হাদীস সংগ্রহ, বাছাই ও সংরক্ষণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
লিখেছেন: ' shovoon' @ শুক্রবার, জুলাই ৮, ২০১১ (২:২৭ অপরাহ্ণ)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ ) এর জীবদ্দশায় হাদীসের চাইতে কুরআন শরীফ শিখা ও লিপিবদ্ধ রাখার ব্যাপারে অধিক গুরম্নত্ব দেয়া হয়। এটা করা হয় সঙ্গত কারণেই, কেননা অন্যান্য কিতাব-প্রাপ্ত জাতি বিপথগামী হয়েছিল মূলত তাদের কাছে আসা কিতাবকে অবিকৃত রাখতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ ) নিজেও হাদীসকে কুরআনের মত সমান গুরম্নত্ব সহকারে মুখস্থ করার জন্য উৎসাহ দেন নাই। তথাপি আবু হুরাইরা ও আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ ) প্রমুখ সাহাবীগণ হাদীস মুখস্থ রাখতে সচেষ্ট থাকতেন। শেষোক্ত সাহাবা রাসূলুল্লাহ (সাঃ ) এর অনুমতি নিয়েই লিখিত আকারেও হাদীস সংরক্ষণ করতেন। হাদীস মুখস্থ রাখার ব্যাপারে এই দুই সাহাবী অগ্রণী ভূমিকা পালন করলেও অন্যান্য অসংখ্য সাহাবী এবং পর্যায়ক্রমে তা’বিয়ীন ও তা’বে-তা’বিয়ীনগণ কর্তৃক হাদীস মুখস্থকরণ ও প্রশিক্ষণ দানের মাধ্যমে মুসলমানগণের মধ্যে হাদীসের চর্চা যথারীতি অব্যাহত থাকে।
খলীফা ওমর ইবনে আব্দুল আযীয (হিজরী দ্বিতীয় শতকের একদম প্রথম ভাগে) হাদীস পুসত্দকাকারে লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে উপলদ্ধি করত এ ব্যাপারে ফরমান জারী করেন। তখন থেকেই প্রকৃতপক্ষে হাদীস গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ হওয়া শুরু হয়। বিশিষ্ট ইমামগণ যথা ইমাম মালিক, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম তিরমিজি, ইমাম আবু দাউদ, ইমাম নাসায়ী, ইমাম ইবনে মাজাহ, ইমাম দারিমী, ইমাম দারা কুতনী, ইমাম বাইহাকী (সকলের প্রতি আল্লাহ্র রহমত) প্রমুখ ইমামগণসহ আরো শত শত নিবেদিতপ্রাণ মুসলমান হাদীস সংগ্রহ ও বাছাই করে পুসত্দকাকারে প্রকাশ করেন।
হাদীস বাছাই প্রক্রিয়া :
হাদীস বাছাই প্রক্রিয়ায় এমন এক অদ্বিতীয় পদ্ধতি উদ্ভাবন ও অবলম্বন করা হয় যা অনেক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকেও হার মানায়। এই প্রক্রিয়ার মূল লক্ষ্য ছিল, – বাছাইকৃত হাদীস যেন সন্দেহাতীতরূপে সত্য হয়। এই লক্ষ্যে হাদীসের বিশ্বসত্দতা প্রমাণে সূত্রপরম্পরায় প্রত্যেক মৌখিক সাক্ষ্যকে তালিকাভুক্ত করা হত এবং প্রত্যেক সূত্র বা সাক্ষীর নাম, ঠিকানা, জ্ঞান, চরিত্র, স্মরণশক্তি ইত্যাদি আবশ্যিক তথ্যও লিপিবদ্ধ করা হত। ইসলামী পরিভাষায় প্রত্যেক সাক্ষ্যদাতাকে বলা হয় ‘রাবী’ এবং সূত্রপরম্পরার তালিকাকে বলা হয় ‘সনদ’। ‘উসূলে হাদীসের’ বা হাদীসের বিশুদ্ধতা প্রমাণের কড়া ও বহুমুখী নিয়ম কানুন এই কারণে অত্যাবশ্যক ছিল যে, সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া কোন উক্তিই যেমন বিশুদ্ধ হিসাবে গণ্য করা যায় না, তেমনি মানুষের স্মৃতিশক্তি দুর্বল হওয়ার কারণে হয় মূল হাদীস পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারত, নয়তবা স্রেফ হাদীস বর্ণনাকারী হিসেবে সুনাম অর্জনের জন্য কারো কিছু আপাত ভাল অথচ মনগড়া কথা হাদীস হিসাবে প্রচলিত হয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকত।
উসূলে হাদীস এর কিছু মৌলিক নিয়ম কানুন ছিল এরূপ :
বর্ণনাকারী তার পূর্বের বর্ণনাকারীর নিকট থেকে নিজ কানে শুনেছেন, এই সাক্ষ্য দিতে হবে, অথর্াৎ যদি তিনি বলেন যে তিনি আরেকজন তৃতীয় ব্যক্তির মাধ্যমে শুনেছেন যিনি পূর্বের মূল ব্যাক্তির নিকট থেকে সরাসরি শুনেন নাই, – তা হলে তার এই বর্ণনা কখনো গ্রহণযোগ্য নয়।
বর্ণনাকারী ও তার পূর্বের বর্ণনাকারীর জীবনকাল ও বাসস্থানও এমন হতে হবে যাতে তাদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ অসম্ভব না হয়। বর্ণনাকারী নিজেও হাদীস-বিশারদ হতে হবে এবং সূত্র পরমপরার প্রত্যেক বর্ণনাকারীকেও জ্ঞানী, খাঁটি সত্যবাদী, সচ্চরিত্র এবং পরহেজগার হতে হবে। তদুপরি তাদের স্মরণশক্তি সমপূর্ণ পাকাপোক্ত হতে হবে।
হাদীস ছাড়াও অন্য যে-কোন বিষয়ে জীবনে একটি মিথ্যা কথা বলেছেন, কিংবা কখনও শরী’আ বিরোধী কোন কর্মে লিপ্ত হয়েছেন, অথবা কোন কর্মে দুর্বল চরিত্রের পরিচয় দিয়েছেন, – এমন ব্যক্তির হাদীসও কোন ক্রমেই গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়নি।
এরকম কষ্টিপাথরে যাচাই করার পর স্বভাবতই হাজার হাজার বর্ণনাকারীর লক্ষ লক্ষ হাদীস থেকে চূড়ান্তভাবে মাত্র কয়েক হাজার হাদীস বিশুদ্ধ হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। এভাবে ইমাম আহমাদ বিন্ হাম্বল (রঃ ) প্রায় দশ লক্ষ হাদীসের মধ্যে ত্রিশ হাজার হাদীস বাছাই করে একটি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন। ইমাম বুখারী (রঃ ) ছয় লক্ষাধিক হাদীস থেকে আঠারো শতাধিক সাক্ষ্যদাতার মাধ্যমে ২৬০২ টি হাদীস চূড়ান্তভাবে বাছাই করে বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ সহীহ্ বুখারী শরীফ প্রণয়ন করেন। (একই হাদীসের পৃথক সকল সনদকে আলাদা হিসাব করলে এই সংখ্যা বেড়ে প্রায় চার হাজারে দাঁড়ায়)। বিশুদ্ধ মুসলিম শরীফ ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থও অনুরূপভাবে প্রণীত হয়। তবে বিশুদ্ধতার ক্ষেত্রে বুখারী, মুসলিম ও মালিক (রঃ ) এর মু’আত্তা নামীয় হাদীস সংকলন সর্বাগ্রে।
সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে এমন প্রশ্ন অনেকের মনে আসতেই পারে যে তা’ হলে বাকী লক্ষ লক্ষ হাদীস কি ভুল, মিথ্যা ও অগ্রহণযোগ্য ছিল? প্রকৃত পক্ষে এই ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন করে অনেক বিধর্মী পন্ডিতও মুসলমানদের মনে সন্দেহ জাগানোর চেষ্টা করেছেন যে, লক্ষ লক্ষ হাদীসের মধ্যে যদি শতকরা প্রায় নব্বই ভাগই বর্জনীয় হয়, তা’ হলে বাকীগুলি বিশুদ্ধ হবে এমন নিশ্চয়তা কোথায়? আসলে এখানে দুটি ব্যাপার প্রণিধানযোগ্য, তার একটি হচ্ছে বাছাই প্রক্রিয়া, যা আগেই বলা হয়েছে, এবং অপরটি হচ্ছে হাদীসের সংখ্যার শুভঙ্করী হিসাব। হাদীসের প্রাথমিক হিসাব হাদীসের বর্ণনার বিষয় অনুযায়ী হয় না, হিসাব হয় প্রান্তিক বা সর্বশেষ বর্ণনাকারীর সূত্র-পরম্পরা বা সনদ অনুযায়ী। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ )-এর তিরোধানের পর ১০০ থেকে ২০০ বৎসরের মধ্যে প্রায় প্রত্যেক হাদীস একজনের নিকট থেকে দুইজন বর্ণনাকারী, পরে এই দুইজন থেকে চারজন বর্ণনাকারী – এরকম জ্যামিতিক হারে বর্ণনাকারীর সূত্র-পরম্পরার সংখ্যা বা সনদ বেড়ে গিয়ে একটি হাদীসের সংখ্যা অনেক ক্ষেত্রেই বর্ণনার সামান্য হেরফের হয়ে দশ, বিশ বা ততোধিক হাদীসে দাঁড়ায় এবং নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক সনদকে একটি পৃথক হাদীস হিসাবে গণনা করা হয়। স্বভাবতই সনদ লিপিবদ্ধকরণ প্রক্রিয়ায় কয়েকহাজার মূল হাদীস কয়েক লক্ষে পরিগণিত হয়। বাছাই প্রক্রিয়ায় ত্রুটিপূর্ণ ও দুর্বল সনদের হাদীসগুলি প্রথমেই বাদ পড়ে এবং বিশুদ্ধ প্রমাণিত হাদীসের একাধিক সনদকে আলাদা করে না দেখানোর কারণে (মূলত পুসত্দকের কলেবর বহুগুণ বড় হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকায়) হাদীস গ্রন্থে, বিশেষত বিশুদ্ধ বুখারী সংকলনে হাদীসের সংখ্যা কমে আসে। হাদীস বর্ণনাকারী মোট ‘রাবীর’ সংখ্যা ৮০ হাজার ৫ শত, তন্মধ্যে মাত্র চার হাজার চারশত জন নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত হন। আর ইমাম বুখারীর মতে নির্ভরযোগ্য রাবীর সংখ্যা তিন হাজার আট শতের মত।
হাদীস বিশারদগণ তাদের বাছাই প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত রূপ দিতে গিয়ে হাদীসের মান আনুযায়ী হাদীসকে বহু স্তরে এবং বহু ভাগে বিভক্ত করেছেন। (বিস্তারিত জানার জন্য বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ইত্যাদি গ্রন্থের প্রথম খন্ড দ্রষ্টব্য)। তন্মধ্যে মূল বিভাগগুলি নিম্নরূপ :
১। সহীহ্ বা বিশুদ্ধ: - সত্য ও বিশুদ্ধতার মাপকাঠিতে যে সকল হাদীস সকল ক্ষেত্রেই উত্তীর্ণ ও সন্দেহাতীত। যেমন সহীহ্ বুখারী। কেবল এই শ্রেণীর হাদীসই ইসলামী তথা শরী’আর আইন কানুন তৈরীতে প্রযোজ্য, অন্য কোন স্তরের হাদীস প্রযোজ্য নয়।
২। হাসান (ভাল): - এই স্তরের হাদীসগুলিকে বলা হয় প্রায় বিশুদ্ধ, অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর হাদীস রূপে মেনে নেওয়া যায়। তবে এইগুলিকে কেবল এই কারণেই সন্দেহাতীত ও বিশুদ্ধ হিসাবে গণ্য করা হয় না যে, হাদীসের বর্ণনাকারীদের মধ্যে কোন একজনের স্মৃতিশক্তি পূর্ণ মানসম্মত ছিল না, অর্থাৎ বর্ণনায় ভুল থাকতে পারে।
৩। যয়ীফ (দুর্বল):- যে সকল হাদীসের বিশুদ্ধ হিসাবে গণ্য হওয়ার মত গুণাবলীর অভাব আছে, তবে মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয় নাই। এসকল হাদীস ব্যক্তিগত পর্যায়ে অভ্যাস করা যায়, তবে মুসলিম সমাজের জন্য প্রযোজ্য (শরী’আ) আইন প্রণয়নে ব্যবহার করা হয় না। বুখারী ও মুসলিম (রঃ) তাঁদের সংকলনে এই স্তরের হাদীসকে আদৌ স্থান দেন নি। (তিরমিজি স্থান দিয়েছেন, তবে দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন)।
৪। আর বাদ বাকী সকল হাদীসকে বর্ণনাকারীর বিভিন্ন রকম চারিত্রিক, মানসিক বা অভ্যাসগত দুর্বলতার কারণে ত্রুটিপূর্ণ, উপেক্ষণীয়, বর্জনীয় অথবা সরাসরি জাল বা মিথ্যা হাদীসরূপে বহুবিধ স্তর ও উপ-স্তরে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, কোন ইমামই এমন দাবী করেন নি যে, তাদের বিচারে/বাছাইয়ে বাদ পড়ে যাওয়া সকল হাদীসই অশুদ্ধ ছিল, বরং অনেক প্রকৃত হাদীসও সেসবের বর্ণনাকারীর বর্ণনা বা পরিচয়ের দুর্বলতার কারণে গৃহীত হয়নি। আর বিশুদ্ধতা যাচাইয়ে কঠোর নিয়ম পালন না করলে তো দুর্বল হাদীসের সাথে যে-কোন লোকের বক্তব্যই হাদীস হিসাবে বিবেচিত হওয়ার সুযোগ থাকত। সুতরাং সুন্নী মুসলিম সমাজে সার্বজনীনভাবে যে-সকল হাদীস বিশুদ্ধ হিসাবে স্বীকৃত, সে-সকল হাদীস নিয়ে কোন রকম বিভ্রান্তির আদৌ কোন অবকাশ নেই। একজন মুসলমানের জন্য কুরআন ও বিশুদ্ধ হাদীসের বাইরে কোন মৌলিক নির্দেশ খোঁজার প্রয়োজনই নেই। একারণে সন্দেহাতীত নয় এমন হাদীসের প্রতি বাড়তি আকর্ষণ দেখানোরও যৌক্তিকতা নেই।
হাদীস সংকলনকারী ইমামগণের সময়কাল (হিজরী সন)
ইমাম বুখারী ১৯৪-২৫৬ হিজরী
মুসলিম ২০৪-২৬১ হিজরী
তিরমিযী মৃত্যুসাল – ২৭৯ হিজরী
আবু দাউদ মৃত্যুসাল – ২৭৫ হিজরী
ইব্ন মাজাহ মৃত্যুসাল – ২৭৩ হিজরী
দারিমী মৃত্যুসাল – ২৫৫ হিজরী
নাসায়ী মৃত্যুসাল- ৩০৩ হিজরী
দারাকুতনী মৃত্যুসাল – ৩৮৫ হিজরী
বাইহাকী মৃত্যুসাল – ৪৫৮ হিজরী
ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর ও উপকারী পোষ্ট দেয়ার জন্য। পিস ইন ইসলামে আপনাকে স্বাগতম।
জাযাকাল্লাহ।
আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
সুন্দর এবং উপকারী পোষ্ট। যাহারা কথায় কথায় যহীফ জাল কিংবা বর্ননাকারী দুর্বল বলেন তাদের জানা জন্য সহজ একটি প্রমান থাকলো। ধন্যবাদ লেখককে।