লগইন রেজিস্ট্রেশন

শাবানের মধ্যরজনীর ফযীলত সম্পর্কিত হাদীসসমূহের পর্যালোচনা

লিখেছেন: ' shovoon' @ বুধবার, জুলাই ১৩, ২০১১ (৫:৩৩ অপরাহ্ণ)

১ নং হাদীস
ইমাম তিরমিযী (রহঃ) বলেনঃ আমাদের কাছে আহমাদ ইবনে মুনী’ হাদীস বর্ণনা করেছেন যে তিনি ইয়াযীদ ইবনে হারূন থেকে, তিনি হাজ্জাজ ইবনে আরতাহ থেকে, তিনি ইয়াহইয়া ইবনে আবি কাসির থেকে, তিনি উরওয়াহ থেকে, তিনি উম্মুল মু’মিনীন আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে তিনি বলেছেনঃ আমি এক রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিছানায় পেলাম না তাই আমি তাকে খুঁজতে বের হলাম, ‘বাকী’ নামক কবরস্থানে তাকে পেলাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তুমি কি আশংকা করেছো যে আল্লাহ ও তার রাসূল তোমার সাথে অন্যায় আচরণ করবেন?
আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমি মনে করেছি আপনি আপনার অন্য কোন স্ত্রীর কাছে গিয়েছেন। তিনি বললেনঃ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন, অতঃপর কালব গোত্রের পালিত বকরীর পশমের পরিমানের চেয়েও অধিক পরিমান লোকদের ক্ষমা করেন।
ইমাম তিরমিযী বলেনঃ আয়িশা (রাঃ) এর এই হাদীস আমি হাজ্জাজের বর্ণিত সনদ (সূত্র) ছাড়া অন্য কোনভাবে চিনি না। আমি মুহাম্মাদকে (ইমাম বুখারী) বলতে শুনেছি যে, তিনি হাদীসটিকে দুর্বল বলতেন। তিরমিযী (রহঃ) বলেন ঃ ইয়াহ্‌ইয়া ইবনে কাসীর উরওয়াহ থেকে হাদীস শুনেননি। এবং মুহাম্মদ (ইমাম বুখারী) বলেছেনঃ হাজ্জাজ ইয়াহ্‌ইয়াহ ইবনে কাসীর থেকে শুনেননি।
এ হাদীসটি সম্পর্কে ইমাম বুখারী ও ইমাম তিরমিযীর মন-ব্যে প্রমাণিত হয় যে, হাদীসটি দুটো দিক থেকে মুনকাতি অর্থাৎ উহার সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন।
অপর দিকে এ হাদীসের একজন বর্ণনাকারী হাজ্জাজ ইবনে আরতাহ মুহাদ্দিসীনদের নিকট দুর্বল বলে পরিচিত।

সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! যারা শবে বরাতের বেশী বেশী ফাযীলাত বয়ান করতে অভ্যস- তারা তিরমিযী বর্ণিত এ হাদীসটি খুব গুরুত্বের সাথে উপস্থাপন করেন অথচ যারা হাদীসটির অবস্থা সম্পর্কে ভাল জানেন তাদের এ মন্তব্য গ্রহণ করতে চাননা। এ হাদীসটি ‘আমলের ক্ষেত্রে পরিত্যাজ্য হওয়ার জন্য ইমাম তিরমিযীর এ মন-ব্যটুকু কি যথেষ্ট নয়? যদি তর্কের খাতিরে এ হাদীসটিকে বিশুদ্ধ বলে ধরে নেয়া হয় তাহলে কি প্রমাণিত হয়? আমরা যারা ঢাকঢোল পিটিয়ে মাসজিদে একত্র হয়ে যেভাবে শবে বরাত উদযাপন করি তাদের ‘আমলের সাথে এ হাদীসটির মিল কোথায়?
বরং এ হাদীসে দেখা গেল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিছানা ছেড়ে চলে গেলেন, আর পাশে শায়িত আয়িশা (রাঃ) কে ডাকলেন না। ডাকলেন না অন্য কাউকে। তাকে জাগালেন না বা সালাত আদায় করতে বললেন না। অথচ আমরা দেখতে পাই যে, রামাযানের শেষ দশকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে রাত জেগে ইবাদাত-বন্দেগী করতেন এবং পরিবারের সকলকে জাগিয়ে দিতেন। বেশী পরিমাণে ইবাদাত-বন্দেগী করতে বলতেন। যদি ১৫ শাবানের রাতে কোন ইবাদাত করার ফাযীলাত থাকত তাহলে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেন আয়িশাকে (রাঃ) বললেন না? কেন রামাযানের শেষ দশকের মত সকলকে জাগিয়ে দিলেন না, তিনি তো নেক কাজের প্রতি মানুষকে আহ্বান করার ক্ষেত্রে আমাদের সকলের চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি তো কোন অলসতা বা কৃপণতা করেননি।

২ নং হাদীস
আলা ইবনে হারিস থেকে বর্ণিত, আয়িশা (রাঃ) বলেন ঃ এক রাতে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করছিলেন। সিজদাহ এত দীর্ঘ করলেন যে, আমি ধারণা করলাম তিনি ইন্তেকাল করেছেন। আমি এ অবস্থা দেখে দাড়িয়ে তার বৃদ্ধাঙ্গুল ধরে নাড়া দিলাম, আঙ্গুলটি নড়ে উঠল। আমি চলে এলাম। সালাত শেষ করে তিনি বললেন ঃ হে আয়িশা অথবা বললেন হে হুমায়রা! তুমি কি মনে করেছ আল্লাহর নবী তোমার সাথে বিশ্বাস ভংগ করেছেন? আমি বললাম ঃ আল্লাহর কসম হে রাসূল! আমি এমন ধারণা করিনি। বরং আমি ধারণা করেছি আপনি না জানি ইনে-কাল করলেন! অতঃপর তিনি বললেন ঃ তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম ঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভাল জানেন। তিনি বললেনঃ এটা মধ্য শাবানের রাত। এ রাতে আল্লাহ তা’আলা তার বান্দাদের প্রতি মনোনিবেশ করেন। ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং রাহমাত প্রার্থনাকারীদের রহম করেন। আর হিংসুকদেরকে তাদের অবস্থার উপর ছেড়ে দেন। (বাইহাকী তার শুয়াবুল ঈমান কিতাবে বর্ণনা করেছেন)
হাদীসটি মুরসাল। সহীহ বা বিশুদ্ধ নয় । কেননা বর্ননাকারী ‘আলা’ আয়িশা (রাঃ) থেকে শুনেননি।

৩ নং হাদীস
অর্থঃ আলী ইবনে আবী তালেব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ঃ যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন তোমরা রাত জেগে সালাত আদায় করবে আর দিবসে সিয়াম পালন করবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা সূর্যাস্তের পর দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করে বলেন ঃ আছে কি কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিয্‌ক প্রার্থনাকারী আমি রিয্‌ক দান করব। আছে কি কোন বিপদে নিপতিত ব্যক্তি আমি তাকে সুস্থতা দান করব। এভাবে ফজর পর্যন্ত- বলা হয়ে থাকে। (ইবনে মাজাহ ও বাইহাকী)
প্রথমতঃ এ হাদীসটি দুর্বল। কেননা এ হাদীসের সনদে (সূত্রে) ইবনে আবি সাবুরাহ নামে এক ব্যক্তি আছেন, যিনি অধিকাংশ হাদীস বিশারদের নিকট হাদীস জালকারী হিসাবে পরিচিত। এ যুগের বিখ্যাত মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দীন আল-বানী (রহঃ) বলেছেন, হাদীসটি সনদের দিক দিয়ে একেবারেই দুর্বল।
দ্বিতীয়তঃ অপর একটি সহীহ হাদীসের বিরোধী হওয়ার কারণে এ হাদীসটি গ্রহণযোগ্য নয়। সে সহীহ হাদীসটি হাদীসে নুযুল নামে পরিচিত, যা ইমাম বুখারী ও মুসলিম তাদের কিতাবে বর্ণনা করেছেন। হাদীসটি হল ঃ

অর্থঃ আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আমাদের রব আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকী থাকতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন ও বলতে থাকেনঃ কে আছ আমার কাছে দু‘আ করবে আমি কবুল করব। কে আছ আমার কাছে চাইবে আমি দান করব। কে আছ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করব। (বুখারী ও মুসলিম)
আর উল্লিখিত ৩ নং হাদীসের বক্তব্য হল আল্লাহ তা‘আলা মধ্য শাবানের রাতে নিকটতম আকাশে আসেন ও বান্দাদের দু‘আ কবুলের ঘোষণা দিতে থাকেন। কিন’ বুখারী ও মুসলিম বর্ণিত এই সহীহ হাদীসের বক্তব্য হল আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের শেষের দিকে নিকটতম আকাশে অবতরণ করে দু‘আ কবুলের ঘোষণা দিতে থাকেন। আর এ হাদীসটি সর্বমোট ৩০ জন সাহাবী বর্ণনা করেছেন এবং বুখারী এবং মুসলিম ও সুনানের প্রায় সকল কিতাবে এসেছে। তাই হাদীসটি প্রসিদ্ধ। অতএব এই মশহুর হাদীসের বিরোধী হওয়ার কারণে ৩ নং হাদীসটি পরিত্যাজ্য হবে।
কেহ বলতে পারেন যে, এই দু হাদীসের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। কারণ ৩ নং হাদীসের বক্তব্য হল আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন মধ্য শাবানের রাতের শুরু থেকে। আর এ হাদীসের বক্তব্য হল প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। অতএব দু হাদীসের মধ্যে কোন বিরোধ নেই যে কারণে ৩ নং হাদীসকে পরিত্যাগ করতে হবে।
আমি বলব আসলেই এ দু হাদীসের মধ্যে বিরোধ আছে। কেননা আবূ হুরাইরা (রাঃ) বর্ণিত বুখারী ও মুসলিমের হাদীসের বক্তব্য হল আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের শেষ অংশে দুনিয়ার আকাশে আসেন। আর প্রতি রাতের মধ্যে শাবান মাসের পনের তারিখের রাতও অন-র্ভুক্ত। অতএব এ হাদীস মতে অন্যান্য রাতের মত শাবান মাসের পনের তারিখের রাতের শেষ তৃতীয়াংশে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে আসেন। কিন’ ৩ নং হাদীসের বক্তব্য হল শাবান মাসের পনের তারিখের রাতের প্রথম প্রহর থেকে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন।

৪ নং হাদীস
অর্থঃ উসমান ইবনে আবিল আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা দেয়ঃ আছে কি কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কেহ কিছু চাইবার আমি তাকে তা দিয়ে দিব। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ মুশরিক ও ব্যভিচারী বাদে সকল প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা কবুল করা হয়। (বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান)
বিখ্যাত মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দীন আল-বানী (রহঃ) হাদীসটিকে তার সংকলন ‘যয়ীফ আল-জামে’ নামক কিতাবের ৬৫২ নং ক্রমিকে দুর্বল প্রমাণ করেছেন।
শবে বরাত সম্পর্কে এ ছাড়া বর্ণিত অন্যান্য সকল হাদীস সম্পর্কে ইবনে রজব হাম্বলী (রহঃ) বলেনঃ এ মর্মে বর্ণিত অন্য সকল হাদীসই দুর্বল।
শাবানের মধ্যরজনীর সম্পর্কিত হাদীসসমূহ পর্যালোচনার সারকথা
শবে বরাত সম্পর্কিত হাদীসগুলো উল্লেখ করা হল। আমি মনে করি এ সম্পর্কে যত হাদীস আছে তা এখানে এসেছে। বাকী যা আছে সেগুলোর অর্থ বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত। এ সকল হাদীসের দিকে লক্ষ্য করে আমরা কয়েকটি বিষয় স্পষ্টভাবেই বুঝে নিতে পারি।
(১) এ সকল হাদীসের কোন একটি দ্বারাও প্রমাণিত হয়নি যে, ১৫ শাবানের রাতে আল্লাহ তা’আলা আগামী এক বছরে যারা ইনে-কাল করবে, যারা জন্ম গ্রহণ করবে, কে কি খাবে সেই ব্যাপারে ফায়সালা করেন। যদি থাকেও তাহলে তা আল-কুরআনের বক্তব্যের বিরোধী হওয়ায় তা গ্রহণ করা যাবে না। কারণ আল-কুরআনের স্পষ্ট কথা হল এ বিষয়গুলির ফায়সালা হয় লাইলাতুল কদরে।
(২) এ সকল হাদীসের কোথাও বলা হয়নি যে, এ রাতে মৃত ব্যক্তিদের আত্মা তাদের গৃহে আসে। বরং এটি একটি প্রচলিত বানোয়াট কথা। মৃত ব্যক্তির আত্মা কোন কোন সময় গৃহে ফিরে আসার ধারণাটা হিন্দুদের ধর্ম-বিশ্বাস।
(৩) এ সকল হাদীসের কোথাও এ কথা নেই যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরাম এ রাতে গোসল করেছেন, মাসজিদে উপসি’ত হয়ে নফল সালাত আদায় করেছেন, যিক্‌র-আযকার করেছেন, কুরআন তিলাওয়াত করেছেন, সারারাত জাগ্রত থেকেছেন, ওয়াজ নাসীহাত করেছেন কিংবা অন্যদের এ রাতে ইবাদাত বন্দেগীতে উৎসাহিত করেছেন অথবা শেষ রাতে জামাতের সাথে দু’আ-মুনাজাত করেছেন।
(৪) এ হাদীসসমূহের কোথাও এ কথা নেই যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) এ রাতের সাহরী খেয়ে পরের দিন সিয়াম (রোযা) পালন করেছেন।
(৫) আলোচিত হাদীসসমূহে কোথাও এ কথা নেই যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা সাহাবায়ে কিরাম এ রাতে হালুয়া-রুটি বা ভাল খানা তৈরী করে বিলিয়েছেন, বাড়ীতে বাড়ীতে যেয়ে মীলাদ পড়েছেন।
(৬) এ সকল হাদীসের কোথাও নেই যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা সাহাবায়ে’ কিরাম (রাঃ) এ রাতে দলে দলে কবরস’ানে গিয়ে কবর যিয়ারত করেছেন কিংবা কবরে মোমবাতি জ্বালিয়েছেন।
এমনকি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগ বাদ দিলে খুলাফায়ে রাশেদীনের ত্রিশ বছরের ইতিহাসেও কি এর কোন একটা ‘আমল পাওয়া যাবে?
যদি না যায় তাহলে শবে বরাত সম্পর্কিত এ সকল ‘আমল ও আকীদা কি বিদ’আত নয়? এ বিদ’আত সম্পর্কে উম্মাতে মুহাম্মাদীকে সতর্ক করার দায়িত্ব কারা পালন করবেন? এ দায়িত্ব পালন করতে হবে আলেম-উলামাদের, দ্বীন প্রচারক, মাসজিদের ইমাম ও খতীবদের। যে সকল বিষয়ে কুরআন ও সহীহ হাদীসের ইশারা নেই সে সকল ‘আমল থেকে সাধারণ মুসলিম সমাজকে বিরত রাখার দায়িত্ব পালন করতে হবে নবী-রাসূলগণের উত্তরসূরীদের।

ভাগ্য লিপিবদ্ধ করা সম্পর্কিত একটি হাদীস ও উহার পর্যালোচনা
অনেকে বলে থাকেন শবে বরাতে সৌভাগ্য বা এক বছরের তাকদীর লেখা সম্পর্কিত কোন হাদীস নেই বলে যে দাবী করা হয় তা সঠিক নয়। ‘মিশকাত আল-মাসাবীহ’ কিতাবে এ সম্পর্কে হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে।
পাঠকগণের অবগতির জন্য উক্ত হাদীসটির পর্যালোচনা নিম্নে তুলে ধরলাম।
হাদীসটি হলঃ
আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ তুমি কি জানো এটা (অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত) কোন্‌ রাত? তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! এ রাতে কি রয়েছে? তিনি বললেনঃ এ রাতে এই বছরে যে সকল মানব-সন্তান জন্ম গ্রহণ করবে তাদের ব্যাপারে লিপিবদ্ধ করা হয়, যারা মৃত্যু বরণ করবে তাদের তালিকা তৈরী হয়, এ রাতে ‘আমলসমূহ পেশ করা হয়, এ রাতে রিয্‌ক নাযিল করা হয়।
আলোচ্য হাদীসটি আল-মিশকাতুল মাসাবীহ কিতাবে ‘রামাযান মাসে কিয়াম’ (রামাযান মাসের রাতের সালাত) অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
তিনি লিখেছেন যে, ইমাম বাইহাকী (রঃ) তার ‘আদ-দাওআত আল-কাবীর’ গ্রনে’ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। হাদীসটির পর্যালোচনা নিম্নে তুলে ধরলামঃ
(এক) উল্লিখিত হাদীসে ‘অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত’ বাক্যটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা নয়। এ বাক্যটি পরবর্তী কালের বর্ণনাকারীর নিজস্ব বক্তব্য বলে। আর আয়িশা (রাঃ) এমন কোন অজ্ঞ মহিলা ছিলেন না যে তাকে তারিখ বলে দিতে হবে।
(দুই) এ হাদীসে বর্ণিত ‘অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত’ কথাটি আয়িশার (রাঃ) বক্তব্য নয়। কারণ তার বক্তব্য শুরু হয়েছে ‘তিনি জিজ্ঞেস করলেন’ বাক্যটির পর। তাহলে এ বক্তব্যটি কার? এ বক্তব্যটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আয়িশা (রাঃ) ব্যতীত অন্য কোন বর্ণনাকারীর নিজস্ব মন্তব্য, যা মেনে নেয়া আমাদের জন্য যরুরী নয়।
(তিন) এ হাদীসের বিষয়বস’র দিকে তাকালে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, হাদীসে ভাগ্য লেখার বিষয়টি লাইলাতুল কদরের সাথে সম্পর্কিত। কেননা জন্ম, মৃত্যু, আমল পেশ, রিয্‌ক ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী রামাযান মাসে লাইলাতুল কদরে স্থির করা হয়। এ কথা যেমন কুরআনের একাধিক আয়াত দ্বারা প্রমাণিত তেমনি বহু সংখ্যক সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
(চার) আল-মিশকাত আল-মাসাবীহর সংকলক বিষয়টি ভালভাবে বুঝেছেন বলে তিনি হাদীসটিকে রামাযান মাসের সালাত (কিয়ামে শাহরি রামাযান) অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। বুঝা গেল যে, তার মত হল হাদীসটি রামাযান মাসের লাইলাতুল কদর সম্পর্কিত। যদি তিনি বুঝতেন যে, হাদীসটি মধ্য শাবানের তাহলে তিনি তা রামাযান মাসের অধ্যায়ে আলোচনা করবেন কেন?
(পাঁচ) এ হাদীসটি আল-মিশকাত আল-মাসাবীহর সংকলক উল্লেখ করার পর বলেছেন, তিনি হাদীসটি ইমাম বাইহাকীর ‘আদ-দাওআত আল-কাবীর’ কিতাব থেকে নিয়েছেন।
ইমাম বাইহাকী তার ‘আদ-দাওআত আল-কাবীর’ গ্রনে’ শবে বরাত সম্পর্কে মাত্র দুটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। তার একটি হল এই হাদীস। তিনি তার শুআবুল ঈমান গ্রন্থে শবে বরাত সম্পর্কিত এই বইয়ে আলোচিত একটি হাদীস উল্লেখ করার পর লিখেছেনঃ
এ বিষয়ে বহু মুনকার হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যার বর্ণনাকারীরা অপরিচিত। আমি তা থেকে দুটি হাদীস আদ-দাওআত আল-কাবীর’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছি।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! তাহলে ফলাফল দাড়াল কি? ইমাম বাইহাকীর এ কথায় যা প্রমাণিত হলঃ
(১) শবে বরাত সম্পর্কে অনেক মুনকার (অগ্রহণযোগ্য) হাদীস রয়েছে।
(২) আদ-দাওআত আল-কাবীর গ্রন্থে শবে বরাত সম্পর্কে বর্ণিত হাদীস দুটি মুনকার।
(৩) তাই আলোচ্য হাদীসটি হাদীসে মুনকার।
(৪) তিনি আদ-দাওআত আল-কাবীর গ্রন্থটি আগে সংকলন করেছেন, তারপরে শুআবুল ঈমান সংকলন করেছেন। এ কারণে তিনি পরবর্তী কিতাবে আগের কিতাবের ভুল সম্পর্কে পাঠকদের সতর্ক করেছেন। এটা তার আমানতদারী ও বিশ্বস-তার একটি বড় প্রমাণ।
(৫) মুনকার হাদীস আমলের জন্য গ্রহণ করা যায় না।
(৬) যিনি হাদীসটি আমাদের কাছে পৌছিয়েছেন তিনি নিজেই যখন হাদীসটি গ্রহণযোগ্য নয় বলে মতামত দিয়েছেন তখন আমরা তা সঠিক বলে গ্রহণ করব কেন?

Processing your request, Please wait....
  • Print this article!
  • Digg
  • Sphinn
  • del.icio.us
  • Facebook
  • Mixx
  • Google Bookmarks
  • LinkaGoGo
  • MSN Reporter
  • Twitter
৫৮৫ বার পঠিত
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars ( ভোট, গড়:০.০০)

৭ টি মন্তব্য

  1. আপনি হাদিস সম্বন্ধে যে মন্তব্য দিলেন সেটার রেফারেন্স দিলে ভালো হোতো।

  2. বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শাবান ও শবেবরাত – মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক – পরিচালক, উচ্চতর ইসলামি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘মারকাযুদ দাওয়া’ – সম্পাদক, মাসিক আল কাউসার

    এতদিন পর্যন্ত শবে বরাতকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণীর মানুষ বাড়াবাড়িতে লিপ্ত ছিল। তারা এ রাতটি উপলক্ষে নানা অনুচিত কাজকর্ম এবং রসম-রেওয়াজের অনুগামী হচ্ছিল। উলামায়ে কেরাম সবসময়ই সবের প্রতিবাদ করেছেন এবং এখনো করছেন। ইদানিং আবার এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ছাড়াছাড়ির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তাদের দাবী হল ইসলামে শবে বরাতের কোন ধারণা নেই। এ ব্যাপারে যত রেওয়ায়েত আছে সব মওযু বা যয়ীফ। এসব অনুযায়ী আমল করা এবং শবে বরাতকে বিশেষ কোন ফযীলতপূর্ণ রাত মনে করা শরীয়তের দৃষ্টিতে জায়েয নয়। তারা এসব বক্তব্য সম্বলিত ছোটখাট পুস্তিকা ও লিফলেট তৈরী করে মানুষের মধ্যে বিলি করে।

    বাস্তব কথা হল, আগেকার সেই বাড়াবাড়ির পথটিও যেমন সঠিক ছিল না, এখনকার এই ছাড়াছাড়ির মতটিও শুদ্ধ নয়। ইসলাম ভারসাম্যতার দ্বীনএবং এর সকল শিক্ষাই প্রান্তকতা মুক্ত সরল পথের পথ নির্দেশ করে। শবে বরাতের ব্যপারে সঠিক ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান হল, এ রাতের ফযীলত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। সম্মিলিত কোর রূপ না দিয়ে এবং এই রাত উদযাপনের বিশেষ কোন পন্থা উদ্ভাবন না করে বেশি ইবাদত করাও নির্ভরযোগ্য রেওয়াত দ্বারা প্রমাণিত। এই রাতকে অন্য সব সাধারণ রাতের মতো মনে করা এবং এই রাতের ফযীলতের ব্যাপারে যত হাদীস এসেছে, তার সবগুলোকে মওযু বা যয়ীফ মনে করা ভুল যেমন অনুরূপ এ রাতকে শবে কদরের মত বা তার চেয়েও বেশি ফযীলতপূর্ণ মনে করাও ভিত্তিহীন ধারণা।

    এখানে শবে বরাতের (পনের শাবানের রাত) ফযীলত ও করণীয় বিষয়ক কিছু হাদীস যথাযথ উদ্ধৃতি ও সনদের নির্ভরযোগ্যতার বিবরণ সহ উল্লেখ করা হল।

    ১ম হাদীসঃ

    عن مالك من يخامر , عن معاذ بن جبل, عن النبى (, قال : يطلع الله الى خلقه فى ليلة النصف من شعبان, فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مشاحن ]رواه ابن حبان وغيره, ورجاله ثقات, وإسناده متصل غلى مذهب مسلم الذى هو مذهب الحمهورفى المعنعن, ولم يحزم الذهبى بأن مكحولالم يلق مالك بن يخامر كما زعم, وإنما قاله على سبيل الحسان, راجع ,سبر أعلام النبلاء [

    মুআয ইবনে জাবাল বলেন, নবী করীম স. ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন।

    এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, এ রাতে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে রহমত ও মাগফেরাতের দ্বারা ব্যপকভাবে উন্মুক্ত হয়। কিন্তু শিরকি কাজ-কর্মে লিপ্ত ব্যক্তি এবং অন্যের ব্যাপারে হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী মানুষ এই ব্যপক রহমত ও সাধারণ ক্ষমা থেকেও বঞ্চিত থাকে। যখন কোন বিশেষ সময়ের ব্যাপারে আল্লাহ তাঞ্চআলার পক্ষ থেকে রহমত ও মাগফেরাত ঘোষণা হয়, তখন তার অর্থ এই হয় যে, এই সময় এমন সব নেক আমলের ব্যাপারে যত্নবান হতে হবে যার মাধ্যমে আল্লাহর রহমত ও মাগফেরাতের উপযুক্ত হওয়া যায় এবং ঐ সব গুণাহ থেকে বিরত থাকতে হবে। এ কারণে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে রহমত ও মাগফেরাত থেকে বঞ্চিত হয়।

    যেহেতু উপরোক্ত হাদীস এবং অন্যান্য হাদীসে অর্ধ-শাবানের রাতে ব্যাপক মাগফেরাতের গোষণা এসেছে, তাই এ রাতটি অনেক পূর্ব থেকেই শবে বরাত তথা মুক্তির রজনী নামে প্রসিদ্ধ হয়েছে। কেননা, এ রাতে গুনাহসমূহ থেকে মুক্তি লাভ হয় এবং পাপের অশুভ পরিণাম থেকে রেহাই পাওয়া যায়।

    যদি শবে বরাতের ফযীলতের ব্যাপারে দ্বিতীয় কোন হাদীস না থাকত, তবে এই হাদীসটিই এ রাতের ফযীলত সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এবং এ রাতে মাগফেরাতের উপযোগী নেক আমলের গুরুত্ব প্রমাণিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট হত। অথচ হাদীসের কিতাবসমূহে নির্ভরযোগ্য সনদে এ বিষয়ক আরো একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে।

    হাদীসটির সনদ বিষয়ক আলোচনা

    উপরোক্ত হাদীসটি অনেক নির্ভরযোগ্য হাদীসের কিতাবেই নির্ভরযোগ্য সনদের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে হিব্বান তার জ্ঞকিতাবুস সহীহঞ্চ এ (যা সহীহ ইবনে হিব্বান নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ, ১৩/৪৮১ এ) এই হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। এটি এই কিতাবের ৫৬৬৫ নং হাদীস। এ ছাড়া ইমাম বাইহাকী (রহঃ) জ্ঞশুআবুল ঈমানঞ্চ এ (৩/৩৮২, হাদীস ৩৮৩৩); ইমাম তাবরানী জ্ঞআলজ্ঞমুজামুল কাবীরঞ্চ ও জ্ঞআলজ্ঞমুজামুল আওসাতঞ্চ এ বর্ণনা করেছেন। এ ছাড়াও আরো বহু হাদীসের ইমাম তাদের নিজ নিজ কিতাবে হাদীসটি উল্লেখ করেছেন।

    হাদীসটির সনদ সহীহ। এজন্যই ইমাম ইবনে হিব্বান একে জ্ঞকিতাবুস সহীহঞ্চ এ বর্ণনা করেছেন। কেউ কেউ হাদীসটিকে পারিভাষিক দৃষ্টিকোণ থেকে হাসান বলেছেন; কিন্তু হাসান হাদীন সহীহ তথা নির্ভরযোগ্য হাদীসেরই একটি প্রকার।

    ইমাম মনযিরী, ইবনে রজব, নূরুদ্দীন হাইসামী, কাস্‌তাল্লানী, যুরকানী এবং অন্যান্য হাদীস বিশারদ এই হাদীসটিকে আমলযোগ্য বলেছেন। দেখুন আততারগীব ওয়াততারহীব ২/১৮৮; ৩/৪৫৯. লাতায়েফুল মাআরিফ ১৫১; মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৮/৬৫; শারহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়্যা ১০/৫৬১।

    বর্তমান সময়ের প্রসিদ্ধ শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী (রহঃ) সিলসিলাতুল আহাদসিস্‌ সাহীহা ৩/১৩৫-১৩৯ এ এই হাদীসের সমর্থনে আরো আটটি হাদীস উল্লেখ করার পর লেখেনঃ

    وجملة القول أن الحديث بمجموع هذه الطرق صحيح بلاريب. والصحة تثبت بأقل منها عددا، مادامت سالمة من الضعف الشديد، كماهو الشأن فى هذاالحديث .

    এ সব রেওয়াতের মাধ্যমে সমষ্টিগত ভাবে এই হাদীসটি নিঃসন্দেহে সহীহ প্রমাণিত হয়।ঞ্চ তারপর আলবানী (রহঃ) ওই সব লোকের বক্তব্য খন্ডন করেন যারা কোন ধরণের খোঁজখবর ছাড়াই বলে দেন যে, শবে বরাতের ব্যাপারে কোন সহীহ হাদীস নেই।

    ইদানিং আমাদের কতক সালাফী বা গাইরে মুকাল্লিদ; বন্ধুকে দেখা যায়, তারা নানা ধরণের লিফলেট বিলি করেন। তাতে লেখা থাকে যে, শবে বরাত (লাইলাতুল নিস্‌ফি মিন শাবান) এর কোন ফযীলতই হাদীস শরীফে প্রমাণিত নেই। ওই সব বন্ধুরা শায়খ আলবানী (রহঃ) এর গবেষণা ও সিদ্ধান্ত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। কেননা, তাদেরকে আলবানী (রহঃ) এর বড় ভক্ত মনে হয় এবং তার কিতাবাদি অনুবাদ করে প্রচার করতে দেখা যায়। আমি ওই সব ভাইদের কাছে বিনীতভাবে আরজ করতে চাই যে, আপনারা যদি শায়খ ইবনে বাযের অনুসরণে বা নিজেদের তাহ্‌কীক মতো এই রাতের ফযীলতকে অস্বীকার করতে পারেন তাহলে যারা উপরোক্ত মুহাদ্দিস ও ফকীহগণের অনুসরণে উল্লেখিত হাদীসটির ভিত্তিতে এই রাতের ফযীলতের বিশ্বাস পোষণ করেন এবং সব ধরণের বেদআত রসম-রেওয়াজ পরিহার করে নেক আমলে মগ্ন থাকার চেষ্টা করেন তারাই এমন কি অপরাধ করে বসলেন যে, আপনাদেরকে তাদের পেছনে লেগে থাকতে হবে? এবং এখানকার উলামায়ে কেরামের দলীলভিত্তিক সিদ্ধান্তের বিপরীতে অন্য একটি মত যা ভুলের সম্ভাবনার উর্ধ্বে নয়, তা সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার করে তাদেরকে আলেম-উলামার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আস্থাহীন করা এবং বাতিলপন্থিদের মিশন সফল করতে সহায়তা দেওয়া কি সত্যিকার অর্থেই খুব বেশি প্রয়োজন? এতে তো কোন সন্দেহ নেই যে, আপনারা আপনাদের মতটিকে খুব বেশি হলে একটি ইজতেহাদী ভুল-ভ্রান্তির সম্ভাবনাযুক্তই মনে করেন এবং নিশ্চয়ই আপনারা আপনাদের মতটিকে একেবারে ওহীর মতো মনে করেন না। একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করুন, এরপর আপনাদের এই অবস্থানের যৌক্তিক কোন ব্যাখ্যা আর থাকে কি না?

    আপনাদের প্রতি আমার সর্বশেষ অনুরোধ এই যে, দয়া করে এ রাতের ফযীলত ও আমল সম্পর্কে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) [মৃ. ৭২৮ হিঃ] এর ইক্‌তিযাউস সিরাতিল মুস্তাকিম/৬৩১-৬৪১ এবং ইমাম যায়নুদ্দীন ইবনে রজব (রহঃ) [মৃ. ৭৯৫] এর লাতায়েফুল মাআরেফ ১৫১-১৫৭ পড়ুন এবং ভেবে দেখুন যে, তাদের এই দলীলনির্ভর তাহকীক অনুসরণযোগ্য, না শায়খ ইবনে বায (রহঃ) এর একটি আবেগপ্রসূত মতামত? যা হয়ত তিনি শবে বরাত নিয়ে জাহেল লোকদের বাড়াবাড়ির প্রতিকার হিসেবেই ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু এ কথা স্পষ্ট যে, বাড়াবাড়ির প্রতিকার কোন বাস্তব সত্য অস্বীকার করে নয়; বরং সত্য বিষয়টির যথাযথ উপস্থাপনের মাধ্যমেই হয়ে থাকে।

    এই রাতের আমল

    উল্লেখিত হাদীস শরীফে এ রাতের কী কী আমলের নির্দেশনা-ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তা আমি ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। নিম্নে এ বিষয়ে আরেকটি হাদীস পেশ করছি।

    হযরত আলা ইবনুল হারিস (রহঃ) থেকে বর্ণিত, হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (ক্ষ) রাতে নামাযে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হল তিনি হয়ত মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, জ্ঞহে আয়েশাঞ্চ অথবা বলেছেন, জ্ঞও হুমাইরা, তোমার কি এই আশংকা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন?ঞ্চ আমি উত্তরে বললাম, জ্ঞনা, ইয়া রাসূলুল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার এই আশংকা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা।ঞ্চ নবীজী জিঞ্চেস করলেন, জ্ঞতুমি কি জান এটা কোন রাত?ঞ্চ আমি বললাম, জ্ঞআল্লাহ ও তার রাসূলই ভাল জানেন।ঞ্চ রাসূলুল্লাহ (ক্ষ) তখন ইরশাদ করলেন,

    هذه ليلة النصف من شعبان ان الله عزو جل يطلع على
    عباده فى ليلة النصف من شعبان فيغفر للمستغفرين
    ويرحم المشترحمين ويؤخر اهل الحقد كماهم

    ‘এটা হল অর্ধ শাবানের রাত (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত)। আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তার বান্দার প্রতি মনযোগ দেন এবং ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।‘ [শুআবুল ঈমান, বাইহাকী ৩/৩৮২-৩৬৮]

    ইমাম বাইহাকী (রহঃ) এই হাদীসটি বর্ণনার পর এর সনদের ব্যাপারে বলেছেন,

    هذا مرسل جيد

    এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়, এ রাতে দীর্ঘ নফল পড়া, যাতে সেজদাও দীর্ঘ হবে, শরীয়তের দৃষ্টিতে কাম্য। তবে মনে রাখতে হবে যে, অনেক অনির্ভরযোগ্য ওয়ীফার বই-পুস্তকে নামাযের যে নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন লেখা আছে অর্থাৎ এত রাকআত হতে হবে, প্রতি রাকআতে এই সূরা এতবার পড়তে হবে – এগুলো ঠিক নয়। হাদীস শরীফে এসব নেই। এগুলো মানুষের মনগড়া পন্থা। সঠিক পদ্ধতি হল, নফল নামাযের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী দুই রাকআত করে যত রাকআত সম্ভব হয় পড়তে থাকা। কুরআন কারীম তেলওয়াত করা। দরূদ শরীফ পড়া। ইস্‌তেগফার করা। দুআ করা এবং কিছুটা ঘুমের প্রয়োজন হলে ঘুমানো। এমন যেন না হয় যে, সারা রাতের দীর্ঘ ইবাদতের ক্লান্তিতে ফজরের নামায জামাআতের সাথে পড়া সম্ভব হল না।

    পরদিন রোযা রাখা

    সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে ঃ

    عن على بن ابى طالب رضى الله عنه قال : قال رسول الله (() : إذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا نهارها, فإن الله ينزل فيهالغروب الشمس الى سماء الدنيا, فيقول : ألا من مستغفر فاغفر له على مستزرق فأرزقه, ألا مبتلى فأعافيه , ألا كذا, ألا كذا, حتى يطلع الفجر

    হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, জ্ঞপনের শাবানের রাত (চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগীতে কাটাও এবং দিনের বেলা রোযা রাখ। কেননা, এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে আসেন এবং বলেন, কোন ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিযিক প্রার্থী? আমি তাকে রিযিক দেব। এভাবে সুব্‌হে সাদিক পর্যন্ত আল্লাহ তাঞ্চআলা মানুষের প্রয়োজনের কথা বলে তাদের ডাকতে থাকেন।ঞ্চ [সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৩৮৪]

    এই বর্ণনাটির সনদ যয়ীফ। কিন্তু মহাদ্দিসীন কেরামের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হল, ফাযায়েলের ক্ষেত্রে যয়ীফ হাদীস গ্রহণযোগ্য। তাছাড়া শাবান মাসে বেশি বেশি নফল রোযা রাখার কথা সহীহ হাদীসে এসেছে এবং আইয়ামে বীয অর্থাৎ প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখার বিষয়টিও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।

    এলা বাহুল্য, পনের শাবানের দিনটি শাবান মাসেরই একটি দিন এবং তা আয়্যামে বীযের অন্তর্ভূক্ত। এজন্য ফিক্‌হের একাধিক কিতাবেই এদিনে রোযাকে মুস্তাহাব বা মাসনূন লেখা হয়েছে। আবার অনেকে বিশেষভাবে এ দিনের রোযাকে মুস্তাহাব বা মাসনুন বলতে অস্বীকার করেছেন। এ প্রসঙ্গে হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ত্বাকী উসমানী (দাঃবাঃ) তার ইসলাহী খুতুবাতে বলেন, ‘আরো একটি বিষয় হচ্ছে শবে বরাতের পরবর্তী দিনে অর্থাৎ শাবানের পনের তারিখে রোযা রাখা। গভীরভাবে বিষয়টি উপলব্ধি করা প্রয়োজন। হাদীসে রাসুলের বিশাল ভান্ডার হতে একটি মাত্র হাদীস এর সমর্থনে পাওয়া যায়। তাতে বলা হয়েছে, জ্ঞশবে বরাতের পরবর্তী দিনটিতে রোযা রাখ।‘ সনদ বর্ণনার সূত্রের দিক থেকে হাদীসটি দুর্বল। তাই এ দিনের রোযাকে এই একটি মাত্র দুর্বল হাদীসের দিকে তাকিয়ে সুন্নাত বা মুস্তাহাব বলে দেওয়া অনেক আলেমের দৃষ্টিতে অনুচিত।’

    তবে হ্যাঁ, শাবানের গোটা মাসে রোযা রাখার কথা বহু হাদীসে পাওয়া যায়। অর্থাৎ ১ শাবান থেকে ২৭ শাবান পর্যন্ত রোযা রাখার যথেষ্ট ফযীলত রয়েছে। কিন্তু ২৮ ও ২৯ তারিখে রোযা রাখতে রাসূলুল্লাহ (() নিজেই বারণ করেছেন। ইরশাদ করেন, জ্ঞরমযানের দুঞ্চএকদিন পূর্বে রোযা রেখো না।ঞ্চ যাতে রমযানের পূর্ণ স্বস্তির সাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রস্তুতি নেওয়া যায়। কিন্তু ২৭ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিনের রোযাই অত্যন্ত বরকতপূর্ণ।

    একটি লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হচ্ছে যে, শাবানের এই ১৫ তারিখটি তো ‘আইয়ামে বীয’ এর অন্তর্ভূক্ত। আর নবীজী প্রতি মাসের জ্ঞআইয়ামে বীযঞ্চ এ রোযা রাখতেন। সুতরাং যদি কোন ব্যক্তি এই দুটি কারণকে সামনে রেখে শাবানের ১৫ তারিখের দিনে রোযা রাখে যা জ্ঞআইয়ামে বীযঞ্চ এর অন্তর্ভূক্ত, পাশাপাশি শাবানেরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন, তবে ইনশাআল্লাহ নিশ্চয়ই সে প্রতিদান লাভ করবে। তবে শুধু ১৫ মাবানের কারণে এ রোযাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে সুন্নাত বলে দেওয়া অনেক আলেমের মতেই সঠিক নয়। আর সে কারণেই অধিকাংশ ফুকাহায়ে কেরাম মুস্তাহাব রোযার তালিকায় মুহাররমের ১০ তারিখ ও আইয়ামে আরাফা (যিলহজ্জের ৯ তারিখ) এর কথা উল্লেখ করেছেন অথচ শাবানের ১৫ তারিখের কথা পৃথকভাবে কেউই উল্লেখ করেননি। বরং তারা বলেছেন, শাবানের যে কোন দিনই রোযা রাখা উত্তম। সুতরাং এ সকল বিষয়ের দিকে দৃষ্টি রেখে যদি কেউ রোযা রাখে তরে ইনশাআল্লাহ সে সওয়াব পাবে। তবে মনে রাখতে হবে যে, এ মাসের নির্দিষ্ট কোন দিনের পৃথক কোন বৈশিষ্ট নেই।

    এ রাতের নফল আমলসমূহ সম্মিলিত নয়, ব্যক্তিগত

    এ বিষয়টিও মনে রাখতে হবে যে, এ রাতের নফল আমলসমূহ, বিশুদ্ধ মতানুসারে একাকীভাবে করণীয়। ফরয নামাযতো অবশ্যই মসজিদে আদায় করতে হবে। এরপর যা কিছু নফল পড়ার তা নিজ নিজ ঘরে একাকী পড়বে। এসব নফল আমলের জন্য দলে দলে মসজিদে এসে সমবেত হওয়ার কোন প্রমাণ হাদীস শরীফেও নেই আর সাহাবায়ে কেরামরে যুগেও এর রেওয়াজ ছিল না। [ইক্‌তিযাউস সিরাতিল মুসতাকীম ২/৬৩১-৬৪১; মারাকিল ফালাহ ২১৯]

    অবে কোন আহবান ও ঘোষণা ছাড়া এমনিই কিছু লোক যদি মসজিদে এসে যায়, তাহলে প্রত্যেকে নিজ নিজ আমলে মশগুল থাকবে, একে অন্যের আমলের ব্যাঘাত সৃষ্টির কারণ হবে না।

    কোন কোন জায়গায় এই ওেয়াজ আছে যে, এ রাতে মাগরিব বা ইশার পর থেকেই ওয়াজ-নসীহত আরম্ভ হয়। আবার কোথাও ওয়াজের পর মিলাদ-মাহফিলের অনুষ্ঠান হয়। কোথাও তো সারা রাত খতমে-শবীনা হতে থাকে। উপরন্তু এসব কিছুই করা হয় মাইকে এবং বাইরের মাইকও ছেড়ে দেওয়া হয়।

    মনে রাখতে হবে, এসব কিছুই ভুল রেওযাজ। শবে বরাতের ফাযায়েল ও মাসায়েল আগেই আলোচনা করা যায়। এ রাতে মাইক ছেড়ে দিয়ে বক্তৃতা-ওয়াজের আয়োজন করা ঠিক না। এতে না ইবাদতে আগ্রহী মানুষের পক্ষে ঘরে বসে একাগ্রতার সাথে ইবাদত করা সম্ভব হয়, আর না মসজিদে। অসুস্থ ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় আরামেরও মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে। আল্লাহ আমাদের এসব ভুল কাজকর্ম পরিহার করার তাওফীক দিন।

    সাদাত

    @সাদাত,

    http://prothom-aloblog.com/posts/16/53866
    এখান থেকে নিয়েছি। বানান সহ অনেক টাইপিং ভুল আছে। মূল লেখাটার সফট কপি আল-কাউসারে নেটে দেয় নাই।

  3. শবে বরাত:সঠিক দৃষ্টিকোন
    প্রতি বছর যখন ১৫ শাবান আসে তখন দেখি আলেম-উলামাগণ, ওয়াজীনে কিরাম, আইয়েম্মায়ে মাসাজিদ বিভিন্ন মাসজিদে, পত্র-পত্রিকায়,রেডিওটিভিতে শবে বরাত সম্পর্কে লাগামহীন এবং মনগড়া আলোচনা করেন, যা শুনে একজন সাধারণ মানুষ ধারণা করে নেয় যে, শবে বরাত ইসলামের মূল পর্বগুলিার একটি। তাই তারা অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে তা পালন করেন। এ অবস্থান দেখে অত্যন্ত দুঃখ লাগে, ব্যথা পাই।

    যখন ১৫ শাবান সমাগত হয় তখন সাধারণ মানুষ ও অনেক দা’য়ী ইলাল্লাহ, আলেম-উলামাগণ এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেন, জানতে চান। তাদের প্রশ্নের ভাষা এ রকমঃ “অনেকে বলেন শবে বরাত বলতে কিছু নেই, এ সম্পর্কে কোন সহীহ হাদীস নেই। আবার অনেকে বলেন শবে বরাত, উহার ফাযীলাত ও ‘আমল রয়েছে, আছে তার বিশুদ্ধ প্রমাণ। আসলে বিষয়টির ব্যাপারে সঠিক অবস্থান কি হওয়া উচিত?” তাদের এ প্রশ্নের পূর্ণ জওয়াব দেয়া যেমন যরুরী তেমনি কঠিন। আর কিছু না বলে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এড়িয়ে গেলে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না।

    আমাদের দেশে বা দেশের বাইরে যারা বিভিন্ন বিদ’আতী কাজ-কর্মে লিপ্ত তারা নিজেদের কাজের সমর্থনে কিন্তু জবরদস্ত দলীল উপস্থাপন করে। কিন্তু এ সব দলীল কি গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ? না, সেগুলো মোটেই বিশুদ্ধতার মানদন্ডে মাকবুল নয়। দলীল থাকলেই তা গ্রহণ করে ‘আমল করা যায় না। ‘আমল করার জন্য তা একশ ভাগ বিশুদ্ধ হতে হবে।

    কতিপয় মূলনীতি
    মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে কতিপয় মূলনীতি উল্লেখ করছি যা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে বলে আমার বিশ্বাস।

    (এক) যদি কোন একটা প্রথা যুগ যুগ ধরে কোন অঞ্চলের মুসলিম সমাজে চলে আসে, তাহলে তা শরীয়ত সম্মত হওয়ার প্রমাণ বহন করেনা। এটা বলা ঠিক হবে না যে, শত শত বছর ধরে যা পালন করে আসছি তা না জায়েয হয় কিভাবে? বরং তা শরীয়ত সম্মত হওয়ার জন্য অবশ্যই শর’য়ী দলীল থাকতে হবে।

    (দুই) ইসলামের যাবতীয় বিষয়াবলী দু’ প্রকার (ক) আকীদাহ বা বিশ্বাস (খ) ‘আমল বা কাজ। কোন ‘আমল বা কাজ ইসলামের শরীয়ত সম্মত হওয়ার জন্য অবশ্যই কুরআন, হাদীস, ইজমা ও কিয়াস এই চারটির যে কোন একটি দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে। কিন’ আকীদাগত কোন বিষয় অবশ্যই কুরআন অথবা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে। ইজমা অথবা কিয়াস দ্বারা আকীদাহর কোন বিষয় প্রমাণ করা যাবে না।

    (তিন) যে সকল হাদীস কিতাব আকারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তার মধ্যে উল্লিখিত সবগুলো হাদীস বিশুদ্ধ বা সহীহ নয়। হাদীস বিশারদগণ যুগ যুগ ধরে গবেষণা করে নির্ধারণ করেছেন কোনটি সহীহ, কোনটি যয়ীফ (দুর্বল সূত্র), কোনটি মওজু (জাল বা বানোয়াট)। তাই সব ধরনের হাদীস মোতাবেক ‘আমল করা ঠিক নয়। হাদীসসমূহ থেকে শুধু সহীহগুলি ‘আমলে নেয়া হবে। যদি সব ধরনের হাদীস ‘আমলে নেয়া হয় তাহলে শত শত বছর ধরে এ বিষয় গবেষণা ও তা চর্চার সার্থকতা কি?
    (চার) দুর্বল বা জাল হাদীসের উপর ভিত্তি করে ইসলামী শরীয়তে কোন আকীদাহ ও ‘আমল চালু করা যায় না। তবে কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত কোন ‘আমলের ফাযীলাতের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস গ্রহণ করা যায়।

    (পাঁচ) কোন স্থান বা সময়ের ফযীলাত কুরআন বা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হলে তা দ্বারা সে স্থানে বা সে সময়ে ‘আমল (ইবাদাত-বন্দেগী) করার ফযীলাত প্রমাণিত হয়না। যদি ‘আমল করার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র শরয়ী দলীল থাকে তাহলেই ‘আমল করা যায়।

    ‘শবে বরাত’ এর অর্থ
    ‘শব’ একটি ফারসী শব্দ এর অর্থ রাত। ‘বারায়াত’কে যদি আরবী শব্দ ধরা হয় তাহলে এর অর্থ হচ্ছে সম্পর্কচ্ছেদ, পরোক্ষ অর্থে মুক্তি। যেমন কুরআন মাজীদে সূরা বারায়াত রয়েছে যা সূরা তাওবা নামেও পরিচিত। ইরশাদ হয়েছেঃ بَرَاءَةٌ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ
    অর্থঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা।(সূরাতাওবা,১)
    এখানে বারায়াতের অর্থ হল সম্পর্ক ছিন্ন করা।
    ‘বারায়াত’ মুক্তি অর্থেও আল-কুরআনে এসেছে
    যেমনঃ أَكُفَّارُكُمْ خَيْرٌ مِنْ أُولَئِكُمْ أَمْ لَكُمْ بَرَاءَةٌ فِي الزُّبُرِ
    অর্থঃ তোমাদের মধ্যকার কাফিররা কি তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ? না কি তোমাদের মুক্তিরসনদ রয়েছে কিতাবসমূহে? (সূরা কামার, ৩৪)
    আর ‘বারায়াত’ শব্দক যদি ফারসী শব্দ ধরা হয় তাহলে উহার অর্থ হবে সৌভাগ্য। অতএব শবে বরাত শব্দটার অর্থ দাড়ায় মুক্তির রজনী, সম্পর্ক ছিন্ন করার রজনী। অথবা সৌভাগ্যের রাত, যদি ‘বরাত’ শব্দটিকে ফার্সী শব্দ ধরা হয়।শবে বরাত শব্দটাকে যদি আরবীতে তর্জমা করতে চান তাহলে বলতে হবে ‘লাইলাতুল বারায়াত’।
    এখানে বলে রাখা ভাল যে এমন অনেক শব্দ আছে যার রূপ বা উচ্চারণ আরবী ও ফারসী ভাষায় একই রকম, কিন’ অর্থ ভিন্ন।যেমন ‘গোলাম’ শব্দটি আরবী ও ফারসী উভয় ভাষায় একই রকম লেখা হয় এবং একইভাবে উচ্চারণ করা হয়। কিন’ আরবীতে এর অর্থ হল কিশোর আর ফারসীতে এর অর্থ হল দাস।
    সার কথা হল ‘বারায়াত’ শব্দটিকে আরবী শব্দ ধরা হলে উহার অর্থ সম্পর্কচ্ছেদ বা মুক্তি। আর ফারসী শব্দ ধরা হলে উহার অর্থ সৌভাগ্য।

    আল-কুরআনে শবে বরাতের কোন উল্লেখ নেই
    শবে বরাত বলুন আর লাইলাতুল বারায়াত বলুন কোন আকৃতিতে শব্দটি কুরআন মাজীদে খুজে পাবেন না। সত্য কথাটাকে সহজভাবে বলতে গেলে বলা যায় পবিত্র কুরআন মাজীদে শবে বরাতের কোন আলোচনা নেই। সরাসরি তো দূরের কথা আকার ইংগিতেও নেই।
    অনেককে দেখা যায় শবে বরাতের গুরুত্ব আলোচনা করতে যেয়ে সূরা দুখানের প্রথম চারটি আয়াত পাঠ করেন। আয়াতসমূহ হলঃ
    হা-মীম। শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের। আমিতো এটা অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রাতে। আমি তো সতর্ককারী। এই রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় সি’রকৃত হয়। (সূরা দুখান, ১-৪)
    শবে বরাত পন্থী আলেম উলামারা এখানে বরকতময় রাত বলতে ১৫ শাবানের রাতকে বুঝিয়ে থাকেন। আমি এখানে স্পষ্টভাবেই বলব যে, যারা এখানে বরকতময় রাতের অর্থ ১৫ শাবানের রাতকে বুঝিয়ে থাকেন তারা এমন বড় ভুল করেন যা আল্লাহর কালাম বিকৃত করার মত অপরাধ।
    কারণঃ
    (এক) কুরআন মাজীদের এ আয়াতের তাফসীর বা ব্যাখ্যা সূরা আল-কদর দ্বারা করা হয়। সেই সূরায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ
    আমি এই কুরআন নাযিল করেছি লাইলাতুল কদরে। আপনি জানেন লাইলাতুল কদর কি? লাইলাতুল কদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে প্রত্যেক কাজের জন্য মালাইকা (ফেরেশ্‌তাগণ) ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশে। এই শানি- ও নিরাপত্তা ফজর পর্যন- অব্যাহত থাকে। (সূরা কাদর, ১-৫)
    অতএব বরকতময় রাত হল লাইলাতুল কদর। লাইলাতুল বারায়াত নয়। সূরা দুখানের প্রথম সাত আয়াতের ব্যাখ্যা হল এই সূরা আল-কদর। আর এ ধরনের ব্যাখ্যা অর্থাৎ আল-কুরআনের এক আয়াতের ব্যাখ্যা অন্য আয়াত দ্বারা করা হল সর্বোত্তম ব্যাখ্যা।
    (দুই) সূরা দুখানের লাইলাতুল মুবারাকার অর্থ যদি শবে বরাত হয় তাহলে এ আয়াতের অর্থ দাড়ায় আল কুরআন শাবান মাসের শবে বরাতে নাযিল হয়েছে। অথচ আমরা সকলে জানি আল-কুরআন নাযিল হয়েছে রামাযান মাসের লাইলাতুল কদরে। যেমন সূরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃরামাযান মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে আল-কুরআন।
    (তিন) অধিকাংশ মুফাচ্ছিরে কিরামের মত হল উক্ত আয়াতে বরকতময় রাত বলতে লাইলাতুল কদরকেই বুঝানো হয়েছে। শুধু মাত্র তাবেয়ী ইকরামা রহ. এর একটা মত উল্লেখ করে বলা হয় যে, তিনি বলেছেন বরকতময় রাত বলতে শাবান মাসের পনের তারিখের রাতকেও বুঝানো যেতে পারে।
    তিনি যদি এটা বলে থাকেন তাহলে এটা তার ব্যক্তিগত অভিমত। যা কুরআন ও হাদীসের বিরোধী হওয়ার কারণে পরিত্যাজ্য। এ বরকতময় রাতের দ্বারা উদ্দেশ্য যদি শবে বরাত হয় তাহলে শবে কদর অর্থ নেয়া চলবেনা।
    (চার) উক্ত আয়াতে বরকতময় রাতের ব্যাখ্যা শবে বরাত করা হল তাফসীর বির-রায় (মনগড়া ব্যাখ্যা), আর বরকতময় রাতের ব্যাখ্যা লাইলাতুল কদর দ্বারা করা হল কুরআন ও হাদীস সম্মত তাফসীর। সকলেই জানেন কুরআন ও হাদীস সম্মত ব্যাখ্যার উপস্থিতিতে মনগড়া ব্যাখ্যা (তাফসীর বির-রায়) গ্রহণ করার কোন সুযোগ নেই।
    (পাচ) সূরা দুখানের ৪ নং আয়াত ও সূরা কদরের ৪ নং আয়াত মিলিয়ে দেখলে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বরকতময় রাত বলতে লাইলাতুল কদরকেই বুঝানো হয়েছে। সাহাবী ইবনে আব্বাস (রাঃ), ইবনে কাসীর, কুরতুবী প্রমুখ মুফাচ্ছিরে কিরাম এ কথাই জোর দিয়ে বলেছেন এবং সূরা দুখানের ‘লাইলাতুম মুবারাকা’র অর্থ শবে বরাত নেয়াকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। (তাফসীরে মায়ারেফুল কুরআন দ্রষ্টব্য)
    ইমাম কুরতুবী (রহঃ) তাঁর তাফসীরে বলেছেনঃ “কোন কোন আলেমের মতে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল মধ্য শাবানের রাত (শবে বরাত)। কিন্তু এটা একটা বাতিল ধারণা।” অতএব এ আয়াতে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ এর অর্থ লাইলাতুল কদর। শাবান মাসের পনের তারিখের রাত নয়।
    (ছয়) ইকরামা (রঃ) বরকতময় রজনীর যে ব্যাখ্যা শাবানের ১৫ তারিখ দ্বারা করেছেন তা ভুল হওয়া সত্ত্বেও প্রচার করতে হবে এমন কোন নিয়ম-কানুন নেই। বরং তা প্রত্যাখ্যান করাই হল হকের দাবী। তিনি যেমন ভুলের উর্ধ্বে নন, তেমনি যারা তার থেকে বর্ণনা করেছেন তারা ভুল শুনে থাকতে পারেন অথবা কোন উদ্দেশ্য নিয়ে বানোয়াট বর্ণনা দেয়াও অসম্ভব নয়।
    (সাত) শবে বরাতের গুরুত্ব বর্ণনায় সূরা দুখানের উক্ত আয়াত উল্লেখ করার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে এ আকীদাহ বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, শবে বরাতে সৃষ্টিকূলের হায়াত-মাউত, রিয্‌ক-দৌলত সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ও লিপিবদ্ধ করা হয়। আর শবে বরাত উদযাপনকারীদের শতকরা নিরানব্বই জনের বেশী এ ধারণাই পোষণ করেন। তারা এর উপর ভিত্তি করে লাইলাতুল কদরের চেয়ে ১৫ শাবানের রাতকে বেশী গুরুত্ব দেয়। অথচ কুরআন ও হাদীসের আলোকে এ বিষয়গুলি লাইলাতুল কদরের সাথে সম্পর্কিত। তাই যারা শবে বরাতের গুরুত্ব বুঝাতে উক্ত আয়াত উপস্থাপন করেন তারা মানুষকে সঠিক ইসলামী আকীদাহ থেকে দূরে সরানোর কাজে লিপ্ত, যদিও মনে-প্রাণে তারা তা ইচ্ছা করেন না।
    (আট) ইমাম আবু বকর আল জাসসাস তার আল-জামে লি আহকামিল কুরআন তাফসীর গ্রনে’ লাইলালাতুন মুবারাকা দ্বারা মধ্য শাবানের রাত উদ্দেশ্য করা ঠিক নয় বলে বিস্তারিত আলোচনা করার পর বলেন : লাইলাতুল কদরের চারটি নাম রয়েছে,তা হল : লাইলাতুল কদর, লাইলাতু মুবারাকাহ, লাইলাতুল বারাআত ও লাইলাতুস সিক।(আল জামেলি আহকামিল কুরআন,সূরা আদদুখানের তাফসীর দ্রষ্টব্য)
    লাইলাতুল বারাআত হল লাইলাতুল কদরের একটি নাম। শাবান মাসের পনের তারিখের রাতের নাম নয়।ইমাম শাওকানী (রহ.) তার তাফসীর ফতহুল কাদীরে একই কথাই লিখেছেন।
    (তাফসীর ফাতহুল কাদীর : ইমাম শাওকানী দ্রষ্টব্য)
    এ সকল বিষয় জেনে বুঝেও যারা ‘লাইলাতুম মুবারাকা’র অর্থ করবেন শবে বরাত, তারা সাধারণ মানুষদের গোমরাহ করা এবং আল্লাহর কালামের অপব্যাখ্যা করার দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না।

    শবে বরাত নামটি হাদীসের কোথাও উল্লেখ হয়নি
    প্রশ্ন থেকে যায় হাদীসে কি লাইলাতুল বরাত বা শবে বরাত নেই? সত্যিই হাদীসের কোথাও আপনি শবে বরাত বা লাইলাতুল বারায়াত নামের কোন রাতের নাম খু্‌জে পাবেন না। যে সকল হাদীসে এ রাতের কথা বলা হয়েছে তার ভাষা হল ‘লাইলাতুন নিস্‌ফ মিন শাবান’ অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত্রি। শবে বরাত বা লাইলাতুল বারায়াত শব্দ আল-কুরআনে নেই, হাদীসে রাসূলেও নেই। এটা মানুষের বানানো একটা শব্দ। ভাবলে অবাক লাগে যে, একটি প্রথা ইসলামের নামে শত শত বছর ধরে পালন করা হচ্ছে অথচ এর আলোচনা আল-কুরআনে নেই। সহীহ হাদীসেও নেই। অথচ আপনি দেখতে পাবেন যে, সামান্য নফল ‘আমলের ব্যাপারেও হাদীসের কিতাবে এক একটি অধ্যায় বা শিরোনাম লেখা হয়েছে।

    ফিকহের কিতাবে শবে বরাত
    শুধু আল-কুরআনে কিংবা সহীহ হাদীসে নেই, বরং আপনি ফিক্‌হের নির্ভরযোগ্য কিতাবগুলো পড়ে দেখুন, কোথাও শবে বরাত নামের কিছু পাবেন না। বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে দ্বীনি মাদ্রাসাগুলিতে ফিক্‌হের যে সিলেবাস রয়েছে যেমন মালাবুদ্দা মিনহু, নুরুল ইজাহ, কদুরী, কানযুদ্‌ দাকায়েক, শরহে বিকায়া ও হিদায়াহ খুলে দেখুন না! কোথাও শবে বরাত নামের কিছু পাওয়া যায় কিনা! অথচ আমাদের পূর্বসূরী ফিকাহবিদগণ ইসলামের অতি সামান্য বিষয়গুলো আলোচনা করতেও কোন ধরনের কার্পণ্যতা দেখাননি। তারা সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণের সালাত সম্পর্কেও অধ্যায় রচনা করেছেন। অনুচ্ছেদ তৈরী করেছেন কবর যিয়ারতের মত বিষয়েরও। শবে বরাতের ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহর সামান্যতম ইশারা থাকলেও ফিকাহবিদগণ এর আলোচনা মাসয়ালা-মাসায়েল অবশ্যই বর্ণনা করতেন।

    অতএব এ রাতকে শবে বরাত বা লাইলাতুল বারায়াত অভিহিত করা মানুষের মনগড়া বানানো একটি বিদ‘আত যা কুরআন বা হাদীস দ্বারা সমর্থিত নয়।
    শবে বরাতের সম্পর্ক শুধু আমলের সাথে নয়
    শবে বরাত সম্পর্কে যে সকল ধর্ম বিশ্বাস বা আকীদাহ পোষণ করা হয় তা কিন্তু কোন দুর্বল হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত হয় না। যেমন ভাগ্যলিপি ও বাজেট প্রনয়নের বিষয়টি।
    যারা বলেনঃ ‘‘আমলের ফাযীলাতের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস গ্রহণ করা যায়, অতএব এর উপর ভিত্তি করে শবে বরাতে ‘আমল করা যায়, তাদের কাছে আমার প্রশ্নঃ
    *তাহলে শবে বরাতের আকীদাহ সম্পর্কে কি দুর্বল হাদীসেরও দরকার নেই?
    *অথবা এ সকল প্রচলিত আকীদাহর ক্ষেত্রে যদি কোন দুর্বল হাদীস পাওয়াও যায় তাহলে তা দিয়ে কি *আকীদাহগত কোন মাসয়ালা প্রমাণ করা যায়?
    *আপনারা শবে বরাতের ‘আমলের পক্ষ সমর্থন করলেন কিন্তু আকীদাহর ব্যাপারে কি জবাব দিবেন?
    কাজেই শবে বরাত শুধু ‘আমলের বিষয় নয়, আকীদাহরও বিষয়। তাই এ ব্যাপারে ইসলামের দা’য়ীদের সতর্ক হওয়ার দাওয়াত দিচ্ছি।

    শবে বরাত সম্পর্কে এ বিশ্বাস পোষণ করা যে, আল্লাহ তা‘আলা এ রাতে আল-কুরআন অবতীর্ণ করেছেন, তিনি এ রাতে মানুষের হায়াত, রিয্‌ক ও ভাগ্যের ফায়সালা করে থাকেন, এ রাতে ইবাদাত বন্দেগীতে লিপ্ত হলে আল্লাহ হায়াত ও রিয্‌ক বাড়িয়ে সৌভাগ্যশালী করেন ইত্যাদি আকীদা কি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি মিথ্যা আরোপ করার মত অন্যায় নয়?

    আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেনঃ তার চেয়ে বড় যালিম আর কে যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে? (সূরা সাফ, ৭)

    সৌভাগ্য রজনী ধর্ম বিকৃতির শামিল

    ইসলাম ধর্মে সৌভাগ্য রজনী বলতে কিছু নেই। নিজেদের সৌভাগ্য রচনার জন্য কোন অনুষ্ঠান বা ইবাদাত-বন্দেগী ইসলামে অনুমোদিত নয়। শবে বরাতকে সৌভাগ্য রজনী বলে বিশ্বাস করা একটি বিদ‘আত তথা ধর্মে বিকৃতি ঘটানোর শামিল। এ ধরনের বিশ্বাস খুব সম্ভব হিন্দু ধর্ম থেকে এসেছে। তারা সৌভাগ্য লাভের জন্য গনেশ পূজা করে থাকে। সৌভাগ্য অর্জন করতে হলে জীবনের সর্বক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহ অনুসরণ করতে হবে। কুরআন-সুন্নাহ বাদ দিয়ে এবং সারা জীবন সালাত-সিয়াম-যাকাত ত্যাগ করে শুধুমাত্র একটি রাতে মাসজিদে উপস্থিত হয়ে রাত জেগে ভাগ্য বদল করে সৌভাগ্য হাসিল করে নিবেন এমন ধারণা ইসলামে একটি হাস্যকর ব্যাপার।

    ধর্মে বিকৃতির কৃতিত্বে শিয়া মতাবলম্বীদের জুড়ি নেই। এ শবে বরাত প্রচলনের কৃতিত্বও তাদের। ফারসী ভাষার “শবে বরাত” নামটা থেকে এ বিষয়টা বুঝতে কারো কষ্ট হওয়ার কথা নয়। তারা এ দিনটাকে ইমাম মাহদীর জন্ম দিন হিসাবে পালন করে থাকে। তারা বিশ্বাস করে যে, এ রাতে ইমাম মাহদীর জন্ম হয়েছে। এ রাতে তারা এক বিশেষ ধরনের সালাত আদায় করে। যার নাম দিয়েছে “সালাতে জাফর”।

    এ শিরোনামে আমি শবে বরাত সম্পর্কে বিশ্ব বরেণ্য আলেম শায়খ আবদুল আযীয আবদুল্লাহ বিন বায (রহঃ) এর প্রবন্ধ ‘মধ্য শাবানের রাত উদযাপনের বিধান’ এর সার-সংক্ষেপ তুলে ধরব। তার এ প্রবন্ধে অনেক উলামায়ে কিরামের মতামত তুলে ধরা হয়েছে।
    তিনি বলেছেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ
    আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে তোমাদের জন্য পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের জন্য আমার নেআমাত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম। (সূরা মায়িদা, ৩)
    আল্লাহ তা’আলা আরো বলেনঃ
    তাদের কি এমন কতগুলো শরীক আছে যারা তাদের জন্য ধর্মের এমন বিধান দিয়েছে যার অনুমতি আল্লাহ দেননি? (সূরা শুরা, ২১)
    হাদীসে এসেছেঃ
    অর্থঃ যে আমাদের এ ধর্মে এমন কিছুর প্রচলন করবে যা দ্বীনের মধ্যে ছিল না তা প্রত্যাখ্যাত হবে। (বুখারী ও মুসলিম)

    হাদীসে আরও এসেছেঃ
    সাহাবী জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুমু‘আর খুতবায় বলতেনঃ আর শুনে রেখ! সর্বোত্তম কথা হল আল্লাহর কিতাব ও সর্বোত্তম পথ-নির্দেশ হল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের পথ-নির্দেশ। আর ধর্মে নতুন বিষয় প্রচলন করা হল সর্ব নিকৃষ্ট বিষয়। এবং সব ধরনের বিদ‘আতই পথভ্রষ্টতা। (মুসলিম)

    এ বিষয়ে অনেক আয়াতে কারীমা ও হাদীস রয়েছে যা থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা ইসলাম ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। আর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে কোন রকম অলসতা করেননি বা কার্পণ্যতা দেখাননি। ইসলাম ধর্মের সকল খুটিনাটি বিষয় তিনি স্পষ্টভাবে তাঁর উম্মতের সামনে বর্ণনা করে গেছেন যা আজ পর্যন- সুরক্ষিত রয়েছে।

    নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পর যে সমস- নতুন আচার-অনুষ্ঠান, কাজ ও বিশ্বাস ধর্মের আচার বলে যা চালিয়ে দেয়া হবে তা সবগুলো প্রত্যাখ্যাত বিদ‘আত বলেই পরিগণিত হবে, তা উহার প্রচলনকারী যে কেউ হোক না কেন এবং উদ্দেশ্য যত মহৎ হোক না কেন। সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) ও তাদের পরবর্তী উলামায়ে ইসলাম এ ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন বলে তারা বিদ‘আতকে প্রত্যাখ্যান করেছেন ও অন্যদের বিদ‘আতের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন।

    এ ধারাবাহিকতায় উলামায়ে কিরাম মধ্য শাবানের রাত উদযাপন ও ঐদিন সিয়াম পালন করাকে বিদ‘আত বলেছেন। কারণ এ বিষয়ের উপর ভিত্তি করে ‘আমল করা যেতে পারে এমন কোন দলীল নেই। যা আছে তা হল কিছু দুর্বল হাদীস যার উপর ভিত্তি করে ‘আমল করা যায় না। উক্ত রাতে সালাত আদায়ের ফাযীলাতের যে সকল হাদীস পাওয়া যায় তা বানোয়াট। এ ব্যাপারে হাফেয ইবনে রজব তার কিতাব লাতায়িফুল মায়ারিফে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

    একটি কথা অবশ্যই বলতে হয় যে, দুর্বল হাদীস ঐ সকল ‘আমল ও ইবাদাতের ক্ষেত্রে গ্রহণ করা যায় যে সকল ‘আমল কোন সহীহ হাদীস দ্বারা ইতোপূর্বে প্রমাণিত হয়েছে। কিন’ মধ্য শাবানের রাতে একত্র হয়ে ইবাদাত-বন্দেগী করার ক্ষেত্রে কোন সহীহ হাদীস নেই। এ মূল নীতিটি ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) উল্লেখ করেছেন।

    সকল উলামায়ে কিরামের একটি ব্যাপারে ইজমা (ঐকমত্য) হয়েছে যে, যে সকল ব্যাপারে বিতর্ক বা ইখতিলাফ রয়েছে সে সকল বিষয় কুরআন ও সুন্নাহর কাছে নেস্ত করা হবে। কুরআন অথবা হাদীস যে সিদ্ধান্ত দিবে সেই মোতাবেক ‘আমল করা ওয়াজিব।

    এ কথা তো আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই বলেছেনঃ
    হে ঈমানদারগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তাহলে আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য কর রাসূলের এবং তাদের, যারা তোমাদের মধ্যে (ধর্মীয় জ্ঞানে ও শাসনের ক্ষেত্রে) ক্ষমতার অধিকারী; কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ হলে তা নেস্ত কর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর। এটাই উত্তম ও পরিণামে উৎকৃষ্টতর। (সূরা নিসা, ৫৯)
    এ বিষয়ে অসংখ্য আয়াত ও হাদীস রয়েছে।

    হাফেয ইবনে রজব (রহঃ) তার কিতাব লাতায়িফুল মায়ারিফে লিখেছেনঃ
    “তাবেয়ীদের যুগে সিরিয়ায় খালিদ ইবনে মা’দান, মকহুল, লুকমান ইবনে আমের প্রমুখ আলিম এ রাতকে মর্যাদা দিতে শুরু করেন এবং এ রাতে বেশী পরিমাণে ইবাদাত-বন্দেগী করতেন। তখন লোকেরা তাদের থেকে এটা অনুসরণ করতে আরম্ভ করল। এরপর লোকদের মধ্যে মতানৈক্য শুরু হল; বসরা অঞ্চলের অনেক আবেদগণ এ রাতকে গুরুত্ব দিতেন। কিন’ মক্কা ও মদীনার আলিমগণ এটাকে বিদ‘আত বলে প্রত্যাখ্যান করলেন। অতঃপর সিরিয়াবাসী আলিমগণ দুই ভাগ হয়ে গেলেন। একদল এ রাতে মাসজিদে একত্র হয়ে ইবাদাত-বন্দেগী করতেন। এদের মধ্যে ছিলেন খালেদ ইবনে মাদান, লোকমান ইবনে আমের। ইসহাক ইবনে রাহভিয়াহও তাদের অনুরূপ মত পোষণ করতেন।

    আলিমদের অন্যদল বলতেনঃ এ রাতে মাসজিদে একত্র হয়ে ইবাদাত-বন্দেগী করা মাকরূহ, তবে কেহ ব্যক্তিগতভাবে ইবাদাত-বন্দেগী করলে তাতে দোষের কিছু নেই। ইমাম আওযায়ী এ মত পোষণ করতেন।
    মোট কথা হল, মধ্য শাবানের রাতের ‘আমল সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরামদের থেকে কোন কিছু প্রমাণিত নয়। যা কিছু পাওয়া যায় তা তাবেয়ীগণের যুগে সিরিয়ার একদল আলেমের আমল।

    বিশুদ্ধ কথা হল, এ রাতে ব্যক্তিগত আমল সম্পর্কে ইমাম আওযায়ী ও ইবনে রজব (রহঃ) এর মতামত যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে তা তাদের ব্যক্তিগত অভিমত যা সহীহ নয়। আর এটাতো সকল আলেমে দ্বীনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত যে, শরয়ীভাবে প্রমাণিত নয় তা ব্যক্তিগত হোক বা সমষ্টিগত প্রকাশ্যে হোক অথবা গোপনে হোক তা কোন মুসলিমের ধর্মীয় আমল হিসাবে পালন করা জায়েয নয়।

    এ ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত নিম্নের হাদীস হল আম তথা ব্যাপক অর্থবোধক। তিনি বলেছেনঃযে কেহ এমন ‘আমল করবে যা করতে আমরা (ধর্মীয়ভাবে) নির্দেশ দেইনি তা প্রত্যাখ্যাত। (মুসলিম)।ইমাম আবূ বকর আত-তারতূশী (রহঃ) তার কিতাব আল-হাওয়াদিছ ওয়াল বিদআতে উল্লেখ করেনঃ ইবনে ওয়াদ্দাহ যায়েদ বিন আসলাম সূত্রে বর্ণনা করে বলেনঃ আমাদের কোন উস্তাদ বা কোন ফকীহকে মধ্য শাবানের রাতকে কোন রকম গুরুত্ব দিতে দেখিনি। তারা মাকহূলের হাদীসের দিকেও তাকাননি এবং এ রাতকে অন্য রাতের চেয়ে ‘আমলের ক্ষেত্রে মর্যাদা সম্পন্ন মনে করতেন না।

    হাফেয ইরাকী (রহঃ) বলেনঃ মধ্য শাবানের রাতে সালাত আদায় সম্পর্কিত হাদীসগুলো বানোয়াট বা জাল এবং এটা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি মিথ্যা আরোপের শামিল। এ সম্পর্কে সকল উলামাদের মতামত যদি উল্লেখ করতে যাই তাহলে বিরাট এক গ্রন্থ হয়ে যাবে। তবে সত্যানুরাগীদের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যা ইতোপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।

    মধ্য শাবানের রাতে সালাত আদায়ের জন্য একত্র হওয়া, ঐ দিন সিয়াম পালন করা ইত্যাদি বিদআত। অধিকাংশ উলামায়ে কিরাম এটাই বলেছেন। এ ধরনের আমল আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে যেমন ছিল না তেমনি ছিল না তাঁর সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) এর সময়ে। যদি এ রাতে ইবাদাত- বন্দেগী করা সওয়াবের কাজ হত তাহলে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতকে সে সম্পর্কে সতর্ক ও উৎসাহিত করতে কার্পণ্য করতেন না, যেমন তিনি কার্পণ্য করেননি লাইলাতুল কদর ও রামাযানের শেষ দশ দিন ইবাদাত-বন্দেগী করার ব্যাপারে মুসলিমদের উৎসাহিত করতে।

    যদি মধ্য শাবানের রাতে অথবা রজব মাসের প্রথম জুমু‘আর রাতে বা মি’রাজের রাতে ইবাদাত-বন্দেগী করা সওয়াবের কাজ হত তাহলে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতকে এ ব্যাপারে অবশ্যই দিক-নির্দেশনা দিতেন। আর তিনি যদি দিক-নির্দেশনা দিতেন তাহলে তার সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) কোনভাবেই তা গোপন করতেন না। তারা তা অবশ্যই জোরে শোরে প্রচার করতেন। তারা তো নবীগণের পর উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।

    সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! চলমান শিরোনামে এতক্ষণ যা বলা হল তা ছিল শায়খ আবদুল আযীয আবদুল্লাহ বিন বাযের বক্তব্যের সার কথা।

    কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে, শবে বরাতের বিপক্ষে উলামাদের বক্তব্য উল্লেখ করলেন, কিন্ত শবে বরাত উদযাপনের পক্ষেও তো অনেক বিখ্যাত উলামাদের বক্তব্য আছে তা তো উল্লেখ করলেন না। তাই ব্যাপারটা কি একপেশে ও ইনসাফ বহির্ভূত হয়ে গেল না?

    এর জবাবে আমি বলবঃ দেখুন, কোন বিষয় বিদ‘আত হওয়ার ক্ষেত্রে উলামাদের বক্তব্য যথেষ্ট। কেননা কুরআন ও হাদীসে কোন বিষয়কে নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি যে, অমুক কাজটি বিদ‘আত। তাই আলেমগণ যেটাকে বিদ‘আত বলে রায় দিবেন সেটা বিদ‘আতই হবে। বিদ‘আত নির্ধারণের দায়িত্ব আলেমদের । কিন্তু কোন বিষয়কে ওয়াজিব, সুন্নাত বা মুস্তাহাব অথবা সওয়াবের কাজ বলে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আলেমদের বক্তব্য যথেষ্ট হবে না যদি না উহার পক্ষে কুরআন ও হাদীসের সহীহ দলীল থাকে। অতএব কোন বিষয় বিদ‘আত হওয়ার ক্ষেত্রে উলামাদের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য কিন্ত সুন্নাত হওয়ার ব্যাপারে নয়।

    আর এ কারণে আমরা শবে বরাত প্রচলনের সমর্থনে আলেমদের বক্তব্য উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করিনা।
    এ বিবেচনায় যে সকল আলেম শবে বরাত উদযাপন করাকে বিদ‘আত বলেছেন তাদের বক্তব্য গ্রহণ করতে হবে। যারা শবে বরাতের পক্ষে বলেছেন তাদের বক্তব্য এ জন্য গ্রহণ করা যাবে না যে, তা কুরআন ও সুন্নাহর সহীহ দলীলে উত্তীর্ণ নয়।

    শবে বরাত সম্পর্কে মুসলিম উম্মাহর অবস্থান
    শবে বরাত উদযাপন করা ও না করার ক্ষেত্রে বিশ্বের মুসলিমদেরকে চার ভাগে ভাগ করা যায়।
    প্রথমতঃ যারা কোনভাবেই শবে বরাত উদযাপন করেন না ও উদযাপন করাকে ইসলাম সম্মত মনে করেন না।
    দ্বিতীয়তঃ যারা সম্মিলিতভাবে শবে বরাত উদযাপন করেন না ঠিকই, কিন্ত এ রাতে ব্যক্তিগতভাবে চুপে চুপে আমল করা ফাযীলাতপূর্ণ মনে করেন, দিবসে সিয়াম পালন করেন ও রাত্রি জাগরণ করেন।
    তৃতীয়তঃ যারা ১৫ শাবানের রাতে মাসজিদে জমায়েত হয়ে ইবাদাত-বন্দেগী করেন, কবর যিয়ারত করেন, মাসজিদে ওয়াজ-নাসীহাতে শরীক হন, পরের দিন সিয়াম পালন করেন, এই রাতে হায়াত-মউত, রিয্‌ক-দৌলত সম্পর্কে আল্লাহ সিদ্ধান্ত নেন বলে বিশ্বাস করেন। সারা রাত জেগে ইবাদাত-বন্দেগী করেন। তবে আতশ-বাযি, মোমবাতি জ্বালানো ও আলোকসজ্জা ইত্যাদিকে নাজায়েয বলে জানেন।
    চতুর্থতঃ যারা ১৫ শাবানের রাতে আতশবাজি, আলোক সজ্জা ও আমোদ ফুর্তি করেন ও সময় সুযোগ মত ইবাদাত-বন্দেগীও করেন।

    এ চার প্রকার লোকদের মধ্যে প্রথম প্রকারের মানুষের সংখ্যাই বেশী। আমি কিন্তু এ কথা বলতে চাচ্ছিনা যে, অধিকাংশ মুসলিম শবে বরাত পালন করেন না বলে তা করা ঠিক নয়। বরং আমি বলতে চাচ্ছি যে, শবে বরাত সম্পর্কে মুসলিম উম্মাহর এ বিভক্তি শবে বরাত উদযাপন বিদআত হওয়ার একটা স্পষ্ট আলামত।

    এ ক্ষেত্রে আমি বিশ্ববরেণ্য আলেমে দ্বীন আবুল হাসান আলী নদভী (রহঃ) এর কিতাব ‘শির্‌ক ও বিদয়াত’ থেকে একটি উদ্ধৃতি দেয়া যথার্থ মনে করছি। তিনি লিখেছেনঃ

    “আল্লাহর দ্বীন ও শরীয়তের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট হলো বিশ্বব্যাপী সম-আদর্শতা। এই সমাদর্শ ও স্বাদৃশ্যতা যেমন কাল ও সময়ের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় তেমনি সময়ের ক্ষেত্রেও। আল্লাহ হচ্ছেন রাব্বুল মাশরিকাইন ওয়া রাব্বুল মাগরিবাইন; পূর্ব-পশ্চিম সকল কিছুর রব ও মালিক। তিনি সময় ও কালের সীমা ও বাধার উর্দ্ধে। তাই তাঁর শরীয়াত ও তাঁর দ্বীনে এক অত্যাশ্চর্য সমতা ও সমাদর্শ বিদ্যমান। তাঁর আখিরী শরীয়াত ও আখিরী নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনাদর্শে এসে যা হয়েছে তাকমীল পূর্ণতা প্রদীপ্ত সূর্যের মতই সকলের জন্য সমান এবং আকাশ ও মাটির মত সকলের জন্য সম উপযোগীতাপূর্ণ।

    প্রথম যুগে এর যে রূপ ও আকৃতি ছিল হিজরী পনের শতকেও উহার রূপ ও আকৃতি সেই একই। প্রাচ্যবাসীদের জন্য এটি যেমন ও যতটুকু, ঠিক তেমন ও ততটুকুই প্রতীচ্যের জন্য। যে সমস্ত নীতি ও নির্দেশ, ইবাদাতের যে রূপ ও আকৃতি, আল্লাহর নৈকট্য লাভের যে সমস্ত সুনির্ধারিত পন্থাও উপায় আরবদের জন্য ছিল ঠিক তদ্রূপ আছে তা ভারতবাসীর জন্যও। তাই দুনিয়ার যে কোন অংশের একজন মুসলিম অধিবাসী অপর কোন অংশে যদি চলে যায় তাহলে ইসলামী ফরয আদায় এবং ইবাদাত-বন্দেগী করার ক্ষেত্রে তার কোন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় না।

    বিদ‘আতের অবস্থা এর বিপরীত। এতে সমদৃশ্যতা ও একত্বতা নেই। স্থান ও কালের প্রভাব এতে পরিস্ফুট থাকে। গোটা মুসলিম বিশ্বে এর একটিমাত্র রূপে প্রচলনও হয়ে ওঠে না।

    সকল ধরনের বিদ‘আতের ক্ষেত্রে উপরোক্ত কথা প্রযোজ্য। শবে বরাত এমনি একটা বিষয় যা আমরা ভারতীয় উপমহাদেশের লোকেরা মহা ধুমধামে উদযাপন করছি, কিন্তু অন্য এলাকার মুসলিমদের কাছে এ সম্পর্কে কোন খবর নেই। কি আশ্চর্য! এমন এক মহা-নিয়ামাত যা মক্কা-মদীনার লোকেরা পেলনা, অন্যান্য আরবরা পেলনা, আফ্রিকানরা পেলনা, ইন্দোনেশীয়, মালয়েশীয়রা পেলনা, ইউরোপ-আমেরিকা-অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশের লোকেরা পেলনা; অথচ ভাগ্যক্রমে সৌভাগ্যের মহান রাত পেয়ে গেলাম আমরা উপ-মহাদেশের কিছু লোকেরা ও শিয়া মতাবলম্বীরা!

    এ বিষয়টি যদি বিভ্রান্তিকর না হত তাহলে সকল মুসলিমের পাওয়ার কথা ছিল। হাদীসে এসেছেঃ
    সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন আল্লাহ তাআলা আমার উম্মতকে কোন গোমরাহী বা বিভ্রান্তিতে একমত হতে দিবেন না। (তিরমিযী)
    অন্য বর্ণনায় এসেছেঃ
    সাহাবী আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা আমার উম্মতকে কোন ভ্রান্তিকর বিষয়ে একমত হওয়া থেকে মুক্তি দিয়েছেন। (সহীহ জামেয়)
    এ হাদীসের অর্থ হল আমার উম্মত যদি কোন বিষয়ে একমত হয় তাহলে সে বিষয়টি বিভ্রান্তিকর হতে পারে না। আর আমার উম্মতের কোন বিষয়ে একমত না হওয়ার বিষয়টি বিভ্রান্তিকর হওয়ার একটা আলামত হতে পারে।
    শবে বরাত এমনি একটি আমল যে উম্মতে মুসলিমাহ এ বিষয়ে কখনো একমত হয়নি, হওয়া সম্ভবও নয়। আবার যারা উদযাপন করেন তাদের মধ্যেও দেখা যায় আমল ও বিশ্বাসের বিভিন্নতা।

    শবে বরাত সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করার দায়িত্ব উলামায়ে কিরামের
    ইসলাম ধর্মে যতগুলো বিদআত চালু হয়েছে তা কিন্তু সাধারণ মানুষ বা কাফির মুশরিকদের মাধ্যমে প্রসার ঘটেনি। উহার প্রসারের জন্য দায়ী যেমন এক শ্রেণীর উলামা, তেমনি উলামায়ে কিরামই যুগে যুগে বিদআতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, নির্যাতন সহ্য করেছেন, দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, জেল-যুল্‌ম বরদাশত করেছেন।
    তাই বিদআত যে নামেই প্রতিষ্ঠা লাভ করুক না কেন উহার বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করতে হবে আলেমদেরকেই। তারা যদি এটা না করে কারো অন্ধ অনুসরণ বা অনুকরণ করেন, বিভ্রান্তি ছড়ান বা কোন বিদআতী কাজ-কর্ম প্রসারে ভূমিকা রাখেন, তাহলে এ জন্য তাদেরকে আল্লাহর সম্মুখে জবাবদিহি করতে হবে। যে দিন বলা হবেঃ
    আর সে দিন আল্লাহ তাদেরকে ডেকে জিজ্ঞেস করবেন, তোমরা রাসূলদের আহ্বানে কিভাবে সাড়া দিয়েছিলে? (সূরা কাসাস, ৬৫)
    সেদিন তো এ প্রশ্ন করা হবে না যে, তোমরা অমুক পীরের মত অনুযায়ী বা অমুক ইমামের মত অনুযায়ী আমল করেছিলে কিনা। যারা সহীহ সুন্নাহ মত আমল করবে তারাই সেদিন সফলকাম হবে।

    একটি বিভ্রান্তি নিরসন
    ১৫ শাবানে দিনের সিয়াম ও রাতের ইবাদাত-বন্দেগী, কুরআন তেলাওয়াত, নফল সালাত, কান্নাকাটি, দু‘আ-মুনাজাত, কবর যিয়ারাত, দান-সাদকাহ, ওয়াজ-নাসীহাত প্রভৃতি নেক ‘আমল গুরুত্বসহকারে পালন করাকে যখন কুরআন ও হাদীস সম্মত নয় বলে আলোচনা করা হয় তখন সাধারণ ধর্ম-প্রাণ ভাই-বোনদের পক্ষ থেকে একটি প্রশ্ন আসে যে, জনাব! আপনি শবে বরাতে উল্লিখিত ইবাদাত-বন্দেগীকে বিদ‘আত বা কুরআন ও সুন্নাহ সম্মত নয় বলেছেন, কিন্তু রোযা রাখা সওয়াবের কাজ ও রুটি তৈরী করে গরীব দুঃখীকে দান করা ভাল কাজ নয় কি? আমরা কান্নাকাটি করে আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে দোষের কি?
    সুপ্রিয় পাঠকবৃন্দ! নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য দুয়া-মুনাজাত, সালাত, সিয়াম, দান-ছাদাকাহ, কুরআন তিলাওয়াত, রাত্রি জাগরণ হল নেক ‘আমল। এতে কারও দ্বি-মত নেই। আমরা কখনো এগুলিকে

    shovoon

    শাবানের মধ্যরজনীর ফযীলত সম্পর্কিত হাদীসসমূহের পর্যালোচনা পোস্ট এ দ্রষ্টব্য।

    shovoon

    একটি বিভ্রান্তি নিরসন
    sআমরা কখনো এগুলিকে এর পর থেকে
    আমরা কখনো এগুলিকে বিদআত বলি না। যা বিদ‘আত বলি এবং যে সম্পর্কে উম্মাহকে সতর্ক করতে চাই তা হল এ রাতকে শবে বরাত বা সৌভাগ্য রজনী অথবা মুক্তি রজনী মনে করে বিভিন্ন প্রকার ‘আমল ও ইবাদাত বন্দেগীর মাধ্যমে দিবসটি উদযাপন করা। এটা কুরআন ও সুন্নাহ পরিপন্থি এটাই ধর্মে বাড়াবাড়ি। যা ধর্মে নেই তা উদযাপন করা ও প্রচলন করার নাম বিদআত।
    নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর নবুওয়াতের তেইশ বছরের জীবনে কখনো তার সাহাবীগণকে সাথে নিয়ে মক্কায় মাসজিদুল হারামে অথবা মদীনায় মাসজিদে নবুবীতে কিংবা অন্য কোন মাসজিদে একত্র হয়ে উল্লিখিত ইবাদাত-বন্দেগীসমূহ করেছেন এমন কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। তাঁর ইন্তেকালের পরে তাঁর সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) তথা খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে কেহ জানতো না শবে বরাত কি এবং এতে কি করতে হয়। তারা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমল প্রত্যক্ষ করেছেন। আমাদের চেয়ে উত্তম রূপে কুরআন অধ্যয়ন করেছেন। তারা তাতে শবে বরাত সম্পর্কে কোন দিক-নির্দেশনা পেলেন না। তারা তাদের জীবন কাটালেন আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে, অথচ জীবনের একটি বারও তাঁর কাছ থেকে শবে বরাত বা মুক্তির রজনীর ছবক পেলেন না? যা পালন করতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে যাননি, যা কুরআনে নেই, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তালীমে নেই, সাহাবীগণের আমলে নেই, তাদের সোনালী যুগের বহু বছর পরে প্রচলন করা শবে বরাতকে আমরা বিদআত বলতে চাই। আমরা বলতে চাই, এটা একটা মনগড়া পর্ব। আমরা মানুষকে বুঝাতে চাই, এই সব প্রচলিত ও বানোয়াট মুক্তির রজনী উদযাপন থেকে দূরে থাকতে হবে। আমরা উম্মতকে কুরআন ও সুন্নাহমুখী করতে এবং সেই অনুযায়ী আমল করাতে অভ্যস্ত করতে চাই।

    সন্দেহজনক নফল আমল থেকে দূরে থাকা উত্তম
    যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেই যে, শবে বরাত শরয়ীভাবে প্রমাণিত, তাহলে উহার মর্যাদা কতটুকু হবে? বেশী হলে মুস্তাহাব। কেহ যদি সারা জীবন মুস্তাহাব শবে বরাতটা বর্জন করে তাহলে তার কি ক্ষতি হবে?
    কিন্তু যদি এটা বিদআত হয়, আর যারা এর দিকে মানুষকে আহ্বান করল, উৎসাহিত করল, মানুষকে বিভ্রান্ত হতে প্ররোচিত করল, আকীদা-বিশ্বাসে বিকৃতি ঘটালো, এর প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রাখল তাহলে তাদের পরিণাম কি হবে? একটু ভেবে দেখবেন কি?
    ফিকাহর মূলনীতিতে একটি কথা আছে, ‘’একটা বিষয় লাভ ও ক্ষতি উভয়ের সম্ভাবনা থাকলে ক্ষতির বিষয়টি প্রাধান্য পাবে এবং বিবেচনায় আনা হবে।‘’

    হাদীসে এসেছেঃ
    আবূ আব্দুল্লাহ নুমান ইবনে বাশীর (রাঃ) থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শুনেছিঃ নিশ্চয়ই হালাল স্পষ্ট করে বলা হয়েছে ও হারাম পরিস্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আর এ দুটোর মাঝে কিছু সন্দেহজনক বিষয় আছে যা অনেক মানুষই জানে না। সুতরাং যে ব্যক্তি সন্দেহজনক বিষয় থেকে বেঁচে থাকল সে নিজের দ্বীন ও ইয্‌যাত আবরুকে বাঁচাল। আর যে সন্দেহজনক বিষয়ে লিপ্ত হয় সে প্রকারান-রে হারামে লিপ্ত হয়ে পড়ল। যেমন কোন রাখাল যদি তার গবাদিপশু নিষিদ্ধ চারণভূমির পাশে নিয়ে যায় তাহলে তার অচিরেই নিষিদ্ধ চারণভূমিতে ঢুকে যাওয়ার আশংকা থাকে। তোমরা সাবধানতা অবলম্বন কর! প্রত্যেক রাজা-বাদশার সংরক্ষিত এলাকা রয়েছে, আর আল্লাহ তা‘আলার সংরক্ষিত এলাকা হল তাঁর নিষিদ্ধ বিষয়সমুহ। (বুখারী ও মুসলিম)

    সর্বশেষ আহ্বান
    উপরোক্ত আলোচনার শেষ কথা হল, শবে বরাত একটি বিদ‘আতী পর্ব। অতএব আমরা এ সিদ্ধানে- পৌঁছতে সক্ষম হলাম যেঃ
    (১) এ রাতকে কেন্দ্র করে কোন ধরনের আমল করার সমর্থনে কোন সহীহ হাদীস নেই।
    (২) এ রাত সম্পর্কে যা কিছু আকীদাহ বিশ্বাস প্রচলিত আছে তা পোষণ করা জায়েয নয়।
    (৩) এ রাতে ইবাদাত বন্দেগী করলে সৌভাগ্য খুলে যায় এমন ধারণা একটি বাতিল আকীদাহ।
    (৪) এ রাতে হায়াত, মউত ও রিয্‌ক বন্টনের বিষয় লেখা হয় বলে যে বিশ্বাস তা কুরআন ও হাদীসের বিরোধী। তাই তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
    (৫) এ রাতকে কেন্দ্র করে যেমন সম্মিলিতভাবে ইবাদাত বন্দেগী করা, রাত্রি জাগরণ করা ঠিক নয় তেমনি ব্যক্তিগত ইবাদাত বন্দেগী করাও ঠিক হবে না। তবে নিয়ম বা রুটিন মাফিক ইবাদাত বন্দেগীর কথা আলাদা। যেমন কেহ সপ্তাহের দু দিন রাত্রি জাগরণ করে থাকে। ঘটনাচক্রে এ রাত সেদিনের মধ্যে পড়লে অসুবিধা নেই। কিন’ এ রাতে ইবাদাত-বন্দেগী করলে অধিক সওয়াব হবে এমন ধারণায় ব্যক্তিগতভাবে বা চুপিসারে কিছু করাও ঠিক হবে না।
    (৬) ১৫ শাবানের রাতই দুয়া কবূলের রাত নয়। বরং প্রতি রাতের শেষ অংশ দু‘আ কবূলের সময়।
    (৭) শুধু ১৫ শাবানের রাতেই আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন প্রথম আকাশে অবতরণ করেন না, বরং প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে তিনি প্রথম আকাশে অবতরণ করে বান্দাদেরকে তাদের প্রয়োজন পূরণের জন্য প্রার্থনা করতে আহ্বান জানান।
    (৮) শবে বরাতের ‘আমল সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসগুলো কোনটা জাল, আবার কোনটা যয়ীফ বা দুর্বলসূত্রের।
    সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! একটি বিষয় আপনারা অবশ্যই খেয়াল করে থাকবেন যে, মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যত ফিরকা বন্দী, দলাদলি ও অনৈক্যের জন্ম হয়েছে উহার প্রায় সবগুলোই কিন্তু বিদআত চালু করাকে কেন্দ্র করে হয়েছে।
    একদল লোক কোন একটা বিদআতী কাজের ‘আমল শুরু করে দিল, অন্য একদল আলেম তার প্রতিবাদ করলেন। ব্যাস শুরু হল ফিরকাবাজী; শেষ পর্যন- মারামারি খুনাখুনি। অতঃপর ঐ বিদ‘আত-পন্থিদের আক্রোশ আরো বেড়ে গেল। তারা এ কাজটাকে তাদের দলের শ্লোগানে পরিণত করল। এরপর তারা এ তরবারি দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করে মুসলিম উম্মাহর সুদৃঢ় বন্ধনকে রক্তাক্ত করতে থাকল। মুসলিমগণ হানাহানিতে লিপ্ত হয়ে পড়ল। কেন তারা আল্লাহ তা’আলার হুকুমের প্রতি একটু খেয়াল করে না যেখানে তিনি বলেছেনঃ
    কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ হলে তা উপস্থাপিত কর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিকট। এটাই উত্তম ও পরিণামে উৎকৃষ্টতর। (সূরা নিসা, ৫৯)
    অতএব এ রাত উদযাপন করা থেকে মানুষদেরকে নিষেধ করতে হবে। যে কোন ধরনের বিদ‘আতী কাজ থেকে মানুষকে সাধ্যমত বিরত রাখা ‘আল-আমর বিল-মারূফ ওয়ান নাহয়ি আনিল মুনকার’ এর অনর্ভুক্ত।
    আর এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশী ভূমিকা পালন করতে পারেন মুহতারাম উলামায়ে কিরাম, শ্রদ্ধেয় আইয়েম্মায়ে মাসাজিদ, দায়ীগণ ও ইসলামী আন্দোলনে শরীক ব্যক্তিবর্গ।
    সমস্ত প্রশংসা উভয় জাহানের মালিক আল্লাহর। তাঁর রাহমাত বর্ষিত হোক তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর, তাঁর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের) পরিবারবর্গ এবং সাহাবীগণের (রাঃ) উপর। আমীন!!! ওয়া আখিরুদ দাওয়ানা আনিল হামদুলিল্লাহি রাব্বিল ‘আলামিন।
    এ আহ্বান রেখে এবং মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে সকল ব্যাপারে সকল ঈমানদারদের জন্য সত্য-সঠিক পথের দিশা প্রার্থনা করে শেষ করছি।

  4. শাবানের মধ্যরজনীর যে হাদীস গুলিকে আপনি দুর্বল বলেছেন। ফযিলতের ক্ষেত্রে যয়িফ হাদীসতো গ্রহনযোগ্য তাহলে এ রাত্রে নফল ইবাদত, কবর যিয়ারত করতে অসুবিধা কি? তবে অবশ্যই বেদাআত যেমন হালুয়া রুটি বিতরন, মোম বাতি জ্বালানো ইত্যাদি থেকে অবশ্যই বেচে থাকতে হবে।