তাক্বদীরে বিশ্বাসের অপরিহার্যতা
লিখেছেন: ' sayedalihasan' @ সোমবার, এপ্রিল ২৩, ২০১২ (২:৪১ অপরাহ্ণ)
আমরা বর্তমানে এমন এক যুগে বাস করছি, যেখানে মুসলমানরা দুনিয়া নিয়ে খুব বেশী ব্যস্ত এবং তারা তাদের ধর্ম সম্পর্কে খুবই উদাসিন। এর ফলে, অনেকেই দেখা যায়, ইসলামের সঠিক আক্বীদাহ সম্পর্কে জানে না। আক্বীদাহ’র যে যে বিষয়গুলোর ব্যাপারে অনেকে বিভ্রান্ত হয়েছে, তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ভাগ্য বা তাকদীরে বিশ্বাস। সংক্ষেপে তাক্বদীর এর অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ স্বীয় মাখলুককে সৃষ্টি করার পূর্বেই তার ভাগ্য নির্ধারন করেছেন এবং প্রত্যেক জিনিস প্রকাশিত হবার পূর্বেই আল্লাহ তা’আলার কাছে লাওহে-মাহফুযে লিখিত হয়ে গেছে।
তাক্বদীর ঈমানের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ একটি রুকন। আল্লাহ কোরআনে বলছেন,‘ আমরা সবকিছুই অবশ্যই একটি সুনির্দিষ্ট পরিমানমতো সৃষ্টি করেছি’। ( ৫৪-৪৯)। জিব্রিলের (আ ) হাদিস নামে একটি হাদিসে এ ব্যাপারে উল্লেখ আছে, ‘ জিব্রিল (আ ) যখন রাসুল (স ) কে জিজ্ঞেস করলেন, ঈমান কি? তখন রাসুল রাসুল (স ) বললেন, ঈমান হচ্ছে আল্লাহর উপরে, তার ফেরেশতার উপরে, তার কিতাবের উপরে, বিচার দিবসের উপরে, তাক্বদীরের ভাল -মন্দের উপরে বিশ্বাস রাখা’।- সহীহ বুখারী.( অংশ বিশেষ)।
আরেকটি হাদিসে রাসুল (স ) বলেন, ‘ আল্লাহ’র কোন বান্দার ঈমান পরিপূর্ন হবেনা, যতক্ষন না সে তাক্বদিরে বিশ্বাস করে এবং সে এটা মানে যে, তার জীবনে যা ঘটেছে তা না ঘটে পারেনা, আর যা তার জীবনে ঘটেনি, তা কোনদিন ঘটার ছিলনা।’- সহীহ তিরমিযি।
উলামাদের সর্বসম্মত ঐক্যমত হচ্ছে, তাক্বদীরে অবিশ্বাসী ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায়।
ইসলামি স্কলাররা তাক্বদীরের ব্যাপারে মূলত চারটি মূলনীতিতে উপনীত হন।
১। অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত সকল কিছুর জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ’র কাছে আছে।
২। যা কিছু ঘটেছে, ঘটছে এবং ভবিষ্যতে ঘটবে সকল কিছুই আল্লাহ লাওহে-মাহফুযে লিখে রেখেছেন।
৩। আল্লাহ’র ইচ্ছা ছাড়া কোন কিছুই ঘটেনা।
৪। আল্লাহই ভাল-মন্দ সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা।
তাক্বদীরের ব্যাপারে কতিপয় বিভ্রান্ত গোষ্ঠীঃ
ইমাম মুসলিম তার সহীহ মুসলিমের প্রথম হাদিসের ভুমিকায় বসরার একজন ব্যক্তি কে তাক্বদীরের ব্যাপারে প্রথম পথভ্রষ্ট হিসেবে উল্লেখ করেন। তার নাম মু’আয আল-জুহনি। তার থেকেই প্রথম এই বিভ্রান্তি শুরু হয়ে যুগে যুগে নানা গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়, যারা তাক্বদীর সম্মন্ধে নিজেদের ইচ্ছামত ব্যাখ্যা প্রদান করে। যেমন: মু’তাযিলা গোষ্ঠী, জাহমিইয়্যাহ গোষ্ঠী এবং আশা’আরিয়্যাহ গোষ্ঠীর কতিপয় পথভ্রষ্ট লোক। কিন্তু তাদের সকলের এই ভ্রান্ত বিশ্বাস সেই প্রধান দুটি গ্রুপেরই প্রতিফলন, যথা: কাদিরিয়্যাহ সম্প্রদায় এবং জাবারিয়্যাহ সম্প্রদায়।
কাদিরিয়্যাহ হচ্ছে সেইসব সম্প্রদায়ের লোক যারা তাক্বদীরকে সম্পূর্ণরূপে অবিশ্বাস করে। তারা বলে, তাক্বদীর বলে কিছু নেই, আমরা আমাদের কাজের ব্যাপারে পুরোপরি স্বাধীন এবং আমাদের কোন কাজের ব্যাপারে আল্লাহ’র কোন নিয়ন্ত্রণ নেই এবং তিনি কোন ঘটনার ব্যাপারে ততক্ষণ পর্যন্ত জানেন না, যতক্ষণ না তা না ঘটে। অন্যদিকে, জাবারিয়্যাহরা বিশ্বাস করে, আমাদের কোন স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি নেই, আমরা যা করি এ সব কিছু করতে আমরা বাধ্য এবং এ ব্যাপারে আমরা দায়ী নই।
তাক্বদীরের ব্যাপারে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের অবস্থান এই দুই পথভ্রষ্ট গ্রুপের মধ্য অবস্থানে। আমরা বিশ্বাস করি যে আল্লাহ আমাদের সকল কাজের ব্যাপারে জানেন এমনকি তা আমরা করার পূর্বেই এবং তিনি আমাদের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন যাতে আমরা যা করতে চাই তা করতে পারি। হোক সেটা ভাল অথবা মন্দ এবং এই অনুসারেই আমরা আল্লাহ’র বিচারের সম্মুখীন হব। আল্লাহ বলেন, ‘এখন মুশরেকরা বলবেঃ যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন, তবে না আমরা শিরক করতাম, না আমাদের বাপ দাদারা এবং না আমরা কোন বস্তুকে হারাম করতাম। এমনিভাবে তাদের পূর্ববর্তীরা মিথ্যারোপ করেছে, এমন কি তারা আমার শাস্তি আস্বাদন করেছে। আপনি বলুনঃ তোমাদের কাছে কি কোন প্রমাণ আছে যা আমাদেরকে দেখাতে পার। তোমরা শুধুমাত্র আন্দাজের অনুসরণ কর এবং তোমরা শুধু অনুমান করে কথা বল।’ (৬-১৪৮)। আরেক আয়াতে আল্লাহ তাদেরকে সাবধান করে দিচ্ছেন এই বলে, ‘সুসংবাদদাতা ও ভীতি-প্রদর্শনকারী রসূলগণকে প্রেরণ করেছি, যাতে রসূলগণের পরে আল্লাহর প্রতি অপবাদ আরোপ করার মত কোন অবকাশ মানুষের জন্য না থাকে। আল্লাহ প্রবল পরাক্রমশীল, প্রাজ্ঞ।’ (৪-১৬৫)।
একদিন রাসুল (স ) বলেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই, কে জান্নাতে যাবে আর কে জাহান্নামে যাবে তা নির্দিষ্ট হয়ে গেছে।’
সাহাবীরা (রা ) এ কথা শুনে প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ, তবে কেন আমরা ভাল কাজ করব, সৎপথে চলব। আমরা কি ভাগ্যের (তাক্বদীর) উপর নির্ভরশীল হয়ে, এসব কিছু ছেড়ে দিতে পারিনা। এ কথা শুনে তিনি (স ) বললেন, ‘না, বরং তোমরা তোমাদের ভাল আমল ছেড়োনা। প্রত্যেকেই সে যেখানে যাবে (জান্নাত বা জাহান্নাম) সে পথ বা সে পথের আমল তার কাছে সহজ মনে হবে।’
যদি তাক্বদীর নির্দিষ্ট হয়ে গিয়ে থাকে তবে কেন আমরা দোয়া করি:
এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় যে, কোন কিছু করতে হলে আমাদের সে অনুসারে ব্যবস্থা নিতে হয়। আমরা বিশ্বাস করি, আল্লাহ সকল কিছুর নিয়ণ্ত্রক এবং তিনি সব কিছুই করতে পারেন। আমাদের সকল প্রয়োজনে আমরা তার কাছেই চাই। তিনি আগে থেকেই জানেন যে, আমরা তার কাছে কোন কিছুর ব্যাপারে দোয়া চাইব, কিন্তু তিনি আমাদের ঐ দোয়া না চাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। তাই আমরা যা চাই তা পেতে হলে আমাদেরকে আল্লাহ’র কাছে দোয়া চাওয়া চালিয়ে যেতে হবে। রাসুল (স ) বলেন, ‘ দোয়া ছাড়া অন্য কোন কিছুই মানুষের তাক্বদীর পরিবর্তন করতে পারেনা।’ -সহীহ ইবন মাজাহ।
জীবনের বিভিন্ন দুর্ঘটনায় আমাদের করনীয়:
আল্লাহ কোরানে বার বার বলেছেন মানুষকে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করা হবে, কষ্ট দ্বারা, দুর্যোগ দ্বারা, যে তখন সে চিন্তা করে, এ অবস্থা থেকে সে কখনোই পরিত্রান পাবেনা। আবার যখন সে সুখে থাকে তখন মনে এ পৃথিবীতে কোন কষ্টই নেই। সুতরাং এ ক্ষেত্রে মুসলিমদের কিরূপ অবস্থা প্রদর্শন করা উচিত? আল্লাহ বলেন, ‘এবং অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের।যখন তারা বিপদে পতিত হয়, তখন বলে, নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো।
।’ (২-১৫৫,১৫৬) এই আয়াতের আগে আরেক আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘ হে মুমিন গন! তোমরা ধৈর্য্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চিতই আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সাথে রয়েছেন।’
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বিপদাপদের সময় আমাদের প্রথমেই ধৈর্য ধারন করতে হবে। আমাদের অতিরিক্ত আবেগ থেকে দূরে থাকতে হবে, সে সময় বার বার আল্লাহ’র কথা স্মরণ করতে হবে। এবং সেটা নামাযের মাধ্যমে।
তাক্বদীরে বিশ্বাসের সুফল:
১। তাক্বদীরে বিশ্বাস একজন বিশ্বাসীকে মানসিক প্রশান্তি প্রদান করে। যাই ঘটুক না কেন, সে জানে যে এটা তার জীবনে যেকোনভাবেই হোক ঘটতই। অপরদিকে অন্যকারো সাফল্যে কখনো ইর্ষা বা আফসোস করেনা।
২। এটা মানুষকে ভাল কাজে উদ্বুদ্ধ করে, এবং এই বিশ্বাস এনে দেয় যে কোন বাধাই তাকে তার কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবেনা, যদি আল্লাহ তার তাকেদীরে সেটা লিখে থাকেন।
৩। এটা মানুষকে অহংকার থেকে দূরে রাখে এবং তাকে বিনয়ী এবং মিতাচারি করে, কারন সে বিশ্বাস করে আল্লাহই তার সকল কাজের এবং ফলাফলের সৃষ্টিকর্তা। তার জ্ঞান, তার ধন-দৌলত, তার বংশ কোন কিছুই কোন কাজের কারন নয়।
৪। তাক্বদীর মানুষকে তার সামর্থ মত চেষ্টা করার শিক্ষা দেয় এবং বাকিটা আল্লাহ’র উপর ছেড়ে দেয়, ফলে সে তার চেষ্টার ফলাফল যাই হোকনা কেন, তাতে সন্তুষ্ট থাকে।
একটি ভুল ধারনা খন্ডন:
১। আল্লাহ’র হুকুম ছাড়া একটি গাছের পাতাও পড়েনা, তাহলে মানুষ কেন তার কাজের জন্য দায়ী: এখানে আল্লাহ’র হুকুমকে ভুল বুঝার ফলেই এ প্রশ্নের উৎপত্তি।
আল্লাহ মানুষকে স্বাধীনতা দিয়েছেন, স্বাধীনভাবে ইচ্ছা করার ক্ষমতা দিয়েছেন। এখন মানুষ চাইলে কোন একটি কাজ করতে ইচ্ছা করতে পারে এবং নাও পারে। কোন কাজ করার আগে মানুষ প্রথমেই সে কাজের ব্যাপারে পরিকল্পনা করে। তার মনে এ কাজের ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতা অনুসারে এ কাজ করনীয় সময় এবং এর ফলাফলের সময় কি কি ঘটতে পারে তার একটা ধারনা মাথায় থাকে। এ অনুসারেই সে কাজটি করে। যদি সে ঐ কাজটির ফলাফল ভাল মনে করে কাজ করা শুরু করে, তবে এ ক্ষেত্রে তার নিয়্যত ভাল, এবং এ পর্যন্ত তার আল্লাহ প্রদত্ত স্বাধীনতা বিদ্যমান। এখন সে এই কাজটি শেষ করতে পারবে কিনা, যদি করেও তবে তার ফলাফল কি হবে এ সকলকিছুই আল্লাহ’র উপর নির্ভর করে। এ জন্যই রাসুল (স ) বলেন, মানুষকে তার নিয়তের উপর বিচার করা হবে। তা না হলে দেখা যায়, অনেক সময় অনেক ভাল কাজও খারাপ ফলাফল নিয়ে আসে।
আবার আল্লাহ’র হুকুম বলতে শুধুই আল্লাহ কোন কিছু ঘটানোর জন্য হুকুম করাকেই বুঝায় না, বরং আল্লাহ যদি কাউকে কোন কিছুর ব্যাপারে স্বাধীনতা দিয়ে থাকেন, এবং সে তার স্বাধীনতা অনুসারে কোন কিছু করতে থাকল, এখানে আল্লাহ’র কোন হস্তক্ষেপ না করাকেও আল্লাহ’র হুকুম বোঝায়, অর্থাৎ আল্লাহ তাকে তার ইচ্ছানুসারে তা করতে দিচ্ছেন। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে, আল্লাহ’র হুকুমেই সবকিছু হয়, আবার মানুষ তার কাজের জন্যও দায়ী, এ কথার মাঝে কোন মতবিরোধ নেই।
আল্লাহ আমাদের সকলকে হিদায়াত করুন।