনুগ্রহের জন্যে তারা আনন্দ প্রকাশ করে এবং তা এভাবে যে, আল্লাহ্‌‌ ঈমানদারদের শ্রমফল বিনষ্ট করেন না।” (-সুরা আল ইমরান, ১৬৯-১৭১ নং আয়াত।) মহান আল্লাহ্‌‌ পবিত্র কুরআনে মৃত্যু পরবর্তী র্দূভাগা লোকদের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন ঃ “যখন তাদের কারও কাছে মৃত্যু আসে, তখন সে বলে ঃ হে আমার পালনকর্তা! আমাকে পুনরায় (দুনিয়াতে) প্রেরণ করুন, যাতে আমি সৎকর্ম করতে পারি, যা আমি (পূর্বে) করিনি।” (-সুরা আল মু’মিনুন, ৯৯-১০০ নং আয়াত।) পুনরূত্থান দিবস পৃথিবীতে ঐশী গ্রন্থগুলোর মধ্যে একমাত্র পবিত্র কুরআনেই কেয়ামত বা পুনরূত্থান দিবস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এমন কি ঐশীগ্রন্থ ‘তাওরাতে’ কেয়ামতের নামটি পর্যন্ত উলেখিত হয়নি। আর ‘ইঞ্জিল’ গ্রনে’ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত আকারে কেয়ামতের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে মাত্র। পবিত্র কুরআনে শতাধিক স্থানে বিভিন্ন প্রসংগে এবং বিভিন্ন নামে কেয়ামত বা পুনরূত্থান দিবসের কথা উল্লেখিত হয়েছে। এ বিশ্বজগত ও তার অধিবাসীদের অবস্থা কেয়ামতের দিন কেমন হবে, তা কখনও বা সংক্ষেপে আবার কখনও বা বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। পবিত্র কুরআনে অসংখ্যবার স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, মহান আল্লাহ্‌‌র প্রতি ঈমান আনয়নের পাশাপাশি প্রতিদান (কেয়ামত) দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করাও আমাদের অবশ্য কর্তব্য। কারণ; প্রতিদান (কেয়ামত) দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ইসলামের তিনটি (আল্লাহ্‌র একত্ববাদ, নবুয়ত ও কেয়ামত) মূলনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ বিশেষ। সুতরাং, প্রতিদান দিবসের অস্বীকারকারী প্রকৃতপক্ষে ইসলামী আর্দশ থেকে বিচ্যুত। আর প্রতিদান দিবসে অবিশ্বাসী ব্যক্তির পরিণতি হচ্ছে নিশ্চিত ধ্বংস, এটা নিশ্চিত সত্য। কারণ; মহান আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে মানব জীবনের কৃতকর্মের কোন হিসাব নিকাশ এবং শাস্তি বা পুরুস্কারের কোন ব্যবস্থাই যদি না থাকে, তাহলে আল্লাহ্‌র দ্বীন বা ধর্ম প্রচার নিষ্ফল হয়ে পড়বে। কেননা, আদেশ নিষেধ সম্বলিত নির্দেশ সমূহের সমষ্টির নামই তো ‘দ্বীন’। ঐ অবস্থায় নবীদের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি এবং ‘দ্বীন’ প্রচার উভয়ের ফলাফলই হবে এক। বরং, এমতাবস্থায় নবী ও ‘দ্বীন’ প্রচারের অনুপস্থিতি তার অস্থিত্বের উপর অগ্রাধিকার পাবে। কারণ; ঐ অবস্থায় ‘দ্বীন’ গ্রহণ করা ও শরীয়তের আইন-কানুন মেনে চলার মাধ্যমে নিজেকে কষ্ট দেয়া এবং আত্মস্বাধীনতা বির্সজন দেয়ারই নামান্তর হবে। দ্বীনের অনুসরণের মধ্যে যদি কোন সুফলই লাভ না হয়, তাহলে জনগণ কখনেই দ্বীনের অধীনতা স্বীকার করবে না। আর প্রাকৃতিক স্বাধীনতা ভোগ থেকেও কখনোই তারা বিরত হবে না। এ থেকেই স্পষ্ট প্রতীয়মাণ হয় যে, প্রতিদান বা কেয়ামতের দিনকে স্মরণ করানোর গুরুত্ব প্রকৃতপক্ষে দ্বীন প্রচারের গুরুত্বেরই সমান। আর এ থেকে এটাও প্রমাণিত হয় যে, প্রতিদান বা কেয়ামত দিনের প্রতি বিশ্বাসই মানুষকে ‘তাকওয়া’ (খোদাভীতি) অবলম্বন, অসচ্চরিত্র থেকে বেঁচে থাকা এবং বড় ধরণের পাপকাজ থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে। একই ভাবে কেয়ামতের বিষয়টি ভুলে যাওয়া বা ঐ দিনের প্রতি অবিশ্বাসই মানুষের যে কোন ধরণের পাপকাজে লিপ্ত হওয়ার মূল কারণ। মহান আল্লাহ্‌‌ বলেছেন ঃ “নিশ্চয় যারা আল্লাহ্‌র পথ থেকে বিচ্যুত হয়, তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি, এ কারণে যে তারা হিসাব দিবসকে ভুলে গিয়েছিল।” (সুরা আস্‌ সোয়াদ, ২৬ নং আয়াত।)উপরোক্ত আয়াতে কেয়ামতের বিষয়টি ভুলে যাওয়াকেই মানুষের সবধরণের পথ ভ্রষ্টতার উৎস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সমগ্র সৃষ্টিজগতের সৃষ্টি এবং ঐশী আইনমালার মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কে সুগভীরভাবে পর্যালোচনা করলেই এই প্রতিদান (কেয়ামত) দিবসের অপরিহার্যতা আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এমনকি আমরা এ সৃষ্টিজগতের সচরাচর সংঘটিত কার্য কলাপকে যদি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করি, তাহলে দেখতে পাব যে, সুনির্দিষ্ট কোন উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য ছাড়া কোন কাজই সস্পন্ন হয় না। কখনও কোন বস্তুর জন্যে তারই স্বয়ংক্রিয় গতি স্বকীয়ভাবে অথবা সত্তাগতভাবে তারই কাঙ্খিত বিষয় বা লক্ষ্যবস্তু হতে পারে না। বরং বিশেষ কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিদিষ্ট কোন কাজ সাধিত হওয়ার ব্যাপারে তার পটভূমি রচনা করে। অতঃপর তা কাঙ্খিত কাজে পরিণত ও সাধিত হয়। এমনকি আপাত দৃষ্টিতে অনেক কাজকেই আমাদের কাছে উদ্দেশ্যবিহীন বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা উদ্দেশ্যবিহীন নয়। যেমনঃ শিশু সুলভ খেলা-ধুলা ইত্যাদি। যদি আমরা অত্যন্ত সূক্ষ্ম ভাবে এ ধরণের কাজকর্ম পযর্বেক্ষণ করি, তাহলে দেখতে পাব যে, বাহ্যতঃ লক্ষ্যহীন ঐসব কাজের পিছনেও তার উপযোগী উদ্দেশ্য ক্রিয়াশীল রয়েছে। এভাবে প্রকৃতিতে যত কাজই সম্পন্ন হয়, সবই কোন না কোন উদ্দেশ্য সম্বলিত। তেমনি শিশু সুলভ খেলা ধুলার উদ্দেশ্যও এক ধরণের নিছক কল্পনা প্রসূত আনন্দ উপভোগ, যা ঐ শিশুর জন্যেই উপযোগী, ঐ লক্ষ্যে পৌঁছাই তার খেলার উদ্দেশ্য। অবশ্য এ বিশ্বজগত ও মানুষ সৃষ্টি আল্লাহ্‌রই কাজ। আর মহান আল্লাহ্‌র অবশ্যই যেকোন অর্থহীন বা উদ্দেশ্যহীন কাজ সম্পাদনের মত বৈশিষ্ট্য থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। মহান আল্লাহ্‌‌ একের পর এক সৃষ্টিই করে চলেছেন, তাদের জীবিকা দান করেছেন। অতঃপর তাদের মৃত্যু দিচ্ছেন। আবার নতুন করে সৃষ্টি করছেন। আবার তাদের জীবিকা দিচ্ছেন, মৃত্যু দিচ্ছেন। এভাবে সর্বক্ষণ সৃষ্টি করছেন আর ধ্বংস করছেন। এটা আদৌ কল্পনা যোগ্য নয় যে, এ ধরণের সৃষ্টি ও ধ্বংসের পেছনে আল্লাহ্‌র নিদিষ্ট কোন লক্ষ্য নেই। অতএব এ বিশ্বজগত ও মানুষের সৃষ্টির পেছনে সুনির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের অস্থিত্বের ধারণা একটি অপরিহার্য বিষয়। অবশ্য এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, এ সৃষ্টিকার্যের মাঝে নিহিত লাভ, নিঃসন্দেহে অভাবমুক্ত আল্লাহ্‌র দিকে প্রত্যাবর্তন করবে না। এ সৃষ্টি রহস্যের মাঝে লুকায়িত লাভ দ্বারা একমাত্র সৃষ্টিনিচয়ই লাভবান হবে। সুতরাং , বলা যায় যে, এ বিশ্বজগত ও মানুষ এক সুনির্দিষ্ট ও শ্রেষ্ঠতর অস্থিত্ব লাভের প্রতি ধাবমান, যা অবিনশ্বর ও অনন্ত। আমরা যদি দ্বীনি শিক্ষার দৃষ্টিকোন থেকে সূক্ষ্ম ভাবে জনগণের আস্থা পর্যবেক্ষণ করি, তাহলে দেখতে পাব যে, খোদায়ী নির্দেশনা ও দ্বীনি প্রশিক্ষণের প্রভাবে মানুষ সৎ ও অসৎ দু’দলে বিভক্ত। অথচ পাথির্ব জীবনে এ দু’দলের মাঝে বিশেষ কোন পার্থক্যই পরিলক্ষিত হয় না। শুধু তাই নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পাই যে পৃথিবীর অত্যাচারী ও অসৎ লোকরাই সকল উন্নতি ও সাফল্যের ধারক-বাহক আর সর্ব সাধারণের বঞ্চনা, কষ্টভোগ দূর্দশা ও অসহায়ত্বের কারণ। অথচ পৃথিবীর সৎ লোকেরাই সাধারণত সব ধরণের কষ্টভোগ, বাঞ্চনা, দূর্দশা ও অত্যাচারের শিকার হয়। এমতাবস্থায় ঐশী ন্যায়বিচারের দৃষ্টিতে এমন একটি জগত ও জীবনের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন, যেখানে উপরোক্ত দু’দলের লোকেরাই তাদের স্ব-স্ব কার্য কলাপের উপযুক্ত প্রতিদান পাবে। আর সবাই তাদের নিজ নিজ কর্মফল অনুযায়ী সেখানে উপযুক্ত জীবন যাপন করবে। মহান আল্লাহ্‌‌ তাই পবিত্র কুরআনে বলেছেন ঃ “আমরা নভো-মন্ডল, ভূ-মন্ডল ও এতদভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। আমরা এগুলো যথাযথ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছি। কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা বোঝে না।” (-সুরা আদ্‌ দুক্ষান, ৩৮-৩৯ নং আয়াত।)মহান আল্লাহ্‌‌ অন্যত্র বলেছেন যে ঃ “যারা দুষ্কর্ম উপার্জন করেছে তারা কি মনে করে যে, আমি তাদের সে লোকদের মত করে দেব, যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তাদের জীবন ও মৃত্যু কি সমান হবে? তাদের দাবী কত মন্দ! আল্লাহ্‌ নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডল যথাযথভাবে সৃষ্টি করেছেন। যাতে প্রত্যেক ব্যক্তি তার উপার্জনের ফল পায়। তাদের প্রতি যুলুম করা হবে না।” (-সুরা আল্‌ জাসিয়াহ্‌, ২১-২২ নং আয়াত।) অন্য একটি ব্যাখ্যাপবিত্র কুরআনের বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ দিকের আলোচনায় ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, পবিত্র কুরআনে ইসলামী জ্ঞান বিভিন্ন পন্থায় আলোচিত হয়েছে। আর ঐসকল পন্থা বাহ্যিক (জাহের) ও আভ্যন্তরীণ বা গোপন (বাতেন) দিক নামে দু’ভাগে বিভক্ত। কুরআনের বাহ্যিক বর্ণনা পদ্ধতি গণমানুষের সাধারণ মেধাশক্তির স্তরের উপযোগী। কিন্তু কুরআনের আধ্যাত্মিক বা বাতেনী বর্ণনা পদ্ধতি প্রথম পদ্ধতির সম্পূর্ণ বিপরীত। এই পদ্ধতি গণমুখী নয়। বরং বিশেষ এক শ্রেণীর জন্যে এই পদ্ধতি নির্ধারিত। শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক জীবনের অধিকারীগণ তাদের পরিশুদ্ধ আত্মার মাধ্যমেই উক্ত পদ্ধতি উপলব্ধি করতে সর্মথ। কুরআনের বাহ্যিক বর্ণনা পদ্ধতিতে মহান আল্লাহ্‌‌কে সমগ্র সৃষ্টিজগতের নিরংকুশ অধিপতি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সমগ্র বিশ্ব জগতে তিনিই একমাত্র সত্ত্বাধিকারী। মহান আল্লাহ্‌‌ তার আদেশ সমূহ বাস্তবায়নের জন্যে অসংখ্য ফেরেস্তা সৃষ্টি করেছেন। তারা এ বিশ্ব জগতের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। সৃষ্টিজগতের প্রতিটি জিনিসের জন্যেই দায়িত্বশীল বিশেষ একদল ফেরেস্তা নিযুক্ত রয়েছে। তারা তাদের ঐ নির্দিষ্ট বিভাগের দায়িত্বশীল প্রতিনিধি স্বরূপ। মানুষ আল্লাহ্‌রই সৃষ্টি এবং তারই দাস স্বরূপ। আল্লাহর সকল আদেশ-নিষেধ মেনে চলা তার একান্ত কর্তব্য। নবীগণ আল্লাহ্‌র বাণীবাহক এবং তার পক্ষ থেকে শরীয়ত বা ঐশী আইন আনয়নকারী। তারা আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে মানব জাতির জন্যে এ পৃথিবীতে প্রেরিত হয়েছেন। মহান আল্লাহ্‌ তার প্রতি ঈমান বা বিশ্বাস স্থাপনকারী ও তার অনুগত লোকদের জন্যে পূর্ণ পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর তাকে অস্বীকারকারী পাপীদের জন্যে চরম শাস্তির হুমকি দিয়েছেন। তিনি যা কিছু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার খেলাপ তিনি কখনেই করবেন না। মহান আল্লাহ্‌ ন্যায়বিচারক। তাই ন্যায়বিচারের দাবী হচ্ছে, এ জাগতিক জীবনে সৎলোক বা অসৎ লোক তাদের কর্মের উপযুক্ত প্রতিদান না পাওয়ার কারণে এমন একটি জীবনের অবতারণা প্রয়োজন, যেখানে সৎলোক ও অসৎলোক উভয়েই তাদের কাজের উপযুক্ত প্রতিদান ভোগ করবে।মহান আল্লাহ্‌ তার ন্যায়বিচারের প্রমাণ স্বরূপ এ পৃথিবীর সকল মানুষকে মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত করবেন। অতঃপর প্রতিটি মানুষের মৌলিক বিশ্বাস ও তার কার্য কর্মের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হিসাব-নিকাশ করবেন। তিনি সত্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে মানুষের কৃতকর্মের বিচার করবেন। আর সে অনুযায়ী সবার প্রাপ্য অধিকার তিনি আদায় এবং অত্যাচারীর হাত থেকে অত্যাচারীতের হৃত অধিকার পুনরূদ্ধার করবেন। প্রতিটি ব্যক্তিই তাদের কৃতকর্মের উপযুক্ত প্রতিদান পাবে। মানুষ তার কৃতকর্ম অনুসারে কেউ অনন্ত কালের জন্যে বেহেশতে প্রবেশ করবে,আবার কেউ বা চিরদিনের জন্যে দোযখের আগুনে প্রবেশ করবে। এটাই পবিত্র কুরআনের বাহ্যিক বর্ণনা। আর এটাই সত্য ও সঠিক। এ বিষয়টি মানুষের জন্যে সহজ ও বোধগম্য ভাষায় রচিত, যাতে এ থেকে সাধারণ গণমানুষ ব্যাপকভাবে উপকৃত হতে পারে। অপরদিকে যারা পবিত্র কুরআনে লুকায়িত নিগূঢ় অর্থ ও তার রহস্যময় আধ্যাত্মিক ভাষা সম্পর্কে অবহিত, তারা গণমানুষের দ্বারা লব্ধ সাধারণ অর্থের চেয়ে অনেক উচ্চস্তরের জ্ঞান কুরআন থেকে আহরণ করে থাকেন। পবিত্র কুরআনও তার সহজ সাধারণ বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে প্রায়ই ঐ বর্ণনায় লুকায়িত গূঢ় অর্থের প্রতি ইঙ্গিত করে থাকে। পবিত্র কুরআন অসংখ্য ইঙ্গিতের মাধ্যমে মোটামুটি ভাবে এটাই বুঝাতে চায় যে, মানুষ সহ এ সৃষ্টিজগতের সকল অংশই তার নিজস্ব প্রাকৃতিক গতির (যা অবিরাম গতিতে পূর্ণত্ব আহরণের পথে ধাবমান) মাধ্যমে ক্রমাগতভাবে মহান আল্লাহ্‌র দিকে ধাবমান। এভাবে চলতে চলতে একদিন অবশ্যই তার গতি পরিক্রমা থেমে যাবে। এ সৃষ্টিনিচয় সেদিন সর্বস্রষ্টা আল্লাহ্‌র অসীম মহত্বের সম্মুখে নিজের সকল আমিত্ব ও সার্বভৌমত্ব হারিয়ে ফেলবে। মানুষও সৃষ্টিজগতের একটি অংশ বিশেষ। মানুষের জন্যে নির্ধারিত পূর্ণত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব জ্ঞান ও উপলব্ধি ক্ষমতা বিকাশের মাধ্যমে অর্জিত হয়। আর এ পথেই বিকশিত হওয়ার মাধ্যমে প্রতিনিয়তই তার গতি মহান প্রভু আল্লাহ্‌র প্রতি ধাবমান। মানুষের এ গতি যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে শেষ হবে, তখনই মানুষ প্রকৃত সত্যে উপনীত হবে এবং আল্লাহ্‌র একত্ব ও মহত্বকে চাক্ষুষভাবে অবলোকন করবে। তখন সে চাক্ষুষভাবে উপলব্ধি করবে যে, শক্তি ও মালিকানা সহ শ্রেষ্ঠত্বের সকল গুণাবলীই একমাত্র মহান আল্লাহ্‌র পবিত্র সত্তার জন্যে নির্ধারিত। আর তখনই এ জগতের সকল বস্তু ও বিষয়ের প্রকৃত রহস্য ও স্বরূপ তার কাছে উদঘটিত হবে। এটাই অনন্ত ও অসীম জগতে প্রবেশের সর্বপ্রথম তোরণ। মানুষ যদি তার ঈমান ও সৎকাজের মাধ্যমে ঐ ঐশী জগতের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে এবং আল্লাহ্‌‌ ও তার নৈকট্য প্রাপ্তদের সাথে আত্মিক বন্ধন ও যোগাযোগকে সুদৃঢ় করতে পারে, তাহলেই মহান আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভ করতে পারবে। যার ফলে সে আল্লাহ্‌‌ ও পবিত্র আত্মাদের সান্নিধ্যে স্বর্গীয় জীবন যাপন করার সৌভাগ্যলাভ করবে। এটা এমন এক সৌভাগ্য যাকে পৃথিবীর কোন বিশেষণে বিশেষিত করা অসম্ভব। কিন্তু মানুষ যদি তার হৃদয় থেকে এ নশ্বর জগতের মায়া কাটাতে সক্ষম না হয়, যার ফলে আল্লাহ্‌‌, পবিত্র আত্মাগণ ও স্বর্গীয় জগতের সাথে তার ঐশী সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে অবশ্য তাকে চিরদিনের জন্যে সুকঠিন ও কষ্টময় শাস্তির শিকার হতে হবে। যদিও এ কথা সত্য যে, জাগতিক জীবনে মানষের কৃত সৎ বা অসৎ কাজ দু’টোই এক সময় বাহ্যত নশ্বর হয়ে যায়। কন্তু মানুষের কৃত সৎ বা অসৎ কাজের প্রতিচ্ছবি তার আত্মায় চিরদিনের জন্যে সঞ্চিত হয়ে থাকে, যা কখনোই মুছে ফেলা যায় না। যেখানেই সে যাক না কেন, তার কৃতকর্মের ঐ স্মৃতি তার সাথে থাকবেই। মানব জীবনের কৃত ঐসব সৎ বা অসৎ কাজই পরকালে তার অনন্ত সুখী জীবন অথবা কষ্টময় জীবনের একমাত্র পুজিঁ স্বরূপ। উপরোক্ত বিষয়টি পবিত্র কুরআনের নিম্নোলি−খিত আয়াত সমূহে আলোচিত হয়েছে। মহান আল্লাহ্‌‌ বলেছেন ঃ “নিশ্চয়ই আপনার পালনকর্তার দিকেই প্রত্যাবর্তন হবে।” (-সুরা আল আলাক, ৮ নং আয়াত।)মহান আল্লাহ্‌‌ বলেছেন ঃ “জেনে রাখ! সমস্ত বিষয় আল্লাহ্‌র দিকেই প্রত্যার্বতন করনে।” (-সুরা আশ্‌ শুরা, ৫৩ নং আয়াত।)মহান আল্লাহ্‌‌ বলেছেন ঃ “সেদিন কেউ কারো কোন উপকার করতে পারবে না এবং সেদিন সব কর্তৃত্ব আল্লাহ্‌রই।” (-সুরা আল ইনফিত্‌ার, ১৯ নং আয়াত।)মহান আল্লাহ্‌‌ বলেছেন ঃ “হে বিশ্বস্ত আত্মা, তুমি তোমার পালনকর্তার দিকে প্রত্যাবর্তন কর সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন অবস্থায়। অতঃপর আমার উপাসনায় মনোনিবেশ কর এবং আমারই জান্নাতে প্রবেশ কর।” (-সুরা আল ফাজ্‌র, ২৭-৩০ নং আয়াত।)মহান আল্লাহ্‌‌ কেয়ামতের দিন বেশকিছু লোককে উদ্দেশ্য করে বলবেন ঃ “(তাদেরকে বলা হবে, তোমরা যাকিছু এখন দেখছো) তুমি তো এই দিন সম্পর্কে উদাসীন ছিলে। এখন তোমার নিকট থেকে যবনিকা সরিয়ে দিয়েছি। ফলে আজ তোমার দৃষ্টি সুতীক্ষ্ম।” (-সুরা আল ক্ব্‌াফ, ২২ নং আয়াত।)মহান আল্লাহ্‌‌ পবিত্র কুরআনের ‘তাউইল’ সম্পর্কে (কুরআনের গূঢ় অর্থ এখান থেকেই উৎসরিত) বলেছেন ঃ “যারা কুরআনকে স্বীকার করে না, তারা কি এখনো ‘তাউইল’ ব্যতীত অন্য কিছুর অপেক্ষায় আছে, যেদিন এর ‘তাউইল’ প্রকাশিত হবে, পূর্বে যারা একে ভুলে গিয়েছিল, সেদিন তারা বলবেঃ বাস্তবিকই আমাদের প্রতিপালকের পয়গম্বরগণ সত্যসহ আগমন করেছিলেন। অতএব, আমাদের জন্যে কোন সুপারিশকারী আছে কি যে, সুপারিশ করবে অথবা আমাদেরকে পুণঃ (পৃথিবীতে) প্রেরণ করা হলে আমরা পূর্বে যা করতাম তার বিপরীত কাজ করে আসতাম। নিশ্চয়ই তারা নিজেদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তারা মনগড়া যা বলত, উধাও হয়ে যাবে।” (-সুরা আল্‌ আরাফ, ৫৩ নং আয়াত।)মহান আল্লাহ্‌‌ বলেন ঃ “সেদিন আল্লাহ্‌‌ তাদের শাস্তি পুরোপুরি দিবেন এবং তারা জানতে পারবে যে, আল্লাহ্‌‌ই সত্য, স্পষ্ট ব্যক্তকারী।” (-সুরা আন্‌ নুর, ২৫ নং আয়াত। )আল্লাহ্‌‌ বলেন ঃ “হে মানুষ তোমাকে তোমার পালনকর্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে কষ্ট স্বীকার করতে হবে, অতঃপর তার সাক্ষাত ঘটবে।” (-সুরা আল্‌ ইনশিকক, ৬ নং আয়াত।)আল্লাহ্‌‌ আরো বলেন ঃ ‘যে আল্লাহ্‌র সাক্ষাত কামনা করে, আল্লাহ্‌র সেই নির্ধারিত কাল অবশ্যই আসবে।” (-সুরা আল্‌ আন্‌কাবুত, ৫ নং আয়াত।)আল্লাহ্‌‌ আরো বলেন ঃ “অতএব, যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার পালনকর্তার উপাসনায় কাউকে অংশীদার না করে।” (-সুরা আল্‌ কাহফ্‌, ১১০ নং আয়াত।)মহান আল্লাহ্‌‌ আরও বলেছেন ঃ “হে বিশ্বস্ত আত্মা, তুমি তোমার পালনকর্তার দিকে প্রত্যাবর্তন কর সস্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন অবস্থায়। অতঃপর আমার উপাসনায় মনোনিবেশ কর এবং আমারই জান্নাতে প্রবেশ কর।” (-সুরা আল্‌ ফাজ্‌র, ২৭-৩০ নং আয়াত।)মহান আল্লাহ্‌‌ বলেন ঃ “অতঃপর যখন মহাসংকট (কেয়ামত) এসে যাবে। অর্থাৎ যেদিন মানুষ তার কৃতকর্ম স্মরণ করবে এবং দর্শকদের জন্যে জাহান্নাম প্রকাশ করা হবে, (মানুষেরা দু’শ্রেণীতে বিভক্ত হবে) তখন যে ব্যক্তি সীমালংঘন করেছে এবং পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সামনে দন্ডায়মান হওয়াকে ভয় করেছে এবং খেয়াল খুশী থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রেখেছে, তার ঠিকানা হবে জান্নাাত।’’ (-সুরা আন্‌ নাযিআ’ত, ৩৪ থেকে ৪১ নং আয়াত।)মানুষের কৃতকর্মের প্রতিদানের স্বরূপ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্‌ বলেন ঃ “হে কাফের সমপ্রদায়, তোমরা আজ কোন অজুহাত পেশ করো না। তোমাদেরকে তারই প্রতিফল দেয়া হবে যা তোমরা করতে।” (-সুরা আত্‌ তাহরীম, ৭নং আয়াত।) সৃষ্টির অব্যাহত অস্থিত্ব আমাদের দৃশ্যমান এ সৃষ্টিজগত অন্তহীন আয়ুর অধিকারী নয়। একদিন অবশ্যই এ সৃষ্টিজগতের আয়ু নিঃশেষ হয়ে যাবে। পবিত্র কুরআনেরও এ মতের সমর্থন পাওয়াযায়।মহান আল্লাহ্‌‌ বলেন ঃ “নভোমন্ডল, ভূ-মন্ডল ও এদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু আমি যথাযথ ভাবেই এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্যেই সৃষ্টি করেছি (একটি নিদিষ্ট ও নির্ধারিত সময়ের জন্যে সৃষ্টি করা হয়েছে)।” (-সুরা আল্‌ আহ্‌ক্বাফ্‌ ৩ নং আয়াত।) উপরোক্ত সুনির্দিষ্ট ও সীমিত সময় সীমার কথা উলেখ করা হয়েছে। কিন্তু এ পৃথিবী ও মানব জাতির বর্তমান প্রজন্ম সৃষ্টির পূর্বে অন্য কোন পৃথিবী বা প্রজন্ম সৃষ্টি করা হয়েছিল কি? এ বিশ্ব এবং মানব জাতির ধ্বংসপ্রাপ্তির পর (যেমনটি কুরআনে উলেখ করা হয়েছে) পুনরায় অন্য কোন বিশ্ব ও মানবজাতির সৃষ্টি হবে কি ? সামান্য কিছু ইঙ্গিত ছাড়া এসব প্রশ্নের সরাসরি ও সুস্পষ্ট কোন উত্তর পবিত্র কুরআনে খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে আমাদের ইমামগণের (আ.) বর্ণিত হাদীস সমূহে এসব প্রশ্নের সুস্পষ্ট ও ইতিবাচক উত্তর দেয়া হয়েছে। (বিহারুল আনোয়ার, ১৪ নং খন্ড, ৭৯ নং পৃষ্ঠা।)

Processing your request, Please wait....
  • Print this article!
  • Digg
  • Sphinn
  • del.icio.us
  • Facebook
  • Mixx
  • Google Bookmarks
  • LinkaGoGo
  • MSN Reporter
  • Twitter
১৮৭ বার পঠিত
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars ( ভোট, গড়:০.০০)

১ টি মন্তব্য

  1. ধন্যবাদ লেখাটির জন্য। continuous বড় paragraph পড়তে কষ্ট হয়। ছোট ছোট প্যারাগ্রাফ আকারে হলে আরও ভাল হতো।