কোরআন ও হাদীসের আলোকে মুনাফীকের চরিত্র। পর্ব ০১।
লিখেছেন: ' shahedups' @ সোমবার, সেপ্টেম্বর ৫, ২০১১ (৭:৩৯ অপরাহ্ণ)
কুরআন ও হাদিসে মুনাফিকদের চরিত্র :
কুরআনে করীম ও রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর পবিত্র হাদিসের অসংখ্য জায়গায় মুনাফিকদের আলোচনা এসেছে। তাতে তাদের চরিত্র ও কর্মতৎপরতা আলোচনা করা হয়েছে। আর মুমিনদেরকে তাদের থেকে সতর্ক করা হয়েছে যাতে তাদের চরিত্র মুমিনরা অবলম্বন না করে। এমনকি আল্লাহ তা‘আলা তাদের নামে একটি সুরাও নাযিল করেন।
১. মুনাফিকদের অন্তর রুগ্ন ও ব্যাধিগ্রস্ত:
মুনাফিকদের অন্তর রুগ্ন ও ব্যাধিগ্রস্ত থাকে। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে করীমে এরশাদ করেন, “তাদের অন্তরসমূহে রয়েছে ব্যাধি। অতঃপর আল্লাহ তাদের ব্যাধি বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব। কারণ তারা মিথ্যা বলত”। [বাকারাহ: ১০]
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ. বলেন, সন্দেহ, সংশয় ও প্রবৃত্তির ব্যাধি তাদের অন্তরকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলছে, ফলে তাদের অন্তর বা আত্মা ধ্বংস হয়ে গেছে। আর তাদের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা ও নিয়তের উপর খারাপ ও নগ্ন মানসিকতা প্রাধান্য বিস্তার করছে। ফলে তাদের অন্তর একদম হালাক বা ধ্বংসের উপক্রম। বিজ্ঞ ডাক্তাররাও এখন তার চিকিৎসা দিতে অক্ষম।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٞ فَزَادَهُمُ ٱللَّهُ مَرَضٗاۖ ﴾ [তাদের অন্তরসমূহে রয়েছে ব্যাধি। অতঃপর আল্লাহ তাদের ব্যাধি আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন।]
২. মুনাফিকদের অন্তরে অধিক লোভ-লালসা:
মুনাফিকরা অধিক লোভী হয়ে থাকে। যার কারণে তারা পার্থিব জগতকে বেশি ভালোবাসে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“হে নবী পত্নীগণ, তোমরা অন্য কোন নারীর মত নও। যদি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর, তবে (পরপুরুষের সাথে) কোমল কণ্ঠে কথা বলো না, তাহলে যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে সে প্রলুব্ধ হয়। আর তোমরা ন্যায়সঙ্গত কথা বলবে”। [আহযাব: ৩২]
অর্থাৎ, যে ব্যক্তির অন্তরে ঈমান দুর্বল থাকে, সে তার দুর্বলতার কারণে লোভী হয়ে থাকে। আর সে তার ঈমানের দুর্বলতার কারণে ইসলাম বিষয়ে সন্দেহ পোষণকারী একজন মুনাফেক। যার ফলে সে আল্লাহ তা‘আলার দেয়া বিধানকে গুরুত্বহীন মনে করে এবং হালকা করে দেখে। আর অন্যায় অশ্লীল কাজ করাকে কোন অন্যায় মনে করে না।[1]
৩. মুনাফিকরা অহংকারী ও দাম্ভিক:
মুনাফিকরা কখনই তাদের নিজেদের দোষত্রুটি নিজেরা দেখতে পায় না। তাই তারা নিজেদের অনেক বড় মনে করে। কারো কোন উপদেশ তারা গ্রহণ করে না, তারা মনে করে তাদের চাইতে বড় আর কে হতে পারে? আল্লাহ তা‘আলা তাদের অহংকারী স্বভাবের বর্ণনা দিয়ে বলেন,
“ আর তাদেরকে যখন বলা হয় এস, আল্লাহর রাসূল তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন, তখন তারা তাদের মাথা নাড়ে। আর তুমি তাদেরকে দেখতে পাবে, অহঙ্কারবশত বিমুখ হয়ে চলে যেতে”। [সূরা আল-মুনাফিকুন: ৫]
এ আয়াতে অভিশপ্ত মুনাফিকদের বিষয়ে সংবাদ দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “আর তাদেরকে যখন বলা হয় এস, আল্লাহর রাসূল তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন, তখন তারা তাদের মাথা নাড়ে। আর তুমি তাদেরকে দেখতে পাবে, অহঙ্কারবশত বিমুখ হয়ে চলে যেতে”। অর্থাৎ, তাদের যা পালন করতে বলা হল, অহংকার ও অহমিকা বশত বা নিকৃষ্ট মনে করে তারা তা পালন করা হতে বিরত থাকে। এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা তাদের শাস্তি দিয়ে বলেন,
“তুমি তাদের জন্য ক্ষমা কর অথবা না কর, উভয়টি তাদের ক্ষেত্রে সমান। আল্লাহ তাদেরকে কখনো ক্ষমা করবেন না। অবশ্যই আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে হেদায়েত দেন না”।
৪. মুনাফিকদের চরিত্র হল, আল্লাহ তা‘আলার আয়াতসমূহের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“মুনাফিকরা ভয় করে যে, তাদের বিষয়ে এমন একটি সূরা অবতীর্ণ হবে, যা তাদের অন্তরের বিষয়গুলি জানিয়ে দেবে। বল, ‘তোমরা উপহাস করতে থাক। নিশ্চয় আল্লাহ বের করবেন, তোমরা যা ভয় করছ’। [তওবা: ৬৪]
আয়াতের ব্যাখ্যা:
মুনাফিকরা সব সময় এ আশংকা করত যে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের অন্তরে যা আছে, তা মুমিনদের নিকট একটি সূরা নাযিল করে জানিয়ে দিবেন। তাদের এ আশংকার প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন। কারো মতে, আল্লাহ তা‘আলা তার রাসূলের উপর এ আয়াত নাযিল করেন, কারণ, মুনাফিকরা যখন রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর কোন দোষ বর্ণনা, তার বা মুসলিমদের কোন কর্মের সমালোচনা করত, তখন তারা নিজেরা বলাবলি করত, আল্লাহ আমাদের গোপন বিষয় প্রকাশ করে না দেয়। তাদের কথার প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তা‘আলা তার নবীকে বলেন, আপনি তাদের ধমক ও হুমকি দিয়ে বলুন, [‘তোমরা উপহাস করতে থাক। নিশ্চয় আল্লাহ বের করবেন, তোমরা যা ভয় করছ’]
৫. মুমিনদের সাথে বিদ্রূপ:
মুনাফিকরা মুমিনদের সাথে বিদ্রূপ করত। তারা যখন মুমিনদের সাথে মিলিত হত, তখন তারা মুমিনদের সাথে প্রকাশ করত যে, তারা ঈমানদার আবার যখন তারা তাদের কাফের বন্ধুদের সাথে মিলিত হত, তখন তারা তাদের সাথে ছির অন্তরঙ্গ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“আর যখন তারা মুমিনদের সাথে মিলিত হয়, তখন বলে ‘আমরা ঈমান এনেছি’ এবং যখন গোপনে তাদের শয়তানদের সাথে একান্তে মিলিত হয়, তখন বলে, ‘নিশ্চয় আমরা তোমাদের সাথে আছি। আমরা তো কেবল উপহাসকারী’। আল্লাহ তাদের প্রতি উপহাস করেন এবং তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় বিভ্রান্ত হয়ে ঘোরার অবকাশ দেন”। [সূরা বাকারাহ: ১৪, ১৫]
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ. বলেন, মুনাফিকদের দুটি চেহারা: একটি চেহারা দ্বারা তারা মুমিনদের সাথে সাক্ষাত করত, আর আরেকটি চেহারা দ্বারা তারা তাদের মুনাফেক -কাফের- ভাইদের সাথে সাক্ষাত করত। তাদের দুটি মুখ থাকত, একটি দ্বারা তারা মুসলিমদের সাতে মিলিত হত, আর অপর চেহারা তাদের অন্তরে লুকায়িত গোপন তথ্য সম্পর্কে সংবাদ দিত। তারা কিতাব ও সুন্নাহ এবং উভয়ের অনুসারীদের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে ফিরে যায় এবং তারা তাদের নিকট যা আছে তার উপর সন্তুষ্ট থাকে। আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল কৃত ওহীর বিধানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশকে অস্বীকার করত। তারা মনে করত, তারাই বড় জ্ঞানী। হে রাসূল আপনি তাদের বলে দিন, তাদের জ্ঞান যতই থাকুক না কেন, তা তাদের কোন উপকারে আসে না, বরং তা তাদের অন্যায় অনাচারকে আরো বৃদ্ধি করে। আর আপনি কখনোই তাদের ওহীর প্রতি আনুগত্য করতে দেখবেন না। তাদের আপনি দেখবেন ওহীর প্রতি বিদ্রূপ কারী। আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন তাদের বিদ্রূপের বদলা দেবেন। [আল্লাহ তাদের প্রতি উপহাস করেন এবং তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় বিভ্রান্ত হয়ে ঘোরার অবকাশ দেন।] তারা তাদের কু-কর্মে আনন্দ ভোগ করতে থাকবে।
৬. মানুষকে আল্লাহর রাহে খরচ করা হতে বিরত রাখা:
মুনাফিকরা মানুষকে আল্লাহর রাখে খরচ করাকে অনর্থক মনে করে। তাই তারা মানুষকে আল্লাহর রাহে খরচ করতে নিষেধ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“তারাই বলে, যারা আল্লাহর রাসূলের কাছে আছে তোমরা তাদের জন্য খরচ করো না, যতক্ষণ না তারা সরে যায়। আর আসমানসমূহ ও যমিনের ধনÑভাণ্ডার তো আল্লাহরই, কিন্তু মুনাফিকরা তা বুঝে না”। [সূরা আল মুনাফিকুন: ৭]
যায়েদ ইবনে আরকাম রা. হতে বর্ণিত, আমি একদা একটি যুদ্ধে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই কে বলতে শুনি সে বলে, তোমরা মুহাম্মদের আশ পাশে যে সব মুমিনরা রয়েছে, তাদের জন্য খরচ করো না, যাতে তারা তাকে ছেড়ে চলে যায়। আর যদি তারা মদিনায় ফিরে আসে তাহলে মদিনার সম্মানী লোকেরা এ সব নিকৃষ্ট লোকদের বহিষ্কার করবে। আমি বিষয়টি আমার চাচা অথবা ওমর রা. কে বললে, তারা বিষয়টি রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর নিকট আলোচনা করে। রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলে আমি তাকে বিস্তারিত বিষয়টি জানালাম। তারপর রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ও তার সাথীদের ডেকে জিজ্ঞাসা করলে, তারা শপথ করে বলল, আমরা এ ধরনের কোন কথা বলি নাই। তাদের কথা শোনে রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] তাদের কথা বিশ্বাস করল, আর আমাকে মিথ্যুক সাব্যস্ত করল। এরপর আমি এত চিন্তিত হলাম ইতি পূর্বে আর কোন দিন আমি এত চিন্তিত হই নাই। আমি লজ্জিত হয়ে ঘরে বসে থাকতাম। লজ্জায় ঘর থেকে বের হতাম না। তখন আমার চাচা আমাকে বলল, আমরা কখনো চাইছিলাম না যে, রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] তোমাকে মিথ্যুক সাব্যস্ত করুক বা তোমাকে অস্বীকার করুক। তারপর আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত-[যখন তোমার কাছে মুনফিকরা আসে, তখন বলে, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয় আপনি আল্লাহর রাসূল এবং আল্লাহ জানেন যে, অবশ্যই তুমি তার রাসূল। আর আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, অবশ্যই মুনাফিকরা মিথ্যবাদী] নাযিল করেন। তারপর রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] আমাকে ডেকে পাঠান এবং আমাকে এ আয়াত পাঠ করে শোনান এবং বলেন, হে যায়েদ! আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে সত্যবাদী বলে আখ্যায়িত করেন।
চলবে…….ইনশাল্লাহ……..