কোরআন ও হাদীসের আলোকে মুনাফীকের চরিত্র। পর্ব ০৪।
লিখেছেন: ' shahedups' @ বৃহস্পতিবার, সেপ্টেম্বর ৮, ২০১১ (৫:১৪ অপরাহ্ণ)
১৯. মুনাফিকরা খারাপ কাজের আদেশ দেয় আর ভালো কাজ থেকে নিষেধ করে:
মুনাফিকরা মানুষকে খারাপ ও মন্দ কাজের দিকে আহ্বান করে। ভালো কাজের দিকে ডাকে না। পক্ষান্তরে মুমিনরা তাদের সম্পূর্ণ বিপরীত, তারা মানুষকে ভালো কাজের দিকে আহ্বান করে এবং মন্দ কাজ হতে বিরত রাখে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“ মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারীরা একে অপরের অংশ, তারা মন্দ কাজের আদেশ দেয়, আর ভাল কাজ থেকে নিষেধ করে, তারা নিজদের হাতগুলোকে সঙ্কুচিত করে রাখে। তারা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছে, ফলে তিনিও তাদেরকে ভুলে গিয়েছেন, নিশ্চয় মুনাফিকরা হচ্ছে ফাসিক”। [সূরা তওবা: ৬৭]
আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের অবস্থার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, তারা মুমিনদের বিপরীত গুণের অধিকারী। কারণ, মুমিনরা মানুষকে ভালো কাজের আদেশ দেয়, আর খারাপ কাজ হতে বারণ করে। পক্ষান্তরে মুনাফিকরা খারাপ কাজের আদেশ দেয় এবং ভালো কাজ হতে নিষেধ করে। আর আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করা হতে তারা তাদের হাত-দ্বয় গুটিয়ে রাখে। তারা আল্লাহর স্মরণকে ভুলে যায়, আল্লাহ তা‘আলাও তাদের সাথে সে ব্যক্তির আচরণ করেন, যে তাদের ভুলে যান। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা অন্য আয়াতে বলেন, তাদের বলা হবে আজকের দিন আমরা তোমাদেরকে ভুলে যাব, যেমনটি তোমরা আজকের দিনের সাক্ষাতের দিনটি ভুলে গিয়েছিলে, ﴿إِنَّ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ هُمُ ٱلۡفَٰسِقُونَ﴾ নিশ্চয় মুনাফিকরা হল, সত্যের পথ হতে বিচ্যুত, আর গোমরাহির পথে পরিবেষ্টিত।[19]
২০. জিহাদকে অপছন্দ করা ও জিহাদ হতে বিরত থাকা:
মুনাফিকরা জিহাদকে অপছন্দ করে। তারা কখনোই আল্লাহর রাহে জিহাদ করতে চায় না। এ কারণে তারা বিভিন্ন অজুহাতে জিহাদ হতে বিরত থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“পেছনে থাকা লোকগুলো আল্লাহর রাসূলের বিপক্ষে বসে থাকতে পেরে খুশি হল, আর তারা অপছন্দ করল তাদের মাল ও জান নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতে এবং তারা বলল, ‘তোমরা গরমের মধ্যে বের হয়ো না। বল, ‘জাহান্নামের আগুন অধিকতর গরম, যদি তারা বুঝত’। [সূরা তওবা: ৮১]
তাবুকের যুদ্ধে রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর সাহাবীদের সাথে যারা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেনি সে সব মুনাফিকদের সমালোচনা করে বলেন, তারা তাদের গৃহাভ্যন্তরে বসে থাকাকে পছন্দ করে এবং ﴿وَكَرِهُوٓاْ أَن يُجَٰهِدُواْ بِأَمۡوَٰلِهِمۡ وَأَنفُسِهِمۡ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ﴾ আর আল্লাহর রাস্তায় জান মাল দিয়ে জিহাদ করতে অপছন্দ করে। আর তারা একে অপরকে বলে, ﴿لَا تَنفِرُواْ فِي ٱلۡحَرِّۗ﴾ তোমরা গরমের মধ্যে বের হয়ো না। অর্থাৎ, তাবুকের যুদ্ধের অভিযান ছিল উত্তপ্ত গরমের মৌসুমে এবং ফসল কাটার উপযুক্ত সময়। এ কারণেই মুনাফিকরা বলে তোমরা গরমের মধ্যে ঘর থেকে বের হয়ো না। আল্লাহ তা‘আলা তার স্বীয় রাসূল কে বলেন, আপনি তাদের বলুন, ﴿نَارُ جَهَنَّمَ أَشَدُّ حَرّٗاۚ لَّوۡ كَانُواْ يَفۡقَهُونَ﴾ তোমরা আল্লাহর রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর আদেশের বিরোধিতা করার মাধ্যমে জাহান্নামের যে পরিণতির দিকে যাচ্ছ, তা দুনিয়ার এ গরমের চেয়ে আরো বেশি উত্তপ্ত। যদি তোমরা বুঝতে পারতে।[20] সুতরাং তোমাদের জন্য জাহান্নামের আগুনের চেয়ে দুনিয়ার গরম অনেক সহনীয়। কিন্তু তোমরা এখন তা বুঝতে পারছ না।
২১. অপমান ও অপদস্থের দায়িত্ব কাঁধে নেয়া:
মুনাফিকরা যুদ্ধ হতে বিরত থাকার জন্য অপমানিত হবে তবুও তারা যুদ্ধে যাবে না। তাদের নিকট মান-সম্মান ও ইজ্জতের কোন দাম নাই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“ আর স্মরণ কর, যখন মুনাফিকরা ও যাদের অন্তরে ব্যাধি ছিল তারা বলছিল, ‘আল্লাহ ও তার রাসূল আমাদেরকে যে ওয়াদা দিয়েছিলেন তা প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর যখন তাদের একদল বলেছিল, ‘হে ইয়াসরিববাসী, এখানে তোমাদের কোন স্থান নেই, তাই তোমরা ফিরে যাও। আর তাদের একদল নবীর কাছে অনুমতি চেয়ে বলছিল, আমাদের বাড়িঘর অরক্ষিত, অথচ সেগুলো অরক্ষিত ছিল না। আসলে পালিয়ে যাওয়াই ছিল তাদের উদ্দেশ্য”। [সূরা আহযাব: ১২, ১৩
২২. মুমিনদের থেকে পিছে হটা :
মুনাফিকদের চরিত্র হল, তারা সব সময় পিছু হটে থাকে। তারা কোন ভালো কাজের পিছনে থাকে। সালাতে তারা সবার পিছনে আসে এবং পিছনের কাতারে দাঁড়ায়। রাসূল সা. এর তালীমের মজলিশে তারা পিছনে থাকে। জিহাদে বের হলে তারা মুমিনদের পিছনে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“আর তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ এমন আছে, যে অবশ্যই বিলম্ব করবে। সুতরাং তোমাদের কোন বিপদ আপতিত হলে সে বলবে, ‘আল্লাহ আমার উপর অনুগ্রহ করেছেন যে, আমি তাদের সাথে উপস্থিত ছিলাম না’। [সূরা নিসা: ৭২]
আয়াতের ব্যাখ্যা: এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের গুণাগুণ ও তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেন, আল্লাহ তা‘আলা তাদের মুমিন বলে সম্বোধন করেন এবং বলেন, হে মুমিনগণ! কিছু লোক আছে যারা তোমাদের অন্তর্ভুক্ত ও তোমাদের সম্প্রদায়ের। আর তারা তোমাদেরই সাদৃশ্য। তারা মানুষের মধ্যে প্রকাশ করে যে, আমরা তোমাদের দাওয়াত ও ধর্মের অনুসারী অথচ তারা এ দাওয়াত ও ইসলাম ধর্মের অনুসারী নয়, সত্যিকার অর্থে তারা হল মুনাফেক। যার ফলে তোমাদের দুশমনদের সাথে জিহাদ ও তাদের সাথে লড়াই করতে তারা বিলম্ব করে। তোমরা মুমিনগণ ঘর থেকে বের হলেও তারা ঘর থেকে বের হয় না। فَإِنۡ أَصَٰبَتۡكُم مُّصِيبَة যদি তোমাদের কোন মুসিবত তথা পরাজয় নেমে আসে অথবা তোমাদের কেউ আহত বা শহিদ হয়, তখন তারা বলে, ﴾ ﴿قَدۡ أَنۡعَمَ ٱللَّهُ عَلَيَّ إِذۡ لَمۡ أَكُن مَّعَهُمۡ شَهِيدٗا আল্লাহ আমার উপর অনুগ্রহ করেছেন যে, আমি তাদের সাথে উপস্থিত ছিলাম না। কারণ, যদি আমি তাদের সাথে উপস্থিত থাকতাম, তবে আমিও আক্রান্ত হতাম; আহত বা নিহত হতাম। তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ হতে বিরত থাকাতে খুশি ও আনন্দ যোগায়। কারণ, সে তো মুনাফিক। আল্লাহর রাস্তায় আক্রান্ত হলে বা শহীদ হলে যে সব সাওয়াব ও বিনিময়ের ঘোষণা আল্লাহ তা‘আলা দিয়েছেন সে বিষয়ে সে বিশ্বাস করে না, বরং সন্দেহ পোষণকারী। সে কখনোই সাওয়াবের আশা করে না এবং আল্লাহর আযাবকে ভয় করে না।
২৩. জিহাদ থেকে বিরত থাকতে অনুমতি চাওয়া: মুনাফিকরা জিহাদে অংশ গ্রহণ করাকে অপছন্দ করে। তার জন্য তারা রাসূল সা. এর দরবারে এসে বিভিন্ন ধরনের অহেতুক অজুহাত দাড় করায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“আর তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলে, ‘আমাকে অনুমতি দিন এবং আমাকে ফিতনায় ফেলবেন না’। শুনে রাখ, তারা ফিতনাতেই পড়ে আছে। আর নিশ্চয় জাহান্নাম কাফিরদের বেষ্টনকারী”। [সূরা তওবা: ৪৯]
আয়াতের ব্যাখ্যা:
আর মুনাফিকদের মধ্যে থেকে কেউ কেউ তোমাকে বলবে হে মুহাম্মদ!ٱئۡذَن لِّي ‘আমাকে ঘরে বসে থাকতে অনুমতি দিন আমি যুদ্ধে তোমাদের সাথে শরিক হবো না। তুমি যদি আমাকে যুদ্ধে যেতে বাধ্য কর, আমি আমার বিষয়ে আশংকা করছি যে, রুমের সুন্দর সুন্দর রমণীদের কারণে আমি ফিতনায় আক্রান্ত হতে পারি। সুতরাং, وَلَا تَفۡتِنِّيٓۚ তুমি আমাকে ফিতনায় ফেলবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, أَلَا فِي ٱلۡفِتۡنَةِ سَقَطُواْ শুনে রাখ, তারা তাদের এ কথার কারণেই ফিতনাতেই পড়ে আছে।[22]
২৪. জিহাদে না গিয়ে বিভিন্ন ওজুহাত দাঁড় করানো:
রাসূল সা. যখন জিহাদ থেকে ফিরে আসতো, তখন মুনাফিকরা রাসূল সা. এর দরবারে এসে বিভিন্ন ধরনের অজুহাত দাঁড় করান এবং নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করতে চেষ্টা করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“তারা তোমাদের নিকট ওজর পেশ করবে যখন তোমরা তাদের কাছে ফিরে যাবে। বল, ‘তোমরা ওজর পেশ করো না, আমরা তোমাদেরকে কখনো বিশ্বাস করব না। অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের খবর আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন। আর আল্লাহ তোমাদের আমল দেখবেন এবং তাঁর রাসূলও। তারপর তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে গায়েব ও প্রকাশ্যের পরিজ্ঞাতার নিকট। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে জানিয়ে দেবেন যা তোমরা আমল করতে সে সম্পর্কে’। [সূরা তওবা: ৯৪]
আয়াতের ব্যাখ্যা:
আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের বিষয়ে সংবাদ দেন যে, তারা যখন মদিনা ফিরে আসবে তখন তারা তোমাদের নিকট ওজর পেশ করবে। আল্লাহ বলেন, قُل لَّا تَعۡتَذِرُواْ لَن نُّؤۡمِنَ لَكُمۡ বল, ‘তোমরা ওজর পেশ করো না, আমরা তোমাদেরকে কখনো বিশ্বাস করব না। قَدۡ نَبَّأَنَا ٱللَّهُ مِنۡ أَخۡبَارِكُمۡۚ অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের খবর ও অবস্থা সম্পর্কে আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন। وَسَيَرَى ٱللَّهُ عَمَلَكُمۡ وَرَسُولُهُۥ অর্থাৎ, আল্লাহ তোমাদের আমলসমূহ দেখবেন এবং তাঁর রাসূলও। অর্থাৎ, তোমাদের আমলসমূহ আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াতে মানুষের সম্মুখে প্রকাশ করে দেবেন। ثُمَّ تُرَدُّونَ إِلَىٰ عَٰلِمِ ٱلۡغَيۡبِ وَٱلشَّهَٰدَةِ তারপর তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে গায়েব ও প্রকাশ্যের পরিজ্ঞাতার নিকট। فَيُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمۡ تَعۡمَلُونَ অতঃপর তিনি তোমাদেরকে জানিয়ে দেবেন যা তোমরা আমল করতে সে সম্পর্কে’। অর্থাৎ তোমাদের খারাপ আমল ও ভালো আমল সম্পর্কে অবগত করবে আর তোমাদের তার উপর বিনিময় দিবেন।[23]
২৫. মানুষের থেকে আত্ম-গোপন করা:
মুনাফিকরা মাথা লুকাত এবং নিজেদের সব সময় আড়াল করে রাখতো। কারণ, তাদের মনে সব সময় আতংক থাকতো। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“তারা মানুষের কাছ থেকে লুকাতে চায়, আর আল্লাহর কাছ থেকে লুকাতে চায় না। অথচ তিনি তাদের সাথেই থাকেন যখন তারা রাতে এমন কথার পরিকল্পনা করে যা তিনি পছন্দ করেন না। আর আল্লাহ তারা যা করে তা পরিবেষ্টন করে আছেন”। [সূরা নিসা: ১০৮]
আয়াতের ব্যাখ্যা:
আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের আমলের নিন্দা করে বলেন, তারা তাদের খারাপীগুলো মানুষের থেকে গোপন করে, যাতে তারা তাদের খারাপ না বলে, অথচ, আল্লাহ তা‘আলা তাদের চরিত্রগুলো প্রকাশ করে দেন। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা তাদের গোপন বিষয় ও তাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে কি আছে, সে সম্পর্কে জানেন। এ কারণেই তিনি বলেন, ﴿وَهُوَ َ مَعَهُمۡ إِذۡ يُبَيِّتُونَ مَا لَا يَرۡضَىٰ مِنَ ٱلۡقَوۡلِۚ وَكَانَ ٱللَّهُ بِمَا يَعۡمَلُونَ مُحِيطًا﴾ অথচ তিনি তাদের সাথেই থাকেন যখন তারা রাতে এমন কথার পরিকল্পনা করে যা তিনি পছন্দ করেন না। আর আল্লাহ তারা যা করে তা পরিবেষ্টন করে আছেন। এটি তাদের হুমকি ও ধমক আল্লাহর পক্ষ হতে।
চলবে…………ইনশাল্লাহ………………………..